গত ১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ঘুরতে চলে গেছিলাম ভাগীরথীর তীরে একসময়ের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে । সকাল ৬ টা ৫০ মিনিটে কলকাতা ষ্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে মুর্শিদাবাদ পৌছালাম সকাল ১০ টা ৩০ এ । বাইরে বেড়িয়ে দেখি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতিঝিল টুরিস্ট লজ থেকে আমাদের জন্য টোটো পাঠিয়েছে । জন প্রতি ২০ টাকা ভাড়া ষ্টেশন থেকে মতিঝিল টুরিস্ট লজ যেতে যা ভাড়া নেয় অন্য টোটোও । মতিঝিল পার্কে পৌঁছে টুরিস্ট লজ দেখে খুব ভাল লাগলো । মনে হচ্ছিল কোথাও না গিয়ে শুধু এই মতিঝিলে কাটালেও ভাল লাগবে । ৩৫০ একর জমিতে ঘোড়ার নালের মত পরিষ্কার টলটলে জলে ভরা একটি বিশাল বড় ঝিল , নানা রংবাহারি ফুলের বাগান, বিভিন্ন বড় বড় ফলের গাছ ও সবুজ ঘাসের কার্পেটের মধ্য দিয়ে গোলাপি সিরামিক টাইলসের নানা আকারের রাস্তা এই ইকো পার্কটাকে দারুন আকর্ষিত করে তুলেছে । টুরিস্ট লজের কটেজগুলোও খুব সুন্দর দেখতে । মনে পরে যায় কলকাতার ইকো পার্কের কথা । ইতিহাস বলে ৩০০ বছর আগে এইখানে একটি ঝিল এবং তৎসনলগ্ন বাগান সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের পতি নওয়াজেশ মহম্মদ নির্মাণ করান। পাশেই রয়েছে ওনাদের ভগ্নপ্রায় মসজিদ ও প্রাসাদ ।
টুরিস্ট লজে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের আহার সেরে আমরা ঐ টোটো নিয়ে দুপুর একটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম খোশবাগের উদ্দেশ্যে । খোশবাগ যেতে গেলে ভাগীরথীকে পার করতে হয় । নৌকার উপর আমরাও উঠলাম আর আমাদের টোটোও উঠলো । ভাড়া জন প্রতি ৫ টাকা আর টোটোর ভাড়া ২৫ টাকা । নদী পার হয়ে আরও কিছুটা গিয়ে পৌঁছে গেলাম খোশবাগে। খোশবাগে আলিবর্দি খান, সিরাজ, সিরাজপত্নী লুৎফউন্নিসা, এবং সিরাজের পরিবার পরিজনের কবর রয়েছে যা দেখতে দেখতে ও নির্মম , নিদারুণ হত্যার ইতিহাস শুনতে শুনতে মনটা ভারাক্রান্ত
হয়ে গেল । ভাবতে অবাক লাগে যে এত নিশংস মানুষ হয় । এরপর দেখলাম ফৌতি মসজিদ , জগদ্বন্ধু ধাম ও আশ্রম , কিরীটেশ্বরী মন্দির যেটা সতীর পীঠস্থান , আরও দুএকটা মন্দির দেখে আবার ভাগীরথীকে পার করে ফিরে আসলাম মতিঝিল । গরম গরম কফি খেয়ে রাতের আলোয় মতিঝিলে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে টোটো নিয়ে রাতের আলোর মুর্শিদাবাদ দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম ।
পরেরদিন প্রাতরাশ সেরে সকাল ৯ টা নাগাদ বেড়িয়ে পড়লাম লালবাগ । একে একে দেখলাম জাহানকোষা কামান , কাটরা মসজিদ , আস্তাবল , নশিপুর রাজবাড়ি , নশিপুর আখড়া , জগৎশেঠের বাড়ি , কাঠগোলা বাগান ,নবাব বাহাদুর স্কুল , চক মসজিদ এবং সর্বশেষে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ , ইমামবাড়া ও বাচ্চোওইয়ালী তোপ । এরপর মুর্শিদাবাদ শহরটাকে এক চক্কর লাগিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম মতিঝিল । সকলের সুন্দর ব্যবহার ও মনোরম আবহাওয়া আমাদের এই ভ্রমনে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছিল । পরেরদিন অর্থাৎ ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৬ টা ২০ মিনিটে ভাগীরথী এক্সপ্রেস ধরে ফিরে আসলাম শিয়ালদহ। দুটো দিন দারুন সুন্দর কাটিয়ে অনেক ভাল ভাল স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম ।
দর্শনীয় স্থানগুলি সম্বন্ধে নিচে কিছুটা বিবরণ দিলাম –
হাজারদুয়ারি – হাজার দুয়ার থেকে এর নামকরন হয় হাজারদুয়ারি । হাজারের দুয়ারের মধ্যে ৯০০ টা আসল আর ১০০ টা নকল । সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে ১৮৩৭ সালে এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় । এর একতলায় আছে অস্ত্রাগার , রেকর্ড ঘর ও অফিস ঘর । পলাশী যুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র এখানে আছে । দোতলায় আছে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারী ও দর্শনীয় জিনিস । সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ বাতির ঝাড়লন্ঠন । জন প্রতি টিকিট ২৫ টাকা । প্রতি শুক্রবার এটি বন্ধ থাকে ।
ইমামবাড়া – সিরাজদ্দৌলার সময়ের তৈরি কাঠের ইমামবাড়াটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হাজারদুয়ারির বিপরীতে ৬৮০ ফুট দীর্ঘ এই ইমামবাড়াটি তৈরি করেন ১৮৪৭ সালে ফেরাদুন ঝা । এটি বাংলার বৃহত্তম ইমামবাড়া । মহরমের সময় ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে এই ইমামবড়া বন্ধ থাকে।
বাচ্চোওইয়ালী তোপ – ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারির মাঝখানে সিরাজের মদিনার পাশে ১৮ ফুট লম্বা ১৬৮৮০ পাউনড ওজনের এই কামানটি দেখা যায় । কামানটির আওয়াজে অনেক মহিলার গর্ভপাত ঘটেছিল বলে এর নাম বাচ্চোওইয়ালী তোপ ।
সিরাজের মদিনা – ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারির মাঝখানে রয়েছে সিরাজের মদিনা যদিও এর সৌন্দর্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে ।
খোশবাগ – ভাগীরথী নদীর অপর পারে রয়েছে খোশবাগ। খোশবাগে আলিবর্দি খান, সিরাজ, সিরাজপত্নী লুৎফউন্নিসা, এবং সিরাজের পরিবার পরিজনের কবর রয়েছে।
জাহানকোষা কামান – ১৮ ফুট দীর্ঘ ও ৪ ফুট পরিধি বিশিষ্ট ৯ টি পিতলের ফলকখণ্ড সহিত ২১২ মন ওজনের এই কামানটি পর্যটকদের কাছে এখনও বিস্ময় । কামানটি ঢাকায় তৈরি করেছিলেন জনার্দন কর্মকার । জাহানকোষা মানে জগজ্জয়ী ।
কাটরা মসজিদ – নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭২৩ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই মসজিদের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে, তবে সরকার এই স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এই মসজিদের ৫টি গম্বুজ ছিল, কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দুইটি গম্বুজ ভেঙ্গে পড়ে। এই মসজিদে একসময়ে একসাথে ২,০০০ ব্যাক্তি প্রার্থনা করতে পারেন।
নশিপুর রাজবাড়ি– কুখ্যাত দেবী সিংহের উত্তর পুরুষ কীর্তিচন্দ্র বাহাদুর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই প্রাসাদ নির্মাণ করান। প্রাসাদের উদ্যানে রাম ও লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির রয়েছে। জন প্রতি টিকিট ২০ টাকা ।
কাঠগোলা বা কাঠগোলা বাগানবাড়ী- রাজা ধনপত সিং দুগর এবং রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগরের বাগানবাড়ী শতাব্দীপ্রাচীন। এখানকার আদিনাথ মন্দিরটি ১৮৭৩ সালে হেরেক চাঁদ নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের দেওয়ালের কারুকার্য অতি সুন্দর।জন প্রতি টিকিট ৩০ টাকা ।
জগৎশেঠের বাড়ি – ইতিহাস খ্যাত ধনকুবের শেঠদের বাড়ি ছিল এখানে । এরা ছিল ঐ সময়ের ব্যাংকার । এখানে ছিল শেঠদের কাছারি বাড়ি , বাসস্থান , বাগান ও মন্দির । জন প্রতি টিকিট ২০ টাকা ।
মতিঝিল – ৩৫০ একর জমিতে ঘোড়ার নালের মত পরিষ্কার টলটলে জলে ভরা একটি বিশাল বড় ঝিল , নানা রংবাহারি ফুলের বাগান, বিভিন্ন বড় বড় ফলের গাছ ও সবুজ ঘাসের কার্পেটের মধ্য দিয়ে গোলাপি সিরামিক টাইলসের নানা আকারের রাস্তা এই ইকো পার্কটাকে দারুন আকর্ষিত করে তুলেছে । টুরিস্ট লজের কটেজগুলোও খুব সুন্দর দেখতে । মনে পরে যায় কলকাতার ইকো পার্কের কথা । ইতিহাস বলে ৩০০ বছর আগে এইখানে একটি ঝিল এবং তৎসনলগ্ন বাগান সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের পতি নওয়াজেশ মহম্মদ নির্মাণ করান। পাশেই রয়েছে ওনাদের ভগ্নপ্রায় মসজিদ ও প্রাসাদ ।
আস্তাবল – ফেরাদুন জা এটি তৈরি করান । এর বিশাল আকৃতি দেখে কার্জন সিরাজের প্রাসাদ ভেবে ভুল করেন । এটি এখন পাটের আড়ত ও সবজি বাজার ।