৩০ অক্টোবর, ২০১৫ সকাল সাড়ে ছ’টা। দমদম বিমানবন্দরে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে, বুকের ভেতর কেমন অজানা শিহরণ— প্রথম বিদেশ সফর, তাও আবার লন্ডন!
মুম্বাই পর্যন্ত দেশীয় উড়ান। কারণ মুম্বাই থেকেই হবে ইমিগ্রেশন ও আন্তর্জাতিক যাত্রা।
দুপুর ১টা ২০-এ বিমানে উঠলাম। জানালার বাইরে মেঘের স্তর পেরিয়ে উড়ছে বিমান, আর আমাদের মন বারবার বলছে —“লন্ডন, আমরা আসছি!”
প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টা টানা যাত্রার শেষে অবশেষে পৌঁছে গেলাম হিথ্রো (Heathrow Airport) — ইউরোপের অন্যতম ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ হাতে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে লন্ডনের বুক চিরে— রাস্তার ধারে পুরনো ভবন, সাজানো গাছ, সিগন্যালের শৃঙ্খলা।
প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, তাও আবার এত পরিপাটি শহর দেখে রোমাঞ্চে মন কাঁপছিল।
হোটেলে চেক-ইন করে বেশিক্ষণ সময় না নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখার জন্য।তাপমাত্রা তখন মাত্র ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, হালকা কুয়াশা।
রাস্তা পার হব, কিন্তু দূর থেকে গাড়ি আসছে দেখে থেমে গেলাম।
অবাক হয়ে দেখি— গাড়িটা নিজে থেমে গেল এবং চালক ইশারায় বলল, “You may cross.”
এমন ভদ্রতা, এমন নাগরিক সচেতনতা— মনে দাগ কেটে গেল।
হোটেল থেকে কিছুটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম ব্যস্ত Queensway Street-এ।
দু’পাশে সারি সারি দোকান— কাপড়, জুতো, গয়না, সুভেনির, আর নানা দেশের খাবারের রেস্তরাঁ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল , ডিনার করতে হবে । কিন্তু কোথায় সস্তায় মন মতন খাবার পাবো , সেটাই দেখছিলাম । হঠাৎ লিপিকার চোখে পড়ে গেল একটা রেস্তরাঁ নামIndian Currey । রেস্তরাঁটা ছিল বাঙালি মালিকানাধীন, বাঙালির স্নেহে ভরা পরিবেশ যেন বিদেশের মাটিতেও আপন হয়ে গেল।
রেস্তরাঁর মালিকের সঙ্গে গল্পে জানলাম তাঁদের লন্ডনে আসা, পরিশ্রম আর রেস্তরাঁ গড়ে তোলার গল্প।খাওয়ার পর মন ভরে গেল— খাবারেও, গল্পেও।
“লন্ডনে বসেও মনে হচ্ছিল যেন বাংলায় বসে আছি— এক প্লেটে ভাত, আর পাশে হাসিমুখে মানুষ।”
পরের দিন সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। রাস্তায় ছড়িয়ে আছে লাল-হলুদ Maple পাতা, ঠান্ডা হাওয়ায় ভাসছে কুয়াশা।অপরিচিত শহর, তবুও যেই সামনে আসছে, হাসিমুখে বলছে — “Good Morning!”
এই ছোট্ট সৌজন্যবোধেই লন্ডনের সকালটা হয়ে উঠেছিল অসাধারণ।
হোটেলে ফিরে পেলাম কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। বিদেশে এসে পাউন্ড বাঁচানোও এক আর্ট!
আমাদের কাছে ছিল আগে থেকেই কেনা London Pass —
দু’দিনের জন্য অগণিত সুবিধা:
- Hop-on Hop-off বাসে সীমাহীন যাত্রা
- বিনামূল্যে প্রবেশ বহু ঐতিহাসিক স্থানে
- গাইডসহ শহর ভ্রমণ
Bayswater Road থেকে উঠলাম সেই বিখ্যাত লাল দোতলা বাসে।
উপরের অংশ খোলা, যাতে পর্যটকরা চারপাশ দেখতে পারে।
প্রতিটি বাসেই একজন গাইড, যিনি লন্ডনের ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে গল্প করে যান মনোমুগ্ধকরভাবে।
আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো Madame Tussauds Museum থেকে।
সেখানে সারা পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের মোমের মূর্তি।
চার ঘণ্টা ধরে ঘুরে দেখলাম, অবাক হয়ে খেয়াল করলাম—
কোনও কমিউনিস্ট নেতার মূর্তি নেই!
তারপর একে একে ঘুরলাম —
- Parliament Square
- Westminster Abbey
- Big Ben
- The Houses of Parliament
- St. James Park
- Buckingham Palace
- Trafalgar Square
- London Eye
- Tower of London
সবশেষে এক ঘণ্টার Thames River Cruise —
জানলে অবাক হবে, London Pass থাকলে এই নদী ভ্রমণ একদম ফ্রি!
নদীর দুই তীর গমগম করছে পর্যটকে, সঙ্গী ঠান্ডা হাওয়া আর সোনালি আলো।London Eye-এর চাকা ঘুরছে, দূর থেকে দেখলে মনে হয়— সময়ও যেন থেমে গেছে লন্ডনের রঙে।
দু’দিনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল একেকটা গল্প— একেকটা অভিজ্ঞতা। অসংখ্য ছবি রয়ে গেছে আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে ।
পরের দিন ভোরে রওনা হলাম নরওয়ে হয়ে ফিনল্যান্ডে।
তাই আগে থেকেই করে রেখেছিলাম UK ও Schengen Visa।
সত্যি লন্ডনে কাটানো দু’দিন ছিল যেন এক স্বপ্ন।অপরিচিত রাস্তায় হাঁটা, অপরিচিত মুখের হাসি, আর প্রতিটি কোণে ইতিহাসের ছোঁয়া— এই সব মিলিয়ে লন্ডনকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম আমরা দু’জনে।
Travel Tips for London Travellers
(যাত্রা আরও সহজ ও উপভোগ্য করতে)
আবহাওয়া অনিশ্চিত, তাই ছাতা বা হালকা রেইনকোট রাখতে ভুলবেন না।
London Pass আগেভাগে অনলাইনে কিনে রাখুন — এটি আপনার সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচাবে।
সকালে বেরোলে মিউজিয়াম ও পর্যটন স্পটে ভিড় কম থাকে।
Oyster Card থাকলে স্থানীয় বাস ও মেট্রোতে ভ্রমণ অনেক সাশ্রয়ী হয়।
স্থানীয় মানুষদের “Thank You”, “Please”, “Good Morning” বলা লন্ডনে একপ্রকার অভ্যাস— এই সৌজন্যবোধ আপনাকেও ভালো লাগাবে।