রাতের আলো থেকে দিনের ইতিহাসে আমাদের শিকাগো সফর

রাতের আলো থেকে দিনের ইতিহাসে আমাদের শিকাগো সফর

সিয়াটেল থেকে আকাশপথে আমাদের শিকাগো যাত্রা শুরু হয়েছিল আমেরিকার 24/10/2025 সন্ধ্যা ছ’টায়, আর যখন শিকাগো ও’হেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামলাম, শিকাগোর ঘড়িতে তখন বাজে প্রায় রাত এগারোটা । রেন্টাল কার থেকে গাড়ি নিয়ে হোটেলে গিয়ে ফর্মালিটি সেরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত্রি সাড়ে বারোটা বেজে গেল।

আমরা তিনজন — আমি, লিপিকা আর আমাদের ছোট ছেলে স্বস্তিক — একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে একমত হলাম, “রাতের শিকাগো না দেখলে এই শহরকে চেনা হবে না।”ব্যস, লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম — অজানা শহরের আলোর নেশায়।

রাতের শিকাগো যেন আলোয় ভেজা এক কবিতা। শহরের কেন্দ্রস্থল ডাউনটাউন শিকাগো, যাকে স্থানীয়রা ভালোবেসে বলে The Loop, সেখানে পৌঁছাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। উঁচু উঁচু স্কাইস্ক্র্যাপারগুলোর গায়ে ঝলমল করছে লাইট, নিচে বয়ে যাচ্ছে মিচিগান লেকের হাওয়া।

একদিকে বিশাল Lake Michigan, যার জলরাশি শহরটাকে একেবারে সমুদ্রতীরের মতো করে তুলেছে। এই লেকই আসলে শিকাগোর প্রাণ — শহরের জল, বাতাস, বিনোদন, সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।

রাত তিনটের দিকে আমরা হোটেলে ফিরলাম, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন এখনও শহরটা ঘুমায়নি। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তার আলোয় গুনগুন করছে শহরের হৃদস্পন্দন।

সকাল আটটার মধ্যে সবাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম । হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের এক পারিবারিক বন্ধুর মেয়ের বাড়ি — রিম্পির কাছে।

রিম্পির বাড়ি যেতে যেতে চোখে পড়ল এশিয়ান দোকানের সারি। এক দোকানের নাম বাংলায় লেখা — “সুন্দরবন”। বিদেশের মাটিতে প্রিয় মাতৃভাষা দেখা সত্যিই এক আলাদা উচ্ছ্বাস এনে দেয়।

রিম্পির বাড়িতে লাগেজ রেখে আমরা চললাম নেভি পিয়ার-এর দিকে। এটি শিকাগোর সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, ১৯১৬ সালে তৈরি হয়েছিল বাণিজ্যিক জেটি হিসেবে। এখন এখানে আছে জাদুঘর, দোকান, রেস্তোরাঁ, এবং বিখ্যাত ১৫-তলা উঁচু সেন্টেনিয়াল হুইল (Ferris Wheel)।

চাকা যখন ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠে , নিচে দেখা যায় বিস্তীর্ণ মিচিগান লেক, আর তার ওপারে সোনালি সূর্যের আলোয় ঝলমল করা শিকাগো শহর। সেই দৃশ্যের সঙ্গে মিশে থাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

শিকাগোকে বলা হয় “Birthplace of the Skyscraper” — আধুনিক উঁচু ভবনের জন্ম এই শহরেই। ১৮৭১ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো শহর পুড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকেই নতুনভাবে উঠে দাঁড়ায় শিকাগো, বিশ্বের প্রথম আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের মাধ্যমে।

আজও শহরের স্থাপত্যে সেই গৌরবের ছাপ। “Willis Tower” (পুরনো নাম Sears Tower) একসময় ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। এছাড়া আছে আর্ট ডেকো স্টাইলের অসংখ্য ভবন, আর নদীর ধারে গড়ে ওঠা ঝকঝকে মডার্ন হাইরাইজ।

এরপর গেলাম মিলেনিয়াম পার্কে, যেখানে আছে শিকাগোর প্রতীক হয়ে ওঠা বিশাল ইস্পাতের ভাস্কর্য — “দ্য বিম” (Cloud Gate)। অনেকেই একে ভালোবেসে বলে “শিকাগো বিন”। এর চকচকে গায়ে পুরো শহরের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায় — মনে হয় যেন শিকাগো নিজেকেই নিজের মধ্যে খুঁজছে। আর দেখলাম মনোমুগ্ধকর জলফোয়ারা।

তারপর গেলাম ঐতিহাসিক Art Institute of Chicago-তে। এখানেই ১৮৯৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় World’s Parliament of Religions, যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিখ্যাত “Sisters and Brothers of America” বক্তৃতা দিয়েছিলেন।আজ সেই জায়গার পাশের রাস্তার নাম Swami Vivekananda Way — আমাদের জন্য এক অনন্য গর্বের মুহূর্ত।

দুপুরে গেলাম Maharaja Indian Restaurant-এ। একেবারে দেশীয় ঢাবার ঢঙে সাজানো — খাটিয়া, রঙিন কুশন, পেতলের থালা, আর সুরভিত মসলা। খাবারও ছিল অসাধারণ — চিকেন টিক্কা, ডাল মাখানি, নান, সব কিছুই ভারতীয় স্বাদে ভরা। দামও তুলনায় সাশ্রয়ী।

আর আথিথিয়তা , শিকাগো শহরে এই উষ্ণতা সত্যিই অমূল্য। শুনেছি, শিকাগোর বিখ্যাত ডিপ-ডিশ পিৎজাও একবার চেখে দেখার মতো।

খাওয়াদাওয়া শেষে রিম্পির বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে ইন্দিয়ানার পথে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই বিপত্তি। রিম্পির দশতলা ফ্ল্যাট থেকে নীচে নামতেই আমাদের ছোট ছেলে অর্ঘ চিৎকার করে উঠল — “আমাদের গাড়ি কোথায়?” সত্যিই তো! যেখানে পার্ক করেছিলাম, গাড়ি সেখানে নেই অথচ চাবি আমাদের কাছে ! আমাদের সবার মুখ ফ্যাকাশে। লিপিকার চোখে প্রায় জল।

অর্ঘ ছুটে গেল খুঁজতে, রিম্পিও সঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ পর ওরা খবর দিল — গাড়িটা আসলে শিকাগো কর্পোরেশন ভুলবশত টো করে নিয়ে গেছে! কথাবার্তা বলে অবশেষে গাড়ি উদ্ধার হলো। তখন মনে হচ্ছিল যেন হারানো প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

সব ঝামেলা মিটিয়ে আমরা রওনা হলাম ইন্দিয়ানার পথে আমাদের ভাইঝির বাড়ির উদ্দেশ্যে । পেছনে রেখে এলাম আলোকিত, সজীব, প্রাণময় শিকাগো — এক অনন্য স্মৃতি হয়ে।

24 thoughts on “রাতের আলো থেকে দিনের ইতিহাসে আমাদের শিকাগো সফর

  1. Aparajita Sengupta

    খুব ভালো লাগল তোমাদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লেখা পড়ে। বিশেষত স্বামী বিবেকানন্দ এর কথা পড়ে খুব গর্ব হলো ভারতীয় হিসেবে।

    Like

  2. Ratnabali Chatterjee

    আপনাদের সঙ্গে শিকাগোর মানস ভ্রমণ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।কত অজানারে জানাইলে তুমি,এই কথাটাই মনে হল।শিকাগো নামটার সঙ্গে সমস্ত ভারতবাসীর বিশেষতঃ বাঙালীদের এক অসাধারণ আবেগ জড়িয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দের অবিস্মরণীয় বক্তৃতার সুবাদে।যেন হঠাৎ করে এক বিপত্তির উৎপত্তি ,গাড়ি হারানো।সেও জীবনেরএক নতুন অভিজ্ঞতা ।সব মিলিয়ে লেখাটা ভারি মনোগ্রাহী।

    এবার ইন্ডিয়ানার ভ্রমণ কাহিনীর অপেক্ষায় রইলাম।

    ছবিগুলো অসাধারণ।

    Like

  3. Probodh Pal

    খুব ভালো লাগলো তোমাদের ভ্রমণ কাহিনী। শিকাগো শহরের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আর তোমার লেখেনি তো অসাধারণ মনে হয় আমরাও ভ্রমন করে আসলাম শিকাগো।

    Like

  4. Partha Pratim Dasgupta

    শিকাগো মানেই বিবেকানন্দ আর বিবেকানন্দ মানেই ভারত। তাই ভারতীয় হিসেবে ভারত কে খুঁজে পেলাম স্বামী বিবেকানন্দ ওয়ে তে। আর শেষে তোমার লেখায় তোমার কথাই ধার করে বলতে হয়, “রাতের শিকাগো যেন আলোয় ভেজা এক কবিতা”।

    Like

Leave a reply to supriyoroy Cancel reply