কাজের মেয়ে

কাজের মেয়ে

মা , আজ তো আমার জন্মদিন তাইনা ? আমি আজ ১৪ বছরে পড়লাম । আজ তোমাদের কি আমাকে মনে পড়ছে ? সত্যি আজ তোমাদের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করছে আমার । কিন্ত জানি সেটা সম্ভব নয় । আমি এখন তোমাদের থেকে অনেক দূরে কোলকাতা শহরে । আমি জানি তোমাদের কাছে তেমন পয়সা নেই যে আমার সাথে দুদণ্ড দেখা করতে আসবে ।আমার যখন খুব ইচ্ছা করছে তখন আমি জানি তোমাদেরও খুব ইচ্ছা করছে আমার সাথে দেখা করার। আমাকে তোমাদের কাছে রাখার । চাইলেই তো হবে না আমায় কি খেতে দেবে বল । তোমাদেরই প্রতিদিন খাওয়া জোটে না । তাই তো বাধ্য হয়ে আমাকে তোমাদের থেকে এত দূরে কাজ করতে পাঠিয়েছ । প্রথম প্রথম যখন কাজ করতে আসলাম তখন বেশ আনন্দই হচ্ছিল । তোমরা বলেছিলে প্রতিদিন খেতে পাবো , ভাল জামা কাপড় পড়তে পারবো । শহরের আদব কায়দা শিখতে পারবো । সত্যি মা , তিনবেলা খেতে পারছি । দিদিমনির পুরানো ভাল ভাল জামা কাপড় পরতেও পারছি তবুও মনটা মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে । তোমাদের কাছেই ছুঁটে যেতে ইচ্ছা করে । আমার স্বাধীনতা যেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে । আমার নিজের কোন ইচ্ছা নেই । জানো মা , আমাদের এই বাড়ির পাশেই একটা পার্ক আছে। আমার বয়সী মেয়েরা বিকাল বেলা সবাই মিলে কত আনন্দ করে । আমাকে সেই সময় কিছু না কিছু কাজ করতে হয় । মাঝে মাঝেই জানলার কাছে গিয়ে লুকিয়ে ওদের খেলা দেখি । কেননা বাড়ির কেউ দেখে ফেললেই বকাবকি করবে । বলবে কাজে ফাকি দিচ্ছি । মনটা হু হু করে ওঠে ।

প্রথম যেদিন বাবা আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলো , সেদিনটার কথা আমার খুব ভালো করে মনে আছে । এই বাড়ির বসার ঘরে সোফায় কর্তাবাবু , কর্তামা আর আমার থেকে একটু বড় একটা দিদি বসে ছিল। বাবা বসেছিল মাটিতে । আর আমি বাবার পাশে বাবাকে ধরে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমি ভাবছিলাম সবাই তো উঁচুতে বসে আছে , বাবা কেন মাটিতে বসে । আমাদের বাড়িতে তো এরকম উঁচুতে বসবার জায়গা নেই তাই বাবা বোধহয় মাটিতে বসতেই পছন্দ করেছে । কিন্তু এখন বুঝি – বাবুরা যাতে বসে আমাদের তাতে বসার অধিকার নেই । বাবুরা যেখানে শোয় আমাদের সেখানে শোয়ার অধিকার নেই । কর্তামা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমার বয়স কত । বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কর্তামাকে বলেছিল – “এই ১৩ বছর মেমসাহেব” । কর্তা বাবু খুব জোরে হেসে উঠেছিল । বলেছিল – “ সাহেব , মেম কবে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে নিজেদের দেশে চলে গেছে । এখন আর কেউ সাহেব , মেম নয় । আমরা কর্তাবাবু , কর্তামা । এই নামেই ও আমাদের ডাকবে । আর আমদের মেয়েটিকে ও ডাকবে দিদিমনি বলে ।” কর্তামা আমকে বলেছিল – “ এই দিদিটা তোর থেকে দুবছরের বড় । এই দিদিটার বেশ কিছু জামা কাপড় ছোট হয়ে গেছে । তোকে দেব এক এক করে । যদি ভালো মতো কাজ করিস তাহলে সব জামাকাপড় পাবি । নাহলে না । এই দিদিটার সাথে মাঝে মাঝে তুই খেলতে পাবি ।দিদিটার সাথে মাঝে মাঝে বসে টিভি দেখতে পাবি”। খুব আনন্দ হয়েছিল । আমাদের বাড়িতে তো টিভি নেই তাই । তখন তো আমি বুঝিনি যে বনের পাখীটাকে খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হচ্ছে ।

জানো মা , সেদিন দিদিমনির এক বন্ধুর জন্মদিনে সেই বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম কর্তামা আর দিদিমনির সাথে । এমনিতে সব অনুষ্ঠান বাড়িতে ওনারা আমাকে নিয়ে যায় না । ওখানে দিদিমনির বন্ধুরা কেক কাটল । সবাই মিলে খুব আনন্দ করছিল । আমি এক কোনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম । বসার জায়গা ছিল কিন্তু জানি ওখানে আমি বসলে কর্তামাই আমাকে উঠিয়ে দেবে । বসার পরে সবার সামনে উঠিয়ে দিলে আমার কান্না পাবে । তাই আগে থাকতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমি নিজেকে নিমন্ত্রিত বলে ভাবতেই পারছিলাম না । যদিও নিমন্ত্রণ করার সময় ওনারা আমাকেও নিয়ে যেতে বলেছিল । দিদিমনি যাদের সাথে খেলছিল তারা সবাই আমারই বয়সই । একটু ছোট – বড় । আমার দিকে ওরা তাকাচ্ছিল কিন্তু আমাকে খেলতে ডাকছিল না । খুব লজ্জা করছিলো । ইচ্ছা করছিলো ওখান থেকে ছুটে বাইরে চলে যাই । তবে একটা জিনিষ আমার খুব ভাল লেগেছে । খাওয়ার সময় আমি সবার সাথে টেবিল চেয়ারে বসে খেয়েছি । বাড়িতে প্রতিদিন আমি মেঝেতে বসে খাই । এখানে কাজের লোকেরা মেঝেতে বসেই খায় , বাবুদের মতো টেবিল চেয়ারে বসে খায় না । আজ টেবিল চেয়ারে বসে খেতে কি ভালই না লাগছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । এখানে কেবল অনুষ্ঠান বাড়িতেই বাবুরা আর কাজের লোকেরা একসাথে টেবিল চেয়ারে বসে খায় । বাড়িতে গেলে আবার যে কি সেই ।

জানো মা, এদের বাড়িতে একটা বড় ঠাণ্ডা মেশিন আছে । যেখানে খাবার রাখলে নষ্ট হয় না । খাবার বেঁচে গেলে এখানে রাখে , পরে বের করে খায় । আমাদের বাড়িতে তো খাবার বাঁচেই না । ভাত যদি বাচে তাহলে তুমি জল ঢেলে রাখ । এখানে এমনি রাখলেই হয় । এত খাবার রাখা হয় যে অনেক সময় মনেই থাকে না কি কি রাখা আছে । যেদিন দেখা হল , দেখা গেল সেই খাবারটা একটু বেশিদিন রাখা আছে । ওনারা তো সেই খাবার খাবে না । বড় খাবার দোকান থেকে আনা খাবারও থাকে অনেকসময় । আমায় জিজ্ঞেস করে আমি খাব কিনা ? কি ভাল ভাল দেখতে সব খাবার । আমরা কোন দিন খাইনি । অনেকসময় আমার লোভ হয় । খেয়ে নিই । মাঝে মাঝেই খাবার ফেলা যায় । তোমাদের সবার কথা খুব মনে হয় তখন । ভাইটার কথা বেশী করে মনে হয় । অনেকসময় কর্তামা আমাকে বকাবকি করে কেন আমি খাবারগুলোর কথা মনে করিয়ে দিইনি । আমিতো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট । তবু কেন আমার দায়িত্ব হবে ? আমি কাজের লোক বলে !

তোমার কি মনে আছে গতবছর দুর্গাপূজার দু / তিন মাস আগে আমি এখানে এসেছিলাম । পুজতে কর্তামা আমাকে দিদিমনির ছোট হয়ে যাওয়া দুটো ফ্রক দিয়েছিল । দিদিমনি আর পরে না । কি সুন্দর দেখতে । পুরানো তো কি হয়েছে ? পূজার সময় আমাদের আগে তো কেউ কক্ষন জামা কাপড় দেইনি । আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছিল । ষষ্টি পূজার দিন সামনেই বাড়ির কাজের মহিলার সাথে সন্ধ্যাবেলা আমি ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছিলাম । চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে ।নদীর মতো মানুষের মিছিল খালি বয়ে চলেছে । তোমাকে চলতে হবে না , পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তোমায় এগিয়ে দেবে । কাছাকাছি অনেক ঠাকুর দেখলাম । আমাদের ওখানে ঠাকুর দেখতে আমাদের কতদূর পায়ে হেঁটে যেতে হতো বল । পূজার কদিন স্কুল বন্ধ থাকতো । তাই আমরা খাওয়া পেতাম না । পূজার কদিন কোথায় কাঙালি ভোজন হয় সেই খোঁজ নিয়ে আমাদের খেতে যেতে হত । কিন্তু জানো মা এখানে বাড়িতে ভোগ দিয়ে যায় । কর্তাবাবু , কর্তামা , দিদিমনি কেউ খায় না । শুধু হাড়িতে হাত লাগিয়ে প্রনাম করে । ব্যাস আমিই দুবেলা খাই । কর্তাবাবু , কর্তামা , দিদিমনিরা পূজার কদিন বাইরেই খায় । তোমাদের কথা খুব মনে হচ্ছিল । বাবা তো পূজার কদিন থাকে না । ঢাক বাজাতে অনেক দূরে চলে যায় টাকা রোজগারের জন্য । পূজার সময় বাবা থাকে না , তোমার খুব খারাপ লাগে আমি জানি । কিন্তু কিছু করার তো নেই । যাদের টাকা পয়সা আছে পুজায় তাদের আনন্দ । আমাদের আবার পূজা !

যাক গে । তুমি কিছু ভেব না । আমি সব মানিয়ে নেব । মানিয়ে তো আমাকে নিতেই হবে তাইনা ? গ্রামে থাকলে তো খেতে পাবো না । স্কুলে গেলে শুধু দুপুরবেলা খেতে পেতাম । যেদিন স্কুল বন্ধ থাকতো সেদিন তো আর খাবার পেতাম না । এছাড়া তোমাদের আরও কত খরচা আছে । আমাকে কাজ না করলে চলবে কেন ? তবে মা , আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের কেন কাজ করতে হবে । আমারা কেন ছোটবেলাটা পাবনা দিদিমনিদের মতো । আমাদের কি দোষ ? অনেক কথা মনে আসলো তাই মনে মনে বললাম । যদি তুমি শুনতে পাও । আমি তো আর লিখতে জানিনা আর তুমিও পড়তে জাননা । তাই আমাদের অনেক্ কথা আমাদের ভিতরেই থেকে যায় । জানো মা , আমাদের একটা গালভরা নাম আছে পরিচারিকা । আসলে ২৪ ঘণ্টার কাজের লোক ।

ভাল থেকো । শুধু মনে বিশ্বাস রাখ একদিন সুদিন আসবেই আসবে ।

Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos

6 thoughts on “কাজের মেয়ে

  1. কঠোর বাস্তব কে তুলে ধরে সমাজ কল্যাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ইদানীং খুব ভালো লাগছে মনে হচ্ছে আমি ও কাজের কাজ কিছু করি ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবনা

    Liked by 1 person

  2. Apurba Neogi
    Excellent heart touching story..
    Sanjukta Mohanty
    minor children r facing such problems.even in hotel u find plenty r working.
    Tapasi Banerjee
    Khub bhalo laglo.
    Shubhranshu Mohan Banerji
    আবহমান কাল থেকে এই পরিস্থিতিতে আমরা চলছি । তবুও পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে সম্মান করি ।
    Bani Paul
    Khub sundor.
    Krishna Kumar Ganguly
    Khoob bhalo
    Mita Sengupta
    Khub bhalo laglo.
    Krishna Chaudhuri
    মন ছুয়ে গেল।
    Soma Dasgupta
    অপূর্ব লাগল লেখাটা , একদম সত্যি কথাটা তুলে ধরা হয়েছে ।
    Aparajita Sengupta
    বাস্তবধর্মী লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল ।আমার মনে হয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি র পরিবর্তন ঘটলে তবেই পরিবর্তন আসবে ।ওদের প্রতি একটু ভালোবাসা ও সহানুভূতির প্রয়োজন ।
    Kanti S
    Ato gaver bhabe sabai jode oder katha vabto jate oder sapno puron hoy ate amader samajeri lav hoto amar mone hoy
    Papia Kargupta
    Mon chhuya gelo re !!vison2 valo tor sob lekha gulo ak songe kore 1ta boi chhapanar sekhan theke 1ta amak gift koris tahole jokhon khusi porte paorbo
    Prasanta Chakraborty
    বাস্তব ও গল্প কখন মিশে গেল বুঝতেই পারলাম না। দারুন লিখেছ সুপ্রিয়।
    Bijaya Chatterjee
    Amader ei niom ki paltabe adeo ? Samne asbe ki sudin . Ashay railam . Thank you
    Chanchal Bhattacharya
    সত্যিকারের সামাজিক সমস‍্যা নিয়ে ভালো লিখেছেন‌‌।
    Prakash Chatterjee
    Khub.bhalo.laglo.
    Biplabshankar Mazumder
    সম্পূর্ণ গল্পটা একবারেই পড়ে নিলাম। এটা তো গল্প নয় , ” কাজের মেয়ের” বায়োগ্রাফি ।
    নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি একটা চ্যাম্পিয়ন ছোট গল্প।
    প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলে হে সুপ্রিয় ।
    Sonali Biswas
    ভীষণ অন্যরকম। বিশেষ করে প্যাটার্ন। কনটেন্ট ত অবশ্যই।
    Mita Sengupta
    Khub laglo..
    Mita Sengupta
    Valo
    Mita Sen
    Daruuuun

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s