টাইমজোনের প্রেম – সুপ্রিয় রায়

শিলিগুড়ির ছেলে সার্থক। পড়াশুনায় খুব ভাল , ইঞ্জিনিইয়ারিং এ মাস্টার ডিগ্রি করে এখন আমেরিকার এক বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করছে। অন্যদিকে কলকাতার মেয়ে সাথী। ও একইভাবে নিজের পড়াশোনায় ভালো, আর এখন কলকাতার এক বড় কর্পোরেট অফিসে চমৎকার চাকরি করছে।

দুজনের পরিচয় এক আত্মীয়র বিয়েবাড়িতে। হুল্লোড়, গানের তালে ভিড় জমেছে নাচের মঞ্চে। ঠিক সেই সময় পাশের বারান্দায় এক কাপ কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সাথীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল সার্থক।

— “আপনি নাচছেন না কেন?”
— “আমি নাচতে পারি না। আর আপনি?”
— “আমারও একই অবস্থা। বা, আমাদের দুজনেরই এ বিষয়ে মিল আছে দেখছি ।”

একটু হাসি, একটু খুনসুটি। তারপর গল্প গড়াল পড়াশোনা, অফিস, বই আর ভ্রমণ নিয়ে। বিদায়ের সময় সার্থক বলেই ফেলল—
— “আমি আপনাকে নম্বরটা দিতে পারি? মাঝে মাঝে কথা বললে খারাপ লাগবে না।”
সাথীর চোখে সরল ঝিলিক—”অবশ্যই।”

পরের সপ্তাহেই শুরু হলো ফোন আর হোয়াটসঅ্যাপ। কিন্তু সমস্যা—সার্থকের আমেরিকা, আর সাথীর কলকাতা। সোম থেকে শুক্র দুজনেই অফিসে ব্যস্ত। আর তার উপর টাইমজোন! সার্থক যখন সকালের জলখাবার খাচ্ছে, তখন সাথী ঘুমোতে যাচ্ছে।

ফলে সারাক্ষণ মিসড কল, মিসড মেসেজ।
— “তুমি আমার মেসেজের রিপ্লাই করোনি কেন?”
— “আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম!”
— ” আমি ফোন করলাম কেন ধরোনি?”
— “তুমি ফোন করলে আমি মিটিংয়ে ছিলাম!”

অবশেষে দুজনের মধ্যে চুক্তি হলো—শনি আর রবি কেবল প্রেমের দিন। ওই দুইদিনই ফোন আর ভিডিও কলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা ।

এমনিতেই ওদের আত্মীয়রা সব সময় অভিযোগ করে—
— “সার্থকের সাথে কথা বলাই যায় না।”
— “সাথী তো এখন ফোন ধরতে পর্যন্ত ভুলে গেছে!”

দুজনের বাড়ির লোকজন একদিন সোজাসুজি বলেই দিল—
— “তোমরা এতদিন ধরে একে অপরকে পছন্দ করছো। এবার বিয়ে করো!”

কিন্তু সমস্যা অন্য। সার্থক বা সাথী কেউই চাকরি ছাড়তে রাজি নয়।
সার্থকের কথা —”আমার ভবিষ্যৎ এখানে গড়ে উঠছে।”
সাথীরও উত্তর—”আমারও কাজের জগৎ তো কলকাতায়।”
বিয়ে করে আলাদা আলাদা থাকাটা দুজনে কেউই আবার চায় না।

এক রবিবার ভিডিও কলে হঠাৎ সাথী মজা করে বলল—
— “আমরা চাইলে ভিডিও কলে বিয়েটা সারতে পারি। পুরোহিতকে জুম লিঙ্ক পাঠিয়ে দেব।”
সার্থক হেসে বলল —
— “আর বিয়ের ভোজে সবাইকে উবার ইটস দিয়ে খাবার পাঠাবো, তাই তো?”

দুজনেই হেসে উঠল, কিন্তু হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটা দীর্ঘশ্বাস।

দিন যায়, মাস যায়। সম্পর্কটা আরও গভীর হয়। মাঝে মাঝে চাপ, ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান হয় বটে। কিন্তু একে অপরের প্রতি বিশ্বাসটা অটল।

দুজনের পরিবার কিন্তু চাপ দিয়েই চলেছে—এভাবে অপেক্ষা করলে বয়স বেড়ে যাবে।
কিন্তু সার্থক-সাথী দুজনেই বলেছে—
— “আমরা তাড়াহুড়ো করব না। যদি ভাগ্যে থাকে, আমরা একদিন একই শহরে একসাথে কাজ করব। সেই দিনেই বিয়ে করব।”

গল্প থেমে যায় এখানে। ভবিষ্যৎ জানে না কেউ। হয়তো সত্যিই একদিন একই জায়গায় সুযোগ আসবে। হয়তো বা আবার অনেক লম্বা অপেক্ষা।

তবে একটা কথা মানতেই হবে—প্রেমের কোনো টাইমজোন হয় না।

23 thoughts on “টাইমজোনের প্রেম – সুপ্রিয় রায়

  1. Aparajita Sengupta

    সকালবেলা চা খেতে খেতে এমন সুন্দর ভালোবাসা র গল্প পড়ে মন ভালো হয়ে গেল। আশা রাখছি সার্থক ও সাথী খুব তাড়াতাড়ি একসাথে থাকবে।সুন্দর লিখেছ লালদা। দারুণ ছবি। আর জায়গা টা ও খুব সুন্দর। ❤🧡

    Like

  2. Ratnabali Chatterjee

    প্রথমেই বলি ,দম্পতির ছবিগুলি ভারি সুন্দর।ব্যাক ড্রপে অনবদ্য নিসর্গ ছবিগুলিকে মনোরম রূপ দিয়েছে।

    বেশ মিষ্টি লাগল সার্থক সাথীর কাহিনী। ইউ এসেতে সাথীর সেট্ল করার অপেক্ষা রইল।এতটা দূরত্বের না হলেও দীর্ঘ দূরত্বের দাম্পত্য চোখে পড়ে এবং তারা মহানন্দে আছে।এখন একটা নতুন কথা প্রায়ই শুনি,দম্পতির একে অপরকে স্পেস দেওয়া।বোধ করি বর্তমানে অনেক দম্পতিরই সেটাই কাম্য।

    Like

  3. Partha Pratim Dasgupta

    প্রকৃত প্রেমের পরিণতি বড্ড ট্র্যাজিক, যেমন লায়লা-মজনু। তাই প্রকৃত অর্থে “ভালোবাসা দীর্ঘজীবী হোক”।

    Like

Leave a reply to supriyoroy Cancel reply