আমাদের শিলিগুড়ির ঘর থেকে আমাদের আবাসনের সামনের বড় পার্কটা পুরোটাই খুব পরিষ্কার দেখা যায় । আবাসনের ছোট ছোট বাচ্চারা নির্ভয়ে বিকালবেলায় খেলাধুলা করে এই পার্কে ।বাচ্চাদের খেলাধুলা করার বেশ কিছু উপকরণ রয়েছে এই পার্কে । সারা বিকাল আবাসনের বাচ্চারা সারা পার্ক মাতিয়ে রাখে । আর ভোরবেলা দেখা যায় আবাসনের বাড়ির কুকুররা পার্ক জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে । কুকুরদের মালিক বা মালকিনরা তাদের প্রিয় কুকুরদের নিয়ে পার্কে বেড়াতে আসে । এইসব কুকুরদের জীবন ছিল স্বপ্নের মত, আরামের মাঝে কাটত ওদের দিনগুলো। ওদের ছিল নরম বিছানা, প্রতিদিনের সুস্বাদু খাবার আর অগাধ ভালবাসা।এর উল্টোদিকে আবাসনের মধ্যে থাকতো কিছু রাস্তার কুকুর । তাদের জীবন ছিল সংগ্রামের, খাবারের খোঁজে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো আর রাতের বেলা রাস্তায় কোন এক কোণে ঘুমানো।একটা জিনিস কদিন ধরেই আমার চোখে পরছিল যে বাড়ির কুকুর আর রাস্তার কুকুর কেউ কারও সাথে মেশে না বরং বলা যায় বাড়ির কুকুরের মনিবরা মিশতে দেয় না । তবে একটা জিনিস লক্ষ করার মত , সবার মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ সহবস্থান ছিল । কেউ কারও দিকে তেড়ে যায়না বা দেখে কেউ ঘেউ ঘেউ করেনা । একটা সমান্তরাল দূরত্ব মেনে চলে । অর্থনৈতিক তারতম্যের বোধ মনে হয় ওদেরকেও জোর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে । শুধু ব্যতিক্রম দুটো বাচ্চা , বাড়ির ও রাস্তার কুকুরের । বাড়ির বাচ্চা কুকুরটার নাম টমি আর রাস্তার বাচ্চা কুকুরটার নাম আবাসনের বাচ্চারা আদর করে রেখেছে ভুতু । টমি পার্কে আসলে ভুতু কি করে জানিনা টের পায় , যেখানেই থাকুক এক ছুটে চলে আসে পার্কের সামনে । একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে । ছুটে কাছাকাছি চলে যেতে চায় । কিন্তু টমির মনিব কিছুতেই টমিকে ভুতুর কাছে যেতে দেয় না । জোর করে চেন ধরে টানতে টানতে দূরে নিয়ে যায় । টমি যেতে যেতে খালি ঘার ঘুরিয়ে ভুতুকে দেখতে থাকে ।আর মাঝে মাঝেই ভুতুর দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে । আমার মনে হয় টমি , ভুতুকে বলতে চাইছে যে “ ভুতু তুমি অনেক ভাল আছ । হতে পারে তোমার সংগ্রামী জীবন আর আমার আরামের জীবন কিন্তু তুমি পুরোপুরি স্বাধীন । যেখানে খুশি যেতে পারো । যার সাথে খুশি মিশতে পারো । আর আমাকে দেখো মনিবের ইচ্ছার উপর চলতে হয়” ।
এরপর বেশ কদিন কেটে গেল টমিকে আর পার্কে নিয়ে আসে না । ভুতুকে দেখি প্রতিদিন সকালে ঠিক সময়ে আসে আর পার্কের চার পাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু সেই ছটফটে ভাবটা ওর মধ্যে আর লক্ষ করা যাচ্ছে না ।একদিন দেখলাম ভুতু পার্কের পাশের রাস্তার কোনায় শুয়ে আছে । টমির মনিব টমিকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল । দেখলাম হটাৎ টমি ভুতুকে দেখতে পেয়ে চীৎকার করতে থাকলো আর ভুতুর দিকে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো । ভুতু টমির আওয়াজ শুনে ঘার উচিয়ে দেখল আবার শুয়ে পড়লো । এবার দেখলাম ঐ শান্ত টমি হিংস্র হয়ে উঠল । মনিবের হাত ছাড়িয়ে ভুতুর দিকে দৌড়ে গেল আর ক্রমাগত চীৎকার করতে লাগলো । যেন বলছে “ ভুতু কি হয়েছে তোর ? আমি এসে গেছি , এবার উঠে পর” । ভুতু চোখ খুলে টমির দিকে তাকাল আর আমি দেখতে পেলাম ভুতুর দুই চোখের কোনা দিয়ে জল ঝরছে । টমির মালিক খুব চেষ্টা করতে লাগলো টমিকে নিয়ে যেতে কিন্তু টমি নাছোড়বান্দা , কিছুতেই ভুতুর কাছে থেকে নড়বে না । আর মনিবের পায়ের কাছে শুয়ে কাঁদতে লাগলো । মনিব টমিকে খুব ভাল বাসতো । বুঝল ভুতুকে ছাড়া টমিকে কিছুতেই বাড়ি নেওয়া যাবে না । ওদের বন্ধুত্ব দেখে মনিবের খুব মায়া হোল । টমির মালিক বুঝলেন ভুতু খুব দুর্বল এবং অসুস্থ। তিনি ভুতুকে তুলে নিলেন এবং বাড়িতে নিয়ে এলেন। আমিও সাথে সাথে গেলাম কেননা ওদের প্রতি আমারও খুব মায়া পড়ে গেছিল । ভুতুর জন্য এক গরম বিছানা আর সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা হল । টমি, ভুতুর পাশে বসে থাকল, যেন সে জানাতে চায়, “বন্ধু তোমার কোন ভয় নেই , আমি সবসময় আছি তোমার পাশে ।”……………
এখন টমি ও ভুতু একসাথে থাকে। প্রতিদিন ওরা পার্কে আসে একসাথে খেলে বেড়ায় । টমি ভুতুকে তার সুখের জীবনের অংশ বানিয়ে নিয়েছে, আর ভুতু টমিকে শিখিয়েছে স্বাধীনতার মর্ম। তাদের বন্ধুত্বের গল্পটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে । এর থেকে একটা জিনিস আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে সব প্রাণীরই একটা সুন্দর মন আছে যেখানে গচ্ছিত আছে অফুরন্ত ভালবাসা আর আবেগ যা কোন শাসন ও বাঁধন মানে না ।