বিচারপতি সমরেশ রায়কে সবাই ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা করত। তিনি সারাজীবন ধরে একটাই কথা বলতেন— “আইন সবার ওপরে, আইনই চূড়ান্ত সত্য।”
দেশে বহু বিচারক এসেছেন,গিয়েছেন, কিন্তু সমরেশবাবুর নীতি, সততা আর কঠোরতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। তাঁর আদালতে দোষী প্রমাণ মানেই কঠোরতম শাস্তি। তাঁর স্বাক্ষর মানেই ন্যায়। মানুষ বলত— “সমরেশবাবুর আদালতে চোখের জলেও রায় বদলায় না।”
কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই সাদামাটা। স্ত্রী সোমা আর একমাত্র ছেলে সৌম্য —এই নিয়েই তাঁর পৃথিবী। বাইরে তিনি যত কঠোর, ঘরে ততটাই নরম। ব্যস্ততার কারণে ছেলের সঙ্গে তিনি সময় কমই কাটাতে পারতেন, তবে ছেলের পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ—সব কিছু নিয়েই তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল।কিন্তু স্বপ্ন যে সব সময় পথ চেনে না, তা তিনি পরে বুঝেছিলেন।
একদিন সকালে সংবাদপত্র হাতে নিয়ে চা খেতে খেতে তিনি আচমকা স্থির হয়ে যান। প্রথম পাতার খবর— “দুর্ঘটনায় মৃত্যু, গাড়িচালক তরুণ আটক।”
নিচে ওনার একমাত্র ছেলে সৌম্যর ছবি!
এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল পৃথিবীটা বোধহয় থমকে গেছে। চোখের সামনে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল ।তিনি দ্রুত ফোন করলেন থানায়। সব তথ্য মিলিয়ে যা জানা গেল, তা আরও ভয়ঙ্কর। সৌম্য নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তায় একজন পথচারীকে চাপা দিয়ে মৃত্যু ঘটায় । প্রমাণ স্পষ্ট, সাক্ষী নির্ভুল।
সমরেশ কিছু বলতেই পারলেন না। ছেলের অমন বিপর্যয় তাঁকে যেন ভিতর থেকে খালি করে দিল।আর বাড়িতে স্ত্রী সোমা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বার বার বলছিল — “আমাদের ছেলে ইচ্ছা করে এমন করতে পারে না ! তুমি কিছু করবে না?”
সমরেশের নীরবতা ঘরটাকে আরো ভারী করে তোলে।
তিন দিন পর মামলা আদালতে ওঠে। বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পড়েছে সমরেশ রায়ের ওপরই। হাজার মানুষের চোখ তাঁর দিকে। কিন্তু তিনি আজ শুধু বিচারক নন—তিনি একজন অসহায় বাবা, একজন ভেঙে পড়া স্বামী।
আদালত কক্ষে ঢোকার সময় তাঁর হাঁটু কাঁপছিল।সৌম্যর দিকে তাকালেন। ছেলে মাথা নিচু করে, চোখ লাল।সমরেশের বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মন চায় ছেলেকে কাছে টেনে বলতে— “বাবা, আমি আছি তোমার পাশে।”
কিন্তু আদালত কক্ষে তিনি বিচারপতি, বাবা নন।
প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য— সৌম্য গাড়ি দ্রুত চালাচ্ছিল।
দ্বিতীয় সাক্ষী— নেশার গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি।
সিসিটিভি ফুটেজ— সবই পরিষ্কার।
সমরেশ যতই চোখ সোজা রাখতে চেষ্টা করছিল , ততই প্রতিটা প্রমাণ তাঁর গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছিল।মনে হচ্ছিল কেউ যেন চিৎকার করে বলুক—
“এ প্রমাণ ভুল! সৌম্য কখনই এটা করতে পারে না!”
কিন্তু সত্যের মুখ নেই, তা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে।
শেষ দিনের সাজা ঘোষণার আগে সৌম্য কাঁপা গলায় বলতে চায়—
“জন্ম থেকে তোমাকে ভয় পাই বাবা। ভালোবাসতেও পারিনি ঠিকমতো। ভুল করেছি… কিন্তু আমি খারাপ নই। আরেকটা সুযোগ দিও…”
এই কথায় সমরেশের বুক দুটি পাথরের মতো ভারী হয়ে ওঠে।
ছেলের চোখে তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া…
বাবার চোখে ছেলের হারিয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ…
দুই দৃষ্টির মাঝখানে এক অদৃশ্য নদী বয়ে যেতে থাকে। যে নদীর স্রোত রায় দিতে পারে, ক্ষমা দিতে পারে না।
সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর সোমা বলেন— “সমরেশ, ছেলেকে যদি তোমার রায়ে হারাই, আমি বাঁচব না।
আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয়। তুমি কি কিছুই করতে পারো না?”
সমরেশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।যে মানুষ সারাজীবনে আবেগকে দূরে রেখেছেন, আজ স্ত্রী-ছেলের ভালোবাসা তাঁর ভিতরটাকে টেনে ধরছে।
তিনি প্রশ্ন করেন নিজেকে— “আইন কি সবসময় মানুষের থেকেও বড়?”
এই প্রশ্নের উত্তর তিনি কখনো ভাবেননি।
পরদিন আদালত জনাকীর্ণ। সাংবাদিক, বিচারক, আইনজীবী—সবাই অপেক্ষায়।
সমরেশ রায় পড়তে শুরু করেন—সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে ভারী শব্দগুলো মুখে নিয়ে।
“সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্ত সৌম্য রায়কে দোষী সাব্যস্ত করা হলো…”
কক্ষ নিস্তব্ধ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল ।
তিনি বাক্যটি শেষ করলেন— “এবং আইন অনুযায়ী কঠোরতম শাস্তি প্রদান করা হলো।”
ছেলের চোখের জল তাঁর হৃদয়ের ওপর বর্ষার জল হয়ে পড়ছিল ।
তবু মুখে তিনি সমরেশ — কঠোর, স্থির, নিরপেক্ষ।
সৌম্য একবার তাকায় বাবার দিকে।
চোখে ব্যথা, কিন্তু একইসঙ্গে অদ্ভুত গর্ব।
বাবা কখনো নিয়ম ভাঙেননি—আজও না।
রায় ঘোষণার পর সমরেশ তাঁর চেম্বারে একখানা চিঠি রেখে আসেন—পদত্যাগপত্র।
চিঠিতে লেখা—
“আজ আমি আইন রক্ষা করেছি,
কিন্তু বাবা হিসেবে ভেঙে গেছি।
আমি আর বিচার করতে পারব না।
কারণ আজ বুঝলাম,
আইন নিরপেক্ষ হতে পারে,
কিন্তু মানুষ নয়।”
সমরেশ বাকি জীবনে আর আদালতে যাননি । মানুষের জীবনে বিচারের প্রভাব সন্মন্ধে উপলব্ধি করেছিলেন আরও গভীরভাবে —”আইন মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।যে আইন মানুষের কথা শোনে, সেই আইনই মানবিক।বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়, সঠিক পথ দেখানোও।”
Sudhir Bagchi
দারুন লিখেছ ভাই। অপূর্ব।
LikeLike
Lipika Roy
Bani Paul সত্যি বাস্তব খুব কঠোর,খুব নির্মম কিন্তু সত্যকে অগ্রাধিকার দেবার জন্য জগতেসত্যের সঙ্গ দিতেই হবে, না দিলে সত্যের ওপর অবিচার করা হবে। সত্যের মাপদন্ড কিন্তু সঠিক ওজনেরই জানান দেয়। সেখানে মনের আবেগের স্থান নেই,শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কোনো ব্যাপার নেই।
কথায় আছে
ইনসাফ কা তরাজু
LikeLike
Dalia Deb
Durdanto as usual……..joto din jachche….lekha ro porishilito porimarjito ashadharon hoye uthche….khub valo laglo re




LikeLike
Aparna Mukherjee
Bishaer vabna jamon valo, shahoj vashae barnona tao temni. Apuuurbo.
LikeLike
Debabrata Mukherjee
Darun
LikeLike
Tapashi Banerjee
খুব সুন্দর লিখেছ। চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাড়িয়ে এক পিতা এক বিচারক। তার কাছে ন্যায় নীতি বোধ সবার আগে।
LikeLike
Samarendra Nath Sarkar
Khub sundor lekhoni
LikeLike
Aloka Mitra
Khub bhalo
LikeLike
Mohan Lal Ghose
E bhabai jaina, khub sundor laglo
LikeLike
Soma Paul
Good morning Supriyo da…
Khub valo laglo lekhata

LikeLike
Champak Mitra
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান এবং বেদনাদায়ক কিন্তু শিক্ষা জগতের সব মাপকাঠি হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে। সিদ্ধান্ত নির্ভুল স্নেহ মমতা তবুও জীবিত।
LikeLike
Jp Bose
The role of a judge in giving verdict in a case ,where his own son is involved as an accused , described beautifully in the story .justice prevailed over fatherly affection.
LikeLike
Gautam Chaki
চমৎকার লাগলো লেখাটা।
LikeLike
Rina Mazumdar
অর্থবহ। অসাধারণ
LikeLike
Bani Paul
বাস্তব বড় কঠোর,মেনে নেয়া শক্ত।ইশ সবাই যদি এমন হতো তবে বোধহয় অপরাধী অবাধে বিচরণ করতে পারত না।আসলে সিস্টেম এর পরিবর্তন না হলে এটা করা কঠিন।খুব ভালো,তবে লেখনীর থেকে বোধোদয় হয় দেখা যাক।
LikeLike
Ruby Nandy
লেখাটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল
LikeLike
Tanima Goswami
Good morning.
Darun laglo tomar lekha ta pore.
LikeLike
Naru Mahato
শুভ সকাল।
খুন সুন্দর হয়েছে লেখাটি।
ভালো লাগলো।
LikeLike
Kanika Dasgupta
Darun laglo lekhata
LikeLike
Suparna Bhattacharjee
সত্য নির্মম বটে
LikeLike
Prokash Bhowmick
Tathya samriddha abegpurna asaadharan kahini Bicharak sattwa o pritti sattwar apurba sangmishran Sasraddha pranati janai ei mahan byaktitwa ke
LikeLike