সালটা ছিল ১৯৪৭ । পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে বাস করতেন সুধীর ঘোষালের পরিবার । পরিবার বলতে ছিল স্ত্রী অনিমা ঘোষাল , ছেলে স্বপন আর মেয়ে স্বপ্না । সুধীর বাবু ছিলেন শহরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি । অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল তাদের বসত বাড়ি । সুন্দর সুখের সংসার নিয়ে হেসে খেলে দিন কাটছিল সুধীর বাবুর পরিবারের । বাদ সাধলো রাজনৈতিক অস্থিরতা । ভারতবর্ষের মানচিত্রে নতুন কাঁটাতার টানা হল, দেশ ভাগ হল দুই টুকরোতে—ভারত আর পাকিস্তান। আর সেই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে এল বিভেদের কালো ছায়া। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বেড়ে উঠল দাঙ্গার আগুন।পূর্ববঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চল পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেল। ঘোষাল পরিবার এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেল। তাদের শহরে হিন্দু-মুসলমানেরা পাশাপাশি বাস করত, কিন্তু নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সবকিছুই বদলে গেল। হটাত করেই শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা । সংখ্যালঘুদের উপর শুরু হোল হামলা, লুটপাটের সাথে সাথে চলল নারী-শিশুদের ওপর অত্যাচার । এক রাতে দেশের অনেক জায়গায় আগুন জ্বলে উঠল, আতঙ্কিত মানুষজন ছুটে পালাতে লাগলো । প্রশাসন বলে আর কাউকেও দেখা যাচ্ছিল না । সুধীর বাবু বুঝতে পারলেন যে তাদের শহরেও আর শান্তি থাকবে না। তাই তিনি পরিবারের সবার সুরক্ষার জন্য এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন । ঠিক করলেন তাদের নিজ ভূমি ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেবেন । এটাই ঐ মুহূর্তে ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য কতটা কষ্টের ছিল, তা কেবল তারাই জানত। পূর্বপুরুষের ভূমি ছেড়ে যাওয়ার কথা তারা কখনও ভাবেনি, কিন্তু হঠাৎ করেই সেই বাস্তবতা এসে উপস্থিত হল। এক অন্ধকার রাতে তারা গ্রামের স্মৃতি, শৈশবের স্মৃতি, ভিটে মাটির স্মৃতি সবকিছু ছেড়ে হাতে সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে জীবন বাচাতে পালাতে বাধ্য হোল । পথে ভয়, অনিশ্চয়তা, আর বিপদের মাঝে শুরু হোল তাদের পথ চলা। পায়ে হেঁটে, ট্রেনে গাদাগাদি করে আরও অনেকের সাথে অজানা অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের পালাতে হচ্ছিল শুধু মাত্র জীবন বাচাতে । অবশেষে তারা বিধ্বস্ত হয়ে অন্যদের সাথে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছাল। কিন্তু সেখানেও জীবন তাদের জন্য সহজ ছিল না। নতুন দেশে এসে তারা নিজেদের পরিচয়হীন মনে করছিল। যারা একসময় ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার , তারা আজ উদ্বাস্তু, শহরের এক করুণ শরণার্থী। ভারতবর্ষের একটি শরণার্থী শিবিরে মাথা গুঁজে থাকল তারা, নতুন করে জীবন শুরু করার সংগ্রামে নামল । এতদিন তাদের পরিচয় ছিল তারা একটি দেশের নাগরিক আর এখন তাদের পরিচয় হয়ে গেল উদ্বাস্তু । ……………
আবার সালটা ১৯৭১ । বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে হাজার হাজার সাধারণ মানুষও দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছে জীবন বাঁচাতে। বাংলাদেশের এক ছোট্ট শহরে বাস করত সেন পরিবার। পরিবারের কর্তা সৌম্য সেন ছিলেন একজন শিক্ষক । তার স্ত্রী কমলা আর দুই সন্তান, রূপা আর রাজু, ছিল তার পৃথিবী।
যুদ্ধের আগুন যখন সেই শহরে পৌঁছায়, পাকিস্থানপন্থীদের ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের কারনে হিন্দুদের উপর বেশী করে আক্রমন নেমে আসলো । তখন সৌম্য বুঝতে পারলেন যে আর এখানে থাকা যাবে না। তাড়াতাড়ি সাধ্যমত সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পরিবারসহ তিনি রওনা হলেন ভারতীয় সীমান্তের দিকে। দুচোখে অশ্রু আর অনিশ্চয়তার কালো মেঘ নিয়ে পা বাড়ালেন অজানা গন্তব্যের দিকে।কিন্তু সীমান্তে পৌঁছানো সহজ ছিল না। পথে লুটপাট আর হিংস্র আক্রমণের মধ্য দিয়ে অতি কষ্টে শেষমেশ তারা পৌঁছালেন কলকাতায় । তাদের পুরানো পরিচয়, স্মৃতি, সবকিছু পেছনে ফেলে চলে আসতে হোল প্রতিবেশী দেশ ভারতবর্ষের কলকাতায় । কলকাতায় তাদের জীবন কিন্তু সহজ ছিল না। পূর্বপুরুষের ভূমি ছেড়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে কি নিদারুন কষ্টের মধ্যে যে তাদের জীবন সংগ্রাম শুরু করতে হোল সেটা যাদের সাথে এরকম ঘটেছে তারা ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না । এতদিন তাদের পরিচয় ছিল তারা একটি দেশের নাগরিক আর এখন তাদের পরিচয় হয়ে গেল শরণার্থী । …………………
আবার সালটা ২০২৪। হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে । সারা বাংলাদেশ ছাত্র আন্দলনে উত্তাল । বাংলাদেশ নাকি আবার স্বাধীনতা পেয়েছে । সারা বাংলা দেশ জুড়ে চলছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সন্ত্রাস ।চারিদিক থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে বেছে বেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে অগ্নিসংযোগ , হত্যা , লুটপাট , ডাকাতি। কেউ কেউ বাড়ি ঘর ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে । বাংলাদেশের এক গ্রামে বাস করত দাস পরিবার। পরিবারের কর্তা হরিপদ দাস ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। অনেকটা চাষের জমি ছিল । গরু , ছাগল , হাস , মুরগি নিয়ে চাষ বাস করে সুন্দর দিন চলে যাচ্ছিল । কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ গ্রামে কালো ছায়া পড়তে শুরু করল। কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী বা বলা যায় দুষ্কৃতকারী এই আন্দোলনের সুযোগে এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য সংখ্যালঘুদের বাড়িতে , ধর্মীয় স্থানে আক্রমন শুরু করলো । রাতের অন্ধকারে কিছু দুষ্কৃতিকারী তার বাড়িতে আক্রমণ করল। বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে দাস পরিবারের সবাইকে হুমকি দিল দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য । ভয় দেখিয়ে চলে যাওয়ার সময় , তাদের সম্পত্তি নষ্ট করল , গৃহপালিত প্রাণী থেকে আরম্ভ করে বাড়িতে যা পেল নিয়ে চলে গেল । নিজের দেশে , নিজের ভিটেতে , নিজের গ্রামে বড় অসহায় লাগছিল হরিপদ বাবুর । হরিপদ বাবু বুঝলেন তার প্রিয় গ্রামটি আর তার জন্য নিরাপদ নয়। তার প্রিয় গ্রামটি আর সেই শান্তির আশ্রয়স্থল রইল না। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়ার। পরের দিনই পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অজানা গন্তব্যের দিকে। হৃদয় ভারাক্রান্ত, চোখে অশ্রু। যে মাটি তার জীবন দিয়ে তৈরি করেছিলেন, সেখান থেকে তাকে পালাতে হচ্ছে নিজের আর পরিবারের জীবন বাঁচানোর জন্য।অনেক কষ্টে পায়ে হেঁটে এসে পৌছালেন সীমান্তে । এসে দেখলেন প্রচুর মানুষ এসে জড় হয়েছে সীমান্তে । সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে বিএসফ । তারা কিছুতেই সীমান্ত পেরিয়ে এদিকে আসতে দিচ্ছে না । এক অসহায় অবস্থা । সবাই পুরানো পরিচয়, স্মৃতি, সবকিছু পেছনে ফেলে ভিটে মাটি ছেড়ে বাধ্য হয়ে পরিবারের প্রান বাচাতে একটু আশ্রয়ের জন্য আজ সীমান্তে এসে হাহাকার করছে । তাদের পরিচয় এখন শুধুই অনুপ্রবেশকারী । ……………
তিনটি সময় কিন্তু ঘটনা একইরকম । যেন মনে হয় একটা Web Serirs চলছে । উড়িষ্যার থেকেও আয়তনে ছোট একটা দেশে প্রশাসন এতই দুর্বল যে বার বার এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে । মৌলবাদীদের/দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচারে সবকিছু পেছনে ফেলে ভিটে মাটি ছেড়ে বাধ্য হয়ে পরিবারের প্রান বাচাতে একটু আশ্রয়ের জন্য কেন মানুষকে এই আধুনিক যুগেও পালাতে হচ্ছে? এর কোন প্রতিকার কেন হবে না ? মৌলবাদীদের বা দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচারে যাদের ক্ষতি হয়েছে তাদের সমস্ত রকম ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব সেই দেশের সরকারের নেওয়া উচিৎ এবং যারা ক্ষতি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিৎ । যদি তা না হয় তাহলে বুঝবো সেই দেশের সরকার মুখে না বললেও অন্তর থেকে মৌলবাদীদেরই সমর্থন করে ।