সত্য ঘটনা অবলম্বনে – সুপ্রিয় রায়

সুপর্ণা ঘরে ঢুকে দেখতে পেল সৌম্য একমনে ল্যাপটপ নিয়ে ওর নিজের  তোলা ছবিগুলো এডিট করে চলেছে । আর ওদের একমাত্র মেয়ে তিস্তা, সৌম্যর মোবাইল নিয়ে বিছানায় বসে একমনে গেম খেলে চলেছে । সুপর্ণা, তিস্তার দিকে না গিয়ে সৌম্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো –  তিস্তা আমাদের জীবনে আসার পর থেকে আমরা আর পাহাড়ে বেড়াতে যাইনি । এখন তো তিস্তার পাঁচ বছর হয়েছে । আমরা এখন তো পাহাড়ে যেতে পারি ? কি , তুমি কি বল ?

  • নিশ্চয় যেতে পারি । চল তিন – চার দিনের জন্য দার্জিলিং ঘুরে আসি । কবে যাবে বল ?   
  •  এই সপ্তাহে বা সামনের সপ্তাহেই যাওয়া যেতেই পারে । এখন দার্জিলিংএর আবহাওয়া বেশ ভাল। আমার আর তোমার কলেজের চাপটাও এখন কম । আশাকরি ছুটি পেতে অসুবিধা হবে না । তুমি দেখো কবে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে ,সেই বুঝে ছুটির আবেদন করবো । সুপর্ণা কথাগুলি বলতে বলতে তিস্তার  দিকে এগিয়ে গেল । তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে বলল –  জানিস তিস্তা আমরা দার্জিলিং যাব । ওখানে দেখতে পাবি বিশাল হিমালয় । আকাশ পরিষ্কার থাকলে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আমরা দেখতে পাবো । 

তিস্তা মোবাইল থেকে মুখ তুলে মার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো – আচ্ছা মা , কাঞ্চনজঙ্ঘা তো তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয়  উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কোনগুলো ?  

  •  মাউন্ট এভারেস্ট ও কে ২।

সৌম্য জানালো যে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার একমাত্র শতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়া আর কোন ট্রেনে যাওয়া ও আসার টিকিট নেই । শতাব্দী এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে দুপুর ২ টা ৩৫ এ ছেড়ে রাত ১০ টা ৩৫ এ পৌঁছায় । সুতরাং সেদিন শিলিগুড়ি থাকতে হবে । আবার ফিরে আসার সময় শতাব্দী এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ভোর ৫ টা ৩০ মিনিটে ছাড়ে । সুতরাং আগের দিন এসে শিলিগুড়িতে থাকতে হবে ।

  • কোন ব্যাপার না । তুমি শতাব্দীতে যাওয়ার টিকিট কাটো । আমরা রাত্রে পৌঁছে নিউ জলপাইগুড়িতে রিটায়রিং রুম পেলে সবচেয়ে ভাল , নাহলে স্টেশনের কাছাকাছি কোন হোটেল রাতটা থেকে যাব । তাহলে সকাল সকাল দার্জিলিং পৌঁছে যাব ।আর ফেরারটা তুমি বাগডোগরা থেকে প্লেনে কাটো তাহলে আর দিনটা নষ্ট হবে না । হোটেলটাও পারলে বুক করে নিও । মনে হচ্ছে দার্জিলিঙে এখন ভালই ভিড় হবে ।

সুপর্ণার কথা শেষ হতেই সৌম্য সব ব্যবস্থা করতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল । এই অবসরে সুপর্ণা আর তিস্তা নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠল । এই প্রথম তিস্তা দার্জিলিং যাবে । এখনও নিজের চোখে পাহাড় দেখেনি । গতবছর সমুদ্র দেখেছে । তাই পাহাড় সম্বন্ধে ওর মনে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে । একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে ওর মাকে । ঘড়ির কাঁটাও সমানতালে এগিয়ে চলছে । হটাৎ ছন্দ পতন ঘটলো সৌম্যর ডাকে । সৌম্য জানালো যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে আর তিনদিন পরে শুরু হচ্ছে ওদের দার্জিলিং ভ্রমণ । খবর শুনে তিস্তা আনন্দে একটু নেচে নিল । তিস্তা নাচ খুব ভালবাসে । খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে । কথা বার্তাও বলে খুব আস্তে আস্তে । চেনা অচেনা নেই সবার সাথে খুব সহজেই মিশে যায় । সৌম্য , সুপর্ণার এটাই ভয় । দিনকাল তো ভাল না তাই ওকে কখনই কাছছাড়া করে না ।

কদিন ধরে দার্জিলিঙের আকাশ একদম ঝকঝকে । মল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । নীল আকাশের মাঝে তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা তার পরিবার নিয়ে অনেকক্ষণ দেখা দিচ্ছে । যার আকর্ষণে প্রচুর পর্যটক দার্জিলিঙে ভিড় করেছে । দার্জিলিঙের মল ও মলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা দাস স্টুডিয়োর দিকে গেছে পর্যটকদের আনাগোনায় সবসময় গমগম করছে । প্রচুর দোকানপাট চারিদিকে গজিয়ে উঠেছে । বলা যায় দার্জিলিঙের এখন ভড়া যৌবন ।এহেন পরিবেশের মধ্যে সৌম্য , সুপর্ণা ও তিস্তা মনের আনন্দে দার্জিলিঙে ঘুরে বেড়াচ্ছিল । মাঝে মাঝেই সৌম্যর ক্যামেরা ঝলসে উঠছিল । মনের মতো প্রচুর ছবি তুলে যাচ্ছিল । সুপর্ণার শপিং করতে খুব ভাল লাগে । তাই ও তিস্তার হাত ধরে চারপাশের সব দোকানের জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করছিল  । হটাৎই একটা সোয়েটার খুব ভাল লেগে গেল । দোকানটা ছিল মলের উপরে । সৌম্যকে বলে ওরা দুজনে  ঢুকল ঐ দোকানের ভিতরে । সৌম্য কাছাকাছি মলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল ।  ভালই ভিড় ছিল দোকানে । সুপর্ণা শক্ত করে তিস্তার হাত ধরে ছিল ।নিজের জন্য আর তিস্তার জন্য দুটো সোয়েটার পচ্ছন্দ করে টাকা দেওয়ার জন্য সাময়িকভাবে তিস্তার হাত ছেড়ে টাকাটা দিয়ে সোয়েটার দুটো হাতে নিতেই দেখে পাশে তিস্তা নেই । ও এদিক ওদিক তাকিয়ে তিস্তাকে না দেখে তিস্তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলো । সৌম্য দোকানের কাছেই ছিল । ও সুপর্ণার চিৎকার শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসলো । সুপর্ণা সৌম্যকে দেখতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটা বলল । ওরা দুজনে দোকান থেকে বেড়িয়ে এসে তিস্তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো । হটাৎ সুপর্ণার নজরে পড়লো তিস্তার মতো জ্যাকেট পরা একটা মেয়ে সৌম্যর মতো একটা লোকের সাথে হাত ধরে চলেছে । সৌম্যকে দেখাতেই ও চিৎকার করে তিস্তাকে ডাকতে ডাকতে ওদের পিছনে দৌড় লাগালো ।আওয়াজ শুনে বাচ্চা মেয়েটা ঘুরে তাকাতেই সৌম্য বুঝতে পারলো বাচ্চা মেয়েটা আর কেউ নয় , ও ওদের একমাত্র মেয়ে তিস্তা । তিস্তাও ওর বাবাকে দেখতে পেয়ে ঐ লোকটার হাত ছাড়িয়ে ওর বাবার দিকে দৌড় লাগালো । তিস্তাকে পেয়ে সৌম্য ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল । এর মধ্যে সুপর্ণাও এসে পৌঁছে গেল । ওর শরীরটা তখনও থর থর করে কাঁপছিল । তিস্তাকে বুকে জরিয়ে হাপুস নয়েনে কেঁদে উঠল । সম্বিত ফিরে পেতেই সৌম্য ঐ লোকটাকে খুঁজতে লাগলো । কিন্তু ঐ লোকটাকে আর দেখা গেল না । তিস্তাকে অনেকবার ওরা দুজনে মিলে জিজ্ঞেস করেছে – কেন কাউকে কিছু না বলে ও ঐ লোকটার সাথে চলে যাচ্ছিল । কিন্তু কোন সদুত্তর পাইনি তিস্তার কাছ থেকে । জিজ্ঞেস করলেই তিস্তা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । বেশ কদিন হোল ওরা সবাই কলকাতায় ফিরে এসেছে । কিন্তু এখনও প্রতি মুহূর্তে মনে হয় যদি আর একটু দেরী হয়ে যেত তাহলে কি সাংঘাতিক ব্যাপারটাই না ঘটে যেত ।

19 thoughts on “সত্য ঘটনা অবলম্বনে – সুপ্রিয় রায়

  1. Sudhir Bagchi
    হ‍্যাঁ ভাই এ রকম ঘটনা খুব ঘটে। বাচ্চারা ভুল করে নিজের বাবা মা ভেবে অন্য লোকের হাত ধরে চলে যায়। আমার ছোট ছেলেরই হয়েছিল।

    Like

  2. Lipika Roy
    যাদের সাথে তাদের সন্তানকে নিয়ে এই ঘটনাটা ঘটেছে তাদেরই মুখ থেকে যখন এই ঘটনার বিবরণ শুনছিলাম তখন ভয়ে আমাদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। খুব জোর এক বছর আগের ঘটনা।
    প্রত‍্যেকেরই খুব সজাগ থাকা উচিত।

    Like

  3. Chanchal Bhattacharya
    একটি ভয়ঙ্কর সত্যি ঘটনার সুন্দর উপস্থাপনা
    এবং খুবই প্রাসঙ্গিক।।

    Like

Leave a comment