ইজিচেয়ারে বসে একা একা স্মৃতি রোমন্থন করতে খুব ভাল লাগছিল । মনে পরছিল আমাদের শহরের আমার পরিচিত বয়স্কা মহিলাদের এক অসাধারণ বন্ধুত্বের গল্প যা অনেক মানুষকে করেছিল অনুপ্রানিত । সেদিন সন্ধাবেলা যখন সপ্তপর্ণীর প্রদর্শনী স্থলে পৌছালাম তখনই অনুষ্ঠান শুরু হোল। একজন বয়স্কা মহিলা আবেগপূর্ণ গলায় খুবই সাবলীলভাবে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন ।
-“ নমস্কার, আজকের এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় , সপ্তপর্ণীর পক্ষ থেকে উপস্থিত সকল শুভানুধ্যায়ীদের জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন । আপনারা যে আপনাদের অমুল্য সময় থেকে আমাদের জন্য কিছুটা সময় ব্যয় করতে এসেছেন তার জন্য সত্যিই আমরা কৃতজ্ঞ । আমাদের এই সাতজন গৃহিণীর ঐকান্তিক চেষ্টায় ও আন্তরিক উৎসাহে প্রথমবারের এই প্রদর্শনী আপনাদের ভাল লাগলে আমরা সার্থক । আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে আমাদের এই সপ্তপর্ণীর সাতজন সক্রিয় সদস্যাদের কারও সাথে কারও পরিচয় কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল না । এই কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে হয় আমাদের পরিচয় । সারাদিনের অনেকটা সময় আমরা একসাথে ছিলাম অপরিচিত গণ্ডির মধ্যে । অনেক মানুষজন তবুও আমরা আমাদের এই সাতজনের মধ্যে একটা টান অনুভব করলাম । একে অপরের মোবাইল নাম্বার শেয়ার করলাম । আমদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে এই অঙ্গীকার করে সেদিনকার মত আমরা যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম ।
আমরা সবাই গৃহিণী । আমাদের সবার স্বামীরা এখন তাদের চাকরী জীবন থেকে অবসর গ্রহন করেছে। আমাদের সন্তানেরা যে যার কর্মে ব্যস্ত ।তাদের অনেকেরই আলাদা সংসার হয়েছে । স্বামীরা যখন চাকরী করত আর সন্তানেরা যখন আমাদের ওপর নির্ভর করত তখন সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যেত টেরই পেতাম না ।এখন মাঝে মাঝে অবসর সময় একা থাকলে মনে হয় এতদিন অমুকের স্ত্রী আর সন্তানদের মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হলাম । আমাদের নিজেদের যে একটা স্বত্বা আছে সেটাই ভুলে গেছিলাম। নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বা নিজেরা স্বাধীনভাবে কিছু করার তাগিদ অনুভব করলাম ।
আমাদের এই নুতন বন্ধুদের সাথে প্রায়ই ফোনালাপ চলতে থাকলো । আমরা আমাদের এই কিছু করার ইচ্ছাটা দেখলাম সবার মধ্যেই অল্প বিস্তর আছে । আমরা সবাই একদিন মিলিত হলাম একটা রেস্তরেন্তে । আলোচনা করে দেখলাম আমরা সবাই কিছু না কিছু বিষয়ে পারদর্শী । যেমন কেউ ভাল রান্না করতে পারে , কেউ ভাল হাতের কাজ করতে পারে , কেউ ভাল গান গাইতে পারে তো কেউ ভাল নাচ , কেউ ভাল ছবি আঁকতে পারে তো কেউ আবার ভাল কবিতা আবৃত্তি করতে পারে । আরেকজন আছে যে ভাল লেখতে পারে । আমরা ঠিক করলাম আমরা আমাদের দক্ষতাগুলো একে অপরের সাথে শেয়ার করবো । দিন ঠিক হল , আমরা এক একদিন একেকজনের বাড়িতে মিলিত হয়ে ক্লাস করা শুরু করলাম । একেকদিন একেকজন শেখায় । তার সাথে আড্ডাও চলতে লাগলো সমানতালে । এইভাবে, আমাদের প্রতিদিনের জীবন আরও রঙিন হয়ে উঠল। আমরা একে অপরকে নতুন নতুন জিনিস শিখিয়ে, একে অপরের জীবনে আনন্দের রঙ যোগ করলাম । আর এর ফলে আমাদের মধ্যে একটি গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল, যা একে অপরকে আরও ভালোভাবে চিনতে এবং বুঝতে সাহায্য করল।
এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম একটি ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করবো । সেখানে আমাদের শেখা সব জিনিস প্রদর্শিত হবে। আর আমাদের এই প্রদর্শনী থেকে যে আয় হবে সেটা আমরা কোন অনাথ আশ্রমে দান করবো ।
আজ এই প্রদর্শনী আমাদের প্রথমবারের ফসল । বলতে দ্বিধা নেই যে আমাদের সকলের স্বামীরা আমাদের সবসময় উৎসাহ দিয়েছে এবং আমাদের পাশে থেকে আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে । এতক্ষণ আমাদের সাত গৃহিণীর সপ্তপর্ণীর উৎস আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম । এইবার আমি একে একে আমাদের বাকি সদস্যাদের সবাইকে মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি আপনাদের সাথে পরিচয় করার জন্য।”………
প্রদর্শনীটি খুবই সফল হয়েছিল , এবং সবাই তাদের কাজের প্রশংসাও করেছিল । তাদের এই বন্ধুত্ব কেবল তাদের জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর মাধ্যম ছিল না, বরং এটি তাদের নতুন করে বাঁচার এবং নতুন কিছু শেখার উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা একে অপরকে ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং সঙ্গ দিয়ে এক অসাধারণ সোনালী বন্ধুত্বের উদাহরণ তৈরি করেছিল । এইভাবেই সপ্তপর্ণীর গল্প আরও অনেক বয়স্কা মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছিল এবং অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল তাদের এই গল্প শুনে ।জানিনা , সপ্তপর্ণীর এই বন্ধুত্ব তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল কিনা । কারও জানা থাকলে জানাবেন ।