ঝর্নার শহর রাঁচি: প্রকৃতি, রোমাঞ্চ ও বিশ্বাসের সহযাত্রা- সুপ্রিয় রায়

গত ১৪ই ডিসেম্বর ২০২৫—শীতের এক মনোরম দুপুরে আমি ও লিপিকা বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে চেপে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে হাওড়া থেকে রাঁচির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দ্রুতগামী এই ট্রেনযাত্রা যেমন আরামদায়ক, তেমনই সময় সাশ্রয়ী। প্রায় সাত ঘণ্টার সফর শেষে রাত্রি সাড়ে ৯টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচিতে —যে শহর তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত “ঝর্নার শহর” কিংবা “ছোটনাগপুরের রানী” নামে।

স্টেশন থেকে বেড়িয়ে একটি অটো ধরে আমরা সোজা চলে গেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেলে। যেহেতু ট্রেনেই রাতের খাবার সারা হয়ে গিয়েছিল, তাই সামান্য ফ্রেশ হয়ে সেদিন আর দেরি না করে বিশ্রামে চলে যাই কারণ পরেরদিন থেকে শুরু হবে আমাদের রাঁচি অভিযান ।  

পরদিন সকালে কলকাতা থেকে বাকি পর্যটকরা হোটেলে এসে পৌঁছাল। সকালের আনুষ্ঠানিকতা ও দুপুরের আহার সেরে আমরা সবাই মিলে একটি ট্র্যাভেলার্সে চেপে রওনা দিলাম রাঁচি থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পত্রাতু ড্যাম ও লেক দর্শনে।

সবুজ বনানীর মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পত্রাতু পৌঁছনোর যাত্রাটাই ছিল চোখ জুড়ানো যেন ভ্রমণের প্রথম পুরস্কার।  মূলত পত্রাতু তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহের জন্য নির্মিত এই বাঁধটি আজ শীতকালে পর্যটকদের কাছে এক মনোরম পিকনিক স্পট। প্রবেশমূল্য মাথাপিছু মাত্র ২০ টাকা সেটা ক্যাশে দেওয়া যাবে না , দিতে হবে অন লাইনে । টিকিট কেটে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়ল একটি সুন্দর পার্ক, তার ঠিক পেছনেই বিশাল জলরাশি নিয়ে বিস্তৃত পত্রাতু লেক। লেকের জলে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে—ছয় জনের একটি স্পিড বোটে ১০–১৫ মিনিট ঘোরার খরচ ৭৫০ টাকা। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে আমরা আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ের ওপর উঠে পত্রাতু ভ্যালির বিস্তৃত দৃশ্য চোখে দেখে মন ভরে গেল । বিকেলের আলোয় এই স্থান সত্যিই অপূর্ব।তারপর  ফিরে আসি হোটেলে।

পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে আবার যাত্রা—এবার গন্তব্য ঝর্নার শহরের অন্যতম আকর্ষণ, রাঁচি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হুন্ড্রু ফলস। সুবর্ণরেখা নদীর প্রবাহে গঠিত এই জলপ্রপাত প্রায় ৩২০ ফুট উপর থেকে নীচে আছড়ে পড়ছে। জলপ্রপাতের পাদদেশে পৌঁছাতে ৭৪৫টি সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। সেই নামার পথে চারপাশে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর নীচে থেকে ভেসে আসা জলরাশির গর্জন—দুয়ে মিলে এক রোমাঞ্চকর, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

আসার পথে দেখে নিলাম  গেটালসুদ বাঁধ (Getalsud Dam) যা ঝাড়খণ্ডের রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় প্রাকৃতিক স্থান, যা সুবর্ণরেখা নদীর উপর নির্মিত এবং রাঁচি ও রামহগড় এলাকার মানুষের জন্য একটি চমৎকার পিকনিক স্পট ও জল সরবরাহকারী উৎস।

হুন্ড্রু ফলস থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম জোনহা জলপ্রপাত বা গৌতম ধারা। রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি ঘন অরণ্যে ঘেরা। দুপুরের আহার সেরে এই জলপ্রপাত দর্শনে এগোলাম। জনশ্রুতি অনুযায়ী, গৌতম বুদ্ধ এখানে স্নান ও ধ্যান করেছিলেন—এই বিশ্বাস থেকেই এর আরেক নাম গৌতম ধারা। ঘন অরণ্যে ঘেরা এই জলপ্রপাতের গোড়ায় পৌঁছতে প্রায় ৬৫০টি সিঁড়ি নামতে হয়। গুঙ্গা নদীর প্রবাহে গঠিত এই জলপ্রপাতে রাড়ু নদী এসে মিশেছে, যা এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশের পরিবেশ এতটাই শান্ত ও রহস্যময় যে, প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর আত্মিক সংযোগ অনুভব করা যায়।

এরপর জোনহা জলপ্রপাত থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সীতা জলপ্রপাত  ছিল আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। রামায়ণের দেবী সীতার নামে নামকরণ করা এই জলপ্রপাতটি সবুজ পাহাড় ও ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক শান্ত, নিরিবিলি স্থান। ট্রেকিং, পিকনিক ও আলোকচিত্র শিকারিদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা ফিরে আসি হোটেলে।

তৃতীয় দিনে আমরা রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে রামগড় জেলায় অবস্থিত রাজারাপ্পা মন্দির দর্শনে যাই। দামোদর ও ভৈরবী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই পবিত্র তীর্থস্থান দেবী ছিন্নমস্তাকে উৎসর্গীকৃত। ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দির তান্ত্রিক স্থাপত্য ও গভীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কাটা মুণ্ড ধারণ করা দেবীর মূর্তি আত্মত্যাগ ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ভক্তদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

ঝর্নার গর্জন, পাহাড়ের নীরবতা আর বিশ্বাসের স্পর্শ—এই তিনের মেলবন্ধনেই আমাদের রাঁচি ভ্রমণ হয়ে উঠল এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা তার সাথে ছিল ডিয়ার ট্রাভেলসের সুস্বাদু আহার( মটন বিরিয়ানি , ফিস চপ , মটন কষা , মটরশুঁটির কচুরি , ছোলে বাঁটুরে ইত্যাদি ) । যারা প্রকৃতি, রোমাঞ্চ ও বিশ্বাস—এই তিনকে একসঙ্গে অনুভব করতে চান, রাঁচি তাঁদের জন্য নিঃসন্দেহে এক আদর্শ গন্তব্য।পরেরদিন যাবো নেতারহাট ।

ছোটনাগপুরের রাণীর কোলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের গল্প

ঝর্না, পাহাড় আর অরণ্যের মায়ায় মোড়া রাঁচি শহর ছেড়ে চতুর্থ দিনের সকালে ডিয়ার ট্রাভেলসের সাথে আমাদের যাত্রা শুরু হল আরও এক মোহময় গন্তব্যের দিকে—ছোটনাগপুরের রাণী নেতারহাট। দশম জলপ্রপাত যেহেতু আমাদের অনেকেরই আগে দেখা, তাই সকালের আহার সেরে সদলবলে আমরা হোটেল ছেড়ে রওনা দিলাম রাঁচি থেকে প্রায় ১৫৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পার্বত্য হিল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। প্রকৃতি-প্রেমীদের কাছে নেতারহাট যে এক আকর্ষণীয় স্বপ্নভূমি, তা যাত্রাপথেই বুঝে নেওয়া যায়।

রাঁচি স্টেডিয়াম ও বিধানসভা ভবনের পাশ দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার এগিয়ে প্রথমেই পৌঁছালাম জগন্নাথ মন্দিরে। একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত এই মন্দিরটি ওড়িশার পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত। বরকাগড় জগন্নাথপুরের তৎকালীন রাজা ঠাকুর অনিনাথ শাহদেও ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেই বছরের ২৫ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়। টিলার উপর দাঁড়িয়ে নীচে তাকালে রাঁচি শহরকে মনে হয় প্রকৃতির কোলে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা এক নীরব জনপদ—শহরের কোলাহল যেন বহু দূরে হারিয়ে যায়।

রাঁচির জগন্নাথ মন্দির থেকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর আমাদের গাড়ি থামল কোয়েল নদীর তীরে। উদ্দেশ্য একটাই—দুপুরের আহার।এই সময় কোয়েল নদীর জলস্তর এতটাই নীচু যে হেঁটে হেঁটেই নদী পার হওয়া সম্ভব। নদীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাথরের উপর দিয়ে মানুষজন অনায়াসে চলাচল করছে, আর কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা গভীর মনোযোগে মাছ ধরায় ব্যস্ত। দৃশ্যটা যেন দৈনন্দিন জীবনের এক নিঃশব্দ, সুন্দর চিত্র।চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে নদীর হালকা শব্দ আর দূরের সবুজ—সব মিলিয়ে জায়গাটার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি রয়েছে, যা শহুরে ভ্রমণের তাড়াহুড়োয় সচরাচর ধরা পড়ে না।

কিছুক্ষণ এই শান্ত পরিবেশে সময় কাটিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম নেতারহাটের উদ্দেশে।এরপর সোজা পথে এগিয়ে নেতারহাটে পৌঁছে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে চলে গেলাম সানসেট পয়েন্টে। পৌঁছে দেখি, সূর্যাস্তের সাক্ষী হতে ইতিমধ্যেই সেখানে ভিড় জমেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পাহাড়ের কোলে ধীরে ধীরে অস্ত যেতে থাকা সূর্য আকাশজুড়ে রঙের এমন এক খেলা শুরু করল, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই অপূর্ব মুহূর্ত মনে ধরে রেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম হোটেলে।

পরদিন ভোরে, কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেই সকাল পাঁচটায় আবার বেরিয়ে পড়লাম সানরাইজ পয়েন্টের দিকে। সূর্যোদয় দেখার জন্য নেতারহাটের এই স্থানটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। হোটেল প্রভাতবিহারের সামনে অবস্থিত এই পয়েন্টটি নেতারহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা থেকে এক কিলোমিটার দূরে। আমাদের আগেই বহু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর পাহাড়ের আড়াল ভেঙে ধীরে ধীরে উদীয়মান সূর্যের আলো যখন চারপাশের প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দিল, তখন সেই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার চেয়ে অনুভব করাই যেন বেশি যথার্থ মনে হল।

সূর্যোদয় দেখে হোটেলে ফিরে প্রাতরাশ সেরে আবার বেরিয়ে পড়লাম নেতারহাটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে। একে একে দেখে নিলাম লেক, কোয়েল ভিউ পয়েন্ট, ঘাঘরি জলপ্রপাত ও নেস্পাতি বাগান। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর পাহাড়ি বাতাসে সময় যে কীভাবে কেটে যায়, তা বোঝাই যায় না—ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল।

দুপুর বারোটার মধ্যে হোটেল চেক আউট করার তাড়া। তাই তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে আবার সেই ট্রাভেলার্সে চেপে রাঁচির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নেতারহাট ঘুরে বুঝলাম—এর নামকরণের পেছনে ‘নেচারহাট’ বা Nature’s Market কথাটাই সবচেয়ে মানানসই। এখানে প্রকৃতি নিজেই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। যে পসরা একবার দেখলে, মন বারবার ফিরে যেতে চায়।

19 thoughts on “ঝর্নার শহর রাঁচি: প্রকৃতি, রোমাঞ্চ ও বিশ্বাসের সহযাত্রা- সুপ্রিয় রায়

  1. Ranjan Das

    খুব ভালো লাগলো। বছর পঞ্চাশ আগে আমি ছিলাম এই পাতরাতুতে PTPS এর ড্যাম প্রোজেক্টে।‌আজ ছবি গুলো দেখে খুব ভালো লাগলো।

    Like

  2. Rupa Bhattacharjee

    দাদা তোমার লেখনীর হাত ভীষণ সুন্দর …এত ভালো বিস্তারিত বর্ণনা দাও যে পড়তে আমার খুব ভালো লাগে…মনে হয় আমিও তোমাদে সাথে ঘুরে এলাম😊😊

    Like

  3. Bani Paul

    বন্ধু তোমাদের চোখে দেখা হলো রাঁচি,নেতারহাট এর নৈসর্গিক বর্ণনা,আপ্লুত, সঙ্গে দারুন সব ছবি

    Like

  4. Lipika Roy

    কিভাবে হৈ হুল্লোড় করে এই কটাদিন কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না। খুব সুন্দর,মনের আনন্দে,প্রানখুলে আনন্দ করাতেই বুঝিনি দেখতে দেখতে পাঁচ টা দিন পার হয়ে গেলো। আমাদের সহযাত্রী রা সবাই মিলেমিশে আনন্দ করলাম যে সেটা আমাদের সারা জীবন মনে থাকবে।

    Like

  5. Ananda Ghosh

    হ্যাঁ দাদা এই নেতারহাট এত সুন্দর একটি জায়গা পাহাড়ের উপরে ঠান্ডা পড়ে প্রচুর কিন্তু মন ভরে যায়। আমরা তো ওখানে ২০০ টাকা বান্ডিল কাঠ কিনে বোন মোরগের বারবিকিউ খেয়ে এসছি, ওখানকার লোকদের বললে ওরা বোন মোরগ এনে দেয় আর আপনার বর্ণনা অসাধারণ চমৎকার খুব ভালো থাকবেন।

    Like

  6. Tapashi Banerjee

    খুব সুন্দর বর্ননা। তোমার লেখা টা পড়ে মনে হচ্ছে ছুটে চলে যাই। আমার রাচি ঘোরা হয় নি। খুব যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।

    Like

  7. Chandana Banerjee

    চমৎকার ছবি আর চমৎকার বর্ণনভঙ্গী তে চিরসুন্দর হয়ে মনের চিত্র পটে আঁকা হয় রইলো আমাদের এই স্বল্পকালীন রাঁচি নেতার হাট ভ্রমণপর্ব। আন্তরিক ধন্যবাদ সুপ্রিয় দা লিপিকা বৌদি সকল ভ্রমণসঙ্গী আর ডিয়ার ট্র্যাভেলসের সকল সদস্যকে। দেখা হবে আবার কোথাও কোনো প্রকৃতির আঙিনায় নিশ্চয় নিশ্চিৎ।

    Like

Leave a comment