আমাদের সিমলা হয়ে কিন্নর ভ্রমণ( সারাহান , সাংলা , চিটকুল , কল্পা , রামপুর )

সিমলা

গতকাল রাত্রে মানালি থেকে সিমলা পৌঁছে পরেরদিন 10/10/2024 তারিখ অর্থাৎ সপ্তমীর দিন সকালবেলা সোজা চলে গেলাম কাছেই বান্টনি পাহাড়ে 1845 সালে নির্মিত সিমলার কালীবাড়িতে দুর্গাপূজার স্বাদ গ্রহণ করতে । এই কালীবাড়ি শ্যামলা দেবীর প্রতি উৎসর্গীকৃত এবং তার নামানুসারে ‘শিমলা’নামটিএসেছে। সিমলার বাঙালিদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে সপ্তমী পূজার অঞ্জলি শেষ হতেই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম একটু হেঁটে সিমলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মল রোডে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের মিশ্রণ দেখতে ।একটু হেটেই পৌঁছে গেলাম দ্য রিজ যা সিমলার কেন্দ্রীয় খোলা স্থান যেখান থেকে আমরা হিমালয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করলাম । বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব এখানে অনুষ্ঠিত হয়, এবং এটি শহরের অন্যতম প্রিয় সমাবেশ স্থান।তারপর সিমলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ৮,০৫৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত জাক্কু মন্দির দর্শন করলাম , মল রোড থেকে জাক্কু মন্দিরের হনুমানজির বিশাল মূর্তি দেখা যায় ।মল রোডের ওপরের দেখলাম ১৮৫৭ সালে তৈরি ক্রাইস্ট চার্চ , নব্য-গথিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি এবং সিমলার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন। একে একে দেখলাম ভাইসারেগাল লজ , গেইটি থিয়েটার ও সারি দিয়ে অসংখ্য দোকান ও ক্যাফে । এটি একটি সুন্দর হেঁটে ঘোরার জায়গা যেখানে থেকে  সিমলার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায় ।ফিরে আসলাম দুপুরে হোটেলে ডিয়ার ট্রাভেলসের সাথে যোগ দিতে পরবর্তী কিন্নর ভ্রমনের জন্য । ডিয়ার ট্রাভেলসের সাথে আগত আরও অনেক পর্যটকদের সঙ্গে বিকালে আবার গেলাম আলোকোজ্জ্বল  মল রোড দেখতে ও সিমলা কালীবাড়ির দুর্গা মণ্ডবে সপ্তমীর রাতে কিছুটা সময় কাটাতে ।সন্ধ্যাবেলা মল রোডে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগছিল ।   

সারাহান

পরেরদিন 11/10/2024 তারিখ , শুক্রবার , মহাষ্টমীর দিন সকালে আমরা আরও 32 জন পর্যটকের সাথে মিলিত হয়ে ডিয়ার ট্রাভেলসের পরিচালনায় সিমলা থেকে ফাগু হয়ে রওনা হলাম , 160 কিমি দূরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2,150 মিটার বা 7053 ফুট উচ্চতায় , হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলার একটি ছোট সুরম্য গ্রাম সারাহানে , যাকে কিন্নরের প্রবেশদ্বার বলা হয়। তুষারাবৃত শ্রী খণ্ড কৈলাস পিকের  মনোরম দৃশ্য ও উপত্যকার নিচ দিয়ে বয়ে চলা সুতলজ বা শতদ্রু নদী এই স্থানটির আকর্ষণ অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে । কৈলাস পর্বতমালার আশেপাশে তিব্বতের রাখাস্তাল হ্রদের কাছে এই শতদ্রু নদীর উৎপত্তিস্থল।সারাহানে পৌঁছেই হোটেলে জিনিস পত্র রেখে কাছেই পৌঁছে গেলাম 400 বছরের পুরানো সারাহানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভীমাকালীর মন্দির দেখতে ।এটি 51টি পবিত্র শক্তিপীঠের মধ্যে একটি ।  সন্ধ্যা 6.30 pm প্রধান মন্দির বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ফিরে আসলাম হোটেলে । পরেরদিন সকাল সকাল আবার গেলাম মন্দিরে ।  মন্দিরটি কাঠ ও পাথরের মিশ্রণে তৈরি একটি প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। মন্দিরের গঠন হিমাচলের ঐতিহ্যবাহী পাগোডা শৈলীতে তৈরি।মন্দিরের পাশেই রয়েছে   হিমাচল প্রদেশের শাহী বুশাহর রাজবংশের রাজবাড়ি নাম শান্তিকুঞ্জ । রাজবাড়ি ঘুরে অনেক ছবি নিয়ে ফিরে আসলাম হোটেলে । খাওয়া দাওয়া সেরে 83 কিমি দূরে রওনা হলাম সাংলা উপত্যকা যা বাস্পা উপত্যকা নামেও পরিচিত।  

সাংলা

12/10/2024 তারিখ সারাহান থেকে এসে পৌছালাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 2,680 মিটার বা 8792 ফুট উচুতে সাংলা উপত্যকাতে যাকে বাস্পা উপত্যকা নামেও ডাকা হয় । সারাহান থেকে সাংলার রাস্তা একটা  চমৎকার রোমাঞ্চকর অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাহাড়ি পথ । এই পথটি সরু এবং কাঁচা, একদিকে পাহাড়ের খাড়া ঢাল আর অন্যদিকে গভীর উপত্যকা। যেহেতু এই রাস্তায় অনেক সঙ্কীর্ণ ও হেয়ারপিন মোড় রয়েছে, তাই খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে  হয় । বিশেষত বড় গাড়ির ক্ষেত্রে এসব মোড়গুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং। রাস্তায় যেতে যেতে মাঝে মাঝে তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়াগুলি চোখে পড়ে আবার পথে বিভিন্ন স্থানে নদী বা ঝর্ণার দেখা মেলে । পথে দেখলাম সুতলজ আর বাস্পা বা বিপাশা নদীর সঙ্গম । সাংলা উপত্যকা তুষার-ঢাকা পাহাড়, সবুজ বন, আপেল বাগান এবং ঘোলাটে বাসপা নদীর সুন্দর ক্যানভাস দ্বারা আবৃত। সাংলা কিন্নরের সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকাগুলির মধ্যে একটি। পরেরদিন খাওয়াদাওয়া সেরে আবার রওনা হলাম 22 কিমি দূরে চিটকুলের উদ্দেশ্যে ।

চিটকুল

13/10/2024 তারিখ দুপুর বেলা সাংলা থেকে ডিয়ার ট্র্যাভেলসের সাথে  আমরা সদলবলে এসে পৌছালাম 3,450 মিটার বা 11318 ফুট উচ্চতায় হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলার ইন্দো-তিব্বত সীমান্তের কাছে চিটকুলে যা  সাঙ্গলা ভ্যালির শেষ বসতিপূর্ণ গ্রাম। সাংলা থেকে চিটকুল ভ্রমণ হলো হিমাচল প্রদেশের একটি অত্যন্ত চমৎকার অভিজ্ঞতা। কখনও পাহাড়ের ছাদের তলা দিয়ে , আবার কখনও  বিপদসংকুল সরু রাস্তা দিয়ে এই যাত্রা সারা জীবন মনে থাকবে । এটি ভারতের শেষ গ্রাম হিসেবে পরিচিত যা তিব্বত সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত। হোটেলে পৌঁছেই দুপুরের আহার সেরে বেড়িয়ে পড়লাম খুব কাছেই আদি বাসপা নদীর শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যেকে চাক্ষুষ করতে ।চারিদিকে হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্যের মাঝে অনেক নীচে গিয়ে নদীর পাশে বসে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা উপভোগ করে এক দারুন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম । এই অঞ্চলে ভারী তুষারপাত হয়, যার ফলে শীতকালে এটি বন্ধ থাকে।

কল্পা

পরেরদিন 14/10/2024তারিখ তাড়াতাড়ি দুপুরের আহার সেরে 60কিমি দূরে সাংলা হয়ে অগুনতি আপেল বাগানকে দুপাশে রেখে সুতলজ বা শতদ্রু নদী উপত্যকার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 2759 মিটার বা 9051 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কল্পাতে এসে পৌছালাম । চিটকুল থেকে কল্পা যাওয়ার যাত্রাপথ একটি সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পাহাড়ি পথে, নদীর ধারে, এবং ছোট ছোট গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা কল্পা এসে পৌছালাম । আপেল বাগানের মধ্য দিয়ে হোটেলে ঢুকতেই সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি কিন্নর কৈলাশ পর্বতশ্রেণীর অসাধারণ দৃশ্য। গোধূলি আলোয় পাহাড়ের চুড়াগুলো মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত । তিনটে চুড়া Roldang (5499 meter) , Jarkanden (6473 meter) এবং Kinnaur Kailash ( 6050 meter) পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল ।

পরেরদিন ভোর থাকতেই পাহাড়ের দিকে ভাল করে তাকাতেই দেখি পাহাড়ের মাথায় কিন্নর কৈলাশ পর্বতশ্রেণীর দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের সাথে একটি বিশেষ শিলা দেখা যাচ্ছে , যাকে স্থানীয়রা শিবলিঙ্গ হিসেবে পূজা করেন। ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়িয়ে পড়লাম কাছেই আপেল বাগান ও তার factory দেখতে । কোন গাছ ভরে আছে লাল আপেলে আবার কোন গাছে ভরে আছে সোনালী আপেলে ।কল্পা থেকে 8 কিমি দূরে  রোগী গ্রাম যাওয়ার পথে পড়লো সুইসাইড পয়েন্ট । একদিকে পাহাড় আর আরেক পাশে খাঁড়াভাবে অনেকটা নীচে নেমে গেছে খাদ । হয়ত এখানে কেউ সুইসাইড করেছিল তাই এই জায়গাটার নাম হয়েছে সুইসাইড পয়েন্ট । রোগী গ্রাম ঘুরে  আমরা গাড়ি করে গেলাম বৌদ্ধ ধর্মের 100 বছরের পুরানো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরকল্পা মনাস্টারি এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তপর্ণি মন্দির দেখতে  । এখানে বৌদ্ধ মঠ এবং প্রাচীন হিন্দু মন্দির পাশাপাশি অবস্থান করছে, যা কিন্নর অঞ্চলের ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রমাণ। অক্টোবর মাসে কল্পার প্রকৃতি সাধারণত খুবই সুন্দর থাকে । চারপাশে তুষারাবৃত পাহাড়, সবুজ বন,নীল আকাশ আর গাছে আপেল দেখার সুযোগ পাওয়া যায় । এই সময় হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গগুলি খুব ভালোভাবে দেখা যায়।

রামপুর

পরেরদিন 16/10/2024 কল্পা থেকে 96 কিমি দূরে সতলেজের বাম তীরে 1,005 মিটারে বা 3297 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বুশহারের শীতকালীন রাজধানী হিসেবে পরিচিত রামপুরে এসে পৌছালাম বিকালে ।  রামপুর মধ্য এশিয়া এবং তিব্বতের সাথে ভারতীয় বাজারে যোগদানকারী প্রধান বাণিজ্য রুটগুলির সাথে ভালভাবে সংযুক্ত হওয়ায়, এই রামপুর বাণিজ্যিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকে, বিশেষ করে নভেম্বর মাসে লাভী মেলার সময়।পরেরদিন সকালে গাড়ি করে সোজা চলে গেলাম কালকা, ট্রেন ধরতে । আমাদের কিন্নর ভ্রমণ শেষ হোল এবার বাড়ি ফেরার পালা ।  

Leave a comment