ট্রেনটা কানপুর স্টেশনে দাঁড়াতেই সার্থক ওর সুটকেসটা নিয়ে নেমে পড়লো । অচেনা শহর । প্রথম চাকরী । তাও আবার বাড়ির থেকে হাজার কিমি দূরে । সম্পূর্ণ অপরিচিত এক গণ্ডির মধ্যে । কিছু করার নেই । চাকরীটা সার্থককে এই মুহূর্তে করতেই হবে । চারিদিক দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে ও স্টেশন থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসলো । প্রচুর সাইকেলরিক্সা দাঁড়িয়ে আছে । সুটকেস নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই একটা রিক্সা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো – “কাহা জানা হ্যায় বাবুজি ?”
– আরমাপুর । যায়গা?
হিন্দিটা খুব ভাল বলতে পারেনা সার্থক । তাই যদি নূতন লোক মনে করে বেশী টাকা চায় তাই বেশী কথা আর বলল না সার্থক । সুটকেসটা পায়ের কাছে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো । ও শুনেছে রিক্সায় আরমাপুর যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে । শহরের মধ্যে দিয়ে রিক্সা চলেছে তার গতি নিয়ে । সার্থক ভাল করে চারিদিক দেখছে । শহরটাকে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । কালপী রোডের উপর দিয়ে যেতে যেতে ডান হাতে দেখতে পেল একটা গেট যার উপর লেখা আছে ARMAPUR ESTATE । ওর রিক্সা গেটের মধ্যে ঢুকে পড়লো । দুপাশে একতলা সব কোয়াটার । সোজা আর একটু এগিয়ে যাওয়ার পর সামনেই একটা চৌরাস্তা । বাঁ হাতে একটা লাল রঙের মন্দির । সার্থক রিক্সা দাড় করিয়ে এদিক ওদিক দেখছে এমন সময় ওর নাম ধরে কে যেন ডেকে উঠলো । তাকিয়ে দেখে কিছু দূরে সাম্য দাঁড়িয়ে । সাম্য ওর ছোটবেলার বন্ধু । যে কোম্পানিতে ও কাজে যোগদান করবে সেখানেই ও কাজ করে । সাম্যর কথায় রিক্সা ছেড়ে হাতে সুটকেস নিয়ে চলল সাম্যর সাথে সাথে । কাছেই থাকে সাম্য । দুকামরার একটা কোয়াটার, কোম্পানিই ঠিক করে দিয়েছে । এবার থেকে ওরা দুজনেই ওখানে একসাথে থাকবে । দুজনেই অবিবাহিত । তাই কোন অসুবিধা হবে না ।
পরেরদিন সকালে নিদিষ্ট সময়ে সার্থক সাম্যর সাথে পৌঁছে গেল ওদের সাইট অফিসে । বিশাল এক কারখানা তৈরি হচ্ছে । চলছে তার কর্মকাণ্ড। অনেক বড় বড় কোম্পানি এখানে কাজের বরাত পেয়েছে । ওদের কোম্পানি বড় বড় পিলার তৈরি করার বরাত পেয়েছে যার উপর অত বড় কারখানাটা দাঁড়িয়ে থাকবে । সবাই টেম্পোরারি সাইট অফিস বানিয়েছে ।সাম্যই সার্থককে ঘুরে ঘুরে সাইটটা দেখাতে লাগলো আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো ।হটাৎই পিছনে সাম্যদা ডাক শুনে দুজনেই পিছনে তাকাল । সার্থক দেখল কালো করে ১৯ -২০ বছরের এক স্বাস্থ্যবান যুবক ওদের দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। সাম্যই পরিচয় করিয়ে দিল। বলল ওর নাম বিপ্লব ।ওর বাড়ি ঘাটশিলার ধারাগিরি ফলসের কাছে বাসাডেরা গ্রামে । ও একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড়। বিপ্লব সাম্যকে বলল যে ওদের কাজ শেষ হয়ে গেছে তাই ওরা কালই বিকালে রওনা দেবে । সাম্য বিপ্লবকে কাল যাওয়ার আগে একবার ঘুরে যেতে বলল । বিপ্লব মাথা নাড়িয়ে সার্থকের দিকে একটু হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল । কি সরলতায় ভরা সে হাসি । বিপ্লব চলে যেতেই সাম্য বলতে লাগলো ঘাটশিলা শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের উপরে ওদের গ্রাম । সামান্য কিছু চাষবাস ছাড়া ওদের জীবন ধারনের আর কিছুই নেই । স্কুলে যেতে গেলেও অনেক দূরে পায়ে হেঁটে যেতে হয় । ঘাটশিলা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মধ্যে পরে কিন্তু ওদের গ্রামে ওরা সবাই বাংলায় কথা বলে । খুবই গরীব সবাই । ওদের গ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশ জন এসেছে এখানে কাজ করতে । বিপ্লবের ধ্যান জ্ঞান শুধু ফুটবল ।ওর স্বপ্ন ও একদিন বড় ফুটবলার হবে । কিন্তু বাড়ির জন্য ওকে ফুটবল ছেড়ে এখানে কাজে আসতে হয়েছে ।কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে বলে ও দারুণ খুশী । গিয়েই আবার ফুটবল খেলতে পারবে । ওকে তাই সাম্য কাল আসতে বলেছে কারণ ওর ইচ্ছা ওকে কিছু ফুটবলের জিনিস কিনে দেবে । সাম্য আরও বলল যে খুব ভাল ছেলে বিপ্লব । সবার বিপদে ঝাপিয়ে পরে । ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে হোগলা পাতার সব ঘর ওখানেই সব অদক্ষ শ্রমিকরা থাকে । এখানে কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে এসেছে এখানকার লেবার কন্টাকটার ।লোকাল লোক কাউকে নেয়নি ।আর সেই সব শ্রমিকদের থাকার জায়গার পাশে একটা মুদি খানার দোকান খুলে দিয়েছে যাতে শ্রমিকদের খাবার জিনিসের জন্য অন্য কোথাও যেতে না হয় । সব শুনে সার্থকের লেবার কন্টাকটার লোকটার প্রতি ধারনাটা ভাল হল । এখানে প্রত্যেকটা কোম্পানির নিজস্ব দক্ষ শ্রমিক আছে শুধু লেবার কন্টাকটারের কাছ থেকে কোম্পানিগুলো অদক্ষ শ্রমিকদের ভাড়া নেয় ।সাম্যর থেকে আরও জানা গেল যে কিছুদিন আগে লোকাল কতগুলি লোফার ছেলে ওদের ওখানকার মেয়ে শ্রমিকদের কুপ্রস্তাব দিতে এসেছিল । বিপ্লব শাবল নিয়ে এমন তাড়া করেছিলো যে ওরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ।বিপ্লবের জন্যই এখানে মহিলা শ্রমিকদের উপর কেউ খারাপ নজর দিতে পারে না । সার্থক যত বিপ্লবের কথা শুনছে ততই যেন বিপ্লবের প্রতি আকর্ষণটা তীব্র হচ্ছে ।
পরেরদিন ঠিক সময়ে সাইট অফিসে এসে সার্থক দেখে কোথাও কোন কাজ হচ্ছে না । শ্রমিকরা সবাই হরতাল করেছে ।একটু খোঁজ নিতেই ব্যাপারটা জানা গেল। লোকমুখে ঘুরছে পুরো ঘটনাটা । যেহেতু ওদের কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং ওরা দেশে ফিরে যাবে তাই বিপ্লব ওর গ্রামের লোকজনদের নিয়ে কন্টাকটার বাবুর কাছে গেছিল ফাইনাল হিসাবের জন্য । ওদের এই এক বছরের মজুরির থেকে মুদিখানার হিসাব কেটে বাকী টাকা নেওয়ার জন্য ।কিন্তু হিসাব দেখে ওদের মাথা ঘুরে গেল । যাতে বাড়ি ফেরার সময় হাতে বেশী টাকা নিয়ে দেশে ফিরতে পারে তাই ওরা মুদিখানার থেকে কম কম জিনিস নিত ।কিন্তু মুদিখানার হিসাব দেখে ওরা অবাক । মুদিখানার হিসাব যা হয়েছে তাতে ওরা প্রত্যেকেই হাতে সামান্য টাকা পাবে । কন্টাকটার বাবু ভেবেছিল শ্রমিকরা সবাই অশিক্ষিত তাই যা হিসাব বলবে সবাই তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। আর বাইরে থেকে সবাই এসেছে তাই কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না । ভাবতেই পারিনি যে বিপ্লব একটু পড়াশুনা জানে এবং ও ব্যাপারটা ধরে ফেলবে ।বিপ্লব আগে থেকেই সবাইকে শিখিয়ে রেখেছিল যে মুদিখানার প্রত্যেক দিনের হিসাব বিপ্লবকে এসে বলতে আর বিপ্লব সেগুলো সব লিখে রাখতো ।এছাড়াও প্রত্যেকটা জিনিষের দাম বাজার থেকে অনেক বেশী ধরা হয়েছে । গরীব অশিক্ষিত মানুষকে ঠকানো সোজা কিনা । কিন্তু ওদের মধ্যে যে বিপ্লবের মতো কেউ আছে সেটা কন্টাকটার বাবু ভাবতেই পারিনি । প্রথমে বিপ্লবকে আলাদাভাবে কিছু লোভ দেখাল কিন্তু বিপ্লব রাজি না হওয়ায় ভয় দেখানো শুরু করলো । বিপ্লব ভয় পাওয়ার ছেলেই নয় । তাই লেগে গেল তুমুল কথা কাটাকাটি । তারপর শুরু হোল হাতাহাতি । বিপ্লবও ছাড়ার পাত্র নয় , বেধড়ক মার দিল কন্টাকটারকে আর বলল যদি ঠিকমত হিসাব না করে তাহলে সবাই মিলে ওর বাড়ি ঘেরাও করবে । ঐ মুহূর্তে কন্টাকটার বাবু পালিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু কিছু পরে পুলিশ এসে বিপ্লবকে ধরে নিয়ে গেল ।কেননা ঐ কন্টাকটার বাবু থানায় গিয়ে বিপ্লবের নামে ভুলভাল রিপোর্ট করেছিল। কন্টাকটার বাবুর টাকার গরম আছে তাই পুলিশও কিছু না শুনে বিপ্লবকে থানায় ধরে নিয়ে গেল আর বাকী সবাইকে শাসিয়ে গেল । তাই সব শ্রমিকরা মিলে ঠিক করলো যতক্ষণ না বিপ্লব মুক্তি পাচ্ছে ততক্ষণ হরতাল চলবে । ব্যাপারটা শুনে সবারই খুব খারাপ লাগছিল । সার্থকও বিপ্লবের জন্য কিছু করার একটা তাগিদ অনুভব করছিল ।সার্থক ঠিক করলো লেবার কমিশনারকে একটা চিঠি দেবে । সেই মতো একটা চিঠি তৈরি করলো আর বেশ কয়েকজন শ্রমিকদের দিয়ে সাইন করিয়ে নিল । তারপর সাম্যকে নিয়ে সার্থক গেল লেবার কমিশনারের অফিসে । লেবার কমিশনারের সাথে দেখা করে চিঠিটা দিল এবং ওনাকে খুব করে অনুরোধ করলো ব্যাপারটা নিয়ে তাড়াতাড়ি কিছু করার জন্য । লেবার কমিশনার কথা রেখেছেন, সাথে সাথেই নিজেই চলে এসেছেন সব খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ।হরতালের খবরও সব শুনলেন । শ্রমিকদের বললেন যে ওনি ব্যাপারটা দেখছেন এবং অনুরোধ করলেন হরতাল তুলে নেওয়ার জন্য । কিন্তু শ্রমিকরা নাছোড়বান্দা বিপ্লবকে না ছাড়লে কিছুতেই হরতাল তুলবে না । কন্টাকটার লোকটার কাছে সব খবর পৌছাল । ও ভাবতেই পারিনি যে বাইরের লোকের জন্য এতো কাণ্ড হয়ে যাবে ।তারমধ্যে আবার লেবার কমিশনারের কাছে রিপোর্ট হয়ে যাওয়াতে খুব ভয় পেয়ে গেল । আর কিছুদিন হরতাল চললে ওর দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারলো । টাকা পয়সার ব্যাপারটা এই ধরনের লোকেরা ভাল বোঝে । তাই থানায় গিয়ে বিপ্লবের নামে সব কেস তুলে নিল । বিপ্লবও মুক্তি পেল আর ওরা ওদের প্রাপ্য টাকা বুঝে পেল ।
তারপর কাজ করতে করতে একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল সার্থক টেরও পেল না ।বিপ্লব চলে যাওয়ার পর ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ ছিল না । কিন্তু হটাৎ একদিন সাম্য একটা খবরের কাগজ নিয়ে এসে সার্থককে দেখাল ।সার্থক দেখল বিপ্লবের ছবি বেড়িয়েছে কাগজে । ঝাড়খণ্ডের হয়ে বিপ্লব সন্তোষ ট্রফিতে বিহারের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করেছে । সার্থকের মনটা আনন্দে ভরে গেল । নিজের অজান্তেই বলে উঠল বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ।
Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos
Naru Mahato
খুব ভালো লাগলো গল্পটা ।
Pradip Kumar Das
লেখাটা খুব সুন্দর খুব ভালো লাগলো
Prasanta Chakraborty
বা:। সুন্দর তরতরিয়ে গল্পটা এগিয়েছে।
Bani Paul
Khub sundor
Swapnesh Ghosh
golpota puro porlam .amar didi ghatsilai thake tai ghatsila amar nijre barir moton .pore darun laglo dada.protiva kokhono lukiye thakena.prokash hoea jai.
Papia Kargupta
অসাধারণ লাগলো
Tapasi Banerjee
Darun laglo.
Gobinda Chakravarty
খুব ভালো লাগলো …
Dipak De
Chaliye Jao. Thamar kono karan nei
Amlan Roy Chowdhuri
খুব ভাল লাগল ।
Manatosh Baroi
Khub sundor
Priyabrata Panja
এক নিশ্বাসে শেষ।টাইট গল্প।সুপ্রিয় দা এর পান্ডুললিপি গুলো রেখে দিও।পরে কাজে আসতে পারে।আর তোমার মত করে চালিয়ে যাও।
Probodh Pal
দারুন লাগলো লেখাটা পড়ে।
Chanchal Bhattacharya
খুব ভালো লাগলো।।
Reena Dasgupta
Khub bhalo laglo
Kanti S
Beplob dergho jibe hok khub sundar galpo
SK Sengupta
দারুন লাগলো তিলক। ভালো থেকো।
Uttam Dey
খুব ভালো লাগলো সুপ্রিয়দা চালিয়ে যায় আমরা পাঠক আছি
Soma Dasgupta
গল্প টা দারুন ভালো লাগল ।
Swapna Sen Gupta
কি দারুন লাগলো গল্পো টা পড়ে।
Tanima Goswami
Darun laglo.
Shilanjib Gayen
Daroon…
Khub valo…💞💞❤️💞👏👏👏
Abani Banerjee
চালিয়ে যাও,সময়ের ব্যবহার ও মনন মিলে গেলে ভাল থাকা যায়।তোমাকে শব্দতরী নামের একটা গ্রুপে এড করব?
Minati De
Tilak lekha gulo khub valo hoache chalie jao.
Bebo Jovius
খুব ভালো লাগলো সুপ্রিয় দা.
লেখাটা চালিয়ে জান. ভালো থাকবেন.
Rina Ray
Tomar lekhonir joban nei
Mita Sengupta
khub bhalo lekha
LikeLiked by 1 person
THANKS TO ALL
LikeLike