ক্ষুধার আড়ালে আলো – সুপ্রিয় রায়

গ্রামের এক কোণে থাকে রামু । প্রতিদিন ভোরে ইটভাটায় কাজ করতে যায়, আর তার স্ত্রী কমলা ধানের ক্ষেতে মজুরির কাজ করে। সংসারটা টানাটানি করে চলে। তাদের দুই সন্তান— পচা (১০) আর পুঁচকি (৭)। গায়ের রং ধুলো মাখা, কিন্তু তাদের চোখ দুটো স্বপ্নভরা। দুর্গা পুজো আসছে। চারপাশে আনন্দের ঢেউ—হাটে, বাজারে, পাড়ায় নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, রঙিন আলো, ব্যান্ডের সুর।

শরৎকালের নীল আকাশ। চারিদিক শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছে । দূর থেকে ঢাক ঢোল কাঁসরের আওয়াজ ভেসে আসছে — বুঝিয়ে দিচ্ছে, দুর্গা পূজো দ্বারপ্রান্তে।

এই আনন্দের ঢেউ ছুঁয়ে যায় সবাইকে, কিন্তু রামুর ছোট্ট কুঁড়েঘরে সেদিনও চুলোর আঁচ ম্লান। ‘দিন আনে দিন খায়’ সংসার, পূজার সময় নতুন জামা কাপড় কেনার সামর্থ্য তাদের নেই।

পচা আর পুঁচকি বাড়ির পাশে বসে দেখে, সমবয়সী বাচ্চারা নতুন জামা পরে দলে দলে পূজার মণ্ডপে যাচ্ছে।

পচা একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল—

— “মা, আমাদেরও কি নতুন জামা হবে ?”

কমলার বুকের ভেতরটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কিন্তু মনটাকে শক্ত করে হাসিমুখে বলে ,

— “হ্যাঁ রে, দুর্গাপুজা তো সবার পুজা । তুই মন থেকে চা, নিশ্চয়ই পাবি।”

রামু রাতে কাজ শেষে ফিরে এসে দেখে ছেলে-মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পচার হাতে আঁকিবুঁকি—খাতায় সে নিজের স্বপ্ন এঁকেছে। একটা লাল শার্ট, একটা নীল ফ্রক। রামু আর কমলার বুকটা হু হু করে ওঠে।

সেই রাতেই দু’জন মিলে ঠিক করল,— যা সামান্য টাকা জমেছে চাল-ডাল কেনার জন্য, তার মধ্য থেকে কিছুটা কেটে ওদের জন্য কিছু কিনে আনবে ।

অষ্টমীর সকালে হাট থেকে রামু ফিরল একখানা লাল শার্ট আর নীল ফ্রক নিয়ে। দামি নয়, চকচকে নয়—তবু একেবারে নতুন।

যখন পচা জামাটা হাতে পেল, তার চোখ ঝলমল করে উঠল। পুঁচকি ফ্রক পরে ঘুরে ঘুরে আয়নায় নিজের ছায়া দেখল। তাদের হাসি আর উচ্ছ্বাসে যেন গোটা কুঁড়েঘর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।

রামু আর কমলা দরজার আড়াল থেকে দেখছিল। ওরা একে অপরের দিকে তাকাল—ক্ষুধা, কষ্ট, দারিদ্র্য সব ভুলিয়ে দিল সন্তানদের খুশি মুখ। বুকের ভেতরটা কেমন হালকা হয়ে গেল। তারা যেন বুঝল—

দুর্গা পূজো মানে শুধু আলোকসজ্জা বা ধনীদের আড়ম্বর নয় , পূজোর আসল মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে ছোট্ট দুটি শিশুর হাসিতে, আর বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ ত্যাগে। নতুন কাপড় বা আলোয় নয়—ভালোবাসা আর ত্যাগেই লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে বড় উৎসব।

17 thoughts on “ক্ষুধার আড়ালে আলো – সুপ্রিয় রায়

  1. Lipika Roy

    খুব মনে পড়ছে ওই অনাথাআশ্রমের বাচ্চা গুলোর কথা।

    সারাদিন ওদের সাথে কাটিয়েছিলাম।ওরা আমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। ওদের সাথে সময় কাটাতে এতো ভালো লেগেছিল লিখে বোঝাতে পারছিনা এটা সম্পূর্ণ অনুভূতির ব্যাপার

    Like

  2. Dipanwita Ganguly

    সুপ্রিয় দা ও লিপি আমার প্রণাম নিও।

    এই লেখাগুলো পড়লে বড় বেদনাদায়ক চোখে জল এসে যায় লিখতে লিখতেই চোখে জল এসে গেল।

    সত্যিকারের এদের জামা কাপড় আমরা দিতে পারি আমাদেরও আনন্দ লাগে, চারিদিকে তো কত পয়সা ব্যয় হয় টাকা-পয়সা খুব ভালো লেখা হয়েছে সরল স্বাচ্ছন্দ্য ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক সবাই।

    Like

  3. Surajit Das Gupta

    সত্যি কত সামান্য জিনিসে ও ছোটদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায়। আর বাবা মায়ের আত্মত্যাগ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।

    Like

  4. Ratnabali Chatterjee

    বেশ ভাল লাগল লেখাটা।।

    এইসব দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের বাচ্চারা অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।

    আমরা বন্ধুরা মিলে একবার চল এই ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আসি।

    Like

Leave a comment