চিড়িয়াখানা – সুপ্রিয় রায়

চিড়িয়াখানা – সুপ্রিয় রায়

একদম ফাঁকা রাস্তা । মাঝে মাঝে দু- একজনকে দেখা যাচ্ছে । হটাৎ হটাৎ একটা দুটো গাড়ি ভুস করে চলে যাচ্ছে । রাস্তাটা বেশ চওড়া   । এই আলিপুর রোড দিয়ে একা একা হাঁটতে সার্থকের খুব ভাল লাগছিল । চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখে কোথাও কোন লোকজন নেই । প্রধান গেটে নেই কোন পাহাড়াদার । একেবারে ফাঁকা । এই লকডাউনে রাস্তা দিয়ে হাটলে যদি পুলিশ ধরে তার থেকে ভাল চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়া যাক ।কোথাও যখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না আর একটা ছোট গেট খোলা আছে তখন কোন কিছু না ভেবে সার্থক ঢুকে পড়ল চিড়িয়াখানায় । দেখলো লেখা আছে এই চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১মে ১৮৭৬ সালে । আর আজকের তারিখ ১ মে ২০২০ ।  মানে আজ থেকে প্রায় ১৪৪ বছর আগে । কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না । করোনার জন্য চিড়িয়াখানা বন্ধ । নইলে কি ভীষণ ভিড় হয় ।অবশ্য বৃহস্পতিবার সাধারণত বন্ধই থাকে চিড়িয়াখানা । কেউ যখন আটকাচ্ছে না তখন সার্থক ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো । প্রথমেই বাঁদিকে দেখলো একটা বিরাট ম্যাপ যেখানে কোথায় এবং কতদূরে কি জন্তু আছে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও বাঘের ছবি , শিম্পাঞ্জীর ছবি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ওনারা কোথায় আছেন । কারন বাচ্চারা ওনাদের দেখতে ভীষণ আগ্রহী ।শীতকালে পিকনিকের আমেজ থাকে এই চিড়িয়াখানায় । করোনার জন্য দূষণের মাত্রা এখন অনেক কম । কলকাতাতে এখন খুব সুন্দর আবহাওয়া । গরম নেই বলেই চলে । তাই ঘুরতে ভালই লাগছিল । একটু সোজা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল রয়েল বেঙ্গল টাইগার । মনের আনন্দে খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে । নইলে এই সময় গরমের জন্য ছায়ায় শুয়ে থাকতে হতো । সার্থককে দেখে বাঘটা একগাল হাসি দিল আর হালুম করে বলে উঠলো ‘ ভাগ্যিস করোনার জন্য কেউ আসছে না নইলে তো আবার নিউইয়র্কের  মতো আমাদেরও করোনা হয়ে যেত । শুনলাম ওখানে নাকি এক বাঘিনী বা সিংহীর মানুষের মতো করোনা হয়েছে ।আমরা তো আবার তোমাদের মতো বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারবো না । হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাইয়ে দিলে যদি আবার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে তোমাদের মতো বমিভাব, মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি পরিবর্তন এবং পেশীর দুর্বলতা হয় তাহলে তো তোমাদের জাতীয় পশু হিসাবে সন্মানে লাগবে । তার থেকে ভাল করোনা টরোনা ঠিক হয়ে যাক তারপরেই চিড়িয়াখানা খুলুক । ও আরেকটা কথা পাশের বড় গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখ কত বাদুর । ওটা ওদের একটা গ্রাম । ওই বাদুর থেকেই তো শুনলাম তোমাদের এই কোভিট ১৯ ভাইরাসটা এসেছে ।তা বাপু  তুমি এখন এখান থেকে যাও ।’ অগ্যতা বাঁদিকে একটু এগিয়ে গেল সার্থক ।  সামনেই দেখলো একদল জেব্রা । আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের হাতের ছাপ যেমন আলাদা তেমন প্রত্যেকটা জেব্রার গায়ের ছাপও আলাদা । ওকে  দেখে ঘোড়ার মত চিঁহি করে উঠলো একটি জেব্রা । মনে হল  বলছে ‘ তোমরা তো এই কদিনের লকডাউনেই হাপিয়ে উঠেছো আর আমাদের দেখো বছরের পর বছর লকডাউনে আছি । তোমরা শুনেছি লকডাউন ঠিক করে মানছোই না । পুলিশ দিয়ে তোমাদের মানাতে হচ্ছে । আমাদের মতো খাঁচায় আটকে রাখলে কি করতে । তোমাদের ভাষায় আমরা তো সবসময় Quarantine বা Hospital এ আছি । Quarantine থেকে ১৪ দিন বাদে তোমরা ছাড়া পেয়ে যাও কিন্তু আমাদের থাকতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত ।’ শুনতে একদম ভাল লাগছিলনা সার্থকের । খালি মানুষের বদনাম । উল্টোদিকে শিম্পাঞ্জীর খাঁচা ওখানেই ও গেল ।ওকে দেখে শিম্পাঞ্জী কটা লাফ দিয়ে নিল তারপর যেন মানুষের মতো বলে উঠলো ‘ চিড়িয়াখানার গেট কি খুলে দিয়েছে ? সবাইকে আবার ঢুকতে দিচ্ছে ?আজ তো  মেদিবস ।বেঙ্গলে তো আজ সবার ছুটি । তাহলে অনেকে আসবে , তাইনা ?   সত্যি একা একা আর ভাল লাগছে না । সারা দিন ঘরের মধ্যে কিছু করার নেই । কারও সাথে একটু কথা বলবো তারও উপায় নেই । আর তাছাড়া লোকজন না আসলে আয় হবে না , কতদিন আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে বল ?’ কি উত্তর দেবে ? তাই কিছু না বলে আর একটু এগিয়ে গেল সার্থক । দেখা হল ব্রাজিলের অ্যামাজনের জঙ্গল থেকে আনা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বাঁদর মারমোসেট (Marmoset ) যার উচ্চতা মাত্র ১৯ সেন্টিমিটার । ব্রাজিলের করোনার আক্রান্ত প্রায় ৮০০০০ এবং মারা গেছে প্রায় ৫৫০০ তা শুনে দেখলাম মারমোসেট মর্মাহত । আমাদের দেশে আছে ঠিকই কিন্তু মন তো পরে আছে ব্রাজিলে । তাই ওখানে না দাঁড়িয়ে আর একটু এগোতেই দেখলো বড় বড় দুটো কচ্ছপ বা অ্যালডেবরা জায়েন্ট টরটয়েস।যাদের নাম কথা আর কলি ।সার্থকের দিকে তাকালোও না ।ওরা দুজনে একে অপরের সাথে ভালই আছে । ওরা একটু আলাদাই থাকতে চায় । তবে অদ্বৈত নামে এখানে আগে ২৫০ বছরেরও বেশি বয়সের এক দৈত্যাকার কছপ ছিল যেটা ২০০৬ সালে মারা যায় ।এরপর আর  কোথাও না গিয়ে সার্থক সোজা গিয়ে পৌছাল পাখীর খাঁচার সামনে । কিচির মিচির করে পাখিরা কথা বলেই চলেছে । সার্থক যেন ওদের প্রতিটা কথা বুঝতে পারছে ।  অনেকটা টিয়ার মতো দেখতে কিন্তু খুব রঙিন একটা ম্যাকাউ (Macaw) পাখি  কাকাতুয়াকে বলছে , ‘ দ্যাখ, আমরা মুক্ত বিহঙ্গ , আমাদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে লাগে না কোন ভিসা , লাগে না কোন যানবাহন । লকডাউন হলেও আমরা কোন নিয়ম ভাঙি না , মানুষের মতো কারও ক্ষতি আমরা করিনা তবুও আমাদের ওরা নিজেদের স্বার্থে বন্দী করে রাখে । নিজেরা বলে মানব না শৃঙ্খলে , মানব না বন্ধনে কিন্তু আমাদের পশু , পাখিদের সাথে উল্টোটাই করে । কথায় এক আর কাজে আরেক । মানুষ জাতিটা যদি না থাকতো তাহলে পরিবেশে এতো দূষণও হতো না আর আমাদের পশু পাখিদের পরাধীন হয়ে থাকতে হতো না । নিজেরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে আর আমাদের পরাধীন করে রাখবে । আমরা সব পশু, পাখিরা এক হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে যদি লড়াই করতে পারতাম বা নিদেন পক্ষে প্রতিবাদ করতে পারতাম তাহলে মানুষ জাতিটার একটু শিক্ষা হতো । পৃথিবীর সর্বত্র চিড়িয়াখানা খুলে আমাদের অনেককে ধরে রেখেছে । পরিবারের সবাইকে নিয়ে যদি একসাথে রাখতো তাহলেও একটা কথা ছিল । কিন্তু তা করবে না । যাকে পাবে তাকে ধরে নিয়ে আসবে । আমাদের পরিবার যে কি কষ্ট পায় তা একবারের জন্যও ভাবে না ।দারুণ নিষ্ঠুর এই মানুষ ।’ কাকাতুয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো ‘ আমার ছেলে , মেয়ে , বৌ , বৃদ্ধ বাবা , মা কোথায় আছে , কি খাচ্ছে কিচ্ছু জানিনা না । কিচ্ছু করার নেই , তাই বসে বসে শধু কাঁদি ।  মানুষরা ভাবে আমাদের মন বলে কিছু নেই । শুধু ওদেরই আছে ।যেদিন সব পশু , পাখি ওদের অধিকার সন্মন্ধে সচেতন হবে আর সবাই একসাথে চীৎকার করে বলবে – এই পৃথিবী আমাদের সকলের , আমাদের সকলের সমানভাবে বাঁচার অধিকার আছে । কোন রকম দমন পীড়ন আমরা মানবোনা । এক মে দিবসে মানুষ ওদের অধিকার অর্জন করেছিল , আরেক মে দিবসে আমরা অর্জন করবো আমাদের অধিকার ।’

সার্থকের নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল । যাতে ওকে কেউ দেখতে না পারে তার জন্য জোরে দৌড়  লাগালো । কিন্তু পা যেন কিছুতেই চলছে না। ও চীৎকার করে উঠলো । সাথীর ধাক্কাতে ওর ঘুম ভেঙে গেল । সাথী জিজ্ঞেস করলো – “ কিগো এমন চীৎকার করছিলে কেন ? স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি ?”              

***** Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos

2 thoughts on “চিড়িয়াখানা – সুপ্রিয় রায়

  1. Apurba Neogi
    Outstanding. Superb creative writing with beautiful imaginary description.
    Swapnesh Ghosh
    mon chuea jawar moton kotha gulo.tobuo valo laglo pore.
    Lipika Roy
    কোনো জীব কেই বন্দী করে রাখা উচিত না।
    আমার একেক সময় মনে হয় পাখীওয়ালাদের থেকে পাখী গুলোকে কিনে খোলা আকাশে উড়িয়ে দি কিন্তু এটাও মনে হয় খাঁচায় বন্দী থাকেতে থাকতে ওদের ডানাগুলো যদি দুর্বল হয়ে ওড়ার শক্তি না থাকে তাহলে ওরা আরো অসহায় হয়ে পড়বে অতএব যার যেখানে থাকার তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত।
    Rina Ray
    Satye Jodi emon hoto
    Rina Ray
    Likhe Tomar bhaloi somoy Kate Sundor hoeche
    Bani Paul
    Khub sundor,Likhe jao,amadero somoy kete jachhe tomar lekha pore.
    Tapan Kumar Sarkar
    Beautiful presentation
    Tapasi Banerjee
    Excellent.mon vore galo.
    Papia Kargupta
    Dàrun sundor laglo golpota👍
    Mita Sengupta
    Bah!! Khub bhalo laglo.
    Jaba Sengupta Roy
    Besh bhalo laglo, ei rakam anando dite theko.Thank you very much. Bhalo theko.
    Kanti S
    Sotti manus khub nesthur khachy bonbheder janne kharap lagche
    Pk Bhattacharjee
    খুবই ভাল লাগল ।
    Soma Dasgupta
    খুবই ভালো লাগল ।এত সুন্দর স্বপ্ন ।

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s