ইউরোপের সিলিকন উপত্যকা – তালিন

ইউরোপের সিলিকন উপত্যকা – তালিন

 

ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭ টা হবে । আমরা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির একটা কফি হাউসে বসে আছি তিনজন । আমি, আমার স্ত্রী ও আমার বড় ছেলে । নভেম্বর মাস , বাইরে ভালই ঠান্ডা । কফি খেতে খেতে ভালই আড্ডা চলছিল ।হঠাৎ আমার ছেলে বলে উঠলো – “শনিবার তালিন গেলে কেমন হয় । শনিবার রাত্রে রওনা হয়ে রবিবার ভোরবেলা তালিন পৌঁছে যাব , সারাদিন ঘুরবো তারপর আবার রাত্রে রওনা হয়ে সোমবার ভোরে হেলসিঙ্কি চলে আসবো ”। প্রস্তাবটা আমাদের মনে ধরলো । নতুন নতুন জায়গা দেখতে কার না ভালো লাগে । আর তালিনতো শুধু এস্তোনিয়ার রাজধানীই নয় , উনেস্কো (UNESCO ) ১৯৯৭ সালে এই তালিন শহরের নাম পৃথিবীর সাংস্কৃতিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে নথিভুক্ত করেছে । শুনেছি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ডের উপসাগরের ধারে এই তালিন শহরের উপর সবার নজর ছিল । ১৩ দশক থেকে ১৯১৮ সাল অবধি এই তালিন শহরের নাম ছিল রেভাল । এস্তোনিয়ার রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র হলো এই তালিন । ভৌগোলিক অবস্থান হিসাবে এই শহরের গুরত্ব অপরিসীম । সমুদ্রপথে ৮০ কিলোমিটার দূরে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি , ৩৮০ কিলোমিটার দূরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম এবং ৩১৯ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ১৯৪০ সালে এস্তোনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয় । কিন্তু ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল অবধি জার্মানদের দখলে চলে যায় ।  তারপর আবার আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তালিন বার বার উপলব্ধি করেছে । শুনেছে অসংখ্য বোমারু বিমানের কর্কশ আওয়াজ । দেখেছে বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের আস্ফালন ।এখনো কিছু ক্ষত চিহ্ন আজও বয়ে চলেছে তালিন । প্রাকিতিক সোন্দর্য দ্বারা পরিপূর্ণ তালিন শহর আজও মধ্যযুগীয় ও আধুনিক সভ্যতার বাহক হিসাবে দাঁড়িয়ে । ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় তখন থেকে এস্তোনিয়া আলাদা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে আসে ।

কফি হাউসে বসেই অন লাইনে তিনটে টিকিট কেটে ফেলা হলো । আমরা যাব ৭/১১/২০১৫ তারিখ ভাইকিং লাইনের জাহাজে , আর ফিরবো ৮/১১/২০১৫ তারিখ তালিন থেকে ।

রাত্রি ৮ টার মধ্যে ট্রামে করে পৌঁছে গেলাম হেলসিঙ্কির বন্দরে কারণ আমাদের জাহাজ ছাড়বে ঠিক রাত্রি সাড়ে ৯ টায় । তালিন যেতে তো মাত্র ৪ ঘন্টা , কিন্তু জাহাজ সারা রাত থাকবে সমুদ্রে । একদম কাক ভোরে তালিনের বন্দরে সকল যাত্রীদের নামাবে । বন্দরে পৌঁছে দেখলাম ভাইকিং লাইনের বিশাল অফিস । টিকিট কাউন্টারে যেতেই আমাদের কেবিনের বোর্ডিং পাস দিয়ে দিল । কেবিন ছাড়া ডেকে বসেও যাওয়া যায় । আমাদের যেহেতু ফিনল্যান্ডের ভিসা ছিল তাই ইউ.কে ছাড়া সেনজেন এলাকার ২৬ টা দেশে যেতে কোনো বাঁধাই ছিল না কারণ এই ২৬ টা দেশের মধ্যে যে কোনো একটা দেশের ভিসা থাকলেই হলো । সিকিউরিটি চেক শেষ করে সোজা পৌঁছে গেলাম জাহাজে ।

t1

১০ তলা জাহাজ । এই প্রথম এত বড় জাহাজ দেখলাম । হোটেলের মত করিডরের দুপাশ দিয়ে  সারি সারি ঘর বা কেবিন ।  আমাদের কেবিনটা ছিল ৬তলাতে । তাই নীচ থেকে ওঠার সময় ভাবলাম “হিসি” করে উঠবো । “হিসি” মানে  ফিনল্যান্ডের  এর ভাষায়  লিফ্ট । মনে হচ্ছিল পাঁচ তারা হোটেল  ।  অনেকগুলো রেস্তরাঁ , ডিউটি ফ্রি সপ, পার্লার, ক্যাসিনো ,বার  কি নেই । এটাচ বাথ ওয়ালা কেবিন , আমার তো অবাকই লাগছিল কারণ  আগে জাহাজে চড়িনি তো । কেবিনে জিনিষ রেখে জাহাজ ঘুরতে বেড়ালাম । মনে হচ্ছিল পারায় বেড়াতে বেড়িয়েছি । ডেক থেকে রাতের হেলসিঙ্কি এককথায় দারূন । ডাঙা থেকে সমুদ্র একরকম ,  আর সমুদ্র থেকে ডাঙার স্বাদ অন্যরকম । রাএি ঠিক সাড়ে নটায় বাল্টিক সি এর উপর দিয়ে জাহাজে রওনা হলাম তালিনের উদ্দেশ্য ।  ধীরে ধীরে ডাঙা মিলিয়ে গেল । যেদিকে তাকাই  শুধু জল আর জল আর মাথার উপর বিশাল আকাশ । এত বড় আকাশ আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না ।

ভোড় হতেই তালিনের মাটিতে পা রাখলাম । যেহেতু আমাদের বড় ছেলে  তালিন আগেও এসেছে তাই ঐ আমাদের সব চিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো । তালিনের দুটো দিক -একটা মধ্যযুগীয়  ও  আরেকটা আধুনিক ।   আধুনিক সভ্যতার কনক্রিটের জঙ্গল প্রায় আমাদের সবজায়গাতে গ্রাস করে নিচ্ছে , তাই  আমরাও চললাম পুরানো শহরের দিকে । মনে হচ্ছিল স্বপ্নপুরী ।

‘ফেয়ারি টেলস’  এর বাড়ীঘরের মতো সব বাড়ী ,    অপূর্ব , মধ্যযুগীয় স্থাপত্য । কিছু কিছু রেস্তরাঁর সাজসজ্যা এমন ভাবে করা যেন মনে হচ্ছে ঐ সময়টাকে ধরে রেখেছে । হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে মাঝে , আর ঠান্ডা ছিল ভালই । ‘মহারাজা’ নামে একটা ভারতীয় রেস্তরাঁও দেখতে পেলাম । নানা দেশীয় পর্যটকদের ভিড় । ভাবছিলাম সারা পৃথিবীর যদি একটাই ভাষা হতো তাহলে কি মজাটাই না হতো । দারূন দেখতে বেশ কয়েকটি চার্চ দেখলাম । তার মধ্যে অন্যতম সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল বা ডোমে চার্চ  । একটা রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ দেখলাম যার নাম আলেক্সান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল । অপূর্ব সব কারুকার্য । মন ভরে যায় । পায়ে হেঁটেই সব ঘুরছি । বৃষ্টি আর ঠান্ডা আবহাওয়া পর্যটকদের আনন্দের কোনো বাঁধাই সৃষ্টি করতে পারছে না ।

t3

দেখলাম এস্তোনিয়ার পার্লিয়ামেন্ট যার মধ্যযুগীয় নাম ‘তূম্পিয়া কাসল’ । অনেক সুন্দর সুন্দর দোকান , ভূটিয়া মার্কেটের মতো একটা মার্কেটও দেখলাম । ফিনল্যান্ড থেকে এখানে জিনিষের দাম কিছুটা হলেও সস্তা । খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ট্যাক্সি  নিয়ে ছুটলাম সমুদ্রের ধারে ৩১৪ মিটার উঁচু এক ওয়াচ টাওয়ার দেখতে। দুপাশে ঘন সবুজ গাছপালার মধ্য দিয়ে সুন্দর রাস্তা । মনে করিয়ে দেয় ডুয়ার্সের লাটাগুরির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা । এখানে সব গাড়ীই লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ । মস্কো অলিম্পিক এর সময় এই টাওয়ার তৈরী হয়ে ছিল । ফ্রান্সের  আইফ্ফেল টাওয়ার থেকে ১২ মিটার উঁচু । টিকিট কেটে লিফটে করে এ সোজা উঠে গেলাম উপরে , পাইন গাছে ঘেরা পুরো তালিন শহর আমাদের চোখের সামনে । আর একদিকে দেখতে পারছি দিগন্ত জুড়ে নীল জলরাশি । মনের ক্যামেরায় জীবন্ত হয়ে রইলো এই দৃশ্য । ছেলের কাছেই শুনলাম এই তালিন শহর বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির জন্মস্থান । যার মধ্যে অন্যতম SKYPE

প্রচুর ছবি আর ভিডিও নিয়ে চললাম তালিনের বন্দরে যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভাইকিং লাইনের জাহাজ । সোজা চলে গেলাম ডেকে । দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম অপূর্ব সুন্দর এক শহরকে । মনের ক্যামেরায় হারিয়ে গেছিলাম । সম্বিত ফিরে পেলাম জাহাজ চলতে শুরু করাতে । ধীরে ধীরে তালিন ছোট হতে হতে দূর আকাশের মধ্যে মিলিয়ে গেল ।

TALLINN 4Jpeg

Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos

2 thoughts on “ইউরোপের সিলিকন উপত্যকা – তালিন

  1. Abani Banerjee
    বা:! খুব ভাল।
    Lipika Roy
    এখনো তালিন শহর চোখে ভাসে আর সোভিয়েতের কথা মনে হয়।
    Swapna Sen Gupta
    খুব খুব ভালো লাগলো।মনে হচ্ছিল তোমাদের সাথ এ আমিও চলে গেছি।সার্থক তোমরা।
    Krishna Chaudhuri
    তালিন শহর আমার চোখের সামনে ভাসে।খুবমনে পড়ছে ছবি গুলো দেখে।
    Mita Sengupta
    Beautiful. Chobi o lekha 2toi khub enjoy korlam.
    Swapnesh Ghosh
    lekhata pore enjoy korlalm.sathe chobi gulo o darun.
    Swapan Dattaray
    Read , enjoyed , thank you again .
    Balajee Patel
    Beautiful
    Tanima Goswami
    Beautiful. I read and enjoyed.
    Apurba Neogi
    Very nice experience of the Tour of TALIN which has been described superbly with video,. Liked and enjoyed the same very much.
    Aloka Mitra
    Vivid description darun laglo
    Ranjit Sen
    nice
    Ranjan Goswami
    Apurba tor chok diye dekhlam
    Buddhadeb Sarma
    Very nice and smart video at TAĹIN .You enjoyed very much and keep it in memory. As you will describe further when we will meet together.
    Mita Sengupta
    Khub bhalo ghurlam tomader sathe
    Gobinda Chakravarty
    আপনার লেখা ভ্রমণ কাহিনীগুলো বরাবরই সুন্দর / তবে তাদের মধ্যে আজকেরটাকে আমি সবার ওপরে রাখছি / প্রাঞ্জল ভাষা , তথ্য সমৃদ্ধ , নিখুঁত বর্ণনা , দেখা জায়গাগুলোর সুন্দর ভিডিও / সব মিলিয়ে mind blowing .
    Soma Dasgupta
    গল্প গান কি সুন্দর মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে ।দেখতে দেখতে চোখ যেন জুরিয়ে গেল ।
    Tapasi Banerjee
    Very nice.
    Tapan Kumar Sarkar
    Most awesome presentation along with back ground amazing video.
    Wonderful ✅
    Reena Dasgupta
    Apurbo
    Basudeb Mukherjee
    Wonderful writing, photography, composition and selection of background music. You folks have real talent. Enjoyed much. Keep it up.
    Kanti S
    Video with description very nice
    Papia Kargupta
    Wow !!
    Aparajita Sengupta
    Tomader sathe abaro akta notun jayga ghurlam.
    Mamata Paul
    Very niceee
    Partho Mukherjee
    Khub khub sundar poribesona.porte porte monta valo hoye gelo.thank you very much.
    Krishnasis Chatterjee
    Ki sundar lekhata
    Ekta Bhraman Kahini lekhar chesta koris
    Tor lekha porle jeno chokher samne bhashe
    Sudhir Bagchi
    সুন্দর সুন্দর। দারুণ দারুণ বর্ণনা সুপ্রিয়। আমরা অনেক কিছুই দেখি কিন্তু তোমার মত সুন্দর করে দেখতেও পারি না এত সুন্দর করে বলতেও পারি না। আসলে তুমি খুবই গুণী মানুষ। খুব ভাল লাগল। সবাই খুব খুব ভাল থাকো।
    Pk Bhattacharjee
    তিলক আমাদের ও তোমাদের সাথে বেরু বেরু করা হয়ে গেলো । ধন্যবাদ
    Pradip Kumar Das
    খুব সুন্দর
    Dalia Deb
    Tor lekhay borabor e 1ta alada ki jano thake.kintu eta jano moner vitore nara die galo.apurbo re!!!!!
    Bani Paul
    Khub sundor poribesona mon vore galo
    Subhashish Chatterjee
    অনবদ্য লেখা। Your qualities are your identity. That’s the reason I was told to be acquainted with you by the people, know you to some extent.
    Kamalendu Haldar
    আমরা যেতে পারবো না, কিন্তু কাহিনী শুনে ভালো লাগলো। আইফেল টাওয়ার জানতাম Paris. ইটালিতে আছে কিনা জানিনা। Retired এর পরে খুব ভালো tour হলো।
    Suman Bose
    যাওয়ার তো কোন সম্ভাবনা নেই, তোমার সাবলীল লেখা পড়ে অনুভবের মধ্যে নিজেকে ওই জায়গায় দেখতে পাচ্ছি
    Tapasi Banerjee
    Khub valo laglo.awsadharon.
    Samarendra Nath Sarkar
    Nice share.. perfect in all respect.. good night 😴
    Tanima Goswami
    Khub valo laglo. Very nice.
    Rina Ray
    Nije na berieo tomader sathe koto sundor jayga dekhlam
    Mohan Lal Ghose
    Ki sundar, mone mone aamio ei sundar sthane ghure beralam
    Aloka Mitra
    Ki darun khub valo laglo
    Bharati Banerjee
    Excellent anubhuti

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s