সূচিপত্র
| ক্রমিক সংখ্যা | জায়গার নাম |
| 1 | সান্তা ক্লসের গ্রাম -ল্যাপল্যান্ড |
| 2 | নোবেল পুরস্কারের জন্মদাতার শহর – স্টকহোম |
| 3 | ফুটবলের মক্কা – বার্সেলোনা,স্পেন |
| 4 | ফুটবলের মক্কা – মাদ্রিদ ,স্পেন |
| 5 | লন্ডন নামচা |
| 6 | ইউরোপের সিলিকন উপত্যকা – তালিন |
| 7 | স্বপ্নের দেশ – ফিনল্যান্ড |
| 8 | নূক্সিও / NUUKSIO NATIONAL PARK, FINLAND |
| 9 | হ্যানকো (Hanko), ফিনল্যান্ড |
| 10 | হেলসিঙ্কি , ফিনল্যান্ড |
| 11 | সৌমেনলিনা দ্বীপ’ , ফিনল্যান্ড |
| 12 | YYTERI BEACH এবং TURKU CITY |
| 13 | আবার তালিন |
| 14 | পৃথিবীর উত্তরের শেষ প্রান্ত – নর্থ কেপ |
| 15 | ফিনল্যান্ডের সংসদীয় নির্বাচন |
| 16 | আমাদের চোখে ফিনল্যান্ড |
| 17 | উৎসবে বাঙালি |
| 18 | ফিনল্যান্ডের মে দিবস যা বাপ্পু (VAPPU) নামে পরিচিত |
| 19 | আমাদের চোখে ফিনল্যান্ডের গ্রাম পুউমালা(PUUMALA) |
| 20 | ফিনল্যান্ডে ভারত দিবস / India Day in Finland |
| 21 | আমাদের চোখে অরোরা বোরিয়ালিস বা Northern light বা মেরুজ্যোতি |
| 22 | SAUNA IN FINLAND |
| 23 | আমাদের চোখে ইতালির ভেনিস |
| 24 | আমাদের চোখে এস্তোনিয়ার পার্নু |
| 25 | আমাদের চোখে জার্মানির মিউনিখ |
| 26 | আমাদের চোখে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস |
| 27 | আমাদের চোখে বেলজিয়াম |
| 28 | আমাদের চোখে লাটভিয়ার রাজধানী রিগা |
| 29 | আমাদের চোখে সুইজারল্যান্ড |
| 30 | আমাদের চোখে ভ্যাটিকান সিটি |
| 31 | আমাদের চোখে ইতালির রাজধানী রোম |
সান্তা ক্লসের গ্রাম -ল্যাপল্যান্ড
পর্যটকদের কাছে ল্যাপল্যান্ডের আকর্ষণ অনেকদিনের । কারণ এখানে আছে সান্তা ক্লসের গ্রাম , প্রচুর রেইন ডিয়ার , অরোরা বোরিয়ালিস , আর্কটিক সার্কেল , মধ্যরাত্রে সূর্য দেখার সূখ , স্লেজ গাড়ি , ইগলু , এছাড়া আছে অপূর্ব প্রাকিতিক সৌন্দর্য আর আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ধংসলীলার ইতিহাস ।
আমরা যদি একটু ভালো করে পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে একদম উপর দিকে অর্থাৎ উত্তর মেরুর দিকে দেখবো একটা গোল বৃত্ত আঁকা আছে । সেটাকেই বলে আর্কটিক সার্কেল । এই আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে যে সব জায়গাগুলো আছে সব জায়গারই আবহাওয়া ঠান্ডা । কিছু কিছু জায়গা আবার সবসময় বরফে ঢাকা থাকে । আটটি দেশের মধ্য দিয়ে এই আর্কটিক সার্কেল গেছে । দেশগুলো হোলো নরওয়ে ,সুইডেন , ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড , রাশিয়া , ইউনাইটেড স্টেটস (আলাস্কা ),কানাডা , গ্রীনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড ।
ল্যাপল্যান্ড ফিনল্যান্ডের উত্তর দিকের একটি সীমান্ত প্রদেশ যার তিনদিকে আছে সুইডেন ,নরওয়ে আর রাশিয়া । আমরা তখন ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে । হেলসিঙ্কি থেকে ট্রেনে ল্যাপল্যান্ড এক রাত্রির যাত্রা । নভেম্বর মাসের শেষ দিক , ভালই ঠান্ডা । ঐ সময় প্রচুর বরফ দেখা যায় আর অরোরা বোরিয়ালিস দেখার খুব সুযোগ থাকে । ছেলের কাছে শুনেছি রাত্রের আকাশ জুড়ে দেখা যায় সবুজ আলোর ঝলকানি । সারা আকাশ জুড়ে অনেক্ষণ ধরে চলে সবুজ আলোর ঢেউ । ওর বেশ কটা ছবিতে অরোরা বোরিয়ালিস দেখার সুযোগ পেয়েছি । তাই নিজের চোখে দেখার সুযোগ ফেলতে পারলাম না । ল্যাপল্যান্ডের হাতছানি তীব্রভাবে অনুভব করতে লাগলাম ।

অগ্যতা ২৭,১১,২০১৫ বিকাল সাড়ে পাঁচটা , তিনজনে রওনা হলাম হেলসিঙ্কি থেকে ট্রেনে করে ল্যাপল্যান্ড । দোতলা ট্রেন , করিডরের পাশদিয়ে পর পর অনেকগুলো ছোট ছোট কামরা । একটা কামরায় দুটো করে বার্থ ,উপরে আর নীচে । সুন্দর করে বিছানা পাতা । বেসিন, জামাকাপড় টাঙ্গানোর হ্যাঙ্গার , ছোটর মধ্যে সবই আছে । সকাল ৮টা নাগাদ ল্যাপল্যান্ড পোঁছালাম । অবশ্য ওখানে অন্ধকার । আলো হয় সকাল ৯টার পর , থাকে ২ টা অবধি ।ওয়েটিং রুমে পরিস্কার হয়ে পাশের একটা রেস্তরাঁতে সকালের জলখাবার খেতে গেলাম ।এখানকার ওয়েটিং রুম ঝকঝকে পরিস্কার । ও একটা কথা লিখতে ভুলে গেছিলাম। এখানে ট্রেনে কোন আলাদা আলাদা ক্লাস নেই । সবই এক ।
স্টেশন থেকে খুব সাবধানে পা ফেলে চলতে হচ্ছে । কারন আগেরদিনের স্নো বরফ হয়ে গেছে । আমাদের সাথে অনেক বিদেশী পর্যটক ট্রেন থেকে নামলো । ঠান্ডাতো কি হয়েছে , জায়গাটা তো ল্যাপল্যান্ড । ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছালাম সান্তা ক্লসের গ্রামে । রাস্তার দুপাশ বরফে সাদা হয়ে আছে । মনে হলো বরফে ঢাকা এক বিদেশী আশ্রম । চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটা বাড়ী । কোনটা সান্তার পোস্ট অফিস , কোনটা বা অফিস । পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে সান্তার নামে চিঠি এখানে আসে । এছাড়া আছে অনেকগুলো রেস্তরাঁ । একটা ভাল হোটেল ও পেট্রল পাম্প দেখলাম । সবই সুন্দর করে সাজানো । আর্কটিক সার্কেলটা যেখান দিয়ে গেছে সেই জায়গাটা খুব সুন্দরভাবে বোঝান হয়েছে । চারিদিকে প্রচুর ক্রিসমাস ট্রি জায়গাটার পরিবেশকে খুবই মনোরম করে তুলেছে । শুধু বড়দিনের সময় নয় , সব সময় এই জায়গা বড়দিনের সাজে সজ্জিত । কিছু দূরে একটা হাস্কি পার্ক (Husky park) দেখলাম । গিয়ে দেখি নেকড়ের মতো দেখতে কিছু কুকুর বরফের উপর দিয়ে স্লেজ গাড়ী টানছে।

ছোটবেলার ভুগোল বইয়ের কথা মনে পরে যাচ্ছিল । বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে স্লেজ গাড়িতে চড়ছি । চারপাশে বেশ কটা ইগলু দেখতে পেলাম । অনেকটা বরফের টেন্ট ।

এরপর আরো অনেকের মতো সান্তার সাথে দেখা করতে চললাম । এখানে সান্তা ক্লসের সাথে প্রতেকদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা অবধি দেখা করা যায় । বিশাল লম্বা লাইন । আমরাও দাঁড়ালাম । দোতলার উপর একটা আলো আধাঁরি ঘরে বসে আছেন ওনার সেই পরিচিত লাল সাদা টুপি আর লম্বা গ্রাউন পরে । সৌম্য দর্শন বয়স্ক মানুষ আমাদের সাথে হাত মেলালেন । হেঁসে আমাদের সমন্ধে জানতে চাইলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি, কেমন লাগছে , কদিন থাকব এই সব আরকি । নিজেদের ক্যামেরাতে ছবি তোলা মানা । ওরাই ছবি তুললো , ভিডিও করলো । যারা নিতে চায় তারা কিনতে পারে । আমরাও সবার মতো স্মৃতি হিসাবে সান্তার সাথে আমাদের ছবি ও ভিডিও কিনে নিলাম । সারা গ্রাম ঘুরতে বেশ সময় লাগে । এখানে ২টার সময় অন্ধকার হয়ে যায় । এরপর আমরা টাক্সি নিয়ে ল্যাপল্যান্ডের রাজধানী রোভানিয়েমিতে আসলাম যেখানে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করা ছিল । ছিমছাম শহর । একটা দুই কামরার আসবাবপত্র সহ ফ্ল্যাট অন লাইনে ব্যবস্থা করা হয়েছিল । অনেকটা হোম স্টের মতো । ইচ্ছা করলে রান্না করেও খাওয়া যাবে । দুদিনের জন্য আমাদের বুক করা ছিল । চাবি নিয়ে নিজেরাই রাস্তা চিনে ফ্ল্যাটে ঢুকলাম । জিনিসপত্র রেখে একটু আরাম করে বেড়িয়ে পরলাম রোভানিয়েমির রাস্তায় । শুনেছি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই রোভানিয়েমিতে জার্মান সৈন্যরা বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে জড়ো হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করার জন্য । যার নাম বার্বারোজা অপারেসন । এই যুদ্ধ আজ ভয়াবহ ইতিহাস । প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সাক্ষী এই ল্যাপল্যান্ড । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগের কোনো বাড়িঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল । সারা রোভানিয়েমি আগুনের শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে গেছিল । যা কিছু এখন ল্যাপল্যান্ডে দেখছি সবই প্রায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের সময়কার । কিছুদূর হাঁটতেই অবাক কান্ড এখানেও একটা ভারতীয় রেস্তরাঁ । নাম রঙ্গমহল । এক নেপালী মহিলা চালান । সুন্দর রান্না । ভালই পরিচয় হলো । উনি নেপাল থেকে এসে এখানে রেস্তরাঁ খুলেছেন যেখানে ভারতীয় খাবার পাওয়া যায় । যেহেতু আমরাও কিছুটা নেপালী বলতে পারি তাই ভাল খাতির পেলাম । ল্যাপল্যান্ড-এ যখন ভারতীয় খাবার পাওয়া যাচ্ছে তখন আমরা নিশ্চিত যে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই ভারতীয় খাবার পাওয়া যাবে । আমার ছেলে বলছিল আজকাল ভারতীয় খাবারের আকর্ষন বিদেশে নাকি দিন দিন বাড়ছে । খাওয়া সেরে আবার ফিরলাম আমাদের হোম স্টে-তে । হোম স্টে-টা খুব ভালো ছিল । এককথায় বলা যায় খুবই আরামদায়ক । কিছুক্ষন হালকা বিশ্রাম নিয়ে ঠান্ডার ভালই প্রস্তুতি নিয়ে আবার চললাম সান্তার গ্রামে , যদি রাত্রের আকাশে অরোরা বোরিয়ালিস দেখতে পাই । শুনেছি বছরে প্রায় ২০০ রাত্রি অরোরা বোরিয়ালিস এখানে দেখা যায় । বাইরে দেখলাম ১ ডিগ্রী , হালকা বৃষ্টি হচ্ছে । ছাতা মাথায় দিয়ে তিনজনে পৌঁছে গেলাম । লোকজন নেই বললেই চলে । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন আকাশ পরিস্কার হলো না, তখন বাধ্য হয়েই ঘরে ফিরতে হলো । রাত্রের খাবার বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল তাই ঘরে বসে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম । হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে নজর যেতেই দেখি বরফ পড়ছে । অসাধারণ । কিছুক্ষন হয়ে বন্ধ হয়ে গেল । আমরাও শুয়ে পড়লাম । ভোরে উঠে দেখি চারিদিক সাদা । সারা রাত ধরে প্রচুর বরফ পরেছে । কাছেই একটা বড় হ্রদ আছে , গিয়ে দেখি জলের অনেকটা অংশই সাদা হয়ে আছে । বুঝতে পারলাম হ্রদের জলের অনেকটাই বরফ হয়ে গেছে । পাশেই একটা বড় পার্ক । এত বরফ পরেছে যে হাঁটতে পা ডুবে যাচ্ছে । মনটা ভরে গেল । তাপমাত্রা -৪ ডিগ্রী । কাছেই আর্কটিক সার্কেলের উপর একটা মিউজিয়াম আছে , সেটাই দেখতে গেলাম । বেশ কটি শ্বেত ভাল্লুক ও বল্গা হরিন ওখানে দেখলাম ।

অরোরা বোরিয়ালিসের উপর একটা ডকুমেন্টারিও দেখলাম । দুধের স্বাদ ঘোলে মিটলো । চরকির মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম । প্রতিটি বাড়ীর মাথা সাদা হয়ে আছে । গাছের উপর বরফ । তাপমাত্রা পজিটিভ হলে নাকি বরফ গলা শুরু হবে । যাইহোক আমাদের রাত্রি ৯টায় ট্রেন । হালকা ডিনার সেরে চললাম ষ্টেশন । ট্রেন ছাড়লো ৯ টা ১৫ মিনিটে । তখন তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল -১ ডিগ্রী । ল্যাপল্যান্ডকে বিদায় জানিয়ে চললাম আমরা হেলসিঙ্কি ।
নোবেল পুরস্কারের জন্মদাতার শহর – স্টকহোম
তখন আমরা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে । যেহেতু ছেলের শনি ও রবিবার ছুটি ,তাই আমরাও প্রতি শনিবার পাড়ি দিচ্ছিলাম অজানার উদ্দেশ্যে । ছেলেই প্রস্তাব দিল এই শনিবার চলো যাই সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম । মাত্র ৪৭৩ কিলোমিটার । আমাদের যেহেতু ফিনল্যান্ডের ভিসা ছিল তাই ইউ.কে ছাড়া সেনজেন এলাকার ২৬ টা দেশে যেতে কোনো বাঁধাই ছিল না কারণ এই ২৬ টা দেশের মধ্যে যে কোনো একটা দেশের ভিসা থাকলেই হলো । ফিনল্যান্ড ,সুইডেন , নরওয়ে , তালিন আর ল্যাপল্যান্ড কমসময়ে একসাথে ঘুরে আসার প্রোগ্রাম বানানো যায় ।পাশাপাশি সব দেশ ।কোনো একটা দেশের ভিসা নিয়ে রওনা হলেই হলো । স্টকহোম থেকে জলপথেও যাওয়া যায় ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি ও তুর্কু , এস্তোনিয়ার তালিন , রিগা , লাতভিয়া, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ । কোনো অসুবিধা ছাড়াই ভালভাবে সব ঘোরা যাবে ।কারণ এদিককার লোকজন একদমই ঠকবাজ নয় আর সব ব্যাপারে ভাল পরামর্শ দেয় । আজকাল বিভিন্ন টুর অপারেটরা নিয়ে যাচ্ছে বা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে । যেকোন দেশে বসে অন লাইনেও ব্যবস্থা করা যায় । শুধু চাই পাসপোর্ট । স্টকহোমের কথা হতে প্রথমেই মাথায় আসে নোবেল প্রাইজের জনক আলফ্রেড নোবেলের জন্মস্থান এই স্টকহোম । প্রতি বছর ১০ ই ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে এই স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার বিতরণের আয়োজন করা হয় । বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত মানুষজনের পদধুলি পরে এই স্টকহোমের মাটিতে । ‘শান্তি’ পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ে থেকে আর বাকি সব বিষয়ের পুরস্কার দেওয়া হয় স্টকহোম থেকে । ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রতি বছর চলছে এই অনুষ্ঠান । বাদ ছিল মাঝের দুটি বছর ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ । কারণ নরওয়ে ছিল সেইসময়ে জার্মানদের অধীনে । ১৪/১১/১৫ বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে রওনা হলাম বাল্টিক সি ধরে জাহাজে স্টকহোম , সুইডেনের রাজধানী । জাহাজতো নয় মনে হয় একটা বড় মল । ভিতরটা পাঁচতারা হোটেল । যে জাহাজে তালিন গেছিলাম এটা তার থেকেও অনেক বড়। ফিনল্যান্ডের সকাল ৯টা মানে সুইডেনের সকাল ১০টায় জাহাজ পৌঁছাল স্টকহোমের বন্দরে । জাহাজেই সকালের জল খাবার করে নিয়েছিলাম । সুইডিস বা ফিনিস খাওয়ারের খুব ভাল ধারণা না থাকায় ‘বুফে ব্রেক ফাস্ট’ ই আমরা পছন্দ করলাম। এক, সব খাবারের স্বাদ নেওয়া যাবে তারপর যেটা পছন্দ পেটপুরে খাওয়া যাবে। টাকাতে হিসাব করলেও দাম ন্যায্যই বলা যায় । আমাদের এখানকার ভালো হোটেলে এর থেকে বেশি দাম ।

কেউ না বললে ফিনল্যান্ড আর সুইডেন একই রকম লাগে। আমাদের চোখে মানুষের রঙ এক । ভাষাও মনে হয় এক যেহেতু বুঝিনা । রাস্তাঘাট একইরকমের । আবহাওয়ার সামান্য তারতম্য । দুদেশের হরফ অনেকটাই ইংরেজির হরফ । ফিনল্যান্ডের মতো কোন রাস্তায় পুলিশ নেই , কিন্তু সবাই সব কিছু মেনে চলছে । দুদেশের কাকের রঙ এক । আমাদের দেশের মতই শুধু গলার কাছের রঙটা সাদা । জাহাজে আসতে আসতে অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ দেখলাম । জাহাজ থেকে স্টকহোম শহরটাকে খুব সুন্দর লাগছিল যেমন লাগছিল হেলসিঙ্কিকে । ফিনল্যান্ড আর সুইডেন দুজায়গাতেই দেখলাম ছেলে ও মেয়েরা বেশ লম্বা লম্বা ।স্টকহোম সুইডেনের পূর্ব উপকূলে ম্যালারেন হ্রদের (Mälaren) মোহনায় অবস্থিত। এছাড়া স্টকহোম শহরের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রের জল অনেকটাই ভিতরে চলে গেছে । নৌকা এবং স্টিমার চলছে তার উপর । ‘হপ অন হপ বোট’এ করেও এখানে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা যায় । স্টকহোমকে অনেক সময় “স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভেনিস” বলা হয়।এছাড়া আছে ‘হপ অন হপ’ বাস । যেটা ইউরোপের সব শহরেই দেখতে পারছি । এছাড়া এখানকার মেট্রো রেল বেশ সাজানো গোছানো । এখানে মেট্রো রেলের পরিষেবা শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে । পর্যটকদের যাতে কোনরকম অসুবিধা না হয় তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা আছে । আমরা গুগল ম্যাপ নিয়ে হেঁটেই ঘুরছি । একটু হেঁটে পৌছেগেলাম রাজবাড়িতে ।

বিশালাকার এই রাজবাড়ি ভাল করে দেখতে অনেকটা সময়ের দরকার । রাজারানীদের মুকুট ও অলঙ্কার আমাদের দেশের নবাবদের কথা মনে পরিয়ে দেয় । কত নামী দামী অলঙ্কার আমাদের দেশে ছিল । বিভিন্ন সময়ে বাইরে থেকে আসা লুঠেরাদের দল ঐ অলঙ্কার যদি লুট না করতো তাহলে আমরাও আমাদের জাদুঘরে সব দেখাতে পারতাম । লন্ডনের রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকতে না পারার আফসোস এই রাজবাড়ি পুষিয়ে দিল । উপরি পাওনা লন্ডনের রাজবাড়ির মত একদল সৈন্য যখন রীতিমত কুজকায়াজ করে আগের সৈন্যদের জায়গা নেয় সেটা দেখার । পর্যটকদের কাছে এটা খুবই আকর্ষনীয় । একটা জমকালো ব্যাপার । রাজবাড়ি অনেক দেখেছি কিন্তু এরকম জীবন্ত রাজবাড়ি আগে দেখিনি । তারপর একটু হেঁটে পৌছে গেলাম জাতীয় জাদুঘরে। ওখান থেকে বেড়িয়ে সোজা চললাম শহর দেখতে । ধীরে ধীরে শহর সেজে উঠছে কারন সামনের মাসেই বড়দিন, এখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব । সুইডেনের জাতীয় ফুটবল স্টেডিয়াম দেখার মত । মনে পরে যায় বিশ্বকাপের কথা । রাত জেগে কত সুইডেনের ফুটবল খেলা দেখেছি । পর্যটকদের কাছে দুটি জায়গার আকর্ষণ খুবই তীব্র । এক স্টকহোম কনসার্ট হল, আরেকটি স্টকহোম সিটি হল । নোবেল পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠান এই দুই জায়গাতে অনুষ্ঠিত হয় ।

বাচ্চারা বরফে স্কেটিং-এ খুব আনন্দ করছে এবং বড়রাও ওদের এই আনন্দকে খুব উপভোগ করছে । সব জায়গার মানুষের মন বোধহয় একইরকম , শুধু ভাষা আলাদা । সময় হয়ে আসছে । আমরা তিনজন আবার ঐ জাহাজেই মানে যেটাতে এসেছিলাম সেটাতেই ঐ কেবিনেই ফিরবো । তাই ঐ কেবিনে কিছু জিনিষ রেখে এসেছি হাল্কাভাবেই ঘুরে বেড়াবো বলে।সুইডেনের সাড়ে ৪ টা আমরা রওনা হলাম হেলসিঙ্কি । যতক্ষন স্টকহোম দেখা যাচ্ছিল ততক্ষন আমরা জাহজের ডেকে দাঁড়িয়ে । তারপর সহযাএিদের সাথে এগিয়ে চললাম ফিনল্যান্ড।
ফুটবলের মক্কা – বার্সেলোনা,স্পেন
আমাদের যেহেতু সেনজেন এলাকার ২৬ টা দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ডের ভিসা ছিল তাই ইউ.কে ছাড়া বাকি ২৬ টা দেশে যেতে কোনো বাঁধাই ছিল না কারণ এই ২৬ টা দেশের মধ্যে যে কোনো একটা দেশের ভিসা থাকলেই হলো । আমাদের দেশের বেশ কিছু টুর অপারেটর স্পেন আর পর্তুগাল একসাথে ঘোরাতে নিয়ে যায় । স্পেনের পাশেই তো পর্তুগাল । সব ফুটবল পাগল দেশ । ১৯/১১/১৫ সকাল সাতটা নাগাদ রওনা হলাম হেলসিঙ্কি বিমানবন্দর থেকে নরওয়ে । হেলসিঙ্কির তাপমাত্রা ছিল তখন ৫ ডিগ্রী। দেড় ঘন্টা লাগলো নরওয়ে পৌঁছাতে । তখনও প্লেন নরওয়ে বিমানবন্দর থেকে কিছুটা উপরে । জানলা দিয়ে যেদিকে তাকাই মনে হচ্ছিল সাদা চাঁদরে ঢাকা একটি শহর । কদিন আগে এই ওসলো শহর হয়ে ফিনল্যান্ড গেছি কিন্তু আজ বরফের আবরণে ওসলোর এক আকর্ষণীয় রূপ দেখলাম । তাপমাত্রা – ২ ডিগ্রী । এখান থেকে প্লেন বদল করে বার্সেলোনা যাবো প্রথমে । তারপর মাদ্রিদ । প্লেন বদল করে গেলে ভাড়াটা বেশ কিছুটা কম পরে । আকাশপথে হেলসিঙ্কি থেকে মাদ্রিদের দূরত্ব প্রায় ২৯২৭ কিলিমিটার । আকাশপথে জার্মান ও ফ্রান্স পেড়িয়ে স্পেন । ডানদিকে থাকে সুইজারল্যান্ড । তাই আল্পস পর্বতমালা দেখার সৌভাগ্য ঘটে । আমরাও দেখেছি দুচোখ ভরে । মনে পরে যাচ্ছিল আকাশপথে বাগডোগরা থেকে দমদম যাওয়ার কথা । সূর্যের আলোয় তুষার শুভ্র শৃঙ্গরাশির রূপ শুধু দুচোখ ভরে উপলব্ধি করা যায় , ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন । দুপুরবেলার মধ্যে পৌছে গেলাম বার্সেলোনার বিমানবন্দরে । যেহেতু আমাদের বড় ছেলে সাথেই রয়েছে তাই কোনো চাপ ছিল না । ও বার্সেলোনা হোটেল না নিয়ে একটা হোম স্টে ঠিক করেছে যেটা শহরের খুব ভাল জায়গায় । কাছাকাছি অনেকগুলো পর্যটকদের দেখার জায়গা । পিকাসোর আর্ট মিউসিয়ামের পাশেই । এক কামরার ফ্ল্যাট । সব রকমের সুবিধা আছে । মোবাইলে ‘গুগুল ম্যাপ’ যে কি কাজের , তা বেশ ভালই উপলব্ধি করলাম । কাউকে জিগ্ঘেষ করার কোন দরকার নেই । হাতে মোবাইল নিয়ে যেখানে খুশী ঘুরে বেড়াও, শুধু মোবাইলে ‘নেট’ থাকতে হবে । ঘরে জিনিষ রেখে একটা টাক্সি নিয়ে ছুটলাম বার্সেলোনা ফুটবল স্টেডিয়াম । পৃথিবীর তাবড় তাবড় ফুটবলারের পদধূলী মাখা মাঠ । যেকোন ফুটবল প্রেমীর কাছে এই মাঠ স্বর্গ । ফুটবলের জাদুঘর বললে ভাল হয় ।

সোনার ফুটবল, সোনার বুট, বড় বড় প্রতিযোগিতার এর কাপ , বিভিন্ন নামী প্লেয়ারদের ব্যবহৃত জারসি, বুট কি নেই । অমূল্য সব ছবি । আর মাঠ , মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি ,টিভিতে বার্সেলোনা আর রিয়েল মাদ্রিদের খেলা । যেন দেখতে পারছি মেসি গোল করার পর সারা স্টেডিয়াম জুড়ে চীৎকার । চোখের সামনে মনে হচ্ছে সব দেখতে পারছি । ঘুরে ঘুরে প্লেয়ারদের পোশাক ছাড়ার জায়গা , ধারা ভাষ্যকারদের বসার জায়গা , ক্লাব সভ্যদের বসার জায়গা , সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতের জায়গা , মাঠের পাশে কোচ ও প্লেয়ারদের বসার জায়গা সব প্রানভড়ে দেখলাম । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্লাব বলে কথা ।পৃথিবীর ধনী ফুটবল ক্লাবগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই এফ সি বার্সেলোনা । বেড়োতেই ইচ্ছা করছিল না । কিন্তু বাকী সব দেখতেতো হবে , তাই চললাম সমুদ্রের ধারে । ভূমধ্য সাগর । শান্ত সমুদ্র । বেশ বড় সমুদ্রের সৈকত কিন্তু সর্বত্রই চারিধারে শুধু বালি নয়। অনেকটা অংশই পাথর দিয়ে মোড়া । সৈকতের ধার ধরে অনেকে স্কেটিং করছে । কেউ কেউ আবার বালি দিয়ে বিভিন্ন মূর্তি বানাচ্ছে যেটা আমাদের দেশেও দেখা যায় ।সারা পৃথিবীর শিল্পীরা বোধহয় একই রকম হয় । রাত্রের খাওয়া দাওয়া সেরে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফিরলাম ।

যেহেতু বাড়ীর পাশে , তাই সকালে প্রথমেই গেলাম পিকাসোর আর্ট মিউসিয়ামে । পাবলো পিকাসোর আঁকা বহু মূল্যবান সব ছবি । মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি ।
তারপর গেলাম ‘সাগ্রাদা ফামিলিয়া অসমাপ্ত ক্যাথেড্রাল । বার্সেলোনায় এই চার্চের স্থাপত্য একেবারেই আলাদা । ফেয়ারী টেলসের গল্পের মতো বাড়ী মনে হয় । এরপর গেলাম একটা টিলার ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা পার্ক নাম ‘পার্ক গুএল’ দেখতে . পার্কের ওপর থেকে সারা শহর খুব সুন্দর দেখা যায় . বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী ‘গাউদি’র পরিকল্পনার ফসল এই পার্ক | ‘পার্ক গুএল’ দেখে সোজা চললাম ‘ মোন্ত্জুইক হিল’ । হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়লো তাই না লিখে পারছি না । ‘পার্ক গুএল’ এ আমার বড় ছেলে আমার ও আমার স্ত্রীর ছবি তুলছিল। একজন বিদেশী বয়স্ক ভদ্রলোক হাসতে হাসতে এসে আমার দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল । আমিও কিছু না বুঝে আমার ডান হাতটা ভদ্রতার খাতিরে ওনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম । দুহাত দিয়ে আমার হাতটা ধরে খুব আন্তরিক ভাবে করমর্দন করলো । মুখে কিছু বললো না । আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারলাম । উনি বলতে চাচ্ছেন কি সুন্দর তোমার প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে তোমাদের সাথে ঘুরছে। আমাদের দেশে এটার অভাব । সত্যিই তাই । ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বাবা মাকে ঘুরতে দেখেছি কিন্তু একটু বড় ছেলেমেয়েদের সাথে চোখে পড়েনি । ‘ মোন্ত্জুইক হিল’ হলো ছোট একটা পাহাড়ের উপর বিশাল দূর্গের মতো একটা বাড়ী যার উপর দাঁড়ালে পুরো শহরের চারিদিক , আর দিগন্ত জুড়ে সমুদ্র দেখা যায় । আলো-আঁধারের রূপ দেখার জন্য অনেক্ষণ ছিলাম । পাহাড়ের ওপর থেকে অনেকটা নীচে শহরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি । খোলা জায়গা তাই ঠান্ডাও ভালই উপলব্ধি করছিলাম । একটু একটু করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শহরে আলো জ্বলতে লাগলো । তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত শহর জ্বলজ্বল করতে লাগলো । মনের ক্যামেরার ছবিগুলো যখনই সামনে আসে মনটা ভরে ওঠে এক অনাবিল আনন্দে । সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পাহাড় ধরে ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম । এসে পৌছালাম ‘ম্যাজিক ফাউন্টেন’ বা জাদুর ফোয়ারাতে ।এরকম নৃত্যের তালে তালে নানা রঙের ফোয়ারা আমরা আগেও দেখেছি । তবে পাহাড় থেকে সমতল অবধি অনেকটা জুড়ে এই ফোয়ারা । দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল । প্রচুর পর্যটকের সমাগম । এক হাতে কফির কাপ নিয়ে উপভোগ করতে বেশ ভালই লাগছিল ।

পরের দিন প্রথমে গেলাম সমুদ্রের ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল এক মাছের অকুয়ারিয়াম দেখতে । মাথার উপর দিয়েও মাছ চলাফেরা করছে । নানারকমের মাছ । ওখানে এই প্রথম ‘সি হর্স’ দেখলাম । মনে হচ্ছিল সমুদ্রের তলায় পৌছে গেছি । উপযুক্ত পোশাক সহ আলাদা টিকিট নিয়ে সাঁতার কেটেও দেখা যায় । শহরের মধ্যে ‘লা রাম্বলা’ ও ‘বার্রিও গোথিক’ দেখলাম । উত্তর কলিকাতাতে যেমন গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ী আর ছোট ছোট রাস্তা দেখা যায় তেমনি একটা জায়গা নাম ‘বার্রিও গোথিক’। পুরনো শহর । তবে রাস্তাগুলো পরিস্কার । ১.২ কিলোমিটার একটা রাস্তা যার নাম ‘লা রাম্বলা’, দেখলাম অনেক শিল্পী ওই রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে , বসে ছবি আঁকছে যেমন আমাদের দেশেও দেখা যায় । পর্যটকদের কেনাকাটার জায়গা । বেশ কিছু দোকান দেখলাম ভারতীয়রা চালাচ্ছে । অনেকদিন পর হিন্দি কথা শুনে ভালো লাগলো । সবই স্যুভেনির দোকান । স্প্যানিসদের সাথে আমাদের অনেক মিল খুঁজে পেলাম । মনে হলো এরাও আমাদের মতো “ মানবো না বন্ধনে,মানবো না শৃঙ্খলে” তে বিশ্বাসী । শহরের মধ্যেই অনেক বাড়ির বারান্দা বা জানলাতে ভেজা জামাকাপড় শুকতে দেখলাম । অনেককেই বলতে শুনলাম ‘লা রাম্বলা’তে পকেটমার থেকে সাবধান । স্পেনের উপাদেয় খাবার পায়লা অর্থাৎ খিচুড়ি খেলাম একটা স্প্যানিস রেস্তরাতে । আমিষ ও নিরামিষ দুরকমেরই পাওয়া যায় । ইউরোপের প্রায় সব দেশেই পর্যটকদের জন্য ‘হপ অন হপ’বাসের ব্যবস্থা আছে । যাতে করে প্রতিটা আকর্ষনীয় স্থান দেখা যায় । বার্সেলোনার সুন্দর স্মৃতি নিয়ে আমরা চললাম বিমানবন্দরে , মাদ্রিদের উদ্দ্যেশে ।
ফুটবলের মক্কা – মাদ্রিদ ,স্পেন
রাত্রে মাদ্রিদ পৌঁছে সোজা হোটেল । হোটেল থেকেই বিমানবন্দরে গাড়ী পাঠিয়েছিল । লন্ডন আর বার্লিনের পর ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম শহর এই মাদ্রিদ । সকাল সকাল পেট ভড়ে খেয়ে চললাম ফুটবল স্টেডিয়াম দেখতে । বার্সেলোনার ফুটবল স্টেডিয়াম আর রিয়েল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম একইরকম দেখতে লাগে । প্রায় আশি হাজার লোক ধরে এই স্টেডিয়ামে । সবই প্রায় একইরকম । এই স্বাদ আজীবন মনে থাকবে । এখানে আলাপ হলো কলিকাতা থেকে ঘুরতে আসা এক বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে । জানলাম ওনি সাইয়ের কোচ ছিলেন । ফুটবলের আলোচনা আর চোখের সামনে রিয়েল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম , সে যে কি অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় ।

স্টেডিয়ামের এর সাথে এখানেও বার্সেলোনার মতো একটা ফুটবলের মিউজিয়াম আছে । সব দেখে প্রচুর ছবি তুলে বাইরে বেড়োলাম। এরপর যাবো রাজবাড়ী দেখতে । ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মতো এখানেও ‘হপ অন হপ’ বাসে করে পুরো শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখা যায় । একদিনের একজনের ভাড়া ২১ ইউরো , দুদিন হলে মাত্র ২৫ ইউরো । সুইডেনের মতো বিশাল এই রাজবাড়ী । বিশাল বিশাল ঘর আর দেখার মতো সব আসবাবপত্র আর ঝারবাতির আলোয় প্রাসাদের রূপ আমাদের দেখা সব রাজপ্রাসাদকে ছাপিয়ে গেছে । ইউরোপের স্থাপত্যের একটা আলাদা ধরন আছে । আমাদের রাজপ্রাসাদের সাথে এখানকার স্থাপত্যের মিল কমই পাওয়া যায় । রাজপ্রাসাদ থেকে বাইরে বেড়িয়ে এক জায়গায় পতাকা হাতে অনেক লোকের ভিড় দেখলাম । ভাষা আলাদা কিন্তু বুঝতে পারছি কোন একটা রাজনৈতিক প্রচার চলছে । মাদ্রিতে কিছু মহিলা ও পুরুষদের মিছিল করে যেতেও দেখলাম । কোনো স্লোগান নেই , শুধু বিভিন্ন পোস্টার হাতে নিয়ে রাস্তার একদম ধার ধরে মিছিল এগোচ্ছে , রাস্তায় গাড়ি চলাচলের কোনো অসুবিধা না করে ।একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগছিল এই ভেবে যে এখানকার লোকজন নিজেদের থেকে অন্যদের অসুবিধার কথা বেশী ভাবে ।ভাবি ,সবাই যদি এমনি করে ভাবতো তাহলে পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে যেত ।

দুপুরবেলার খাবারের জন্য ঢুকলাম ‘দিল্লী’ নামে একটা ভারতীয় রেস্তরাঁতে । কিন্তু ভারতীয় চেহারার কাউকে পেলাম না । জানতে পারলাম অনেক বছর আগে এদের পূর্বপুরুষ এই রেস্তরাঁ খোলেন । দক্ষিণী খাবার ছাড়া সিঙ্গাড়া,পকেড়া থেকে শুরু করে সব ভারতীয় খাবারই পাওয়া যায় । কাটা চামচ দিয়ে কিছু বিদেশীদের সিঙ্গাড়া খেতে দেখলাম । মাদ্রিতে বেশ কটা ভারতীয় রেস্তরাঁ আছে । দুদিন ধরে ‘রয়েল থিয়েটার’, ‘প্লাজা মেয়র স্কোয়ার’, ‘গ্রান ভিয়া এভিনিউ’, ‘সান্তা আনা স্কোয়ার’,’জের্মো চার্চ’ আরো কত কি দেখলাম । মাদ্রীর তাপমাত্রা তখন ১০ থেকে ১১ র মধ্যেই ছিল । স্পেনের বার্সিলোনা আর মাদ্রিদ দুটো শহরই খুব জীবন্ত । রাস্তায় গাড়ী এবং মানুষের ভিড় আছে । সব গাড়ীতেই হর্ন আছে কিন্তু কাউকেই তা ব্যবহার করতে দেখছিনা । একই জিনিষ অন্য দেশগুলিতেও দেখলাম । যেকোন দূষণের ব্যাপারে এরা খুব সচেতন । আমরা কেন হইনা ? কোন দেশেই জলের ফিল্টার নজরে পড়লো না । কলের জলই সবাই খাচ্ছে । আমরাও তাই খেলাম । আমরা প্রায় দেড় মাসের ওপর ইউরোপে ছিলাম,সব ধরনের খাবারও খাচ্ছিলাম কিন্তু একদিনের জন্যও কারো পেটের কোনো অসুবিধা হয়নি ।অথচ এখানে আমাদের বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছু বিদেশী অথিতি এসেছিল । সব নিমন্ত্রিতদের সাথে একসঙ্গে খাবার খেলো । পরের দিন থেকে ওই বিদেশী অথিতিদের সবার পেট খারাপ । আমরা ঠিক আছি । তার মানে এটাই তো বলা যেতে পারে যে ওদের থেকে আমাদের রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক বেশি । সময় হয়েছে, রওনা হতে হবে ফিনল্যান্ড । মাদ্রিদ বিমানবন্দর ছেড়ে আমাদের নিয়ে উড়োজাহাজ আকাশে উঠলো । পিছনে পরে রইলো বেশ কিছু ভালো লাগার মুহূর্ত ।
লন্ডন নামচা
৩0.১0.২০১৫ সকাল সাড়ে ৬টায় দমদম এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হয়ে পৌঁছে গেলাম মুম্বাই । যেহেতু মুম্বাই থেকে লন্ডন যাব তাই এমিগ্রেসন মুম্বাইতেই হলো । ১টা২০ মিনিট নাগাদ সাড়ে ৯ ঘনটা টানা আকাশে ওড়ার পরে পৌঁছলাম লন্ডনের সেই বিখ্যাত এয়ারপোর্টে হেয়াথ্রও (Heathrow) । ঘড়িতে বিকাল ৫টা ২0 । অবশই লন্ডনের ঘড়িতে। সব কিছু সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে চললাম হোটেল । লন্ডন শহরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের ট্যাক্সি । দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম লন্ডন শহরকে। প্রথম বিদেশ সফর তাও আবার লন্ডন । একটু বেশীই শিহরন হচ্ছিল । বেশী সময় লাগলো না , তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম হোটেলে । যেহেতু আগে থেকে বলা ছিল তাই চেক ইন করতে বেশী সময় লাগলো না।
সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে পড়লাম লন্ডনের রাস্তায়।তাপমাএা ৮ডিগ্রি । হালকা কুয়াশা। রাস্তা পার হবো । কিন্তু কিছুটা দূর থেকে একটা গাড়ী আসছে দেখে দাড়িয়ে পড়লাম । হঠাৎ দেখি গাড়ীটা আমাদের একটু আগে দাড়িয়ে গেল আর ইশারায় আমাদের রাস্তা পার হতে বললো । খুব ভাল লাগলো । কারন এসব দেখতে তো আমরা অভস্থ নই । আমাদের হোটেল থেকে একটু হেঁটে পৌছে গেলাম কুঈনওয়ে (Queenway) । রাস্তার দুপাশে সারি সারি ঝলমলে সব দোকান । কি নেই ? যেমনি আছে নানা দেশের খাবারের রেস্তরাঁ , তেমনি আছে নানা ধরনের জিনিষের দোকান । হঠাৎ বেবির অর্থাত্ আমার স্ত্রীর নজরে পড়ল একটা ভারতীয় রেস্তরাঁ । ডিনারের সময়ও প্রায় হয়ে এসেছে, তাই কাল বিলম্ব না করে সোজা ঢুকে পড়লাম ঐ রেস্তরাঁতে। আরে ! লন্ডনে বেঙ্গলি রেস্তরাঁ ! যদিও বাংলাদেশী, ভারতীয় নয় । বাঙ্গালি তো , মনটা আনন্দে ভরে গেল। খাওয়ার সাথে সাথে চললো অনেক গল্প । জানলাম , ওনাদের লন্ডনে আসার কথা । রেস্তরাঁ খোলার ইতিহাস। শুভরাত্রি জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।

হালকা অন্ধকার থাকতেই বেড়িয়ে পড়লাম প্রাতঃভ্রমণে । কুয়াশা ভেজা ভোড় । তখনও রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মাপেল (Maple) পাতা পরিস্কার হয়নি । শীতের সকাল । দুজনে বেশ জোড়ে জোড়েই হাটছিলাম অপরিচিত গণ্ডির মধ্যে । অচেনা জায়গা , অচেনা মানুষ কিন্তু যাদের সাথেই দেখা হচ্ছে সবাই হাসিহাসি মুখে বলছে ‘গুড মর্নিং’ । আমাদের ভোড় শুরু হলো এক ভাল লাগা সুন্দর উপলব্ধি নিয়ে । ফিরে এলাম হোটেলে । এই হোটেলে প্রাতরাশ কমপ্লিমেন্তারি , তাই দুজনে পেট ভর্তি করে খেয়ে নিলাম। পাউন্ডের খরচা যত বাঁচানো যায়, আরকি। লন্ডন পাস আগে থেকে নেওয়া ছিল তাই চললাম ‘হপ অন হপ’ বাস ধরতে।নাহলে মেট্রো ধরেও ঘোরা যায় । কিছুটা যেতেই Bayswater road পেয়ে গেলাম। আর সাথে সাথেই বাস । লাল রঙের দোতলা বাস ।আমাদের দেশের দোতলা বাসের মত । শুধু দোতলার উপরের অনেকটা অংশ চারিদিক থেকে খোলা । যাতে বাইরে দেখতে কোন অসুবিধা না হয় । খোলা আকাশের নীচে শুধু বসার জায়গা । লন্ডন পাসের মজা হলো দুদিন যত বার খুশী বাসে উঠবো টিকিট লাগবে না। যে দিকে খুশী সব দিকেই ঘোরা যাবে । যত দেখার জায়গা সব ঐ বাসে করেই দেখা যাবে। শুধুমাএ পর্যটকদের জন্যই এই ব্যবস্থা । উপরি পাওনা গাইড, যিনি বাসের ভিতর বসে সব বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন । এক এক বাসে আলাদা আলাদা গাইড। ৪৮ ঘণ্টা এই পাসটা ব্যবহার করা যাবে। Madam Tussauds Museum থেকে শুরু হলো আমাদের লন্ডন পরিক্রমা। যাদুঘর দেখতে ৪ ঘন্টার উপর লাগলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি ।সারা পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষের সব মোমের মূর্তি । কিন্তু কোন কম্যুনিস্ট নেতার মূর্তি দেখলাম না । দেখলাম না হিটলারের মূর্তিও । তারপর দুদিন ধরে ঘুরলাম PARLIAMENT SQUARE, WEST MINISTER ABBEY, BIG BEN, THE HOUSES OF PARLIAMENT, ST JAMES PARK, BUCKINGHAM PALACE, TRAFAL SQUARE, LONDON EYE, TOWER OF LONDON এবং এক ঘনটা ধরে টেমস নদীর উপর ক্রুসে (Cruise ) ভ্রমণ ।

ও, লেখতে ভুলে গেছিলাম যে লন্ডন পাসে টেমস নদীর উপর ক্রুসে ঘুরতে কোন খরচ লাগে না । অনেক সময় নিয়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ালাম আর অনেক ছবি তুললাম। নদীর দুপাশ অনেকটা জায়গা বাঁধানো । পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করছিলো চারিধার । লন্ডন আই আর টাওয়ার অফ লন্ডনের কাছেও বেশ ভালই ভিড় ছিল । প্রচুর ছবি তুললাম । বেবি আবার বেশ কিছু ভিডিও করলো। দুদিনের এই স্মৃতি সারা জীবন আমাদের মনে থাকবে। পরদিন ভোরে রওনা হবো নরওয়ে হয়ে ফিনল্যান্ড । তাই আগে থাকতেই UK র সাথে আমরা সেনজেন ভিসাও করেছিলাম ।

ইউরোপের সিলিকন উপত্যকা – তালিন
ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭ টা হবে । আমরা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির একটা কফি হাউসে বসে আছি তিনজন । আমি, আমার স্ত্রী ও আমার বড় ছেলে । নভেম্বর মাস , বাইরে ভালই ঠান্ডা । কফি খেতে খেতে ভালই আড্ডা চলছিল ।হঠাৎ আমার ছেলে বলে উঠলো – “শনিবার তালিন গেলে কেমন হয় । শনিবার রাত্রে রওনা হয়ে রবিবার ভোরবেলা তালিন পৌঁছে যাব , সারাদিন ঘুরবো তারপর আবার রাত্রে রওনা হয়ে সোমবার ভোরে হেলসিঙ্কি চলে আসবো ”। প্রস্তাবটা আমাদের মনে ধরলো । নতুন নতুন জায়গা দেখতে কার না ভালো লাগে । আর তালিনতো শুধু এস্তোনিয়ার রাজধানীই নয় , উনেস্কো (UNESCO ) ১৯৯৭ সালে এই তালিন শহরের নাম পৃথিবীর সাংস্কৃতিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে নথিভুক্ত করেছে । শুনেছি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ডের উপসাগরের ধারে এই তালিন শহরের উপর সবার নজর ছিল । ১৩ দশক থেকে ১৯১৮ সাল অবধি এই তালিন শহরের নাম ছিল রেভাল । এস্তোনিয়ার রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র হলো এই তালিন । ভৌগোলিক অবস্থান হিসাবে এই শহরের গুরত্ব অপরিসীম । সমুদ্রপথে ৮০ কিলোমিটার দূরে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি , ৩৮০ কিলোমিটার দূরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম এবং ৩১৯ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ১৯৪০ সালে এস্তোনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয় । কিন্তু ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল অবধি জার্মানদের দখলে চলে যায় । তারপর আবার আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তালিন বার বার উপলব্ধি করেছে । শুনেছে অসংখ্য বোমারু বিমানের কর্কশ আওয়াজ । দেখেছে বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের আস্ফালন ।এখনো কিছু ক্ষত চিহ্ন আজও বয়ে চলেছে তালিন । প্রাকিতিক সোন্দর্য দ্বারা পরিপূর্ণ তালিন শহর আজও মধ্যযুগীয় ও আধুনিক সভ্যতার বাহক হিসাবে দাঁড়িয়ে । ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় তখন থেকে এস্তোনিয়া আলাদা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে আসে ।
কফি হাউসে বসেই অন লাইনে তিনটে টিকিট কেটে ফেলা হলো । আমরা যাব ৭/১১/২০১৫ তারিখ ভাইকিং লাইনের জাহাজে , আর ফিরবো ৮/১১/২০১৫ তারিখ তালিন থেকে ।
রাত্রি ৮ টার মধ্যে ট্রামে করে পৌঁছে গেলাম হেলসিঙ্কির বন্দরে কারণ আমাদের জাহাজ ছাড়বে ঠিক রাত্রি সাড়ে ৯ টায় । তালিন যেতে তো মাত্র ৪ ঘন্টা , কিন্তু জাহাজ সারা রাত থাকবে সমুদ্রে । একদম কাক ভোরে তালিনের বন্দরে সকল যাত্রীদের নামাবে । বন্দরে পৌঁছে দেখলাম ভাইকিং লাইনের বিশাল অফিস । টিকিট কাউন্টারে যেতেই আমাদের কেবিনের বোর্ডিং পাস দিয়ে দিল । কেবিন ছাড়া ডেকে বসেও যাওয়া যায় । আমাদের যেহেতু ফিনল্যান্ডের ভিসা ছিল তাই ইউ.কে ছাড়া সেনজেন এলাকার ২৬ টা দেশে যেতে কোনো বাঁধাই ছিল না কারণ এই ২৬ টা দেশের মধ্যে যে কোনো একটা দেশের ভিসা থাকলেই হলো । সিকিউরিটি চেক শেষ করে সোজা পৌঁছে গেলাম জাহাজে ।

১০ তলা জাহাজ । এই প্রথম এত বড় জাহাজ দেখলাম । হোটেলের মত করিডরের দুপাশ দিয়ে সারি সারি ঘর বা কেবিন । আমাদের কেবিনটা ছিল ৬তলাতে । তাই নীচ থেকে ওঠার সময় ভাবলাম “হিসি” করে উঠবো । “হিসি” মানে ফিনল্যান্ডের এর ভাষায় লিফ্ট । মনে হচ্ছিল পাঁচ তারা হোটেল । অনেকগুলো রেস্তরাঁ , ডিউটি ফ্রি সপ, পার্লার, ক্যাসিনো ,বার কি নেই । এটাচ বাথ ওয়ালা কেবিন , আমার তো অবাকই লাগছিল কারণ আগে জাহাজে চড়িনি তো । কেবিনে জিনিষ রেখে জাহাজ ঘুরতে বেড়ালাম । মনে হচ্ছিল পারায় বেড়াতে বেড়িয়েছি । ডেক থেকে রাতের হেলসিঙ্কি এককথায় দারূন । ডাঙা থেকে সমুদ্র একরকম , আর সমুদ্র থেকে ডাঙার স্বাদ অন্যরকম । রাএি ঠিক সাড়ে নটায় বাল্টিক সি এর উপর দিয়ে জাহাজে রওনা হলাম তালিনের উদ্দেশ্য । ধীরে ধীরে ডাঙা মিলিয়ে গেল । যেদিকে তাকাই শুধু জল আর জল আর মাথার উপর বিশাল আকাশ । এত বড় আকাশ আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না ।
ভোড় হতেই তালিনের মাটিতে পা রাখলাম । যেহেতু আমাদের বড় ছেলে তালিন আগেও এসেছে তাই ঐ আমাদের সব চিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো । তালিনের দুটো দিক -একটা মধ্যযুগীয় ও আরেকটা আধুনিক । আধুনিক সভ্যতার কনক্রিটের জঙ্গল প্রায় আমাদের সবজায়গাতে গ্রাস করে নিচ্ছে , তাই আমরাও চললাম পুরানো শহরের দিকে । মনে হচ্ছিল স্বপ্নপুরী ।

‘ফেয়ারি টেলস’ এর বাড়ীঘরের মতো সব বাড়ী , অপূর্ব , মধ্যযুগীয় স্থাপত্য । কিছু কিছু রেস্তরাঁর সাজসজ্যা এমন ভাবে করা যেন মনে হচ্ছে ঐ সময়টাকে ধরে রেখেছে । হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে মাঝে , আর ঠান্ডা ছিল ভালই । ‘মহারাজা’ নামে একটা ভারতীয় রেস্তরাঁও দেখতে পেলাম । নানা দেশীয় পর্যটকদের ভিড় । ভাবছিলাম সারা পৃথিবীর যদি একটাই ভাষা হতো তাহলে কি মজাটাই না হতো । দারূন দেখতে বেশ কয়েকটি চার্চ দেখলাম । তার মধ্যে অন্যতম সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল বা ডোমে চার্চ । একটা রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ দেখলাম যার নাম আলেক্সান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল । অপূর্ব সব কারুকার্য । মন ভরে যায় । পায়ে হেঁটেই সব ঘুরছি । বৃষ্টি আর ঠান্ডা আবহাওয়া পর্যটকদের আনন্দের কোনো বাঁধাই সৃষ্টি করতে পারছে না ।

দেখলাম এস্তোনিয়ার পার্লিয়ামেন্ট যার মধ্যযুগীয় নাম ‘তূম্পিয়া কাসল’ । অনেক সুন্দর সুন্দর দোকান , ভূটিয়া মার্কেটের মতো একটা মার্কেটও দেখলাম । ফিনল্যান্ড থেকে এখানে জিনিষের দাম কিছুটা হলেও সস্তা । খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম সমুদ্রের ধারে ৩১৪ মিটার উঁচু এক ওয়াচ টাওয়ার দেখতে। দুপাশে ঘন সবুজ গাছপালার মধ্য দিয়ে সুন্দর রাস্তা । মনে করিয়ে দেয় ডুয়ার্সের লাটাগুরির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা । এখানে সব গাড়ীই লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ । মস্কো অলিম্পিক এর সময় এই টাওয়ার তৈরী হয়ে ছিল । ইতালির আইফ্ফেল টাওয়ার থেকে ১২ মিটার উঁচু । টিকিট কেটে লিফটে করে এ সোজা উঠে গেলাম উপরে , পাইন গাছে ঘেরা পুরো তালিন শহর আমাদের চোখের সামনে । আর একদিকে দেখতে পারছি দিগন্ত জুড়ে নীল জলরাশি । মনের ক্যামেরায় জীবন্ত হয়ে রইলো এই দৃশ্য । ছেলের কাছেই শুনলাম এই তালিন শহর বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির জন্মস্থান । যার মধ্যে অন্যতম SKYPE ।
প্রচুর ছবি আর ভিডিও নিয়ে চললাম তালিনের বন্দরে যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভাইকিং লাইনের জাহাজ । সোজা চলে গেলাম ডেকে । দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম অপূর্ব সুন্দর এক শহরকে । মনের ক্যামেরায় হারিয়ে গেছিলাম । সম্বিত ফিরে পেলাম জাহাজ চলতে শুরু করাতে । ধীরে ধীরে তালিন ছোট হতে হতে দূর আকাশের মধ্যে মিলিয়ে গেল ।
স্বপ্নের দেশ – ফিনল্যান্ড
২৬/০৭/২০১৬ সকাল ১১.৪০ মিনিটে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হয়ে দিল্লী পৌছালাম দুপুর ২.২০ মিনিটে । বাইরে বেরোনোর সময় জানতে পারলাম ট্যাক্সি আর অটো দুটোই স্ট্রাইক । ওলা আর উবেরের বিরুদ্ধে । পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের প্লেন ছাড়বে দিল্লী থেকে । সোজা হেলসিঙ্কি । এবার ফিনল্যান্ডের ভিসার জন্য আর দিল্লী আসতে হয়নি , কোলকাতা থেকেই হয়ে গেছে । আর ফিনল্যান্ডের ভিসা থাকা মানে ইউ .কে ছাড়া ইউরোপের ২৬ টা দেশে যেতে কোনো অসুবিধা রইলো না । কোনো একটা দেশের ভিসা থাকলেই হলো । দুঘন্টার একটু আগেই পৌছে গেলাম এয়ারপোর্ট । বোর্ডিং পাস নিয়ে , লাগেজ জমা করে এগোলাম ইমিগ্রেশনের জন্য । তারপর সিকিউরিটি চেক সেরে অনেকটা হেঁটে ১০ নম্বর গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষায় রইলাম । ঠিক সাড়ে দশটায় রওনা হলাম দিল্লী থেকে হেলসিঙ্কি । পৌছালাম ওদের সময় অনুসারে ঠিক তিনটে পাঁচ মিনিটে অর্থাৎ আমাদের সময় অনুসারে বিকাল ৫ টা ৩৫ মিনিট । প্লেনে বসেই শুনতে পেলাম আমাদের যাত্রাপথ হবে ৫৬০০ কিলোমিটার । দিল্লি থেকে আফগানিস্থান ও মস্কোর আকাশপথ ধরে সোজা হেলসিঙ্কি । একসময় টিভিতে দেখতে পেলাম আমরা ৩৮০০০ ফিট ওপর দিয়ে যাচ্ছি । বাইরের তাপমাত্রা তখন -৫২ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড । আমাদের প্লেনের গতি ছিল ঘন্টায় ৮৭৮ কিলোমিটার । এক লাইনে ৮ জন করে বসার জায়গা । চারশোর ওপরে যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় । এয়ারপোর্টে ছেলে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য । গাড়ি নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে দেখি ঝকঝকে আকাশ । যেদিকে তাকাই নীল আর নীল । সূর্যের আলো দেখে মনে হচ্ছে দুপুর দুটো ।গতবার ২/১১/২০১৫ তারিখ লন্ডন থেকে ফিনল্যান্ড এসেছিলাম তখন শীতকাল ।দেখেছি বিকাল ৩ টার মধ্যেই সূর্যদেব ঘুমিয়ে পড়তেন কিন্তু এখন শুনলাম ভোর ৪ টা থেকে রাত ১১ টা অবধি ওনি জেগে থাকেন ।আর ১১ টা থেকে ৪ টাও পুরো অন্ধকার হয়না , গ্রহনের সময়কার মত আলো থাকে । গতবার শীতের সময় গাছের পাতা সব ঝরে গেছিল , গাছের রঙ ছিল সাদা , প্রচুর বরফ পেয়েছিলাম ।এবার সবুজ রঙের আস্তরণে সারা শহর ঢাকা পরেছে । সত্যি সত্যিই নানা রঙের ফুল বলছে- ধন্য আমি মাটির পরে । গতবার ঘাসের রঙ ছিল সাদা আর এবার ঘাস তার নিজের রঙ ফিরে পেয়েছে ।যেহেতু এখানে এখন সামার চলছে , সবাই যেন বাঁধন হারা পক্ষী । ঘরে থাকতে কারো মন চাইছে না ।রাস্তায় প্রচুর লোকজন দেখা যাচ্ছে । মনে হচ্ছে , কি আনন্দ আকাশে বাতাসে । সবাই প্রাণ ভরে উপভোগ করছে সময়টাকে । এখানকার সামার আমাদের বসন্ত ও শীত কাল ।কাছেই বাড়ি । তাই পৌছে গেলাম তাড়াতাড়ি ।
গতবার ছিলাম হেলসিঙ্কি এবার আছি এসপো । হেলসিঙ্কির গায়ে লাগানো এই শহর । একটা দিন শুধু ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলাম শরীরটাকে এখানকার মত মানিয়ে নেবার জন্য । বিকালে ১৫মিনিট হেঁটে পৌছে গেলাম সমুদ্রের ধারে ।এখানকার সৈকত খুব একটা বড় না । বাচ্চারা সমুদ্রের জলে লাফালাফি করছে কারণ ঢেউ নেই বললেই চলে । বালিতে রোদের মধ্যে অনেকেই শুয়ে আছে । এই সময়টা এখানকার সবাই যতটা পারে শরীরকে রোদের মধ্যে রাখে কারণ শীতকালে সূর্যের আলো খুব কম সময়ের জন্য থাকে এবং তেজও থাকে অনেকটা কম । সমুদ্রের ধারের রাস্তায় জগিং করতে দেখলাম অনেককেই ।এমনি করেই সময় বয়ে যাচ্ছিল । চমকে উঠলাম ঘড়ি দেখে । রাত দশটা বাজে অথচ বোঝার উপায় নেই সূর্যের আলো দেখে । মনে হচ্ছে পড়ন্ত বিকেল ।
গতবারের মত এবারেও ছেলে আমাদের জন্য পাস নিয়ে এলো যাতে আমরা ট্রেনে, বাসে,মেট্রোতে,ট্রামে অনায়াসে ঘুরতে পারি । আলাদা করে টিকিট কাটতে হবেনা । এক পাসেই সব । মনে পড়ে যাচ্ছিল গত ৭/১১/২০১৫ সকাল সকাল আমরা মেট্রো ধরে, তারপর ট্রামে করে গেছিলাম সমুদ্র সৈকতে । বাল্টিক সি বা সমুদ্র , খুবই শান্ত । স্টিমারে করে সোজা চলে গেছিলাম ‘সৌমেনলিনা দ্বীপ’ । মুম্বাইয়ের ‘গেট অফ ইন্ডিয়া’ থেকে ‘এলিফান্টা’ যাওয়ার মতো । স্টিমারে কুড়ি মিনিট মতো লাগে । ছোট্ট একটা দ্বীপ । ইউনেস্কোর হেরিটেজ লিস্টে এই জায়গাটার নাম আছে । ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অনেক নিদর্শন এখানে দেখা যায় । যুদ্ধের জন্য বানানো দূর্গ । ঐ সময়কার দুটো কামানও এখানে রাখা আছে ।

চারিদিকে সমুদ্র । অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গা । পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ । গরমের সময় এখানকার লোকেরা পিকনিক করে ,আমাদের উল্টো । কারণ এখানকার গরমকালে অনেকক্ষণ সূর্য থাকে এবং ঠান্ডা বেশ কিছুটা কম । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ফিনল্যান্ড বা জার্মানির লড়াইয়ের ইতিহাসে এই জায়গা ও ল্যাপল্যান্ডের অনেক ঘটনা আছে । মস্কো মাত্র ১০২০ কি.মি দূর । যাইহোক ইতিহাসের আলোচনায় যাচ্ছিনা । এখানে একটা সুন্দর চার্চ আছে । বেশ কয়েকটা রেস্তরাঁ ও একটা ছোট জাদুঘর আছে । যানবহনে ফিনল্যান্ডে আমাদের দেশের মতো অত শ্রেনী বা ক্লাস নেই । ট্রামে , ট্রেনে একটাই শ্রেনী । যাত্রী সংখ্যা আমাদের দেশের থেকে অবশ্যই অনেক কম । ট্রামে , বাসে , ট্রেনে জিনিষ তুলতে বা পেরাম্বুলেটারে একদম ছোট বাচ্চাকে নিয়ে উঠতে এখানে কোন কষ্টই হয়না, কারন সিড়িটা রাস্তার বা স্টেশনের প্লাটফর্মের সমান হয়ে যায় । বয়স্কদের উঠতেও কোন কষ্ট নেই । খোঁজ নিয়ে যেটুকু জানলাম তাতে এখানকার মানুষের মাসের মাহিনার তারতম্য আমাদের দেশের মতো নয় । কম আর বেশির মধ্যে পার্থক্য বেশিনা । শিক্ষা এবং স্বাস্থের জন্য এখানকার নাগরিকদের কোনো দাম দিতে হয় না । সব জায়গাতে হাসপাতাল ,স্কুল এবং খেলাধুলা করার ব্যবস্থা আছে । রাস্তাঘাটে কোথাও পুলিশ নেই অথচ সব কিছু নিয়ম ধরে চলছে । রাস্তায় কোন কুকুর নেই । রাস্তায় কেউ কিছু ফেলেনা সবাই পরিস্কার রাখে । থুথু নৈব নৈবচ । এখানে বাইরে ঠান্ডা থাকলেও বাসে,ট্রেনে,ট্রামে,দোকানে, ঘরে সর্বত্র সাধারণ তাপমাত্রা মানে ২১ থেকে ২২ ডিগ্রী । দারুনভাবে এরা বজায় রাখে । আর খাওয়ার জল সর্বত্রই একইরকম । যেখান থেকে খুশী জল খাওয়া যায় । লন্ডনের হোটেলে তো বাথরূম থেকেই খাবার জল নিচ্ছিলাম । বাথরূম এত পরিস্কার যে কোন ঘেন্না হয়না । কোন দেশেই জলের জন্য আলাদা কোনো ফিল্টার দেখলাম না । রাস্তাঘাটে গাড়ী,ট্রাম,বাস,মানুষের ভিড় সবই দেখলাম কিন্তু কোন গাড়ীর হর্ন শুনতে পেলাম না । যেকোন দূষণের ব্যাপারে এরা খুবই সচেতন । সচেতনতা সাধারন মানুষের রক্তে মিশে গেছে বলে আমার মনে হয় ।
গতবার ১৯/১১/২০১৫ মানে যেদিন অনেক রাত্রে স্পেন থেকে ফিরলাম , সেদিনই রাত্রে হেলসিঙ্কিতে প্রচুর বরফ পড়েছিলো । চারিদিক ছিল সাদা । তাপমাত্রা ছিল -৭ ডিগ্রী । ছবি তোলার জন্য বাইরে বেড়িয়ে পড়েছিলাম । মন আনন্দে উড়তে লাগছিলো । অনেক ছবি তুলেছিলাম । তার ঠিক দুদিন পরে আবার বরফ পরা দেখেছিলাম দুপুরবেলা । অনেকদিন আগে বরফ পড়তে দেখেছিলাম কেদারনাথে আর ঐদিন পেলাম । পাজা তুলার মতো বরফ নাচতে নাচতে নীচে নেমে আসছিল । সবকিছুকে সাদা আস্তরণে ঢেকে দিচ্ছিল ।

বিভিন্ন রঙের গাড়ি যেগুলো পার্কিংয়ে দাড়িয়ে ছিল ,সবার রঙ ধীরে ধীরে সাদা হয়ে গেছিল ।এতো পাহাড় নয় , শহর ।মুহুর্তের মধ্যে রাস্তা থেকে বরফ পরিস্কার করার গাড়ি এসে গেছিল । কিছুক্ষণ পরেই আবার সব কিছু আগের মতন । নরওয়ে , সুইডেন ,তালিন , ল্যাপল্যান্ড , ডেনমার্ক সবকটা জায়গাই কাছাকাছি । একসাথেই ঘুরে আসা যায় ।আজকাল অনেক টুর অপেরাটের এইসব জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে বা ঘোরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে ।
ইউরোপ খুব ভাল লাগলো । প্রতিটা জায়গাই ভালবেসে ফেলেছি । এখানে প্রায় সবকটা বড় বড় মলেই ঘুরলাম । মলে কোথাও কোন সিকিউরিটির লোক চোখে পড়লো না । প্যাকেট বা ব্যাগ কোন কিছুই মলের বাইরে জমা রাখতে হয়না । মানুষের প্রতি বিশ্বাস ,এটা খুব ভাল লাগছিল । এখানে সবাই স্বাবলম্বী । সব কিছু নিজেদেরকে করতে হয় । আমাদের দেশের মতো অত কাজের লোকের উপর নির্ভর করে এখানে চলা যাবেনা । বয়স্করা নিজেরাই নিজেদের জিনিষ বহন করে । তার জন্য ট্রলি ব্যাগ আছে । যাদের হাঁটতে অসুবিধা তাদের জন্য ছোট্ট অথচ চালানো সহজ ব্যাটারী চালিত গাড়ীর ব্যবস্থা আছে । ছোট ঐ গাড়ী নিয়ে সর্বত্র যাওয়া যায় । ভারতীয় শাক সব না পাওয়া গেলেও সবজি প্রায় সবই পাওয়া যায় । দেখতে কোন কোনটা একটু আলাদা । যেমন শশা প্রথমে আমরা কিনতে গিয়ে চিনতেই পারিনি । মাছ পাওয়া যায় অন্য ধরনের । মাংস সবই পাওয়া যায় । ফলও প্রায় সবই । মিষ্টির দোকান দেখিনি । শুধু জিলিপি পাওয়া যায় । ইরানীদের দোকানে । যদিও জানি জিলিপির উদ্ভব ভারতবর্ষ নয় । বেশ কয়েকটি ভারতীয় দোকান এখানে আছে যেখানে ভারতীয় মশলা সব পাওয়া যায় । যত জায়গা ঘুরলাম সব জায়গাতে পুলিশ আর ট্যাক্সি র উচ্চারণ এক । বানান আলাদা হতে পারে । আরেকটা ব্যপার আমাদের নজরে এসেছে । এখানে জানলায় , বারান্দায় কাচ লাগানো কিন্তু কোন গ্রিল বা লোহার শিক নেই । আমরা ভাবতেই পারিনা । অনেক আগে সিকিমে দেখেছিলাম । কিন্তু সেটাতো পাহাড় । চুরি , ছেনতাইয়ের কোন গল্প এখানে নেই । মিশে দেখলাম সব ব্যাপারে এনারা ভালই খবর রাখে । ব্যবহার সুন্দর । অহেতুক কৌতুহল নেই । কাউকে আঘাত করে মজা করে না । সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করে । শুনলাম এখানে দুটো দূর্গাপূজা হয় । একটা ভারতীয়দের আর একটা বাংলাদেশীয়দের । গতবার পার্ভো ঘুরে এসেছি তাই এবার আর যাচ্ছিনা । পার্ভো , ফিনল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর । এই শহর অতি প্রাচীন । ১৩০০ খৃষ্টাব্দে এই শহরের পত্তন হয় । শহরের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের জল প্রবেশ করাতে জায়গাটা অনেকটা ভেনিসের মত লাগে । মধ্যযুগীয় এই শহর আবার অনেকটা তালিনের মতো দেখতে । তালিনের বাড়ীঘর ছিল পাথরের তৈরি আর এখানকার বাড়ীঘর কাঠের । এছাড়া দেখতে একইরকম ।

পার্ভো ঘুরে আমরা নোকিয়ার অফিস মানে এখন যেটা মাইক্রোসফটের অফিস, দেখতে এস্পো গেছিলাম । ‘নোকিয়ানভিরতা’ নদীর পাশে মাইক্রোসফটের বা নোকিয়ার বিশাল অফিস । জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর । গতবারই পার্লামেন্ট , স্টেডিয়াম , জাদুঘর সবই দেখা হয়ে গেছিল । তাই এবার বেছে বেছে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে । এখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে একটা দারুন পিকনিকের জায়গা আছে শুনলাম । জঙ্গল , লেক এবং ছোট পাহাড় , সবই আছে । জায়গাটার নাম নুউক্সিও । ঘুরে আসলাম । দারুন লাগলো জায়গাটা । আরো অনেক প্রোগ্রাম হচ্ছে , লেখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে । ইউরোপের কয়েকটা দেশ দেখার পর ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে প্রযুক্তিবিদ্যাতে আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই । কিন্তু প্রযোগ করে আমাদের দেশে কম সংখ্যক মানুষ । পরিকাঠামোতে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে । যদিও আমাদের পিছিয়ে থাকার কথা নয় । আমাদের দেশের বেশিরভাগ জায়গায় শহর আর গ্রামের মধ্যে সুযোগ সুবিধার পার্থক্য অনেক । এখানে সেটা নেই বললেই চলে । সমস্যার কথা বলতে গেলে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কথা চলে আসতে বাধ্য । তাই এখানে ইতি টানছি ।
নূউক্সিও / NUUKSIO NATIONAL PARK, FINLAND
রাত্রে গরম গরম আটার রুটি, আলু -ফুল কপির তরকারী ও হাতে বানানো নারু খেতে খেতে হঠাৎ ছেলের কাছে ওর বন্ধুর ফোন আসলো । আগামীকাল পিকনিকে যাবো কিনা ? মালদা থেকে ওর শ্বশুর – শ্বাশুড়ি এসেছে । সবাই মিলে একসাথে যেতে চায় । আমরাতো সব ব্যাপারে হাত উঠিয়েই আছি । ঠিক হয়ে গেল আমরা সকাল সকাল বেড়িয়ে পরবো কিছু খাবার নিয়ে । এখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে একটা দারুন পিকনিকের জায়গা আছে শুনলাম । জঙ্গল , লেক এবং ছোট পাহাড় , সবই আছে । জায়গাটার নাম নুউক্সিও (NUUKSIO) । ওখানে রান্না করতে দেবে না , নিয়ে গিয়ে খাওয়া যাবে ।ভোর ভোর উঠে কিছু খাবার বানিয়ে নিলেই হবে , তাই আপাতত চললাম বিছানায় । নুউক্সিওতে পৌছে দেখি ওরা চারজন পার্কিংয়েই দাঁড়িয়ে আছে । আমাদের একটু আগে ওরা পৌছেছে । আমরা তিনজন আর ওরা চারজন একসাথে জিনিষ পত্র নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম । এখানে পার্কিংএর জন্য ও জঙ্গলে ঢোকার জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না । ভালই ভিড় । শনিবার সব ছুটি, তার উপরে এখানকার সামার । দলে বেঁধে সব বেড়িয়ে পরেছে আনন্দ উপভোগ করতে । অনেকের সাথে আমরাও জঙ্গলের রাস্তা ধরে এগোলাম । একটু এগোতেই নজরে পরলো গাছের গায়ে লাল , নীল আর হ্লুধ রঙ করা তিনটে কাঠের টুকরো লাগানো আছে । যেহেতু মন সবসময় জানার মাঝে অজানাকে সন্ধান করে তাই জানতে চাইলাম ছেলের কাছে । ও বললো এই জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে অনেককটা ট্রেকিং রুট আছে । জঙ্গলে যাতে কেউ রাস্তা না হারিয়ে ফেলে তার জন্য এই ব্যবস্থা । লাল , নীল আর হ্লুধ রঙের আলাদা আলাদা কাঠের টুকরো জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন গাছে লাগানো আছে । রাস্তা চেনানোর জন্য । তাইতো । বেশ কজনকে দেখলাম পিঠে স্যাক , টেন্ট আর স্লীপিং ম্যাট নিয়ে যেতে । জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন রঙের মাশরুম বা বেঙের ছাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । হঠাৎ নজরে পড়ল ছোট ছোট গাছে প্রচুর পাকা ব্লু বেরি । কোনদিন খাইনি তাই ঝাপিয়ে পরলাম ।অরণ্যের অধিকার । তাকিয়ে দেখি আমি শুধু একা নয় , ওদেশের লোকও আছে । কয়েকটা মুখে পুরে আবার হাটতে লাগলাম । একটা রাস্তা সোজা উপরে উঠে গেছে আর একটা ডান দিকে গিয়েছে বেঁকে । ডান দিকের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম । ঝাউ আর ব্লু বেরি গাছ ছাড়া আমাদের কাছে নাম না জানা গাছের সংখ্যাই বেশি । শুনলাম এটা নাকি ফিনল্যান্ডের জাতীয় উদ্যান । ৪৩ টা ছোট বড় মিলিয়ে লেক আর জলাভূমি অনেকটা জায়গা দখল করে আছে । একদিক থেকে আরেকদিকে যাওয়ার জন্য জলের ওপরে কোথাও আছে ভাসমান সেতু , আবার এমনি সেতুও আছে । দূরে ছিপ নিয়ে একজনকে মাছ ধরতেও দেখলাম । লেকের জলে দেখলাম বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি যেটা আমরা দেখতে পাই আমাদের দেশে শীতকালে । ওদিকে আর না এগিয়ে আমরা কিছুটা ফিরে এসে যে রাস্তাটা ওপরের দিকে গেছে সেইদিকেই হাঁটতে লাগলাম । ছোট পাহাড় । পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকদিনের এবং আনন্দেরও । তর তর করে উঠতে লাগলাম । কিছুটা উঠতেই চোখ জুড়িয়ে গেল । পাইন গাছে ঘেরা সুন্দর একটা লেক । জলের উপর ভাসছে অসংখ্য পদ্মপাতা । লেকের পাশে তাঁবু খাটিয়ে একদল ছেলে মেয়ে আনন্দ করছে । কেউ কেউ আগুন জালিয়ে খাবার গরম করছে । আগুন জালানোর কাঠ এখানে বিনা পয়সায় পাওয়া যায় । জঙ্গলের মধ্যে বেশ কটা টয়লেট বানানো । সবার চেষ্টায় সবসময়ই পরিস্কার । আমরা বাড়ির থেকে অভ্যাস মত বিছানা চাদর এনেছি তাই লেকের পাশে বিছিয়ে আড্ডা মারতে বসলাম । আর কাউকে বিছানার চাদর পেতে বসতে দেখিনি । শুনলাম এই লেকের জল শীতকালে বরফ হয়ে যায় । তখন সবাই এর উপর দিয়ে যাতায়াত করে । চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন দলে সবাই আনন্দ করছে । আমদের দেশের পিকনিকের মতোই । নেই শুধু বিভিন্ন মাইকের আওয়াজ । আমাদের দেশে দেখেছি বেশিরভাগ সময়ে অহেতুক শাসন ছোট বাচ্চাদের স্বাধীনভাবে আনন্দ করতে দেয় না । এখানে ছোট বাচ্চাদের অপরিসীম আনন্দ দেখতে খুব ভালো লাগছিল আর রাগ হচ্ছিল আমদের দেশের অতিরিক্ত শাসন প্রিয় বাবা-মার প্রতি । প্রাকিতিকভাবে বাচ্চাদের বড় হওয়া যে কতটা দরকার সেটা আমরা অনেকেই করতে দিই না । তোতা কাহিনী । নির্ভেজাল আড্ডা ,মনোরম পরিবেশ মাতিয়ে রাখলো আমাদের সারাদিন । সারাদিন সবাই নানারকম ভাবে আনন্দ করলো অথচ জায়গাটা একটুও নোংরা হলো না । এরাই কি শুধু দেশটাকে ভালবাসে !

NUUKSIO NATIONAL PARK, FINLAND

হ্যানকো (Hanko), ফিনল্যান্ড
শনিবার হ্যানকো (Hanko) যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাদ সাধলো আবহাওয়া দপ্তর । আবহাওয়া দপ্তর জানালো শনিবার আকাশ থাকবে মেঘাচ্ছন্ন ও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা প্রবল । রবিবার আকাশ থাকবে ঝকঝকে ও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে । এখানে আবহাওয়া দপ্তরের খবর মোটামুটি মিলে যায় । তাই ঠিক হলো রবিবার সকালে রওনা হয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে আসবো ।হেলসিঙ্কি থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে প্রাকিতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ একটি বন্দর শহরের নাম হলো হ্যানকো । দুটো পরিবার সাথে কিছু খাবার আর জল নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম সকাল সকাল । এসপো পার হতেই শহর ছাড়িয়ে পারি দিলাম গ্রামের পথে । ঘন সবুজ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে উঁচু-নিচু ঝকঝকে রাস্তা । আরো কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম দুপাশের বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে চলছে চাষাবাদ । যেহেতু এখানকার জমি সমান নয় ,উঁচু আর নিচু ক্ষেতগুলিও নিচ থেকে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে আবার নিচে নেমে গিয়ে আবার উঠেছে ওপরে। মিরিকের রাস্তার চা বাগানের কথা মনে করিয়ে দেয় । এখানে রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করানো যায় না তাই চলন্ত অবস্থায় ছবি নিতে বাধ্য় হয়েছি । অসাধারণ দৃশ্য । চেখ ফেরানো যায়না । প্রায় দুঘন্টার ওপর লাগলো হ্যানকো পৌঁছাতে । পৌঁছেই দেখি সামনে দিগন্ত জুড়ে নীল জলরাশি । শুনলাম ১৩০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে এই সমুদ্র সৈকত ।অসংখ্য মানুষ শুয়ে আছে বালির ওপর । এসপোতেও একই জিনিস দেখেছি । সারা শরীরে রোদ লাগাতে ব্যস্ত এখানকার মানুষজন । সমুদ্রের ঢেউ নেই তাই জলের মধ্যেই বাচ্চাদের জন্য নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা করা আছে । বাচ্চারা তিন চার ঘন্টার আগে কেউ জলের থেকে উঠছেনা । বেশ কজন ছেলে মেয়েদের দেখলাম রবারের নৌকাবিহারে মত্ত । এখানকার লোকেরা এই সামারে পরিবার নিয়ে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে আনন্দ করতে ব্যস্ত । আমাদের মতো পর্যটকের সংখ্যা এখানে খুবই কম । সমুদ্রের মধ্যে বেশ কটা দ্বীপও দেখা যাচ্ছে । হ্যানকো ফিনল্যান্ডের এক নামকরা বন্দর । নানাধরনের ছোট – বড় অনেক পালতোলা নৌকা দেখা যাচ্ছে বন্দর জুড়ে । মাঝে মাঝেই নৌকা নিয়ে সমুদ্র বিহারে নেমে পরছে এখানকার লোকজন । গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বেরোবার মতো আরকি। সারাদিন ধরে সারা শহর ঘুরে বেড়ালাম । সাজানো গোছানো সুন্দর একটা চার্চ দেখলাম । সমুদ্রের ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোলাপী রঙের জল মিনার । হ্যানকো থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে চললাম আরেকটা গ্রামের দিকে । দুপাশে জবের ক্ষেত । গ্রামের বাড়িগুলো কি সুন্দর , ছোট ছোট বাংলোর মতো । কাঠের বাড়ি , মাথায় টিনের চাল । মাঝে মাঝে মনে হয় আগে থেকে পরিকল্পনা করে একটা দেশ তৈরী করা হয়েছে । সবকিছু জায়গা মত । গ্রাম ছাড়িয়ে আবার পড়লাম জঙ্গলের মধ্যে । দুপাশে ঘন জঙ্গল । হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি ছোট ছোট কটা বল্গা হরিনের বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছে । এ এক বিরল অভিজ্ঞতা । বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা তখনও আকাশে রয়েছে সূর্যের আলো । আর সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সবার চেখে মুখে ।অকৃত্রিম এক আনন্দ ।

হেলসিঙ্কি , ফিনল্যান্ড
বাড়ির সামনে চারটে বড় বড় বাজার আছে যেখানে সব পাওয়া যায় । তিনটে বাজার মলের মধ্যে ও আরেকটা এশিয়ান বাজার , কাছেই একটা বাড়ির নিচের তলায় । হঠাতই এশিয়ান বাজারে একটা ভালো ইলিশ মাছ পাওয়া গেল । কালো জিরাও এশিয়ান বাজারেই পাওয়া গেল । গোটা সর্ষে আমরা দেশ থেকে নিয়ে এসেছি কিন্তু তেল ? অনেক রকমের তেল আছে কিন্তু সর্ষের তেল পাচ্ছিনা । কাছাকাছি সব দোকান দেখা হলো । কোথাও নেই । ইলিশ মাছ সর্ষের তেল ছাড়া ভাবতেই পারছি না । ছেলে বললো ওর অফিসের সামনে একটা ভারতীয় বাজার আছে । কাল ওখানে খোঁজ করবে । মনে পড়ল গতবার ওখান থেকেই সর্ষের তেল এনেছিলাম । অবশেষে পাওয়া গেল সর্ষের তেল । ফিনিসে ইলিশ খাওয়ার স্বাদ পূর্ণ হলো ।
ফিনল্যান্ডের ওপর দিয়ে উড়োজাহাজে আসার সময় জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখছিলাম নীল জল আর সবুজ বন । পরে বুঝলাম নীল জল হলো বাল্টিক সি সহ অসংখ্য লেক এবং সবুজ বন হলো সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি গাছ পালা । আমাদের দেশে শীতের পর আসে বসন্ত কাল আর এখানে বসন্তের পরে শীত । সারা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ম্যাপেল গাছ । সারা পৃথিবীতে প্রায় ১২৫ রকমের ম্যাপেল গাছ আছে । বাড়ির সামনে যতগুলো ম্যাপেল গাছ দেখছি পাতার রঙ এখন ঘন সবুজ । শীতকালে সব পাতা ঝরে যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে নানা রঙে । বোঝা যাবে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে । লন্ডনেও গতবার এমনি শোভা দেখেছিলাম ।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমানুসারে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা এক নম্বরে । স্কুলের বাইরে এখানে টিউসনের কোনো দরকার নেই । আর আমাদের দেশে টিউসন ছাড়া চলবে না। ছেলেমেয়েদের বইয়ের ব্যাগ নিয়ে টিউসন যেতে এখানে দেখা যায় না। অনেক চেষ্ঠা করেও পান আর গুটকা খেতে এখানে কাউকে দেখিনি । রাস্তা – ঘাটে , স্টেশনে , সমুদ্র সৈকতে কোথাও দেখতে পাইনি পান আর গুটকার দাগ ।সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের দেশবাসী । গতবার ভিসার জন্য দিল্লী যেতে হয়েছিল । এখন কলকাতাতে অফিস হওয়াতে আর দিল্লী যাওয়ার প্রয়োজন নেই ।তিন মাসের বেশি ভিসার দরকার হলে শুধু দিল্লী যেতে হবে ।
কাল বিকালে এসপো থেকে ১৩২ নম্বর বাস ধরে চললাম হেলসিঙ্কি । যেহেতু এখানে বাঁদিকে গাড়ির স্টিয়ারিং তাই বাস ধরার জন্য আমাদের দেশের উল্টোদিকে দাঁড়াতে হয় । সামনের গেট দিয়ে এক এক করে সবাই উঠে ড্রাইভারের কাছ থেকে টিকিট কেটে ভিতরে যাচ্ছে । আর যাদের বাস কার্ড আছে তারা গেটের সামনেই একটা ছোট মেসিন আছে তার সামনে কার্ডটাকে ধরতে হচ্ছে । বাসগুলো আমদের দেশের এসি বাসের মতো । শুধু দরজা আর ড্রাইভারের বসার জায়গা উল্টোদিকে ।
সৌমেনলিনা দ্বীপ’ , ফিনল্যান্ড
আমার ছোট ভাইয়ের বড় মেয়ে থাকে জার্মানি । আমাদের কাছে ফিনল্যান্ডে কয়েকদিনের জন্য় বেড়াতে এসেছে । তাই আবার ঠিক হলো সৌমেনলিনা দ্বীপ’ যাওয়ার । ১৭ ই অগাস্ট বিকালে আমরা সবাই মিলে অর্থাৎ আমি ,আমার স্ত্রী বেবি , বড় ছেলে সায়ক আর ছোট ভাইয়ের মেয়ে মিষ্টু স্টিমারে করে সোজা চলে গেলাম ‘সৌমেনলিনা দ্বীপ’ । মুম্বাইয়ের ‘গেট অফ ইন্ডিয়া’ থেকে ‘এলিফান্টা’ যাওয়ার মতো । স্টিমারে কুড়ি মিনিট মতো লাগে । ছোট্ট একটা দ্বীপ । অসাধারণ জায়গা ।চারিদিকে সমুদ্র তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা জায়গা যেখানে ৩০০০ হাজার বছর আগেও মানুষ ছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায় । ইউনেস্কোর হেরিটেজ লিস্টে এই জায়গাটার নাম আছে ।আমাদের দেশে পাথরে বানানো বিভিন্ন দুর্গের মত এখানে চারিদিক ঘেরা একটা দুর্গ আছে ।চারদিকে রাখা অনেকগুলি আগেকার কামান জলের দিকে মুখ করে রাখা যাতে জলপথে কেউ আক্রমন করলে দুর্গকে বাঁচাবে এইসব কামান । ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অনেক নিদর্শন এখানে দেখা যায় ।

যুদ্ধের জন্য বানানো দূর্গ । প্রচুর বাঙ্কার । উপর থেকে দেখলে বোঝাই যাবে না । সৈন্যদের থাকার জায়গা । গতবার এসেছিলাম শীতের সময় । সমুদ্রের জলের রং ছিল নীল কিন্তু চারিদিক ছিল সাদা চাদরে ঢাকা । হালকা বরফের আস্তরণে ঢাকা ছিল সবকিছু । আর এখন চারিদিক সবুজে সবুজ । নানা রঙের ফুল এই ছোট্ট দ্বীপটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে । পাখির কলরবে মুখরিত সবদিক । অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গা । পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ । গরমের সময় এখানকার লোকেরা পিকনিক করে , আমাদের উল্টো কারণ এখানকার গরমকালে অনেকক্ষণ সূর্য থাকে এবং ঠান্ডা বেশ কিছুটা কম । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ফিনল্যান্ড বা জার্মানির লড়াইয়ের ইতিহাসে এই জায়গার অনেক ঘটনা আছে । মস্কো মাত্র ১০২০ কি.মি দূর । যাইহোক ইতিহাসের আলোচনায় যাচ্ছিনা । এখানে একটা সুন্দর চার্চ আছে । বেশ কয়েকটা রেস্তরাঁ ও একটা ছোট জাদুঘর আছে । তিন – চার ঘন্টা কাটানো কোনো ব্যাপারই নয় । নানা দেশীয় পর্যটকদের ভির এখানে ।

আবার স্টিমারে করে ফিরলাম হেলসিংকি । রাত্রে এখানকার সবচেয়ে বড় একটা ভারতীয় রেস্তরাতে খাওয়ার ইচ্ছা । নাম ইন্ডিয়া হাউস । আটটা নাগাদ ডিনারের জন্য ঢুকলাম । সুন্দর সাজানো গোছানো , একসাথে প্রায় ১০০ উপরে লোক বসতে পারে । অপরিচিত গন্ডির মধ্যে পরিচিত মানে দেশীয় কিছু মানুষদের দেখে বেশ ভালো লাগছিল । আরো ভালো লাগলো হিন্দি কথা শুনে । মনে হচ্ছিল দেশেই আছি । বিদেশে আসলে দেশীয় সব ভাষা যেন আরো মিষ্টি লাগে । দেশ নিয়ে অনেক ব্যাপারে আমরা নিজেদের মধ্যে সমলোচনা করি ঠিকই কিন্তু বিদেশে আসলে দেশপ্রেম ভালই উপলব্ধি করা যায় । খাওয়াটা বেশ ভালই হলো । এখানে টিপস দেওয়ার চল নেই এমনকি ভারতীয় রেস্তরাতেও । টা টা ও শুভরাত্রি জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম ইন্ডিয়া হাউস থেকে ।

YYTERI BEACH এবং TURKU CITY
আগে থেকেই ঠিক ছিল তাই শনিবার সকাল সকাল তৈরী হয়ে নিলাম সবাই । কিছু খাবার খেয়ে আর কিছু নিয়ে পারি দিলাম পরী যেখানে YYTERI BEACH আছে। আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূর । এখানে কোল্ড ড্রিঙ্কস ও বিয়ারের থেকে জলের দাম কিনতে গেলে বেশি তাই জলের বোতল সাথে রাখা ভালো । যেখান থেকে খুশি ভরে নেওয়া যাবে ।আমরাও তাই সাথে জল নিয়ে নিলাম । শহর ছাড়িয়ে আঁকা বাঁকা , উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে ।কখনো দুপাশে পাচ্ছি অরণ্য আবার কখনো শস্য়ক্ষেত । গান গাইতে গাইতে আর চারিদিকের শোভা দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম YYTERI BEACH । প্রায় ৬ কিলোমিটার জুড়ে সাদা বালুর সৈকত । সমুদ্রের গর্জন বেশ দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল । হাওয়া চলছিল খুব জোরে । নীল জলের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল ।

মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌচ্ছে গেছে ।প্রচুর পর্যটক । বিভিন্ন adventurous sports এর আয়োজন ছিল । নীল আকাশ তার সাথে টুকরো টুকরো মেঘের আনাগোনা , সামনে বিশাল নীল জলরাশি , সাদা বালুর চর , সমুদ্রের গর্জন আমাদের সবার মন দিয়েছিল মাতিয়ে । সমুদ্রের পাশে অনেক সুন্দর সুন্দর থাকার জায়গা আছে কিন্তু যেহেতু আমাদের ইচ্ছা এখানকার ছোট একটা গ্রামে থাকার তাই সদলবলে চললাম গ্রামের দেশে । আগে থেকেই ঠিক করা ছিল তাই গ্রামের বাড়ির মালকিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । আমরা পৌছাতেই আমাদের সব বুঝিয়ে আমদের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে ওনি অন্য বাড়ি চলে গেলেন । অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা ঘর নিয়ে একটা বাড়ি । বাড়ি সংলগ্ন জমির পর বিশাল ক্ষেত । দুরে দেখা যাচ্ছে কিছু বাড়ি আমদের দেশের গ্রামের মত । কিন্তু ঘরে আছে ইন্টারনেট , ট্যাপ ওয়াটার , ইলেকট্রিসিটি , মডুলার কিচেন , সুন্দর খাট , টিভি, রেফ্রিজারেটর সবই যা শহরের বাড়িতে দেখা যায় । এখানে কোথাও খোলা নালা দেখা যায় না । তখনও আকাশে বেশ আলো , আমরা বেড়িয়ে পরলাম গ্রামের উদ্দশ্যে । দুপাশে ক্ষেত তার মধ্যে দিয়ে ছোট রাস্তা । সবাই সবার মত করে ছবি তুলছি । এমন সময় এক ভদ্রলোক সাইকেল করে আমাদের কাছে এসে জানতে চাইলেন আমরা কে এবং এখানে কেন এসেছি । প্রথমেই আমাদের মাথায় আসলো বোধহয় IB হবে । বললাম আমরা পর্যটক, গ্রাম দেখতে এসেছি । কি দেখে জানিনা ওনি জানতে চাইলেন আমরা ভারতবর্ষ থেকে এসেছি কিনা । আমরাও অবাক । একটা জিনিস ভালো লাগলো যে ইউরোপের শেষ প্রান্তে এত দুরে একটা গ্রামে আমাদের দেশের নাম জানে । মনে মনে একটু গর্বিত হলাম । আমরা শুনলাম ওনি মোবাইলে কাউকে বলছেন যে আমরা ভারতবর্ষ থেকে এসেছি । আমরাও ধরে নিয়েছি নির্ঘাত IB র লোক । আমাদের সাথে সাথেই ওনি ঘুরছেন আর আমাদের সব বলে দিচ্ছেন । ক্ষেতের থেকে ফসল তুলে আমাদের খেতে দিচ্ছেন । খুবই আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে । আমাদের মত কোনো পর্যটকদের ওনি এর আগে গ্রাম বেড়াতে দেখেননি । অনেকটা ঘুরে আমরা যখন ফিরে আসছি তখন দেখি আমাদের জন্য রাস্তায় দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । পরিচয় করিয়ে দিলেন ওই ভদ্রলোক ওনার স্ত্রী ও মেয়ের সাথে । মেয়ে Agriculture নিয়ে বাইরে পড়াশুনা করে এবং ভারতবর্ষ সমন্ধ্যে অনেক কিছু জানে । ভবিষ্যতে ওর কৃষক হওয়ার ইচ্ছা । অনেক গল্প হলো । শুনলাম জার্মান আর সোভিয়েতের যুদ্ধের কাহানী । ভদ্রলোকের বাবা ওই যুদ্ধের একজন শহিদ । একটা শহিদ বেদী আমাদের দেখালেন । ওনাদের সাথে বেশ কটা ছবি রইলো আমাদের স্মৃতি হিসাবে । বুঝলাম ওনি ঐ গ্রামেরই লোক, IB র নয় । এই প্রথম কোনো বিদেশীকে এগিয়ে এসে আলাপ করতে দেখলাম । এর আগে অনেকের সাথে হাসি বিনিময় হয়েছে বা একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি যেগুলোর মধ্যে ছিল লৌকিকতা , ছিলনা এই অকৃত্রিম সরলতা । রাত্রে কিচেন ছেড়ে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো । চারপাশে গোল হয়ে বসলাম আমরা । মনে হচ্ছিল camp fire । আদিম মানুষের মত ঝলসানো খাবার খেতে খেতে বাঁধন হারা হয়ে গেলাম । ওরা গান ধলো –রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে ……… ।
পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে রওনা হলাম Turku যে শহরটা ছিল ফিনল্যান্ডের আগের রাজধানী । শহরের মধ্যে দিয়ে Aura নদী বয়ে গেছে লন্ডনের টেমস নদীর মত । তবে Aura নদী লন্ডনের টেমস নদীর থেকে চওড়ায় অনেকটা কম । মধ্যযুগীয় স্থাপতের কিছু নিদর্শন এখানে দেখা যায় । তারমধ্যে TURKU CASTLE এবং TURKU CATHEDRAL অন্যতম ।

আবার তালিন
গত শনিবার ২১/০৮/২০১৬ আবার হেলসিঙ্কি থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য রওনা হলাম তালিন , ফিরলাম রবিবার রাত্রে । এবারও সেই বিশাল দশ তোলা জাহাজ । মনে হচ্ছিল একটা চলমান বড় পাঁচ তারা হোটেল । কেউ কেবিন ভাড়া নিয়ে যাচ্ছে , কেউবা ডেকে বসে আড্ডা দিতে দিতে যাচ্ছে , আবার কেউ কেউ বিভিন্ন রেস্তরাতে বসে সময় কাটাচ্ছে , কেউবা ক্যাসিনোতে । চারিদিকে অনেক টিভি লাগানো । কয়েকজনদের দেখলাম ভিড় করে খেলা দেখছে । অলিম্পিকে জার্মানি আর ব্রাজিলের । বার রয়েছে বেশ কটা । কোনটাতে হচ্ছে গান আর কোনটাতে নাচ । কিন্তু সবকিছুই হচ্ছে সুশৃঙ্খলভাবে । জাহাজে সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার লোক ধরে ।অবাক লাগলো যখন দেখি একটা রেস্তরাতে খাবার ওজন করে বিক্রি হচ্ছে । পর পর প্রচুর আমিষ ও নিরামিষ খাবার রাখা আছে , পছন্দ মত খাবার প্লেটে নিয়ে যেতে হবে ক্যাশ কাউন্টারে । প্লেটটা খাবার সমেত ওজন করার যন্ত্রে রাখতে হবে । দাম ১০০ গ্রাম ২০ সেন্ট , যেকোনো কোল্ড ড্রিঙ্কস ১ ইউরো । আমরা ছিলাম সর্বঘটে কাঠালী কলার মত । সব আনন্দ কিনে নিচ্ছিলাম । পরিচ্ছন্নতা এদের মজ্জাগত ।তাই সর্বত্রই ঝকঝকে ও তকতকে । যেখানে খুশি কাটানো যেতে পারে । আর পাবলিক টয়লেট আমাদেরকে লজ্জা দেয় ।

প্রথমবার গেছিলাম নভেম্বরের শেষের দিকে অর্থাৎ এখানকার শীতকালে আর এবার এখানকার গরমকালে । । শীতের দাপটে গতবার পর্যটকের সংখ্যা ছিল কম , কিন্তু এবার তালিন যেন সেজে উঠেছে । মনে হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গা থেকে পর্যটক জমা হয়েছে এই তালিনের টাউন হল স্কোয়ারে । রবিবার তালিনের তাপমাত্রা ছিল ২১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । ভোরবেলা তালিনের মাটিতে পা রাখলাম । তালিন হলো এস্তোনিয়ার রাজধানী । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে ।যদিও এখানকার ৬০ ভাগ লোক রাশিয়ান ভাষাতেই কথা বলে । জার্মান আর সোভিয়েতের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার অনেক ইতিহাস বহনকারী এই তালিন । এবারও আমরা আধুনিক তালিনের দিকে না গিয়ে মধ্যযুগীয় তালিন দেখতেই পছন্দ করলাম । বিশ্বের অধিকাংশ পর্যটকদের সাথে আমাদের পছন্দের মিল খুঁজে পেলাম । ১০০০ বছরের পুরানো শহর , বাড়ীঘর গল্পে দেখা ‘ফেয়ারি টেলস’ এর মতো । মনে হচ্ছিল গল্পে দেখা রাজকন্যা থাকে, ওই সাত সাগর আর তের নদীর পারে । কিছু কিছু রেস্তরাঁর সাজসজ্যা, আসবাবপত্র ঐ সময়টাকে ধরে রেখেছে । পার্লামেন্ট , বেশ কটা অপূর্ব সুন্দর চার্চ ,ক্যাথিড্রাল দেখলাম । সবই মধ্যযুগীয় স্থাপত্য ।

পর্যটকদের আনন্দ দেওয়া এবং সংস্কৃতির প্রচারের জন্য অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল । আবার দুপুরে গতবারের মত ‘মহারাজা’ নামে একটা ভারতীয় রেস্তরাঁতে খেলাম ।পরিচয় হলো এক বাংলা দেশীয় যুবকের সাথে যে এখানে মাস্টার ডিগ্রী করছে এবং অবসর সময়ে এই হোটেল কাজ করছে । এইরকম ছেলে মেয়ে সারা ইউরোপে অনেক ছড়িয়ে আছে । প্রতিটা প্রগতিশীল দেশের মত যে কোনো কাজের সন্মান আমরা কবে দেবো ?
পৃথিবীর উত্তরের শেষ প্রান্ত – নর্থ কেপ
কোনদিন কল্পনায়ও ভাবিনি যে সুমেরু বৃত্ত ছাড়িয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌছে যাব একদিন, যেখানে উত্তর মেরু ও আমার মধ্যে থাকবে না কোনো স্থলভূমি । সামনে শুধু কয়েক কিলোমিটার জুড়ে থাকবে নীলাভ সমুদ্র । তারপরেই আছে উত্তর মেরু বা নর্থ পোল । সত্যিই নরওয়ের উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে পোঁছে ,ভাবছিলাম স্বপ্ন দেখছি না তো । সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিটে হেলসিঙ্কির বিমানবন্দর থেকে রওনা হলাম ল্যাপল্যান্ড । এক ঘন্টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পোঁছে গেলাম ল্যাপল্যান্ডের রাজধানী রোভানিয়েমির বিমানবন্দরে । আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ওখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে সব জায়গা ঘুরে আবার রোভানিয়েমিতে ফিরে আসবো সোমবার । এখানে গাড়ি ভাড়া করলে নিজেদেরই চালাতে হয় । আমাদের দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল আমাদের কাছে , ওতেই কাজ হলো ।গত নভেম্বর মাসে ল্যাপল্যান্ড ঘুরে গেছি । তখন সান্তা ক্লসের গ্রামে গিয়ে ওনার সাথে দেখাও করেছিলাম । সেবার ছিল শীত কাল ।চারিদিক ছিল বরফের আস্তরণে ঢাকা ।কিন্তু এবার চারিদিক সবুজে সবুজ । সবেমাত্র হালকা হলুদ রঙ ধরেছে কিছু পাতায় । সান্তার সাথে দেখা করে আমরা এগিয়ে চললাম উত্তর দিকে । রোভানিয়েমি থেকে ৩২৬ কিলোমিটার দুরে ইনারি নামে একটা জায়গায় এক বড় লেকের ধারে আমাদের রাত্রে থাকার কথা । রোভানিয়েমি শহর ছাড়িয়ে দুপাশে সারি সারি পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলছিল আমাদের গাড়ি । সুমেরু বৃত্ত বা আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে আমরা প্রবেশ করেছি ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম । মাঝে মাঝেই ডান এবং বাম দিকে পাচ্ছিলাম বড় বড় লেক । অপূর্ব সুন্দর সে দৃশ্য । সাদা , বাদামী রঙের বেশ কিছু বল্গা হরিণদের খেলা করতে দেখলাম । এই অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বল্গা হরিণদের বাস । লেক ইনারি ল্যাপল্যান্ডের সবচেয়ে বড় লেক । লম্বায় ৮০ কিলোমিটার আর চওড়ায় ৫০ কিলোমিটার । ফিনল্যান্ডের মধ্যে তৃতীয় । লেকের ধার ধরে সারি দিয়ে বেশ কটা কটেজ । হোম স্টে বলা যায় । ঘরের মধ্যেই রান্না করার ব্যবস্থা ও টয়লেট ছিল । ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা সবসময়ের জন্য ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড করা ছিল বাইরের তাপমাত্রা যাই হোক না কেন । ওখানকার যাদের পকেটটা একটু বেশি ভারী তারা বেড়িয়ে পরছিল কারাভান বা চলন্ত বাড়ি নিয়ে । কি সুন্দর সব ব্যবস্থা আর যেখানে খুশী থেকে যাও । যেহেতু এখানে ক্রাইম নেই বললেই চলে সুতরাং এখানে নিরাপদে নিশ্চিন্তে যখন খুশী যেখানে যাওয়া ও থাকা যায় ।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় ফিনিস জল খাবার খেয়ে রওনা দিলাম রাস্সেনেস নামে এক জায়গার উদ্দেশ্যে যেটা নরওয়ের মধ্যে পরে নর্থ ক্যাপ থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার আগে ।কারণ দুটো । এক সারা রাত ধরে দেখব অরোরা বরিয়ালিস -সারা আকাশ জুড়ে সবুজ আলোর ঢেউ আর আরেকটা কারণ পরদিন সকাল সকাল পোঁছে যাব নর্থ ক্যাপ, থাকতে পারব অনেক্ষণ । পৃথিবীর প্রায় মাথার উপর দিয়ে ছুটে চলেছি উত্তর মেরুর কাছাকাছি পৌছানোর জন্য । প্রকৃতি নিজেই নানা রঙে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে । এক একটা গাছের পাতার এক এক রকম রঙ । অনেকটা আমাদের রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়ার মত । মাঝে মাঝেই দুধারে পাচ্ছিলাম লেক ।স্বচ্ছ নীল জল ।প্রানভরে নিচ্ছিলাম নিঃশ্বাস দূষণমুক্ত আকাশে । হিংস্র জন্তু না থাকায় সব বলগা হরিন খেলে বেড়াচ্ছিল ইচ্ছামতো । আর কিছু দিন পরেই বরফে ঢেকে যাবে সব কিছু । অত উপরে নির্জন জায়গা তবুও দেখলাম একটা ঝকঝকে হেলথ সেন্টার । এত সুবিধার জন্যই বোধহয় সারা বিশ্ব থেকে পর্যটক এখানে নিশ্চিন্তে আনন্দ করে ঘুরে যেতে পারে । অনেকটা চলে এসেছিলাম একটু পরেই ঢুকবো নরওয়েতে । তিনতলা সমান উঁচু ঢেউয়ের মতো রাস্তা । মনে হচ্ছিল নাগরদোলায় চড়েছি । এমনিভাবে দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছিলাম । রাস্তায় পড়ল একটা ছোট নদী তার উপরে ছোট একটা ব্রিজ । ছেলে বললো এটাই ফিনল্যান্ড আর নরওয়ের বর্ডার । কেউ আমাদের গাড়ি দাঁড় করালো না , কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না , এ কেমন বর্ডার ! ফিনল্যান্ড ছাড়িয়ে ঢুকে পড়লাম নরওয়েতে । চোখের সামনে ভেষে উঠলো ধুসর আর স্লেট রঙের পাহাড় । রাস্তায় পড়ল নরওয়ের ছোট একটা শহর । ATM থেকে কিছু নরওয়ে কোনার তোলা হলো রাস্তার জন্য । বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বাঁদিকে পেলাম পাহাড় আর ডান দিকে জল । মনে হচ্ছিল সেভক দিয়ে সিকিমের দিকে এগোচ্ছি । ছেলের কাছে শুনলাম এটা সমুদ্রের জল । ম্যাপ দেখলেও বোঝা যাচ্ছিল । গাড়ির মধ্যে জিপিএস আছে তাই কারো সাহায্য ছাড়াই আমরা এগিয়ে চলেছি আমাদের গন্তব্যে । একবারের জন্যেও কাউকে কিছু জিগ্যেস করতে হয়নি । পৌঁচ্ছে গেলাম রাস্সেনেস । অপূর্ব সুন্দর এক জায়গা । ডানদিকে দিগন্ত ব্যাপ্তি সমুদ্র , তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মাঝারি মাপের পাহাড় ।বামদিক রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেছে । মাঝে কটা বাড়ি । তার মধ্যেই একটাতে আমাদের থাকার জায়গা । হোম স্টে । সুন্দর ব্যবস্থা । ইলেকট্রিসিটি , ওয়াই ফাই সবই আছে । এরকম একটা নির্জন জায়গায় যা ব্যবস্থা দেখছিলাম মনে হচ্ছিল পর্যটকদের কাছে তা স্বর্গ । জলের সমস্যা কোথাও নেই । যেকোনো কলের জলই খাওয়া যায় । রাস্তা থেকে কিছু কাঁচা খাবার কিনে নেওয়া হয়েছিল তাই রাত্রে রান্না করেই খাওয়া হলো । কারণ এই নির্জন জায়গায় খাবার কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট ছিলনা । চারিদিক অন্ধকার হতেই বারান্দার আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো । ঘরের পর্দাগুলো ভালো করে টেনে দেওয়া হলো যাতে বাইরে আলো না আসতে পারে । সবাই বেরিয়ে এলাম বাইরে অরোরা বরিয়ালিস দেখার জন্য । আমরা ছাড়া ওখানে আর কোনো পর্যটকদের দেখতে পেলাম না । আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছি । মেঘ রয়েছে আকাশে । আমাদের হোম স্টেটা যার তত্ত্ববাধনে ওনি আমাদের আশাহত হতে দিচ্ছিলেন না । মাথার উপর চারিদিক উম্মুক্ত আকাশে সবুজ আলোর ঢেউ দেখার জন্য সারা পৃথিবী থেকে পর্যটক এসে ভিড় করে এই উত্তর আর দক্ষিণ মেরুতে । উত্তরে যার নাম অরোরা বরিয়ালিস এবং দক্ষিনে অরোরা অস্ট্রালিস । অনেকে একে আবার পোলার লাইটও বলে । বিজ্ঞানের বিশ্লষনে আর যাচ্ছি না । নানা রকম গল্প গুজব করে ভালই কাটছিল সময় আর চলছিল টুকটাক খাওয়া দাওয়া । বাইরে ঠান্ডা তাই মাঝে মাঝে ঢুকে পরছিলাম ঘরে । শুধু লক্ষ্য আকাশের দিকে । স্ত্রীর আওয়াজে সবাই বেরিয়ে এলাম বাইরে । দেখি আকাশ ভরা সবুজ আলোর ঢেউ । মুহুর্তের মধ্যে আমাদের হাতের ক্যামেরাগুলি ঝলসে উঠলো । মনের ক্যামেরা আর যন্ত্র ক্যামেরায় ধরা পরলো অরোরা বরিয়ালিস যার আকর্ষনে ছুটে আসা । আনন্দের ঢেউ খেলে গেল সারা শরীরে । কিছুক্ষণ পরে আবার কোথা থেকে মেঘ এসে সারা আকাশ ঢেকে ফেললো ।আমরাও ঘরে প্রবেশ করলাম । ভুলে গেছিলাম বাইরের ঠান্ডার কথা ।

সকাল হলো । বাইরে বেরিয়ে দেখি কয়েকটা বলগা হরিন আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল । সামনে দিগন্ত ব্যাপী সমুদ্র । শুনলাম তিমি আছে এই সমুদ্রে । অনেকসময় ডাঙা থেকে লেজ দেখা যায় । আমরাও সবাই তাকিয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে যদি তিমির দর্শন পাই । তোমার দেখা নাইরে তোমার দেখা নাই , তাই জলখাবার খেয়ে রওনা হলাম পাহাড়ের চূড়ায় নর্থ ক্যাপে । আবার আমাদের রথ ছুটে চললো বাঁদিকে শ্লেট রঙের পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে । মাঝে মাঝেই বাঁদিকে পাচ্ছিলাম উপত্যকা । রাস্তায় পড়ল চারটে টানেল । একটা টানেল সমুদ্রের তলা দিয়ে গেছে । যাওয়ার সময় রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম ।টানেলের ঢোকার মুখে দেখলাম লেখা আছে ২১২ মিটার গভীর আর ৬৮৭০ মিটার লম্বা । প্রত্যেক কিলোমিটার অন্তর একটা করে টেলিফোন বুথ । নিরাপত্তার সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া আছে । টানেল থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছিলাম । হঠাৎ মেঘ এসে মেঘালয় বানিয়ে দিল । খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল । একটু পরিস্কার হচ্ছিল আবার একটু মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিল ।এমনি করেই ধীরে ধীরে উপরে উঠে পৌচ্ছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে । পাহাড়ের উপর অনেকটা সমতল জায়গা ,ওয়াকার টেবিলের ছবির মতো ।

সামনের দিকটা কেউ যেন সমানভাবে কেটে দিয়েছে ।আর তার নিচের দিকে আছড়ে পড়ছিল ঢেউ । ভাবলে শিহরিত হচ্ছিলাম যে পৃথিবীর উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি ।আমরা আর উত্তর মেরুর মধ্যে কোনো মানুষ নেই , নেই কোনো স্থলভূমি, আছে শুধু কয়েক কিলোমিটার জল । পাহাড়ের উপরেই আছে পাঁচ তলা সমান উঁচু একটা বাড়ি । ভিতরে জাদুঘর , খাবারের তিনটি রেস্তুরেন্ট , সপিং মল ও একটা পেক্ষাগৃহ যেখানে ১৫ মিনিট অন্তর দেখানো হয় নর্থ ক্যাপের উপর একটা ডকুমেন্টারী । কোথা দিয়ে দুই – তিন ঘন্টা সময় চলে গেল বোঝাই গেলনা । এরপর ফেরার পালা । ফিরব আর্কটিক সার্কেল ধরে সুইডেন হয়ে ল্যাপল্যান্ড । তারপর ল্যাপল্যান্ডের রোভানিয়েমির বিমানবন্দর হয়ে হেলসিঙ্কি । রাত্রে থাকবো সুইডেন আর ফিনল্যান্ডের বর্ডারে । নরওয়ের বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে চলেছিলাম । কখনো বাঁদিকে পাহাড় আর ডান দিকে নদী, কখনো বা দুপাশে শস্য ক্ষেত , মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ছিলাম শহরের মধ্যে ।ছবির মতো সুন্দর লাগছিল নরওয়ে । সন্ধ্যে পার হয়ে রাত নেমেছিল , সাথে চলছিল বৃষ্টি ।এরই মধ্যে ভাগ্যক্রমে আবার রাস্তা থেকে দেখতে পেলাম অরোরাকে । বুঝলাম আমরা এখনও আর্কটিক সার্কেলের মধ্যেই আছি । রাত প্রায় একটা নাগাদ পৌচ্ছালাম আমাদের নির্ধারিত হোম স্টেতে । কোনো লোক নেই শুধু আমাদের জন্য চাবি রাখা ছিল একটা খোলা বাক্সের মধ্যে । চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম । সুন্দর ব্যবস্থা । সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম আসতে সময়ই লাগলো না ।

পরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরীই হলো । দরজা খুলে বারান্দায় বেড়তেই দেখি সামনে একটা সুন্দর নদী তরতর করে বয়ে চলেছে যার আওয়াজ কাল রাত্রে থেকেই পাচ্ছিলাম । শুনলাম নদীর ওপারটা সুইডেন । বেশি চওড়া না একটা নদী ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে আলাদা করছে । অনেকটা শিলিগুড়ির কাছে ফানসিদেওয়াতে মহানন্দা নদী যেটা বাংলাদেশ ও ভারতকে আলাদা করেছে । নদীর উপর ছোট একটা ব্রিজ ,একপারে লেখা ফিনল্যান্ড আরেকপারে লেখা সুইডেন ।কোথাও নেই কারও মিলিটারী । অনায়াসে যাতায়াত করা যায় । আমাদের কেউ কোথাও কিছু জিগ্যেস করলনা । ভাবতে ভাল লাগছে প্রতিবেশী দেশের সাথে নেই কোন ঝগড়া , মিলেমিশে এক হয়ে গেছে কিন্তু প্রত্যেকেরই আছে আলাদা সত্তা । পাশের বাড়ির মত । রোভানিয়েমি থেকে প্লেন ধরবো সন্ধ্যা ৬ টা বেজে ১০ মিনিটে আর গাড়িটা দিতে হবে জমা তাই হাতে অনেক সময় । বেড়িয়ে পরলাম সুইডেন অভিমুখে । চলো সুইডেনের গ্রামে চলো । এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । একই চেহারা , একই তাপমাত্রা , একই পরিবেশ তবুও দুটো আলাদা দেশ । ঠিক করলাম দুপুরে সুইডিশ খাবার খাব । ইন্টারনেট দেখে খাবারের দোকান সনাক্ত করা গেল । এখানে সর্বত্র নেট কানেকশন পাওয়া যায় । কাউকে কিছু জিগ্যেস করতেই লাগে না । খেতে বসেছি দেখছিলাম এক ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর মিটিমিটি হাসছেন । আমার স্ত্রী ওনার দিকে হেসে শুভেছা জানালো আর তাতেই ভদ্রমহিলা ওঠে আমাদের কাছে চলে আসলেন । জানলাম ওনি সুইডিশ , ইন্ডিয়া গেছেন ঘুরতে , ওনার ইন্ডিয়ান বন্ধুও আছে । অনেক গল্প হল ,অবশেষে আসতেই হলো ওনাকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে । কেননা আমাদের গন্তব্য হেলসিঙ্কি ।গাড়ি ছুটে চললো রোভানিয়েমির দিকে ।
সংসদীয় নির্বাচন
এবার আমরা ফিনল্যান্ডে আসার পর ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় নির্বাচন অর্থাৎ সংসদীয় নির্বাচন দেখার সাক্ষী হলাম ।গতকাল অর্থাৎ ০২/০৪/২০২৩ তারিখ এখানকার সংসদীয় নির্বাচনে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৯ টা অবধি ভোট দান চললো । ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে আমরা যেখানে থাকি তার খুব কাছেই একটা স্কুলে এখানকার ভোটদান কেন্দ্র ছিল । দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হতে চলেছে অথচ বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে সংসদীয় নির্বাচন চলছে । শহরের কোন দেওয়ালে নেই নির্বাচনী প্রচার বাঁ পোস্টার । শুধু কয়েকটা নিদিষ্ট জায়গায় ক্যান্ডিডেটদের পোস্টার দেখা যায় । রাস্তায় নেই কোন রাজনৈতিক দলের পতাকা । কোথাও দেখা যায় না রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যস্ততা । কোথাও নেই কোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী বুথ । ভোটাররা তাদের ভোট গ্রহন কেন্দ্রে যাচ্ছে আর সুন্দরভাবে নির্ভয়ে ভোট দিয়ে বেড়িয়ে আসছে ।ভোট গ্রহন কেন্দ্রে পুলিশি তৎপরতা একদম চোখে পড়লো না । ফিনল্যান্ডে অগ্রিম ভোট দেওয়ার একটি ব্যবস্থাও রয়েছে, যা ভোটারদের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনের দিন আগে তাদের ব্যালট দেওয়ার অনুমতি দেয়। এটি প্রায়শই এমন লোকেরা ব্যবহার করে যারা অফিসিয়াল নির্বাচনের দিনে কাজ, ভ্রমণ বা অন্যান্য প্রতিশ্রুতির কারণে ভোট দিতে অক্ষম।ফিনল্যান্ডের নির্বাচনী ব্যবস্থা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের উপর ভিত্তি করে। ফিনল্যান্ডকে 13টি নির্বাচনী জেলায় বিভক্ত করা হয়েছে, যেগুলো আবার মোট 200টি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদে বিভিন্ন সংখ্যক সদস্য নির্বাচন করে।

গতকাল সারাদিন ধরে সংসদীয় নির্বাচন হয়ে গেল অথচ কোথাও কোন গণ্ডগোলের খবর নেই ।নির্বাচনের সময় সহিংসতা বা অন্যান্য বিঘ্নিত আচরণের দৃষ্টান্ত ফিনল্যান্ডে খুব বিরল। দেশে অপরাধের হার কম এবং উচ্চ স্তরের সামাজিক সংহতি রয়েছে, যা নির্বাচন প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল হওয়া নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। ফিনিশ সংসদীয় নির্বাচন প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এবং সংসদের 200 জন সদস্য চার বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। ফিনিশ পার্লামেন্টে বর্তমানে নয়টি রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্ব করছে এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি দল প্রতিনিধিত্ব করছে না। তবুও কোন রাজনৈতিক সংঘাত দেখা যায় না ফিনল্যান্ডের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দীর্ঘ ইতিহাসে । সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে ফিনল্যান্ডের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমাদের চোখে ফিনল্যান্ড / The Republic of Finland through our lens
ফিনল্যান্ড হল উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগর, বোথনিয়া উপসাগর এবং ফিনল্যান্ড উপসাগরের সীমানায় অবস্থিত একটি দেশ যার পরিচিতি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং উচ্চ জীবনযাত্রার জন্য ।ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় 5.5 মিলিয়ন এবং এর সরকারী ভাষা ফিনিশ , সুইডিশ ও ইংরাজি । হেলসিঙ্কি হল দেশের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর, যার জনসংখ্যা 650,000-এর বেশি।ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল এর শিক্ষা ব্যবস্থা, যা বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসাবে বিবেচিত হয়। ফিনল্যান্ডের সাক্ষরতার হার 99% এর বেশি, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটাকে প্রতিফলিত করে।ফিনল্যান্ডের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এখানকার প্রযুক্তিগত উন্নতি। ফিনল্যান্ডের একটি অত্যন্ত উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি খ্যাত Nokia, Kone এবং Rovio-এর মতো সুপরিচিত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির জন্মস্থান। ফিনল্যান্ডের সরকার বিভিন্ন শিল্পে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রচারের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করে।ফিনল্যান্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল জঙ্গল, হাজার হাজার হ্রদ যেখানে স্কিইং, হাইকিং এবং বরফে মাছ ধরার মতো ক্রিয়াকলাপগুলি স্থানীয় এবং পর্যটকদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়।

এখানকার অত্যাশ্চর্য উত্তরীয় আলো( Norther light) দেখতে সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা এখানে ছুটে আসে । দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে।ফিনল্যান্ডের প্রধান ১৫ টা বড় শহর হল ঃ Helsinki ,Espoo, Vantaa, Tampere, Turku, Oulu, Lahti, Kuopio, Jyvaskyla, Pori, Lappeenranta, Vaasa, Kotka, Joensuu, Hameenlinna । সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে ফিনল্যান্ড শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপর দাঁড়িয়ে এক অনন্য এবং আকর্ষণীয় দেশ। এখানকার উচ্চ জীবনযাত্রার মান এবং প্রগতিশীল নীতিগুলি বসবাস, কাজ বা ভ্রমণের জন্য একটি পছন্দসই আকর্ষণীয় দেশ হিসাবে পরিগণিত হচ্চে ।
উৎসবে বাঙালি
সারা বাংলা জুড়ে যখন পয়লা বৈশাখ পালন করা হচ্ছিল , তখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে উত্তর মেরুর কাছাকাছি ফিনল্যান্ডে বসে ফিনল্যান্ডের বাঙালিরা মেতে উঠেছিল বাংলা ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে । এবছর এই প্রথম ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে বেশ বড় করে উদযাপিত হোল পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান । হেলসিঙ্কির বাঙালিরা জাতি , ধর্ম ব্যতিরেকে সবাই এক হয়ে দুপুরবেলা মিলিত হোল একটি বড় স্কুল বাড়িতে ।দেখে উপায় নেই কারা বাংলা দেশ আর কারা ভারতবর্ষ থেকে এসেছিল । মনে হচ্ছিল এপার বাংলা আর ওপার বাংলা মিলে মিশে একটাই বাংলা হয়ে গেছে । বাইরে তখন তাপমাত্রা চার ডিগ্রি । কিন্তু সবাই তাদের শীতকালীন বস্ত্র স্কুলের ভিতরে ত্যাগ করে পরিপূর্ণ বাঙালি সেজে উঠেছিল । ছোট থেকে বয়স্ক ছেলেদের গায়ে ছিল পাজামি ও পাঞ্জাবি আর মেয়েরা পড়েছিল শাড়ি ।সবার মুখে ছিল প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা । সারা স্কুল বাড়ি মেতে উঠেছিল বৈশাখী মেলায় । চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বিভিন্ন ছোট ছোট দোকান । কোথাও বিক্রি হচ্ছে শাড়ি , কোথাও জামা – কাপড় ,আবার কোথাও চলছে খাবার-দাবারের দোকান । যেন একটা পরিপূর্ণ মিলন মেলা । একে অপরের সাথে মিলিত হলেই মুখ দিয়ে প্রথমেই বেড়িয়ে আসছে ‘ শুভ নববর্ষ’ । ঠিক তিনটে নাগাদ শুরু হোল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।বাংলা ভাষায় নাচে , গানে , কবিতায় মুখরিত হোল স্কুল বাড়ি । দু / তিনমাস ধরে চলা অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হোল পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত হওয়ায় । অনুষ্ঠান শেষে দুই বাংলার মানুষেরা জাতি , ধর্মকে দূরে রেখে অঙ্গীকার করলো বাংলার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার ।
ফিনল্যান্ডের মে দিবস যা বাপ্পু (VAPPU) নামে পরিচিত
আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি যে মে দিবস অর্থাৎ ১লা মে হোল আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যেটা বিশ্বের অনেক দেশে প্রতি বছর ১লা মে উদযাপিত হয় । আমরা এও জানি যে এটি শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে সম্মান জানানোর এবং তাদের অধিকার ও কাজের অবস্থার আরও উন্নতির আহ্বান জানানোর দিন। মে দিবস হল শ্রমজীবী মানুষের অতীতের অধিকার অর্জনগুলি উদযাপন করার এবং সবার জন্য একটি ভাল ভবিষ্যত গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি করার দিন। কিন্তু ফিনল্যান্ডে মে দিবস পালিত হতে দেখলাম একদমই অন্যরকমভাবে । ফিনল্যান্ডে মে দিবস বাপ্পু নামে পরিচিত । ফিনল্যান্ডে এটা বসন্তের আগমন এবং গ্রীষ্মের শুরুকে চিহ্নিত করার জন্য একটি উৎসব । এই উৎসব দেখলাম 30শে এপ্রিল সন্ধ্যায় শুরু হল ও পরের দিন অর্থাৎ ১ লা মে পর্যন্ত চলতে থাকলো ।ক্রিসমাস এবং ইস্টারের পাশাপাশি এই উৎসবও সারা ফিনল্যান্ডের একটা বড় ছুটির দিন । ফিনল্যান্ডে, মে দিবসটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব আনন্দের সাথে উদযাপন করে। তারা একসঙ্গে সাদা ক্যাপ ও ওভারল (overall dress) পোশাক পরিধান করে রাস্তায় নেমে আসে। সাদা ক্যাপ ও ওভারল (overall dress) পোশাক পরার ঐতিহ্য ১৯ শতকের আগে যখন হেলসিঙ্কির ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্ররা তাদের মর্যাদার প্রতীক হিসাবে পরা শুরু করেছিল। উৎসব পালন করতে 30 শে এপ্রিল সন্ধ্যায় এবং ১লা মে সারাদিন হেলসিঙ্কিতে প্রচুর মানুষ খাবার, পানীয় এবং লাইভ মিউজিক উপভোগ করতে শহরের কেন্দ্রস্থলে জড়ো হয়। আবার অনেকে পিকনিক, বারবিকিউ এবং অন্যান্য বহিরঙ্গন কার্যকলাপের দ্বারা এই উৎসব পালন করে । ছাত্রদের পাশাপাশি, পরিবার এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিও উদযাপনে অংশ নেয়। কোন বেলুন হাতির মতো বা কোন বেলুন ঘোড়ার মতো দেখতে এইরকম বিভিন্ন আকারের বেলুন নিয়ে বাচ্চাদের আনন্দ করতে দেখা যায় । পরিবার , বন্ধু- বান্ধব নিয়ে অনেককে পার্টির মাধ্যমে এই উৎসব পালন করতে দেখা যায় ।এই দিনে ছাত্ররা নানা রকম খেলার আয়োজন করে । মে দিবস হল ফিনিশ জনগণের একত্রিত হওয়ার এবং বসন্তের আগমন এবং একটি নতুন ঋতুর সূচনা উদযাপন করার একটি সময়। এটি আনন্দ এবং সুখে ভরা একটি দিন, যেখানে লোকেরা তাদের উদ্বেগগুলি ভুলে বন্ধু এবং পরিবারের সাথে এই দিনটিকে উপভোগ করে ।

আমাদের চোখে ফিনল্যান্ডের গ্রাম পুউমালা(PUUMALA)
২৮শে এপ্রিল ছিল শনিবার , ২৯ রবিবার আর ১লা মে সোমবার ফিনল্যান্ডে VAPPU DAY হিসাবে ছিল ছুটি । তাই এই তিনদিনের ছুটি উপভোগ করতে আমরা অর্থাৎ আমি , আমার স্ত্রী লিপিকা , আমার বড় ছেলে সায়ক, আমার বৌমা মধুপর্ণা , আমার ছেলের বন্ধু দেবাশীষ , দেবাশীষের স্ত্রী মুন , ওদের ছেলে আরিন আর আমার ছেলের ছোটবেলার বন্ধু পাবলো দুটো গাড়ি নিয়ে চললাম ৩০০ কিমি দূরে ফিনল্যান্ডের গ্রামে যার নাম পুউমালা(PUUMALA) ।

পুউমালা হল ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ অংশে সাইমা হ্রদের একটি উপদ্বীপে দক্ষিণ সাভোনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত । সায়মা হ্রদে বিশ্বের দীর্ঘতম হ্রদ উপকূলরেখা রয়েছে । এটি ফিনল্যান্ডের বৃহত্তম হ্রদ এবং এটি ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম প্রাকৃতিক মিষ্টি জলের হ্রদ।পুউমালা(PUUMALA) তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত, এর সীমানার মধ্যে অসংখ্য হ্রদ, বন এবং দ্বীপ রয়েছে।ভাবতে অবাক লাগে যে ফিনল্যান্ডে ছোট , বড় মিলিয়ে প্রায় 187,888 লেক আছে । আমরা সকাল ১১ টায় দুটো গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে রাস্তায় বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গায় থামতে থামতে পুউমালা গিয়ে পৌছালাম সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ। বাইরে তখন রীতিমতো আলো । নির্জন জঙ্গলের মধ্যে দেখলাম শুধু আমাদের সুন্দর একটা কাঠের কটেজ আর তার সামনে ছোট্ট একটা ঘাসের লন পেরিয়ে শান্ত বিশাল বড় লেক ।কটেজের ভিতরে ঢুকে দেখলাম শহরে যা যা সুবিধা পাওয়া যায় তার সবই আছে ।সুন্দর সাজানো গোছানো একটা three bedroom বাড়ি ।রান্না ঘরে সব সুবিধাই আছে । নৌকা বিহার করারও সব ব্যবস্থা আছে তবে মাঝি নেই , নিজেদেরকেই দাড় টানতে হবে । এগুলি সাধারণত এখানকার সামার কটেজ । লোকে আসে আর লেকের জলে চুটিয়ে স্নান করে । আমাদের ওখানকার পার্সোনাল বিচের মতো । এছাড়া এই জায়গাটা হাইকিং, ফিশিং, বোটিং এবং কায়াকিংয়ের মতো বহিরঙ্গন কার্যকলাপের জন্য জনপ্রিয় ।দুদিন পরে ছিল পূর্ণিমা , তাই রাত্রে চাঁদের আলোয় লেকের সৌন্দর্য অপরূপ হয়ে উঠেছিল । পুউমালার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল পুউমালা চার্চ, যা 18 শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর কাঠের চার্চগুলির মধ্যে একটি। আমরা দুটো দিন সবাই মিলে মুখরোচক খাওয়া দাওয়ার সাথে দারুন আনন্দ করে ১লা মে সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসলাম হেলসিঙ্কি সেন্টারে বাপ্পু (Vappu)উৎসবে নিজেদেরকে সামিল করতে । বেশ কিছুক্ষণ হেলসিঙ্কি সেন্টারে কাটিয়ে ফিরে আসলাম যার যার নিজ গৃহে ।

ফিনল্যান্ডে ভারত দিবস / India Day in Finland
গতকাল, রবিবার অর্থাৎ ২০/০৮/২০২৩ তারিখ ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কির বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে একটা বড় পার্কে অনুষ্ঠিত হল ভারত দিবস বা India Day । ২০১৬ সাল থেকে এই অনুষ্ঠান হয়ে আসছে ফিনল্যান্ডের মাটিতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মজবুত করার জন্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারের জন্য ।

হেলসিঙ্কি ও তার আশে পাশের সমগ্র ভারতীয়রা ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেছিল বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীরা এবং অবশ্যই ফিনিশ ও হেলসিঙ্কিতে বসবাসকারী বিভিন্ন দেশের জনগন ।সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা অবধি চলে এই অনুষ্ঠান । সারাদিন ধরে এখানকার ভারতীয়দের বিভিন্ন নাচের গ্রুপ মাতিয়ে রেখেছিল এই অনুষ্ঠান । এবারের এই অনুষ্ঠানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল কলকাতা থেকে আসা তনুশ্রী শঙ্করের নাচের গ্রুপ ।ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি এখানে ছিল ভারতের সব প্রদেশের রন্ধন শিল্পের ঐতিহ্য । সারা পার্ক ভারতীয় খাবারের সুগন্ধে ম ম করছিল । ভারতীয় ও বাংলাদেশীয়দের সাথে সাথে ফিনিশ ও অন্যান্য বিদেশীরাও রসিয়ে রসিয়ে ভারতীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করছিল ।ভারতীয় জনগণ সমগ্র ফিনল্যান্ডে রয়েছে প্রায় ১১ হাজারের উপর আর হেলসিঙ্কি ও তার আশে পাশে রয়েছে প্রায় ৭ হাজারের কাছাকাছি । স্বভাবতই এই অনুষ্ঠানে সারাদিন ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো ।মাইকে ঘোষণা করলো যে এবছর সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছে , প্রায় ২৫ হাজারের মতো আর এটাও শুনলাম যে সারা মাঠের রক্ষণাবেক্ষণে ছিল ৫০০ মতো ভলেনটিয়ার ।

সাংস্কৃতিক প্রচারের পাশাপাশি, ফিনল্যান্ডে ভারত দিবস একতা এবং বহুসংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। নাচ, সঙ্গীত, খাবার এবং কথোপকথনের মাধ্যমে, ভারত দিবস ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সুন্দর বোঝাপড়া তৈরি করতে সাহায্য করে । এক কথায় বলতে গেলে ফিনল্যান্ডে ভারত দিবস একটি আনন্দদায়ক ও রঙিন অনুষ্ঠান যা ফিনিশ ল্যান্ডস্কেপে ভারতের চেতনা , ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করে । সারাদিন খুব ভাল কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম । লেখাটা শেষ করার আগে একটা কথা উল্লেক না করে পারছি না – এখানে অর্থাৎ ফিনল্যান্ডে যতটা দেখেছি তাতে মনে হয় ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বাঙালিরা ধর্মটাকে সরিয়ে রেখে এখানে প্রকৃত বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছে । এখানে ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বাঙালি্দের একতা চোখে পড়ার মতো । সমগ্র ফিনল্যান্ডের বাঙালিদের কাছে মনে হয় “ ধর্ম যার যার , বাঙালি সবার” ।
আমাদের চোখে অরোরা বোরিয়ালিস বা Northern light বা মেরুজ্যোতি
গতকাল রাত্রে বাড়িতে বসে ভালই আড্ডা হচ্ছিল। হটাৎ বড় ছেলে অভ্র বলল , আজ Helsinki থেকে Northern light দেখার forecast আছে । জানিনা দেখতে পাবো কিনা । কেননা আমরা অনেকবার try করে খুব সামান্যবারই দেখেছি । তোমাদের যদি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলো । আধ ঘণ্টা মতো গাড়িতে যেতে হবে । আমরা আগে দুবার অরোরা বা এই মেরুজ্যোতি দেখেছি তবে সামান্যই । তাই আমরা আবার যেতে চাইলাম । বাইরে তখন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রী । ভাল গরম জামা কাপড় পড়ে তাড়াতাড়ি রাতের আহার করে বেড়িয়ে পড়লাম ছেলের সাথে গাড়ী করে । বেশ অনেকটা যাওয়ার পর একটা বড় লেকের পাশে আমরা গাড়ী থেকে নেমে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম অরোরা বোরিয়ালিস দেখার জন্য । বেশ কিছুক্ষণ ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে হটাৎ ই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশের এক জায়গা দিয়ে হালকা সবুজ আলো বেরচ্ছে । ছেলে বলল আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিও না । এইবার দেখবে আকাশ জুড়ে সবুজ আলোর খেলা । বলতে না বলতেই দেখি অনেকটা আকাশ জুড়ে সবুজ আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে । আকাশের অনেকটা অংশ সবুজ আলোয় ভরে গেছে । কি অপুরুপ মেরুজ্যোতি আকাশ জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে যারা দেখেছে তারাই শুধু অনুভব করতে পারবে ।মোবাইল ক্যামেরায় যতটুকু ধরা গেছে ততটা বন্ধুদের ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য শেয়ার করছি । অরোরা বোরিয়ালিস বা Northern lightএকটি অবিশ্বাস্য আলোর show যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে । অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের মতো গ্যাসের সাথে সংঘর্ষিত হওয়া সূর্য থেকে নির্গত বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণার সংঘর্ষের ফলে ঘটে। উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের magnetic polesর চারপাশে এই আলো দেখা যায়।

SAUNA IN FINLAND
গতকাল ফিনল্যান্ডে বড় ছেলের বাড়িতে একটা নতুন জিনিসের স্বাদ পেলাম । জিনিসটার নাম sauna । Sauna হল একরকমের হিট থেরাপির একটি ঐতিহ্যবাহী রূপ যা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। । হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশনস অনুসারে, মায়ানরা 3,000 বছর আগে ঘামের ঘর ব্যবহার করত। ফিনল্যান্ডে, সনা হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে । sauna হল একটি ছোট ঘর বা বিল্ডিং যাতে শুষ্ক বা ভেজা তাপে ঘর গরম করা হয়, তার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, সাধারণত গরম শিলা বা বাষ্প ব্যবহার করে তাপমাত্রাকে খুব উচ্চ স্তরে বাড়ানো হয়।ছেলের বাড়িতে স্নানঘরের সাথেই রয়েছে sauna করার জায়গা । মেঝের থেকে বেশ কিছুটা ওপরে একটা কাঠের চৌকি বা বড় টেবিল পাতা আছে । তার ওপর পাতা আছে একটা বড় তোয়ালে । তোয়ালের ওপর খালি গায়ে হাফ পেন্ট পড়ে বসলাম । ছোট ঘরটার মধ্যে দেখলাম একটা হিটার জ্বলছে , তার ওপর রয়েছে কয়েকটা পাথর । পাথর গুলো যখন ভাল গরম হল তখন পাশে রাখা ছোট জল ভর্তি বালটি থেকে বড় কাঠের চামচে করে পাথরের ওপর একটু জল ঢাললাম । পাথর থেকে শুস্ক বাষ্প বেড়ল আর ঘরটাকে গরম করে তুললো । ওখানে বসে আমি খুব ভালমতো গরম তাপটাকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম ।কিছুক্ষণ পর পর পাথরে জল ঢালতে লাগলাম । sauna ঘরের মধ্যে রাখা একটা মেসিনে দেখতে পারছিলাম ঘরের তাপমাত্রা কতটা বাড়ছে । বেশ গরম লাগছিল আর শরীর থেকে দর দর করে ঘাম বেড়চ্ছিল । প্রথমদিন বলে ওরা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসর মধ্যেই ঘরটাকে রাখল । সাধারণত 70° থেকে 100° সেলসিয়াস বা 158° থেকে 212° ফারেনহাইটের মধ্যে ঘরটাকে উত্তপ্ত করা হয়।প্রথম দিন বলে আমাকে ১০ মিনিটের মতো বসতে দিয়েছিল । সাধারণত সবাই ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট অবধি থাকে । তারপর ভাল করে স্নান করে নেওয়া । এটাকেই বলে sauna থেরাপি । sauna ব্যবহারের অভ্যাসে শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই অসংখ্য উপকারিতা হয় । সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলির মধ্যে একটি হল শিথিলকরণ (Relaxation) এবং স্ট্রেস কম করার ক্ষমতা। sauna থেরাপি কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি করে বলে প্রমানিত । তাপ রক্তনালীগুলিকে প্রসারিত করে, যা রক্ত প্রবাহকে উন্নত করতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। এটি রক্তচাপ কমাতে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতেও সাহায্য করতে পারে।শরীরের ঘামের সাথে সাথে ত্বকের মাধ্যমে টক্সিন নির্গত হয়, যা শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। উচ্চ তাপমাত্রা শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদনকেও উদ্দীপিত করতে পারে, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। sauna কয়েক প্রকারের হয় ।

সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে sauna থেরাপি হোল সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উন্নতির জন্য একটি নিরাপদ এবং কার্যকর উপায়।
আমাদের চোখে ইতালির ভেনিস / Venice of Italy through our lens
( ০৫/০৪/২০২৩ থেকে ০৬/০৪/২০২৩) গত ০৫/০৪/২০২৩ আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, আমার স্ত্রী লিপিকা , আমার বড় ছেলে সায়ক আর আমার বৌমা মধুপর্ণা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি থেকে রাত সাড়ে ৯ টায় আকাশপথে উত্তর-পূর্ব ইতালির আড্রিয়াটিক সাগরের (Adriatic sea)বুকে গড়ে উঠা ভেনেতো অঞ্চলের প্রধান সুন্দরতম ভাসমান শহর ভেনিস অভিমুখে রওনা দিলাম । সময় লাগলো তিনঘণ্টা । বেশ রাত হয়ে গেছিল তাই আর কোথাও না ঘুরে সোজা চলে গেলাম হোটেলে । ভেনিস শহরে পা রাখতেই মনে পরে গেল শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’। মনে পরে গেল হলিউড, বলিউড সিনেমার অনেক ছবির গানের দৃশ্য যার শুটিং হয়েছিল আড্রিয়াটিক সাগরের বুকের এই শান্তিপূর্ণ রোমান্টিক শহর ইতালির ভেনিস নগরীতে ।
পরেরদিন সকালে হোটেল থেকে complimentary breakfast খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ভাসমান নগরীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে । ভেনিস নগরটি মূলত কতগুলো দ্বীপের সমষ্টি।

একটু এগোতেই বাদিকে চোখে পড়লো দিগন্তব্যাপী স্বচ্ছ নীলজলরাশির আড্রিয়াটিক সাগর । আর সেখান থেকেই বেড়িয়ে এসেছে এক বিরাট খাল যার নাম গ্র্যান্ড ক্যানেল যেটা এই ভাসমান নগরীকে দ্বিখণ্ডিত করেছে । আবার খালের দুই পাশকে সংযুক্ত করেছে অনেক চমৎকার সব সেতু। জলের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে বা ভেসে চলেছে অসংখ্য নৌকা , ভেনিসের জলযানের একটি আকর্ষণীয় রোমান্টিক জলযান গণ্ডোলা , water taxi ও water bus । আমরাও টিকিট কেটে উঠে পড়লাম এক water bus এ । আমাদের নিয়ে গ্র্যান্ড ক্যানেলের উপর দিয়ে ভেসে চললো water bus । হটাৎ Ambulance এর আওয়াজ শুনে সব জলযানগুলি মধ্য থেকে একটু সাইডে সরে গেল যাতে Ambulance এর যেতে কোন অসুবিধা না হয় । দেখলাম মাথায় নীল আলো লাগানো আওয়াজ করতে করতে একটি জলযান ছুটে চলে গেল । শহরে যেমন বাস স্টপেজ থাকে তেমনি জলের ওপর সারা শহর জুড়ে দেখলাম অনেকগুলো জলযান স্টপেজ যেখানে লোক জলযানে উঠছে বা নামছে । ভেনিসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সঙ্গী একমাত্র জলযান । ভেনিসে বসবাস করা প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা হলো নৌকা। বাড়ির ঘাটেই বাঁধা থাকে নিজস্ব নৌকা অথবা স্পিড বোট। মাকড়শার জালের মত পুরো ভেনিস জুড়ে চলে গেছে একেকটা সরু খাল। আর এইসব খালগুলি হল শহরের প্রাণশক্তি।পরিবহন, বাণিজ্য এবং পর্যটনের জন্য ব্যবহৃত হয় এইসব খালগুলি । Water bus এ করে যাতায়াতের পথে দেখতে পেলাম শহরের চোখ জুড়ানো রঙ, নকশা, স্থাপত্যশৈলীর। খালের দুইপাশ দিয়ে জলের উপর থেকে উঠে গেছে অসংখ্য বাড়ি ঘর ।জলের উপর দিয়ে যেতে যেতে চোখ আটকে গেল একটি জমকালো সেতুতে যার নাম শুনলাম দ্য রিয়াল্টো ব্রিজ । এই ব্রিজ প্রাচীনতম এবং এটি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিখ্যাতগুলির মধ্যে একটি । এই সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা করে যেতে খুব ভাল লাগছিল ।

সেতুর চারপাশ লোকে লোকারণ্য ছিল। তারপর একটু এগিয়ে জল থেকে ডাঙ্গায় উঠলাম ভেনিসের সবচেয়ে আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এক অত্যাশ্চর্য ক্যাথেড্রাল ১১ শতকের সেন্ট মার্কস ব্যাসিলিকা দেখতে ।

ক্যাথেড্রালটি তার বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের জন্য পরিচিত ।দেখলাম ভেনিসের আরেকটি বিখ্যাত আকর্ষণ ডোজের প্রাসাদ ,ভেনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি পেগি গুগেনহেইম যেটি ১৮ শতকের একটি অত্যাশ্চর্য প্রাসাদে অবস্থিত। ভেনিসে গিয়ে মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী থেকে লোকজন ভেনিসে এসে জড় হয়েছে । যেদিকে তাকাই মানুষের ভিড় । সারা ভেনিস জুড়ে রয়েছে অনেক ভাল ভাল জাদুঘর, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট
। খাবার মানও খুব ভাল । দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়লাম গন্ডোলা নিয়ে ছোট ছোট খাল দিয়ে শহর পরিক্রমা করতে । সামগ্রিকভাবে ভেনিস সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয় ভেনিস একটি শহর যার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। এটি এমন একটি শহর যা বিশ্বজুড়ে ভ্রমণকারীদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে এবং ইতালিতে ভ্রমণকারী সবার কাছে অবশ্যই ভেনিস হয়ে উঠবে একটি দর্শনীয় গন্তব্য। সারাদিন খুব আনন্দ করে রাত্রের ট্রেন ধরে চললাম ইতালির রাজধানী রোমে ।
আমাদের চোখে এস্তোনিয়ার পার্নু
১৭ই এপ্রিল থেকে ১৯শে এপ্রিল আমদের বউমাকে সুইডেন যেতে হবে অফিসের কাজে ।তাই ছেলে বলল যে চলো এই তিনদিন আমরাও ঘুরে আসি এস্তোনিয়ার পার্নু ও লাটভিয়া থেকে । এখন তো work from home , সুতরাং ও হোটেল থেকে অফিসের কাজ করে নেবে । আর আমরা পার্নুতে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াবো । বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমরা এক পায়ে খাঁড়া । ছেলে বলল বাড়ির থেকে গাড়ি নিয়ে যাবে । জাহাজে করে গাড়িও আমাদের সাথে বাল্টিক সাগর পার হবে ।তারপর পুরোটা গাড়ি করেই ঘুরবো । এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া রাশিয়ার একদম পাশে । 50 বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ছিল । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে এস্তোনিয়ার ও লাটভিয়া স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয় । এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিনে আমরা দু-দুবার গেছি , তাই এবার যাচ্ছি এস্তোনিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর পার্নুতে ।
১৬ তারিখ অর্থাৎ রবিবার দুপুর ১২ টায় খাওয়া দাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে আমরা চললাম জাহাজ ধরতে । দশ তলা জাহাজ । গাড়ি নিয়ে সিকিউরিটি চেক করিয়ে সোজা উঠে গেলাম জাহাজের চার তলায় । তারপর গাড়ি রেখে আমরা গেলাম আট তলায় । জাহাজ তো নয় একটা চলন্ত মল(Mall)।আমরা আট তলায় একটা কফি বারে গিয়ে বসলাম । সামনে উন্মুক্ত গালফ অফ ফিনল্যান্ড । আড়াই ঘণ্টার যাত্রা । এরকম জাহাজ আমরা আগে কয়েকবার চড়েছি । তাই আর বেশি কৌতুহল দেখালাম না । বিকাল সাড়ে পাঁচটায় জাহাজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিনে । যেহেতু তালিন আমাদের আগে দুবার ঘোরা হয়ে গেছে , তাই আমরা সোজা রওনা হলাম এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিন থেকে 128 কিলোমিটার দক্ষিণে এস্তোনিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর পার্নুর দিকে । পার্নু বাল্টিক সাগরের পূর্ব উপকূলে দক্ষিণ-পশ্চিম এস্তোনিয়ায় একটি মনোমুগ্ধকর উপকূলীয় শহর। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পার্নুর হোটেলে পৌছালাম ।তখনও সূর্যের আলো রয়েছে ।হোটেল থেকে বেড়িয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলাম একটা জর্জিয়া হোটেলে রাত্রের আহারের জন্য । ছোট শহর , বাইরে ঠাণ্ডা তখন ৮ ডিগ্রির মতো । তাই ধারণা করেছিলাম খুব বেশিক্ষণ শহরের হোটেল খোলা থাকবে না ।
পরেরদিন হোটেল থেকে complimentary breakfast খেয়ে আমরা দুজন বেড়িয়ে পড়লাম পায়ে হেটে হোটেলের কাছেই সমুদ্র সৈকতে । ছেলে হোটেলে বসে অফিসের কাজ করতে লাগলো । আর আমরা পৌঁছে গেলাম পার্নুর সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি পার্নুর সমুদ্র সৈকতে , যা শহরের উপকূল বরাবর কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।শান্ত সমুদ্র । বিশাল দিগন্ত জুড়ে স্বচ্ছ নীল জলরাশি ।

অনেকক্ষণ সৈকতে কাটিয়ে আমরা পায়ে হেটে শহর ঘুরতে বেরলাম । ছোট শহর, পায়ে হেটে সুন্দর ঘোরা যায় ।হাটতে হাটতে পৌঁছে গেলাম আধুনিক শহরের বাইরে পুরাতন বা মধ্যযুগীয় সময়ের শহর দেখতে যেটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ।

দেখলাম অনেক ঐতিহাসিক ভবন, জাদুঘর এবং গ্যালারী রয়েছে।রয়েছে অনেক রেস্টুরেন্ট , তার মধ্যে দেখলাম একটি নেপালি রেস্টুরেন্ট যেখানে ভারতীয় খাবারও পাওয়া যায় ।এখানে বিকেলের আলো অনেকক্ষণ পর্যন্ত থাকে । তাই ছেলেও অফিস সেরে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারলো ।আমরা তিনজন মিলে পার্নু শহরটাকে একবার পাক দিয়ে পৌঁছে গেলাম পার্নু নদীর তীরে । শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে পরিষ্কার পার্নু নদী যেটা শহরটাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে ।

কয়েক শতাব্দী ধরে পার্নু স্পা চিকিত্সার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান ।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক আকর্ষণ ছাড়াও, পার্নু সারা বছর জুড়ে অসংখ্য উৎসব এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যার মধ্যে রয়েছে পার্নু মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, পার্নু ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং পার্নু বিচ ভলিবল টুর্নামেন্ট।আগামীকাল যাব ইউরোপের আরেকটি দেশ লাটভিয়া ।
আমাদের চোখে জার্মানির মিউনিখ
আমার বড় ছেলে অভ্র গত 22/08/2023 তারিখ ভোরবেলা আমাদের নিয়ে চলল ইউরোপের আরও কতগুলি আকর্ষণীয় দেশ ঘোরাতে ।অফিসের ছুটির অভাবে আমা্দের বৌমা তিতলি যেতে পারলো না । আমরা তিনজন সকালের বিমানে হেলসিঙ্কি থেকে জার্মানির মিউনিখ শহরে এসে নামলাম । আমার ছোট ভাইয়ের ছোট ছেলে মিকি আমাদের সাথে মিউনিখে এসে আমাদের গ্রুপে জয়েন করলো । ও বর্তমানে জারমানিতে MS করছে । হোটেলে সব জিনিসপত্র রেখে আমরা চারজন চললাম মিউনিখ শহর পরিদর্শন করতে । মিউনখ শহরের দর্শনীয় স্থানগুলি মোটামুটি কাছাকাছি । পায়ে হেটেই সব দেখা যায় । মিউনিখ বা জার্মান ভাষায় München, জার্মানির বাভারিয়ার রাজধানী এবং জার্মানির তৃতীয় বৃহত্তম শহর। ব্যাভারিয়ান আল্পসের তীরে ইসার নদীর তীরে অবস্থিত।মিউনিখ তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিখ্যাত বিয়ার সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। ইতিহাস খ্যাত বা অখ্যাত নাজি আন্দোলনের সাথে সাথে হিটলারের উত্থান এই মিউনিখ শহর থেকেই । হিটলার যে বাড়িতে প্রথম সভা করেছিলেন এবং যে স্কোয়ারে লেকচার দিতেন সে জায়গাগুলো দেখতে দেখতে হিটলারের সময়কার বিভীষিকাময় ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠছিল । অবশ্য জার্মানির একটা সুন্দর গৌরবময় ইতিহাসও আছে যখন ইস্ট জার্মান আর ওয়েস্ট জার্মানের দুই দেশের জনগন বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই দেশকে এক করেছিল । আমরা পারবো না কারণ ধর্ম আমাদের অন্তরায় হবে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই শহরটাকে বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছিল, তবে এত সুন্দর পুনর্নির্মাণের কাজ হয়েছে যে আজ এটি জার্মানির অন্যতম পর্যটন শহর।আমরা প্রথমেই চলে গেলাম মারিয়েনপ্ল্যাটজ( Marienplatz ) যেটি মিউনিখের কেন্দ্রীয় স্কোয়ার এবং বিখ্যাত গ্লোকেনস্পিল সহ দুর্দান্ত নিউস রাথাউসের (নিউ টাউন হল) মতো ঐতিহাসিক ভবন দ্বারা বেষ্টিত ।

প্রতিদিন সকাল 11 টা, দুপুর 12 টা এবং বিকাল 5 টার সময় সবাই নিউস রাথাউসের সামনে বিখ্যাত গ্লোকেনস্পিল দেখার জন্য থামে, কারণ এর যান্ত্রিক চিত্রগুলি সামান্য কিছু সময়ের জন্য নাচ করে।আমাদের দেখারও সৌভাগ্য হয়েছিল ।

এর কাছেই রয়েছে 22000 স্কোয়ার মিটারের জনপ্রিয় খাবারের বাজার যার নাম ভিক্তোলিয়েনমার্কট ও আকাশচুম্বী সেন্ট পিটারস চার্চ যার উপর থেকে সারা মিউনিখ শহর আল্পস পর্বত সহ দারুণ সুন্দর দেখা যায় ।

মারিয়েনপ্ল্যাটজ আসার পথে দেখলাম 1733 থেকে 1746 মধ্যে তৈরি সেন্ট জোহান নেপোমুক যা আসাম চার্চ নামে পরিচিত । এছাড়া দেখলাম জার্মানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প জাদুঘর আল্টে পিনাকোথেক , কয়েকটি রাজকীয় প্রাসাদ এবং তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নিম্ফেনবার্গ প্রাসাদ যেটি চমত্কার উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত। এই বারোক প্রাসাদটি একসময় বাভারিয়ান শাসকদের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান ছিল। আরও দেখলাম বিশ্বের বৃহত্তম শহুরে উদ্যানগুলির মধ্যে একটি ইংলিশ গার্ডেন যার মধ্যে দেখলাম আইসবাচ নদীর উপর কৃত্রিম তরঙ্গে চড়ে সার্ফারদের কেরামতি ।

এছাড়া দেখলাম মিউনিখের সবচেয়ে আইকনিক ল্যান্ডমার্কগুলির মধ্যে একটি ফ্রুয়েনকির্চে, একটি অত্যাশ্চর্য গথিক ক্যাথেড্রাল যেখানে স্বতন্ত্র পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ রয়েছে যা শহরের আকাশরেখায় আধিপত্য বিস্তার করে। রাত্রে জার্মানির ঐতিহ্যবাহী বাভারিয়ান রন্ধনপ্রণালীর প্রেটজেল, সসেজ এবং সাউরক্রউটের মতো হৃদয়গ্রাহী খাবারের সাথে জার্মানির বিখ্যাত বিয়ারের স্বাদ গ্রহণ, আমাদের এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল । মিউনিখ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ওক্টোবারফেস্ট বা বিয়ার উৎসবের জন্মস্থান । এই প্রাচীন উৎসবের সূচনা হয় ১৮১০ সালে ।যারা বেড়াতে গিয়ে ভারতীয় খাবার খেতে চায় , তাদেরও কোন অসুবিধা নেই কারণ বেশ অনেককটা ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে এই মিউনিখ শহরে । দেড় দিনের মিউনিখ যাত্রা শেষ করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বাসে করে সুইজারল্যান্ড ।
আমাদের চোখে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস
25/08/2023 তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ আমরা তিনজন মানে আমি , আমার স্ত্রী লিপিকা ও আমদের বড় ছেলে অভ্র জুরিখ থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে প্যারিস পৌঁছলাম রাত সাড়ে দশটা নাগাদ । বিশাল চারতলা রেলওয়ে ষ্টেশন । বাইরে বেড়িয়ে দেখি আমাদের এখানকার মতো ট্যাক্সিতে বিরাট লম্বা লাইন । তাই অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেলাম রাস্তার দিকে । ওখান থেকে ওবার নিয়ে সোজা হোটেল ।শুনেছিলাম প্যারিসে খুব গরম হবে কিন্তু প্যারিসের আবহাওয়া ছিল ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ।হোটেলের চারতলার ঘরে ঢুকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি দূরে আইফেল টাওয়ার দেখা যাচ্ছে । মনটা ভড়ে গেল । প্যারিস বা পারি ফ্রান্সের রাজধানী। শহরটি উত্তর ফ্রান্সে ইল-দ্য-ফ্রঁস অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে সেইন(Seine) নদীর তীরে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে হোটেলের কাছ থেকে মেট্রো ধরে সোজা চলে গেলাম পুরানো ফ্রান্সে ল্যাটিন কোয়ার্টারে অবস্থিত প্যান্থিয়ান(Panthéon)দেখতে । 1885 সাল থেকে এটি মহান লেখক, বিজ্ঞানী, জেনারেলদের জন্য শেষ বিশ্রামস্থল।অনেকটা রোমের সেন্ট পিঁটারসের আদলে তৈরি । অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত । তারপর ইকল ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে পৌছালাম আমাদের ছোটবেলায় পড়া ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত বই – The Hunchback of Notre Dame এর নোত্র্ দাম দ্য পারিতে । গথিক ডিজাইনের নোত্র্ দাম দ্য পারি ক্যাথেড্রাল প্যারিস শহর এবং ফরাসি জাতির একটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত প্রতীক। 1805 সালে, এটি একটি ব্যাসিলিকা হিসাবে সম্মানসূচক মর্যাদা লাভ করে। 15 এপ্রিল 2019 তারিখে এখানে আগুন লেগে ক্যাথেড্রালের চূড়াটি ভেঙে পড়েছিল। তাই রিপেয়ার হওয়ার কারণ এর ভিতর এখন ঢুকতে দেয় না । তারপর একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম চ্যাপেল চার্চ ।ওখান থেকে একটু হেঁটে সেইন নদীর পাশ দিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলাম 171 ফুট উঁচু সেন্ট-জ্যাকস(Saint-Jacques) চার্চের অবশিষ্টাংশ গথিক টাওয়ারটি দেখতে যা 1797 সালে ধ্বংস করা হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়ে , শুধুমাত্র টাওয়ারটা রেখে । তারপর বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প জাদুঘর ও প্যারিসের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন স্থান ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে ঢুকলাম । আমাদের আগে থেকে টিকিট কাটা ছিল । তাই আর বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হয়নি । একটি সুন্দর কাঁচের পিরামিডের প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়ে 73,000-বর্গ-মিটারের প্রদর্শনী স্থানটি তিনটি বিভাগে বিভক্ত- ডেনন, রিচেলিউ এবং সুলি উইংস। এই অপূর্ব ভবনটি একসময় ফরাসী রাজাদের প্রাসাদ ছিল। প্রতিটি উইংয়ে প্রায় 70টি কক্ষ রয়েছে যেখানে চিত্রকর্ম এবং শিল্প সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়েছে । সিকিউরিটি চেকের পর মিউজিয়ামের প্রবেশ করেই ছুটলাম লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মাস্টারপিস মোনালিসার পেইন্টিং (estimated to be worth $790 million or Rs 6539 crore) দেখতে । একদম সামনে থেকে মোনালিসার এই রেনেসাঁ পেইন্টিং দেখে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম । আরও দেখলাম বিখ্যাত অন্যান্য শিল্পকর্মের মধ্যে হাম্মুরাবির সংহিতা, মাইকেলেঞ্জেলোর ভেনাস ডি মিলো এবং দ্য ডাইং স্লেভ, মিশরীয় পুরাকীর্তি এবং রেমব্রান্ট এবং রুবেনসের ছবি মনে হচ্ছিল আধুনিক এবং ধ্রুপদী উপাদানের মিশ্রণ দেখছি । ঐ বিশাল প্রাসাদের সব ভালমতো দেখতে মিনিমাম তিন-চার দিন লাগা উচিৎ ।দেখতে দেখতে অনেক সময় হয়ে গেল তাই ফিরে আসলাম হোটেলে ।

পরেরদিন সকাল সকাল মেট্রো করে গেলাম প্যারিসের অন্যতম আইকনিক ল্যান্ডমার্ক আইফেল টাওয়ার দেখতে । 1889 এক্সপোজিশন ইউনিভার্সেলের জন্য গুস্তাভ আইফেল দ্বারা নির্মিত 1,083 ফুট উঁচু পেটা-লোহার জালির টাওয়ারটি প্যারিসের একটি স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ দর্শককে আকর্ষণ করে।


রাত্রে আলোয় আইফেল টাওয়ার দেখার আমাদের টিকিট কাটা থাকাতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা চললাম আমাদের ইন্ডিয়া গেটের মতো প্যারিসের তথা ফ্রান্সের একটি বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ আর্ক দ্য ত্রিয়োম্ফ (Arc de triomphe) দেখতে ।তারপর হাটতে হাটতে কাছেই এম্বাপে যে ক্লাবে ফুটবল খেলে তাদেরই একটা স্টোরে ঢুকলাম । দেখলাম প্লেয়ারদের অনেককিছু রাখা আছে । ওখান থেকে কিছুটা এগিয়ে পৌছালাম পালে গার্নিয়ে(Palais Garnier) প্যারিসের একটি গীতিনাট্যশালা যেটি প্যারিসের স্থাপত্যকলার একটি অপূর্ব নিদর্শন।

ওর কাছেই দেখলাম বিশাল বিশাল সব প্রাসাদ ও উদ্যান যার মধ্যে রয়েছে জার্দাঁ দু লুক্সমবুর , Tuileries গার্ডেন। তারপর আমাদের গন্তব্য ছোট পাহাড়ের ওপরে 1875 সালের একটি রোমান ক্যাথলিক গির্জা যার নাম Sacré-Cœur ব্যাসিলিকা । একটা কেবিল কারে করে উঠে গেলাম ব্যাসিলিকার কাছে।আমাদের কাছে মেট্রোর টিকিট ছিল তাই কোন চার্জ লাগলো না । উপর থেকে সারা প্যারিস শহর খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছিল ।বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে ফ্রান্সের প্রিয় খাবার ক্রেপ ( Crepe)ও ম্যাকারন (Macarons) খেয়ে ছেলে আমাদের নিয়ে চলল সেইন নদীর ধারে ক্রুজে করে প্যারিস শহরটা প্রদক্ষিণ করাতে । ক্রুজের ছাদে বসে প্রতিটা দর্শনীয় স্থাপত্যের ইতিহাস শুনতে শুনতে নদী পথে আবার প্যারিসকে ভালভাবে দেখে ফিরে আসলাম আইফেল টাওয়ারের সামনে । রাতের আলোয় আলোকউজ্জল আইফেল টাওয়ারের উপর থেকে আলোর শহর বা ভালবাসার শহর প্যারিসকে প্রান ভড়ে দেখা । প্রায় আড়াই ঘণ্টা আইফেল টাওয়ারের উপর কাটিয়ে প্রচুর স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসলাম হোটেলে । পরের দিন আমাদের গন্তব্য বেলজিয়ামের ব্রাসেল ।
আমাদের চোখে বেলজিয়াম

28/08/2023 তারিখ সকাল সকাল ট্রেনে আমরা তিনজন রওনা হয়ে গেলাম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেল। দু ঘণ্টার মতো জার্নি । ব্রাসেল স্টেশনের কাছেই আমাদের হোটেল আর তার আশে পাশেই সব টুরিস্ট স্পট । বেলজিয়াম ইউরোপের ক্ষুদ্রতম ও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির একটি। এটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। বেলজিয়াম ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্রাসেল শহরটি বেলজিয়ামের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইউরোপীয় কমিশন, ন্যাটো এবং বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সদর দপ্তর ব্রাসেল্স-এ অবস্থিত।এটি টিনটিন এবং দ্য স্মারফসের মতো বিখ্যাত কমিক্সের জন্মস্থান। হোটেলে লাগেজ রেখে প্রথমেই চলে গেলাম একটু হেঁটে ব্রাসেলসের সবচেয়ে আইকনিক ল্যান্ডমার্কগুলির মধ্যে একটি গ্র্যান্ড প্লেসে । এটি একটি চমত্কার কেন্দ্রীয় স্কোয়ার যা ঐশ্বর্যশালী ভবন দ্বারা বেষ্টিত। গ্র্যান্ড প্লেস হল ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর স্কোয়ারগুলির মধ্যে একটি । স্কোয়ারটি 17 শতকের অত্যাশ্চর্য স্থাপত্যে সুশোভিত, যার মধ্যে রয়েছে সিটি হল এবং গিল্ডহল । গ্র্যান্ড প্লেসকে কেন্দ্র করেই ব্রাসেলসের সবচেয়ে বড় বাজার গড়ে উঠেছে। আড্ডা হোক কিংবা রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি, সবকিছুই অনুষ্ঠিত হয় ব্রাসেলসের এই প্রাণকেন্দ্রে।

৯৬ মিটার উঁচু ব্রাবানটাইন গোথিক টাওয়ারের এখানকার টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৪০২ সালে।হাতে অনেকটা সময় থাকাতে ছেলের উৎসাহে আমরা আবার ট্রেনে করে চললাম ব্রাসেল থেকে কিছুটা দূরে পশ্চিম ফ্ল্যান্ডার্স প্রদেশের রাজধানী ব্রুজেস (Brugge) শহরে । বেলজিয়ামের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত, এই মনোরম মধ্যযুগীয় শহরটি তার সু-সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্থাপত্য, মনোরম খাল এবং সুন্দর নির্মল পরিবেশের জন্য বিখ্যাত যা পর্যটকদের অনেকদিন ধরেই আকর্ষণ করে নিয়ে আসছে । ব্রুজকে প্রায়ই “উত্তরের ভেনিস” বলা হয়।

এখানে অনেক নাম করা সিনেমার শুটিং হয়েছে । তার মধ্যে রয়েছে হ্যারি পটার ও বলিউডের আমির খানের পিকে । অনুস্কা শর্মা ও সুশান্ত সিং রাজপুতের অনেকটা অংশের শুটিং এখানে হয়েছে । এখানে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে বেলফ্রি অফ ব্রুজস, দ্য ব্যাসিলিকা অফ দ্য হলি ব্লাড, এবং চার্চ অফ আওয়ার লেডি এর বিখ্যাত মাইকেলেঞ্জেলো ভাস্কর্য, ম্যাডোনা এবং চাইল্ড৷ব্রুজে অনেকক্ষণ কাটিয়ে আবার ফিরে আসলাম ব্রাসেলে ।তারপর একে একে দেখলাম – বাদ্যযন্ত্র যাদুঘর হল ( Musical Instruments Museum) , রয়্যাল সেন্ট-হুবার্ট গ্যালারী( Royal Gallery of Saint Hubert) , সেন্ট মাইকেল এবং সেন্ট গুদুলা ক্যাথেড্রাল(St Michael and St Gudula Cathedral), রয়্যাল প্যালেস অফ ব্রাসেলস হল(Royal Palace of Brussels), টিনটিন কমিক স্টোর ও নেপোলিয়নের তৈরি ‘দ্য মিউজিয়াম অব এনশিয়েন্ট আর্ট’ ।
বেলজিয়ান রন্ধনপ্রণালীর ওয়াফেলস, চকোলেট ও বেলজিয়াম ফ্রাই ( যার উৎপত্তি বেলজিয়ামে যা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামে প্রসিদ্ধ কারণ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা বেলজিয়ামে এই আলুর ফ্রাই খাওয়ার সময় ফ্রেঞ্চ কথা শুনে এর নাম দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ) স্বাদ গ্রহণ না করলে বেলজিয়াম ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তাই পরেরদিন এসবের স্বাদ গ্রহণ করে আমরা রওনা দিলাম আকাশপথে আমার ছেলের বাড়ি হেলসিঙ্কি ।ইউরোপের মধ্যে এতোগুলো দেশ ঘুরলাম কোথাও পাসপোর্ট দেখতে চাইলো না আর বুঝতেই পারলাম না যে অন্য দেশের মধ্যে ঢুকে গেছি । না জানলে মনে হতো একটা দেশের মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছি ।
আমাদের চোখে লাটভিয়ার রাজধানী রিগা
১৮/০৪/২০২৩ তারিখ আমরা হোটেল থেকে complimentary breakfast খেয়ে সকাল নটায় গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম ১৮৪ কিমি দূরে লাটভিয়ার রাজধানী রিগার উদ্দেশ্যে । রিগা বাল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত বাল্টিক অঞ্চলের বৃহত্তম শহর আর রাশিয়ার একদম পাশে । লাটভিয়া বিভিন্ন সময়ে সুইডিশ , পোল্যান্ড , জার্মানি ও রুশদের দ্বারা শাসিত হয় । তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে লাটভিয়া একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের রাষ্ট্রে পরিণত হয় ।
আমরা আড়াই ঘণ্টা পর রিগা শহরে ঢোকার মুখেই পেলাম একটা বড় নদী যার নাম শুনলাম Daugava (Western Dvina) River । বেশ চওড়া নদী পরিষ্কার জলে ভরা ।

নদী পেরিয়ে প্রথমেই পৌঁছে গেলাম রিগার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর ওল্ড টাউন, যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ওল্ড টাউন হল একটি গোলকধাঁধা সরু রাস্তা যার পাশে পাশে রয়েছে রঙিন মধ্যযুগীয় সময়কালের দালানকোঠা । ওল্ড টাউনের স্থাপত্য শৈলীগুলি হল গথিক, বারোক এবং আর্ট নুওয়াউর মিশ্রণ।

তারপর গেলাম ঐ পুরাতন শহরেই দ্য হাউস অফ দ্য ব্ল্যাকহেডস দেখতে।এটি এখন জাদুঘর । এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের বোমার আঘাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছিল। এটাকে আবার পুনর্নির্মিত করা হয় ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ এর মধ্যে । এখন এটা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত । বেশ কিছুক্ষণ পুরাতন শহরে কাটিয়ে রিগার আরও অনেক আকর্ষণীয় স্থান যেমন রিগা ক্যাথেড্রাল, সেন্ট পিটার চার্চ এবং স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে আসলাম ।তারপর আসলাম এখানকার শহরের সেন্ট্রাল মার্কেট দেখতে যেটা ইউরোপের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বাজারগুলির মধ্যে একটি।শহরটার চারিদিকে এলোপাথাড়ি ঘুরে লিডো ( LIDO )নামে একটা খুব বড় ও সুন্দর রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম । অনেকগুলো কাউন্টারে নানা রকমের খাবার সাজানো । প্রত্যেক কাউন্টারে লোক রয়েছে খাবার, প্লেটে তূলে দেওয়ার জন্য । আমরা এক জায়গা থেকে প্লেট নিয়ে বিভিন্ন কাউন্টারে গিয়ে আমাদের পছন্দের খাবার তূলে দিতে বললাম । বিভিন্ন কাউন্টার থেকে আমাদের পছন্দের খাবার নিয়ে আমরা গেলাম পেমেন্ট কাউন্টারে । ওখানে দাম দিয়ে একটা টেবিল চেয়ার দখল করে খেতে বসলাম । আমি নিয়েছিলাম চারটে ছোট ব্রেড , একটা চিকেন কাটলেট । ছটা ছোট ছোট গ্রিল চিকেন , একটু আলুভাজা আর স্যালাদ । দারুন টেস্ট। রিগা থেকে পার্নু ফিরে আসার পথে লাটভিয়ারই আরও দুটো জায়গা তুরাইদা ও সিগুলদা- তে চলে গেছিলাম । তুরাইদা ক্যাসেল হল কুর্জেমে থেকে গাউজা নদীর বিপরীত তীরে লাটভিয়ার ভিডজেমে অঞ্চলের সম্প্রতি পুনর্নির্মিত একটি মধ্যযুগীয় দুর্গ। আর সিগুলদা হল লাটভিয়ার ভিডজেমে অঞ্চলের একটি শহর, রাজধানী শহর রিগা থেকে 53 কিলোমিটার দূরে।তারপর ওখান থেকে ফিরে আসলাম আবার এস্তোনিয়ার পার্নুতে, পরেরদিন হেলসিঙ্কি ফিরবো বলে । সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে রিগা একটি প্রাণবন্ত এবং উত্তেজনাপূর্ণ শহর । এর সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এটিকে পর্যটক এবং প্রবাসীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে । খুব সুন্দর একটা ভ্রমণ সারাজীবন আমাদের স্মৃতিকোটায় রয়ে গেল ।
আমাদের চোখে সুইজারল্যান্ড
আমি , আমার স্ত্রী লিপিকা ও আমার বড় ছেলে অভ্র 23/08/23 তারিখ দুপুর বেলা বাসে করে মিউনিখ থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ অভিমুখে রওনা দিলাম ।এয়ার কন্ডিশন দোতালা সুন্দর বাস, ভালই স্পীডে ছুটে চলছিল মিউনিখের গ্রাম শহর পেড়িয়ে । বেশ অনেকটা যাওয়ার পর দেখি আমাদের সামনে কোন রাস্তা বা ব্রিজ নেই, রয়েছে একটা বিশাল লেক । শুনলাম লেকটার নাম কনস্ট্যানজে(Constanze) ।আরও অনেক গাড়ীর সাথে আমাদের বাসটাও যাত্রী সমেত উঠে পড়লো বিশাল বড় একটা বোটের ওপর ।ঐ বোটে ওপারে নেমে আবার রাস্তা ধরে আমরা এসে পৌছালাম জুরিখ বাসস্ট্যান্ড । সাড়ে চার ঘণ্টা মতো সময় লাগলো । বাসস্ট্যান্ডের কাছেই রেলওয়ে ষ্টেশন । আমরা ট্রেন ধরে পৌছালাম জুরিখ এয়ারপোর্ট ।ওখান থেকে গাড়ী নিয়ে নিজেরাই ড্রাইভ করে চললাম সুইজারল্যান্ডের এক সুন্দর পাহাড়ি উপত্যকার লুসার্ন শহরে । লুসার্নে আমাদের হোটেলে পৌছাতে এক ঘণ্টা মতো লাগলো । সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল এর দর্শনীয় আলপাইন দৃশ্যাবলী। সুইস আল্পস দেশের দক্ষিণ অংশে আধিপত্য বিস্তার করে, যেখানে রাজকীয় তুষার-ঢাকা চূড়া, মনোরম উপত্যকা এবং স্ফটিক-স্বচ্ছ হ্রদ রয়েছে।

আমরাও সকাল সকাল গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আল্পসের রাজকীয় তুষার-ঢাকা চূড়া, মনোরম উপত্যকা উপভোগ করতে । আমাদের গন্তব্য ছিল পাহাড়ের 9744 ফুট ওপর শিলথর্ন(Schilthorn), যেখান থেকে 360 ডিগ্রীতে আল্পসের সমস্ত রাজকীয় তুষার-ঢাকা চূড়াগুলো দেখা যায় । আমাদের গাড়ী ছুটে চলল কখনও স্ফটিক-স্বচ্ছ লেকের পাশ দিয়ে , কখনও আবার দুপাশের সবুজ মনোরম উপত্যকার মধ্য দিয়ে , গ্রাম , শহর পেড়িয়ে মুড়েন গ্রামের কাছে যেখান থেকে কেবিল কারে করে তিনবার ধাপে ধাপে উঠতে হবে 9744 ফুট পাহাড়ের ওপরে । এত stiff ও এত উঁচু কেবিল কার রাইড আমি কোথাও দেখিনি । জেমস বন্ডের বেশ কয়েকটা সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে । শিলথর্নে পৌঁছে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আল্পসের সবকটা পিক আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে – শিঙ্গেলহর্ন(Tschingelhorn) , ব্রেথর্ন ( Breithorn) , জংফ্রাউ(Jungfrau) , মঞ্চ(Monch) , আইগার(Eiger) , শ্রেকহর্ন(Schreckhorn) , ওয়েটারহর্ন (Wetterhorn) ও শোয়ার্জহর্ন(Schwarzhorn) । পাহাড়ের মাথায় উঠে চারপাশে এইসব তুষারে ঢাকা চুড়াগুলো সামনে থেকে দেখা – এ এক অপরূপ অনুভূতি ।মনে হয় সবকিছু ভুলে পৃথিবীর এই সুন্দর রূপ প্রাণভরে উপভোগ করি ।

কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা নেমে আসলাম ইন্টারলেকেন যে জায়গার রাস্তাগুলি বলিউডের রোমান্টিক ছবির স্মৃতিতে ভরা। যশ চোপড়া এই ইন্টারলেকেনের এখনও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর,ওনার মূর্তি আছে এখানে ।এখানে দুটো সুন্দর লেক আছে ও বড় একটা সুন্দর পার্ক আছে । অনেক ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে । তারপর ইন্টারলেকেন থেকে আমরা এক ঘণ্টা জার্নি করে আসলাম লুসার্ন ।এসেই চলে গেলাম 170 মিটার লম্বা চ্যাপেল ব্রিজ দেখতে যেটা একটি কাঠের আচ্ছাদিত পথচারী সেতু , লুসার্ন শহরের রিউস নদীর উপর বিস্তৃত। এটি 1333 সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ইউরোপের প্রাচীনতম কাঠের সেতুগুলির মধ্যে একটি।হঠাৎই ছেলে দেখতে পেল রাস্তার ওপর চলা টয়ট্রেন শহর ঘুরে দেখাচ্ছে । সাথে সাথে আমরাও চললাম টয়ট্রেনের করে এই সুন্দর পাহাড়ি শহর ঘুরতে ।এক ঘণ্টার রাইড আর সঙ্গে গাইড, আর কি চাই ।ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ি শহরটা ঘুরে, বেশ কিছুক্ষণ লেকের ধারে বেঞ্চে বসে রইলাম । ঠাণ্ডা নেই তাই প্রচুর লোকের ভিড় এই পরিষ্কার লেকের ধারে । পরেরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে আমরা রওনা হলাম জুরিখ শহর যা সুইজারল্যান্ডের আর্থিক ও ব্যবসায়িক রাজধানী । শহরটি জুরিখ নদী দ্বারা ওল্ড টাউন এবং নিউ টাউনে বিভক্ত। আমাদের সাথে গাড়ী ছিল আর হাতে সময় ছিল অনেক কেননা সন্ধ্যাবেলা জুরিখ থেকে আমাদের প্যারিস যাওয়ার ট্রেন । একে একে দেখলাম জুরিখ লেক , জুরিখের একমাত্র বারোক চার্চ সেন্ট পিটার্স চার্চ, শতাব্দী-পুরনো গীর্জা, রেনেসাঁ যুগের রাস্তা , গ্রস মুনস্টার- একটি সুন্দর রোমানেস্ক প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ । সুইস রন্ধনপ্রণালী বৈচিত্র্যময় এবং প্রতিবেশী দেশগুলির দ্বারা প্রভাবিত। ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে ফন্ডু, রেকলেট, রোস্টি (একটি সুইস আলুর খাবার) । খাওয়া দাওয়া সেরে আবার বেড়িয়ে পড়লাম ঘুরতে । অপেরা হাউস , জাদুঘর , ইভানজেলিকাল গির্জা দেখে শহরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে আসলাম জুরিখ এয়ারপোর্ট যেখানে আমাদের গাড়ী জমা দিতে হবে । এবার ট্রেনে করে ফ্রান্সের প্যারিস যাওয়ার পালা ।

আমাদের চোখে ভ্যাটিকান সিটি/ Vatican City through our lens
07/04/2023 রাতের ট্রেনে করে আমরা চারজন ভোর থাকতেই এসে পৌছালাম ইতালির রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর রোমে । সোজা চলে গেলাম হোটেলে । যেহেতু আমাদের ভ্যাটিকান সিটিতে গাইডেড ট্যুর বুক করা ছিল দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে , তাই ভালমতো ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলাম তিবের নদীর পশ্চিম তীরে ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার সামনে যেটা বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে অলঙ্কৃত গির্জাগুলির মধ্যে একটি।

দিল্লীর রাজপথের অনেক দূর থেকে যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি ভবন দেখা যায় , ঠিক তেমনি অনেকদুর থেকে দেখা যায় সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । পুরো ভ্যাটিকান সিটি একটা উঁচু পাচিল( আমাদের আলিপুর জেলের পাঁচিল থেকেও অনেক উঁচু ) দিয়ে ঘেরা ।
আগে থেকে যেহেতু আমাদের ভ্যাটিকান সিটির গাইডেড ট্যুরের টিকিট কাটা ছিল , তাই আর আমাদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াতে হল না ।সিকিউরিটি চেক করে ভ্যাটিকান সিটির ভিতর প্রবেশ করলাম । গাইডেড ট্যুর ছাড়াও ভ্যাটিকান সিটির ভিতরটা দেখা যায় । তবে গ্রুপ গাইডেড ট্যুর নিলে সবকিছু ভালমতো বোঝা যায় ।ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের সংগ্রহে 70,000 টিরও বেশি পেইন্টিং এবং ভাস্কর্য রয়েছে, যা 54 টিরও বেশি গ্যালারিতে বিশিষ্টভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে । সবচেয়ে বড় কথা এখানে অপূর্ব সুন্দর ক্লাসিক্যাল ভাস্কর্য, ট্যাপেস্ট্রি এবং রেনেসাঁর মহান ব্যক্তিদের যেমন রাফেল, ক্যারাভাজিও, মাইকেলেঞ্জেলো, বার্নিনি এবং দা ভিঞ্চির আঁকা দারুন সব ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে যা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার ।

ভ্যাটিকানের আরেকটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক হল সিস্টিন চ্যাপেল, যা ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের মধ্যে অবস্থিত। সিস্টিন চ্যাপেল তার অত্যাশ্চর্য দেওয়াল চিত্রের জন্য পরিচিত, যার মধ্যে মিকেলেঞ্জেলোর বিখ্যাত সিলিং পেইন্টিং এর ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম রয়েছে।আমাদের দুঘণ্টার গাইডেড ট্যুর শেষ করে আমরা কিছুক্ষণ অপূর্ব সুন্দর ভ্যাটিকান গার্ডেনের মধ্যে সময় কাটিয়ে বেড়িয়ে আসলাম পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ যার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ছাড়াও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কেন্দ্র। ভ্যাটিকানের সারা বিশ্বের দেশগুলির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।দরজা দিয়ে বেড়িয়ে আসতেই পা রাখলাম ইতালির রাজধানী রোমের মাটিতে যার বর্ণনা দেবো আমাদের পরবর্তী লেখনী ‘ আমাদের চোখে রোমে’।
ভ্যাটিকান সিটি হল একটি স্বাধীন শহর-রাষ্ট্র যা ইতালির রোম শহরের মধ্যে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ, মাত্র 44 হেক্টর এলাকা জুড়ে। ভ্যাটিকান ক্যাথলিক চার্চের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র এবং এখানে পোপের বাড়ি, যিনি ক্যাথলিক চার্চের নেতা। ভ্যাটিকান সিটি নগররাষ্ট্রটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয় কিন্তু সেনজেন ভিসায় যাওয়া যায় । তবে এই দেশ ২০০৪ সাল থেকে ইউরোকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করেছে আর এর অফিশিয়াল ভাষা হচ্ছে লাতিন।
আমাদের চোখে ইতালির রাজধানী রোম / Rome through our lens
এর আগের লেখা ‘আমাদের চোখে ভ্যাটিকান সিটি’তে লিখেছি যে 07/04/2023 তারিখ আমরা ভেনিস থেকে ভোরে রোমে এসে পৌঁছেছিলাম । রোম হল ইতালির রাজধানী শহর এবং বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিকভাবে উল্লেখযোগ্য শহরগুলির মধ্যে একটি। প্রথমে চলে গেছিলাম ভ্যাটিকান সিটি দেখতে । ভ্যাটিকান সিটির সুন্দর স্মৃতি নিয়ে দুপুরবেলা ভ্যাটিকান সিটি থেকে বেড়িয়ে আহার সেরে আমরা হেটে হেটে চলে গেলাম তিবের নদীর পাশে ক্যাস্টেল সান্ট’অ্যাঞ্জেলো (Castel Sant’Angelo)দেখতে । একসময় পোপরা এটাকে দুর্গ হিসাবে ব্যবহার করেছিল । এখন এটি একটি জাদুঘর । কাঠামোটি একসময় রোমের সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল। তারপর নদীর পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে পৌঁছে গেলাম Piazza del Popolo যার আধুনিক ইতালীয় ভাষায় নামটির আক্ষরিক অর্থ “পিপলস স্কোয়ার” । এটি রোমের একটি বড় শহুরে চত্বর । তারপর রোমের প্রধান শপিং স্ট্রিট যা সমগ্র ইতালি জুড়ে কেনাকাটার জন্য সেরা জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয়, সেই রাস্তা ধরে আমরা গিয়ে পৌছালাম বিখ্যাত ট্র্যাভি ফাউন্টেন ( Trevi fountain) । ট্র্যাভি ফাউন্টেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ঝর্ণাগুলোর একটি। এটি 1762 সালে সম্পন্ন হয়েছিল। এর কেন্দ্রে সমুদ্রের রোমান দেবতা নেপচুনের একটি বড় মূর্তি রয়েছে। ট্র্যাভি ফাউন্টেন তার জাঁকজমক এবং সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত তাই ট্র্যাভি ফাউন্টেন ঘিরে বিভিন্ন দেশের লোক এসে ভিড় করে । কর্ণাটক থেকে আসা এক পরিবারের সাথে পরিচয় হল এই ট্র্যাভি ফাউন্টেনে । যেহেতু রোমান সাম্রাজ্যের অনেকগুলি স্মৃতিসৌধ দেখা আমাদের এখনও বাকি আছে তাই আবার বেড়িয়ে পড়লাম ট্র্যাভি ফাউন্টেনকে পিছনে রেখে । সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক রোমান স্থাপত্য । এরপর আমরা গিয়ে পৌছালাম স্প্যানিশ স্টেপসে (Spanish Steps)। স্প্যানিশ স্টেপস হল রোমের একটি জনপ্রিয় গন্তব্য যেখানে একটি অনিয়মিত প্রজাপতির মতো প্যাটার্নে সাজানো 135-পদক্ষেপের সিঁড়ি। স্প্যানিশ স্টেপস স্থানীয় সঙ্গীতজ্ঞ, ফটোগ্রাফার এবং শিল্পীদের সাথে একত্রিত হওয়ার এবং মিশে যাওয়ার জন্য একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট।এবার ডিনার করার পালা এবং লিপিকার খুব ভারতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা । ছেলে ও বৌমা খুজে নিল ভারতীয় রেস্তোরাঁ ‘ গান্ধী ২’। রাতের আহার ওখানে সেরে ফিরে আসলাম হোটেলে ।
পরের দিন অর্থাৎ ০৮/০৪/২০২৩ ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম রোমান ফোরাম ( Roman forum ) দেখতে । টিকিট দেখিয়ে সিকিউরিটি চেক করিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল প্রাচীন রোমের অনেক সরকারি স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ।

এটি তদানীন্তন রোমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এর অবস্থান কাপিতোলিনো পর্বত এবং পালাতিনোর মাঝামাঝি একটি নিম্নভূমিতে। ভিতরে জাদুঘরও আছে । অনেকটা নালন্দার মতো। ভালভাবে দেখতে বেশ অনেকটা সময় লাগে । ওর পাশেই পাহাড়ের ওপরে রয়েছে বিখ্যাত ‘সেভেন হিলস অফ রোমের’ মধ্যে সবচেয়ে উঁচু প্যালাটাইন হিল( Palatine Hill ) । এখানে প্রাচীনকালে উচ্চ রোমান সমাজের জন্য তৈরি করা প্রাসাদ এবং স্থানগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় । প্যালাটাইন হিল থেকে নামতেই পৌঁছে গেলাম রোমের সবচেয়ে বিখ্যাত আকর্ষণীয় ল্যান্ডমার্কগুলির মধ্যে একটি, কলোসিয়ামে (Colosseum )।

কলোসিয়াম হল একটি বৃহৎ উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ যা বিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত কাঠামোগুলির মধ্যে একটি। ৬৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন দুই হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিল এই মঞ্চ। এখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের একে অপরের সঙ্গে বা বন্য প্রাণীদের সাথে লড়াই করতে হত যেটা অন্যরা উপভোগ করতো । কলোসিয়াম দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল স্পার্টাকাস নামে একজন থ্রেসিয়ান গ্ল্যাডিয়েটর কথা যিনি রোমে দাস বিদ্রোহের সময় হাজার হাজার ক্রীতদাসের একটি সেনাবাহিনীকে কমান্ড করেছিলেন। এরপর একটু হেটে পৌঁছে গেলাম নাম পিয়াজা ভেনেজিয়া বা ভেনিস স্কোয়ার যেটা রোমের একটি স্কোয়ার যেখানে চারটি প্রধান রাস্তা এসে মিশেছে । পিয়াজা ভেনেজিয়া ক্যাপিটোলিন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। 1455 সালে এর নির্মাণ শুরু হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয় সরকার এই প্রাসাদটি দখল করে নেয়। এর উল্টোদিকে দেখলাম রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন ও জুলিয়াস সিজারের মূর্তি । এরপর আরেকটু হেটে পৌঁছে গেলাম প্যানথিয়ন( Pantheon )যেটা 126 খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি চিত্তাকর্ষক গম্বুজের জন্য পরিচিত যা এখনও বিশ্বের বৃহত্তম অনাবৃত কংক্রিট গম্বুজ। এটি এখন একটি ক্যাথলিক গির্জা এর ভিতরে পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী রাফেলের কবর রয়েছে । এর পর আমরা গেলাম পিয়াজা নাভোনা ( Piazza Navona) যেটা রোমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাণবন্ত স্কোয়ার যেখানে অনেক স্ট্রিট পারফর্মার, ক্যাফে এবং টেরেস রয়েছে। আজকের মতো পর্যটনে ইতি টানার আগে চলে গেলাম রাত্রের আহার করতে সারাভানাতে দক্ষিণ ভারতীয়খাবার খেতে । যদিও রোমান সাম্রাজ্যের বিকাশের হাজার হাজার বছর হয়ে গেছে, তবুও আমরা আমাদের শিল্প, স্থাপত্য, প্রযুক্তি, সাহিত্য, ভাষা এবং আইনে এর প্রমাণ এখনও দেখতে পাই। তাই বোধহয় এই শহরকে বলে চিরন্তন শহর ।এই ইতালির ভ্রমনে আমাদের Super-fast ট্রেনে চড়ার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হল যার স্পীড ছিল ৩০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা ।

Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos