এই গল্পগুচ্ছে আমার লেখা ২২ টা ছোট গল্প প্রকাশিত হল । এই প্রতিটা গল্প আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এমনকি বিভিন্ন দেশে বসে অবসর সময়ে লিখেছি । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এই গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছে । যে সকল পাঠক আমার লেখা পড়তে ভালবাসেন তাদের জন্য এই ছোট গল্পগুলি এক ছাতার তলায় আনলাম । যদি সব গল্পগুলো পাঠকদের ভাল লাগে তাহলে খুব আনন্দ পাবো । যদিও আমি জানি সব গল্প সবার ভাল লাগতে পারে না । যদি আমার লেখার ত্রুটি কোন পাঠক আমায় ধরিয়ে দেন তাহলে খুব উপকৃত হবো । আশায় রইলাম । সবাই ভাল থাকবেন – সুপ্রিয় রায়
সূচীপত্র
ক্রমিক সংখ্যা গল্পের নাম
১ অতি আধুনিকতার শিকার
২ অবাক পৃথিবী
৩ অমানবিক
৪ অলীক বাবু
৫ আজও মনে পরে
৬ আমার ধর্ম আমার অধিকার
৭ ইন্টারভিউঁ
৮ ইস্পাতের রং নীল
৯ কাজের মেয়ে
১০ চিড়িয়াখানা
১১ জলাশয়
১২ ডিভোর্স
১৩ দুর্নীতি
১৪ পেরাসিটামল
১৫ ফিরে দেখা
১৬ বিচ্ছেদ নয় মিলন চাই
১৭ বিবাহের আধুনিক মধ্যপন্থা
১৮ ভালবাসি পর্যটনে
১৯ রাজনীতি তুমি কার – দলের না দেশের
২০ শাস্তি
২১ সিগারেট
২২ স্বভাব চোর
অতি আধুনিকতার শিকার
কলেজ থেকেই ওরা একসাথে রাজনীতি করে এবং তখন থেকেই ওদের ভালাবাসা । একজনকে দেখতে পেলে আরেকজনকে দেখতে পাওয়া যাবেই সেটা আমরা বন্ধুরা সব সময় টের পেতাম । পার্টির মিটিঙে , মিছিলে সব সময় চারটে পা একসাথে চলতো । সমাজ বদলের স্বপ্ন ছিলে ওদের চোখে মুখে । এই ঘুণধরা বস্তাপচা সমাজের কোন কিছুই ওরা মানতে নারাজ । সমাজে থাকতে গেলে অনেক সময় আমরা পছন্দ না হলেও অনেক কিছুই মানিয়ে নিতাম কিন্তু ওদের চিন্তাধারা ও মন যেন একসূত্রে বাঁধা । মনের বিরুদ্ধে কোন কাজ ওদের দিয়ে কেউ করাতে পারত না । আমদের বন্ধুদের চোখে ওদের একটা আলাদা স্থান ছিল। বন্ধু হলেও মনে মনে আমরা ওদের দুজনকে খুব শ্রদ্ধা করতাম । কিছুদিন বাদেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড়বো এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবো । জানিনা কে কোথায় ছড়িয়ে পরবো । তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দিনগুলো মধুর স্মৃতি হয়ে সারা জীবন থাকবে । কফি হাউসের আড্ডার দিনগুলো খুব মিস করবো ভাবলেই চোখে জল চলে আসে । বিশেষ কারে ওদের মানে সাথী আর সার্থককের সান্নিধ্য খুব মনে পড়বে ।
এর মধ্যে পৃথিবী , সূর্যকে বেশ কয়েকবার প্রদক্ষিণ করেছে । আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত । সবাই যে যার কর্ম ও সাংসারিক জীবন নিয়ে দারুন ব্যাস্ত । বছরে একবার আমরা বন্ধুরা পরিবার সমেত এখনও মিলিত হই । কয়েকটা ঘণ্টা দারুনভাবে হুল্লোড় করে আমাদের কেটে যায় । শুধু একটাই দুঃখ সাথী আর সার্থককের সাথে কারও কোন যোগাযোগ নেই । ওরা কোথায় যে চলে গেল কেউ বলতে পারছে না । এমনকি ওদের দুটো বাড়িরও কেউ কিছু জানে না । কেননা ওদের বাড়ির লোকেরা কিছুতেই ওদের সিধান্ত মেনে নিতে পারিনি । ওদের বক্তব্য ছিল ওরা দুজন দুজকে ভালবাসে । ওরা মনে প্রানে একে অপরকে স্বামী – স্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়েছে । একসাথে থাকতে চায় । কয়েকটা কাগজে সই করে বা অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করতে ওরা নারাজ । ওরা আধুনিকতায় বিশ্বাসী । বিদেশের মতো লিভ টুগেদার করতে চায় । ওদের বাড়ির লোকেরা কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারেনি । বাড়ির লোকেরা অনেক করে বুঝিয়েছিল যে শুধু রেজিস্ত্রি ম্যারেজ করে নাও । আর কোন অনুষ্ঠান করতে হবে না । কিন্তু ওরা কিছুতেই তা মানিনি । তাই দুই বাড়ির সাথে বিচ্ছেদ । কাউকে কিছু না জানিয়ে দুজনে কোথায় যে চলে গেল আমরাও সেটা জানতে পারিনি ।
এদিকে অফিসের কাজে আমি বেশ কদিন হোল শিলিগুড়িতে বদলী হয়ে এসেছি । পরিবার নিয়ে শিলিগুড়ির হাকিম পাড়াতে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকি । যেহেতু উত্তরবেঙ্গে আমার জন্ম এবং খুবই পরিচিত জায়গা তাই পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটছিল । এর মধ্যে আমি দু দুটো সন্তানের পিতা হয়ে গেছি । বড় ছেলে এবার ভাল নম্বর নিয়ে দশ ক্লাস পাশ করে শিলিগুড়ির একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে । আমরা ওর জন্য একজন ভাল অঙ্কের শিক্ষকের খোজ করছিলাম যে বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে । পরিচিত অনেকের সাথেই এই বিষয়ে কথা বলেছি । বেশিরভাগ সবার কাছেই গ্রুপে পড়তে হয় । কিন্তু আমাদের খুব ইচ্ছা ও একা পড়ুক । জানতে পেরেছি এক মহিলা শিক্ষিকার কথা । টেলিফোন নাম্বার যোগাড় হল এবং আমার স্ত্রীর সাথে বিস্তারিত কথা হয়ে ঠিক হোল ওনি সপ্তাহে দুদিন সোম ও শুক্রবার বিকালে পড়াতে আসবে ।
সেদিন ছিল শুক্রবার । শরীরটা ভাল ছিল না বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি । বই পরে , ঘরে শুয়ে বসেই সময় কাটছিল । ছেলেরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই বাড়িটা গমগম করে উঠলো । আমিও মেতে উঠলাম ওদের সাথে । এমনি দিনের বেলায় বাড়িতে তো থাকা হয় না । ওরাও খুব খুশী । বড় ছেলে তো বলেই বসলো আজ আর পরবো না , আজ তোমার সাথে গল্প করবো । আর আমার টিচারের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দেব । আমিও হাসতে হাসতে বললাম ঠিক আছে , টিচার আসুক দেখা যাবে । বলতে না বলতেই বেলের আওয়াজ । ছেলে বলল দিদিমনি এসে গেছেন ।দারুন সময় মেনে চলেন । ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়েই ওকে উঠতে হল । বই নিয়ে দিদিমনিকে নিয়ে ওর ঘরে গেল ।
গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছে । কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না । গলার আওয়াজটা ছেলের পড়ার ঘরের দিকে জোর করে আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আমি কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছিনা । চোখের সামনে দেখতে পারছি আমার ছেলে তার দিদিমনির কাছে পড়ছে । দিদিমনি যেহেতু পিছনদিক করে বসে আছে তাই তার মুখটা দেখতে পারছিনা ।দিদিমনির মুখটা দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছি । হঠাৎ ছেলে আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো – বাবা তুমি ? দিদিমনি ও বইয়ের থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল । একি দেখছি ? আমি ঠিক দেখছি তো ? দিদিমনিও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । আমরা কেউই কারও দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না । কখন যে আমার স্ত্রী আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি । ওর ডাকে সম্বিৎ ফিরল । একি চেহারা হয়েছে ? আমার মুখ থেকে জোরে শুধু একটা আওয়াজ বেড়িয়ে এলো – সাথী তুই । সাথীও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে । ওর চোখ ছল ছল করছে । মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে পড়বে । বিশ্বাসই করতে পারছি না যে এতো বছর বাদে এমনিভাবে সাথীর সাথে দেখা হবে । হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম ওকে বসার ঘরে । বললাম – এখনই ফোন কর সার্থককে । আমার আর তর সইছে না । জানিস আমরা সবাই তোদের কত খুঁজেছি । তোদের বাড়ির লোকেরাও তোদের কোন খোঁজ দিতে পারিনি । তোদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে জানতে পারলে সবাই কালই এখানে চলে আসবে ।
সাথী মাথা নিচু করে চুপ করে আছে । কোন কথা বলছে না। আমার তর সইছিল না । আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম – বল , সার্থক কোথায় ? ওকি শিলিগুড়িতেই আছে ? কিরে চুপ করে আছিস কেন ? চারিদিকে নিস্তব্দতা , কোন আওয়াজ নেই । ধীরে ধীরে সাথী মুখ তুললো , দুই চোখ টলটল করছে । দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো – সার্থক আর নেই রে। ও আমাদের ছেড়ে দুবছর আগে চলে গেছে । আমার স্ত্রী ওকে এক গ্লাস জল এনে দিল। সাথী এক নিশ্বাসে পুরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিল । তারপর বলতে লাগলো ——–
তোরা তো আমাদের আগের কথা সবই জানিস। আমারা তোদের নিয়ম মতো বিয়ে করিনি । কিন্তু থাকতাম স্বামী – স্ত্রীর মতো । কারণ আমরা মনে প্রানে স্বামী – স্ত্রী ছিলাম । ইউনিভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে সার্থক ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে দিল্লি গেল । আমিও গেলাম ওর সাথে । জানিস তো আমি শাখা , পলা , সিঁদুর এগুলতে বিশ্বাসী ছিলাম না । তাই এগুলো ছাড়াই আমার পরিচয় ছিল ওর স্ত্রী । কিন্তু দিল্লিতে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমরা স্বামী স্ত্রী । অগত্যা আমাকে স্ত্রী প্রমাণ করার জন্য মাথায় লাগাতে হল সিঁদুর । দিল্লির মালভিয়া নগরে বাসা নিয়ে থাকতে লাগলাম দুজনে । দারুন কাটছিল সময় । মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পরছিলাম এদিক ওদিক ঘুরতে । আমিও একটা স্কুলে চাকরি নিলাম । দিল্লিতেই আমাদের মাঝে আসে আমাদের একমাত্র ছেলে । যার নাম আমরা আমাদের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলাম সাম্য । ও এখন প্রায় তোর ছেলের বয়সই । খুব আনন্দে কাটছিল । আমি আর সার্থক মিলে একটা নাটকের দল তৈরি করেছিলাম। আমাদের বাড়িটাই ছিল নাটকের রিহার্সাল রুম । কিন্তু এতো আনন্দ সইলো না । সার্থককে কলকাতায় বদলী করলো । নানা কারণে আমরা দুজনের কেউই কলকাতায় যেতে চাই না । ও সেটা অফিসকে জানাল ।ওকে মালদহ বদলী করলো । পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলাম মালদহতে । নতুন করে আবার সংসার গোছাতে লাগলাম । আমিও একটা ভাল স্কুলে চাকরি পেয়ে গেলাম। ভালই চলছিল । অফিসের কাজে মাঝে মাঝেই ওকে এদিক ওদিক যেতে হতো । সেদিন রায়গঞ্জ থেকে আসার পথে ওর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে । অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাঁচান যায়নি । খবরের কাগজে ওর নাম দিয়ে খবরটা প্রকাশ হতেই ওর ভাই কলকাতা থেকে ওর মাকে নিয়ে চলে আসে । দুঃখের বিষয় ওনারা এই দুঃখের সময়েও আমাকে আর সাম্যকে কাছে টেনে নেয়নি । উল্টে সবার কাছে প্রচার করে যে আমি ওর স্ত্রী নই । ওরা দাবী করে অফিস থেকে সার্থকের যা কিছু প্রাপ্য সবের অধিকার কেবল মাত্র ওর মায়ের । যেহেতু আমাদের বিয়ের কোন প্রমাণ নেই আইনত আমি কিছুই দাবী করতে পারলাম না । বুঝতে পারছিলাম আবেগ আর বাস্তবের কতটা ফারাক । আইনে আবেগের কোন স্থান নেই , চাই প্রমাণ । এতদিন যারা আমাদের মাথায় করে রাখতো তারাই বলতে শুরু করলো আমি নাকি রক্ষিতা । সাম্যকে নিয়ে ওখানে থাকা দায় হয়ে উঠলো । এসব খবর তো তাড়াতাড়ি ছড়ায় , তাই আমার স্কুলেও খবর পৌছাল । হেড দিদিমনি আমাকে ডেকে বললেন যে আমি ওখানে আর চাকরী করতে পারবো না । কারণ অভিভাবকরা আপত্তি জানাবে । হেড দিদিমনি আমাকে খুব ভাল বাসতেন । ওনি সবটা বুঝতে পারছিলেন কিন্তু জানি ওনার করার কিছু ছিল না । ওনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে শিলিগুড়িতে এই স্কুলে পাঠালেন । টেলিফোনে সব বলে দিয়েছিলেন । তাই চাকরীটা আমি পেয়ে গেলাম । ওনার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারবোনা । এক কথায় ওনি আমাদের জীবন দিলেন । তোদের সবার কথা খুব মনে হচ্ছিল , কিন্তু তোদের কোন যোগাযোগ ছিল না । যাইহোক তারপর থেকে আমি আর সাম্য শিলিগুড়িতেই আছি । আত্মীয় – স্বজন কারও সাথে কোন যোগাযোগ কোনদিন ছিলও না এখনও নেই । আমাদের বিয়ে না করে একসাথে থাকাটা কেউ মানতে পারেনি । আমরা বাস্তবের কথা চিন্তা না করে আবেগের বশে ভুল সিধান্ত নিয়ে ছিলাম যার ফল আজও ভোগ করে চলেছি । দেখলাম সাথীর দুই চোখ এখনও জলে ভরে আছে । খুবই করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । যেন বলতে চাইছে – তোরা তো জানিস আমি রক্ষিতা ছিলাম না , আমি ছিলাম সার্থকের সবচেয়ে কাছের মানুষ , ওর বন্ধু , ওর সহধর্মিণী , ওর সবকিছুর সাথী ।
অবাক পৃথিবী
‘ কি ব্যাপার বলরামের মা ? কদিন ধরে দেখছি দরজার সামনে বসে আছো । কাজে বেড়চ্ছো না কেন ? শরীর খারাপ হল নাকি ? দেখো জ্বর , সর্দি কাশি থাকলে করোনার পরীক্ষা করে নিও । মনে রেখো বাড়িতে তোমার দুটো ছেলে আছে ।’
বলরামের মার নিজের একটা সুন্দর নাম আছে – পলা । বলরাম হওয়ার পর থেকে সবাই বলরামের মা বলেই ডাকে । বাড়ির কাজের লোকদের বোধহয় বেশীরভাগ মানুষ এরকমই নামেই ডাকে । বলরামের মারও এই নামটা শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে । মুখ তুলে দেখলো ওদের বস্তির সামনে রাস্তায় কমলার মা দাঁড়িয়ে আছে । কমলার মা এখন আর লোকের বাড়ি কাজ করে না । ছেলে বড় হয়ে গেছে । ও আর মাকে কাজ করতে দেয় না । কিন্তু বলরামের মাকে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয় । দুটো ছেলে হওয়ার পর স্বামী অন্য মেয়ের সাথে চলে যায় । কোন রকম সাহায্য করে না । তাই বাধ্য হয়েই দুই ছেলেকে বাঁচাতে লোকের বাড়িতে কাজ নিতে হয়েছে ।
বলরামের মাকে চুপ থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করে কমলার মা – ‘ কি গো , কি হল ? কথা বলছো না যে ।’
- “ কি আর বলবো বল । এই করোনার জন্য সবার বাড়িতে কাজে যেতে মানা করেছে ।”
- ‘ তা প্রতি মাসে মাইনা দিচ্ছে তো ?’
- “ আরে দূর, একমাস দেওয়ার পর বন্ধ করে দিয়েছে ।বলছে করোনা দূর হলে আবার রাখবে ।”
‘ এতো বছর কাজ করলে , আর তারা তোমার পরিবারের কথা একবারও চিন্তা করলো না ।তুমি তো কাজ ছাড়নি , তারা ভয় পাচ্ছে তাই তোমাকে ঘরে ঢুকে কাজ করতে দিতে চাইছে না ।তোমার তো কোন দোষ নেই । আর এই সময় অন্য কেউ কাজও দেবে না , এটা তো তাদের বোঝা উচিৎ ছিল ।’
“ একটা বাড়ি থেকে বলে কি জানো , তোরা তো বিনা পয়সায় রেশন পাচ্ছিস তোদের ঠিক চলে যাবে । আর যদি করোনা হয় তাহলে সরকারী হসপিটালে যাবি , বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাবি । কিন্তু আমাদের করোনা হলে আমরা তো আর সরকারী হসপিটালে যেতে পারবো না , আমাদের বেসরকারি হসপিটাল বা নার্সিং হোমে যেতে হবে । তার খরচ জানিস ? এই তো আমাদের জানাশোনা একজন করোনার জন্য নার্সিং হোমে ভর্তি ছিল । ১৩ দিন ছিল নার্সিং হোমে , মারাও গেল কিন্তু নার্সিং হোমকে বিল দিতে হলো ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা । কেন ভয় পাবনা বল ।”
‘ কি বল কি ? এই রোগের তো শুনেছি ওষুধ এখনও বেড়ইনি । তাহলে এতো খরচ কিসের ?’
“ তা আমি কি করে বলবো । ওনারা বললেন , আমি শুনলাম । আরেকটা বাড়িতে কি বলেছে জানো । বাড়ির কর্তার ব্যবসা নাকি করোনার জন্য ভাল চলছে না । তাই এখন আমাকে রাখতে পারবে না । কি করবো , বল । আমি কি আর ঝগড়া করবো ।”
‘তাহলে তোমার চলছে কি করে?’
“ একদমই চলছে না । রেশনে যা পাচ্ছি তা দিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি ।
কি করবো বুঝতেই পারছি না । বড় ছেলেটা ১২ ক্লাস পাশ করেছে । এবার কলেজে ভর্তি হবে আড়াই হাজার টাকার উপরে লাগবে । কোথার থেকে টাকা পাবো বুঝতেই পারছি না । যাদের কাছে চাইছি
তারাই বলছে তাদের অবস্থা ভাল নয় ।মাথায় একটাই চিন্তা ছেলেটাকে কি করে কলেজে ভর্তি করবো । ও এতো পড়াশুনা ভালবাসে অথচ জানিনা ওকে পড়াতে পারবো কিন ?”
- ‘ অত চিন্তা করছো কেন ? সব রাস্তা যখন বন্ধ তখন শেষ একটা রাস্তা আমাদের সামনে খোলা আছে । তোমার ছেলেকে তুমি ঠিক পড়াতে পারবে ।’
- “ কি করে ?” বলরামের মা হাঁ করে কমলার মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
- ‘ রক্ত বিক্রি করে । আমি আর তুমি আমাদের রক্ত বিক্রি করবো । তাহলেই পড়ার টাকাটা যোগাড় হয়ে যাবে ।’
“ আমরা তো ভালমন্দ খেতে পাইনা আমাদের রক্ত নেবে ?” – বলরামের মা জিজ্ঞেস করলো । - ‘ ভালমন্দ খেতে না পেলে কি হবে , আমাদের যা মনের জোড় আছে তাতেই আছে আমাদের রক্তের তেজ । ঠিক নেবে । চলো কাল আমরা দুজনে গিয়ে রক্ত বিক্রি করে আসি । আমি জানি কোথায় গেলে রক্ত বিক্রি করা যাবে ।’
বলরামের মার চোখে জল এসে গেল । নিচু হয়ে কমলার মার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো । কাঁদতে কাঁদতে বললো – “ দিদি তুমি রক্ত দিয়ে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ তৈরি করছো । দেখো এটা বিফলে যাবে না । ও একদিন মানুষের মতো মানুষ হবেই ।” জড়িয়ে ধরলো কমলার মাকে । ভুলে গেল দুরত্ববিধি , ভুলে গেল যার জন্য এতো সব সেই করোনাকে ।
অমানবিক
- এই কাগজটা শাক সবজির দোকানে দিবি আর এই কাগজটা দিবি মুদিখনার দোকানে।দুটো ব্যাগ দিয়ে দিলাম , একটাতে শাক সবজি আর আরেকটাতে মুদিখনার জিনিস আনবি । দোকানদারের থেকে তিন ফুট দূরে দাঁড়াবি ।মুখে মাস্কটা পরে যাবি ।কিরে বুঝলি তো । তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবি । জানিস তো চারিদিকে লকডাউন চলছে । এদিক ওদিক ঘুরলে কিন্তু পুলিশ ধরবে ।বাড়ি এসে বাইরের কল থেকে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত,পা ধুয়ে তারপর ঘরে ঢুকবি । মনে থাকবে তো ! এইনে টাকাটা ভাল করে রাখ । হারাস না আবার ।
কর্তামার হাত থেকে সব নিয়ে বাড়ির বাইরে আসল কমলা । কমলার বাড়ি সুন্দরবনে । তিন বছর হল কোলকাতায় এই বাবুদের বাড়িতে কাজ করছে । এতদিন সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু করোনা নামে কি একটা রোগ এসেছে তার ফলে সব ওলট পালট হয়ে গেছে ।এতদিন কর্তাবাবুই বাজারে যেত ।কিন্তু এখন কর্তামা , কর্তাবাবু বা দাদাবাবুকে বাড়ির বাইরে বেড়তে দেন না । দাদাবাবু তো ঘরে বসেই অফিস করছে । বাড়ির কাজ ও বাইরের সব কাজ এখন কমলাকেই করতে হচ্ছে । ছোটবেলা থেকে কোনদিনই সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস ছিল না কমলার । এখন যখন কর্তামা বার বার বলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য তখন ওর একদম ইচ্ছা করে না । এইসব চিন্তা করতে করতে কমলা এগিয়ে চলল বাজারের দিকে । একটু এগোতেই ফুলির সাথে দেখা । ফুলি কমলারই বয়সী এই ১৬ -১৭ বছর হবে ।কাছের বস্তিতে থাকে । কমলার সাথে বেশ ভাব । - কি রে ফুলি কোথায় চললি ।
- আর বলিস না কমলা । আমি যে বাড়িতে কাজ করি সে বাড়ির দাদাবাবু দুদিন হল বিদেশ থেকে এসেছে ।আজ হঠাৎ জ্বর এসেছে । তাই কর্তামা আর কর্তাবাবু , দাদাবাবুকে নিয়ে হসপিটালে গেছে । আমায় ছুটি দিয়েছে । বলেছে কালকে এসে একবার খোঁজ নিতে ।
– তাহলে তো ভালই হল । চল আমার সাথে ।
দুজনের খুব ভাব । হাসতে হাসতে হাত ধরাধরি করে গল্প করতে করতে দুজনে চলল বাজারের দিকে । রাস্তায় দশ টাকা দিয়ে একটা চিপসের প্যাকেট কিনে দুজনে মিলে তৃপ্তি করে খেল । তারপর বাজার থেকে ফেরার পথে ফুলি ওর বাড়ি চলে গেল । আর কমলা মুদিখানার জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরল । ঘরে ঢুকতেই কর্তামার চীৎকার শুনতে পেল ।
– কখন গেছে আর এই আসলো । ফাকি দিতে পারলে আর কি । ঘরে কত কাজ পরে আছে । যা ভাল করে হাত পা ধুয়ে আগে বাসন গুলো মেজে ফেল ।
মাঝে মাঝে কমলার বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা করে । সবার চাকরীর একটা নিদিষ্ট সময় আছে কিন্তু ওদের নেই । ওরা ২৪ ঘণ্টার কাজের লোক । আর কথা না বাড়িয়ে ও কাজে মন দিল । এমনি করেই চলছিল ।কিন্তু বেশী দিন চলল না । তিন চারদিন পরে একদিন বেশ সকাল হয়ে গেছে কিন্তু কমলা ছাদ থেকে কিছুতেই নামছে না । ছাদের একটা ছোট ঘরে কমলা থাকে । মাথাটা খুব ধরেছে, আর মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর এসেছে । কিছুতেই উঠতে ইচ্ছা করছে না । খালি শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে । কর্তামার চীৎকার কানে আসছে । কর্তামা চীৎকার করে ওকে ডাকছে আর বলছে –
-এতো সকাল হয়ে গেল কিন্তু মাহারানির হুস নেই । ঘরে কত কাজ পরে আছে, আর মাহারানির ঘুমই ভাঙছে না ।
বুঝতে পারলো কর্তামা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে । খুব বকাবকি করবে ও জানে তবুও ওর উঠতে ইচ্ছা করছে না । চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ।মাঝে মাঝে হটাৎ আবার শুকনো কাশি আরম্ভ হয়েছে । কমলা বুঝতে পারলো ঘরের দরজার সামনে কর্তামা এসেছে । তারপর ওর কানে আসলো কর্তামা, কর্তাবাবুকে ডাকছে । কর্তাবাবু এসে দাঁড়ালো সেটাও কমলা বুঝতে পারলো কিন্তু চোখ খুলতে কিছুতেই ইচ্ছা করছে না । শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে । কানে আসলো কর্তামা কর্তাবাবুকে বলছে – আমার ভাল ঠেকছে না ।ওকে দেখে বুঝতে পারছি ওর জ্বর এসেছে । যদি করোনা ভাইরাস এসে থাকে তাহলে তো আমাদের সর্বনাশ । পাড়ায় জানাজানি হলে আমাদের এক ঘরে করে দেবে । কোথায় নিয়ে গিয়ে কোয়রানটিন রাখবে কে জানে । ইচ্ছা মতো কিছুই করতে পারবো না । শোন ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালে পাঠিয়ে দাও ।
- ও তো রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না । ও একা একা যাবে কি করে ?
- কাগজে বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালের নাম আর ঠিকানা লিখে দাও ।আর ওকে ট্যাক্সির ভাড়া দিয়ে দাও । তাহলেই ও চলে যেতে পারবে । আর ও চলে গেলেই পুরো সিঁড়ি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ভাল করে ধুতে হবে । ওকে ডেকে একটা প্যারাসিটামল দাও তাহলেই জ্বরটা কমে যাবে এবং গায়ে কিছুটা জোড় পাবে ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ । তারপর কর্তাবাবু জোরে জোরে কমলা কমলা করে ডাকতে লাগলো । কমলা চোখ খুলতেই কর্তাবাবু একটা ওষুধ ছুঁড়ে দিল ।বলল ওটা খেয়ে নিতে । কমলা ওষুধটা খেল । একটু বাদে ও উঠল , মনে হচ্ছে জ্বরটা এখন অনেকটা কম । ওকে উঠতে দেখে কর্তামা বলে উঠল – - নে নে , তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে । তোকে হসপিটালে যেতে হবে । তাহলেই ভাল হয়ে যাবি । তোকে একটা কাগজে হসপিটালের নাম আর ঠিকানা লিখে দিচ্ছি , আর সাথে টাকা দিয়ে দিচ্ছি ।বাড়ির থেকে বেড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে যে বড় রাস্তাটা পাবি ওখানে ট্যাক্সি পাবি । ঐ ট্যাক্সির ড্রাইভারকে এই কাগজটা দেখাবি তোকে হসপিটালে পৌঁছে দেবে । আর এখানে কোথায় থাকিস কাউকে কিছু বলবি না । আমরা পরে তোর সাথে যোগাযোগ করে নেব । আর যদি কাউকে কিছু বলিস তাহলে আর তোকে রাখবো না ।
অগ্যতা কমলা বেড়িয়ে আসলো বাড়ির থেকে । শরীর আর চলছে না । তবুও জোড় করে চলল বড় রাস্তার দিকে । বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সি পেল । ট্যাক্সির ড্রাইভার ওকে কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করাতে ও কাগজটা দেখাল । তখন ট্যাক্সির ড্রাইভার ওকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল । কমলা বুঝতে পারলো না কি হল । কেন ওকে দাঁড়াতে বলে চলে গেল । যাইহোক কমলা দাঁড়িয়ে রইলো । একটু পরে সেই ট্যাক্সির ড্রাইভারের সাথে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ আসলো । এইবার কমলা একটু ভয় পেয়ে গেল । ও ভাবল ওই যে কর্তামা বলেছিল লকডাউনে এমনি এমনি বেড়লে পুলিশ ধরতে পারে তাই বোধহয় ওকে ধরতে এসেছে । ও পুলিশকে দেখে ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো – আমার জ্বর হয়েছে তাই আমি হসপিটাল যাব বলে বেড়িয়েছি । পুলিশটা ওকে বলল – তোমার কোন ভয় নেই । আমি অ্যাম্বুল্যান্সকে খবর পাঠিয়েছি , এখুনি এসে যাবে।আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব । তুমি একটু দাড়াও ।
একটু বাদেই অ্যাম্বুল্যান্স চলে আসলো । সারা শরীর ঢাকা এমন পোশাক পরে দুজন অ্যাম্বুল্যান্স থেকে একটা বিছানা নিয়ে নামল আর ওকে বলল ওর মধ্যে শুয়ে পড়তে । কমলার একটুও দাঁড়াতে ইচ্ছা করছিল না । ও তাড়াতাড়ি ওই বিছানায় ভয়ে ভয়ে শুয়ে পড়ল । তারপর ওকে নিয়ে গাড়িটা রওনা দিল । অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতর শুয়ে শুয়ে ও ভাবছিল সব পরিচিত লোকগুলো এক মুহূর্তে কেমন অপরিচিত হয়ে গেল আর অপরিচিত লোকগুলো কেমন আপন হয়ে উঠল । ওর বাবা মার কথা খুব মনে হচ্ছিল । খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে বাবুদের বাড়ির জন্য ও দিনরাত পরিশ্রম করে আর ওর শরীর খারাপ হওয়াতে বাড়ির থেকে বেড় করে দিল । ওদের বাড়ির যদি কারও শরীর খারাপ হতো তাহলে কি এমনি করে বেড় করে দিতে পারতো । ভাবতে ভাবতে ওর দুচোখের পাতা জড়িয়ে আসলো ।আর ও হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে ।
অলীক বাবু
অলীক বাবু ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র ছিলেন । চাকরীও করতেন বিজ্ঞানী হিসাবে । কিছুদিন হলো চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন । একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে । ভাল চাকরী করে । আর ওনার স্ত্রী কলেজে অধ্যাপনা করেন । তাই অবসর সময়ের অনেকটা সময়ই ওনাকে একা কাটাতে হয় । তার জন্য অবশ্য ওনার কোন অসুবিধা বা একাকীত্ব বোধ করার ব্যাপার নেই । যাদের বই পড়ার নেশা আছে তারা কক্ষনই একাকীত্ব বোধ করে না । অলীক বাবু তো বইয়ের পোকা । সারাদিন বই পড়ে কাটিয়ে দিতে পারেন । আর ওনার বাড়িতেও একটা ছোটখাটো লাইব্রেরী আছে ।সব বই খুব সুন্দর করে সাজানো ।নানা ধরনের বই আছে ওনাদের বাড়ির লাইব্রেরীতে । সমস্ত ধরণের বই পড়তেই ওনারা অভ্যস্ত ।সেদিন যে বইটা হাতে নিলেন তার নাম – “ মানুষ কখন ও কেন কথা বলতে শিখলো?” বৌমা এই বইটা ওনার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল ।আগে পড়া হয়ে উঠেনি । তাই ঠিক করলেন এই বইটাই ওনি পড়বেন । ভাবতে লাগলেন প্রথম কথা কে বলেছিল এবং কি বলেছিল । তখন তো ভাষা আবিস্কার হয় নি , কথা মানে নানারকম আওয়াজ আর তার সাথে অঙ্গভঙ্গি । বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ সাড়ে ছ’হাজারের মতো ভাষায় কথা বলে। এই সব ভাষার উৎস কি ওই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই এসেছিল? চিন্তা করতে খুব ভাল লাগছিল ।মনে পড়ল অধ্যাপক ফোলির লেখা – “এটাও সম্ভব যে বর্তমানে সব ভাষাই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে,” ।মনে মনে ভাবছিলেন যে জিন – বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী আমাদের প্রায় সবারই অরিজিন আফ্রিকার এক খুদ্র জনগোষ্ঠী থেকে ।তাহলে তো এই হাজার হাজার ভাষার উৎস ঐ আফ্রিকার খুদ্র জনগোষ্ঠী থেকে হওয়া উচিৎ । জীববিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাসের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা ভাষা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন ঠিকই এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম থেকে
কিছু ধারণা পাওয়া যায় যে আমরা ঠিক কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিলাম কিন্তু সেটা কি সুনিদিষ্ট করে এখনও কেউ বলতে পেরেছেন ?মানুষেরা প্রথমে নানা রকম আওয়াজ বা শব্দ বের করে তাদের ভাব আদান প্রদান করতো । তারপর নিজেদের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করলো । ভাবতে অবাক লাগছিল অলীক বাবুর । ভাবছিলেন এ বিষয়ে তিনি তো আগে এতো গভীরভাবে ভাবেননি । ভাবতে ভাবতে চার্লস ডারউইন, নোয়াম চমস্কির লেখা মনে পড়তে লাগলো । এক জায়গায় ভাষা নিয়ে চার্লস ডারউইন লিখেছিলেন – ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দের ইঙ্গিত, প্রাণীদের আওয়াজ ও মানুষের স্বভাবগত উচ্চারিত ধ্বনির অনুসরণ ও সংশোধন করে।’ আবার নোয়াম চমস্কির লেখায় পাওয়া যায় – ‘ ভাষা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ভাষা মানুষের সৃজনী চেতনার সঙ্গে যুক্ত।’ সবচেয়ে বড় কথা পুরানো অনেক ভাষা আজ হারিয়ে গেছে এবং দিন দিন হারিয়েও যাচ্ছে আরও অনেক ভাষা । হটাৎ ওনি ভাবতে বসলেন , আচ্ছা আমরা যখন কথা বলি তখন আমরা নানা রকমের শব্দ তৈরি করি । মানে এক একটা বর্ণের জন্য এক একরকম শব্দ । আকার , ইকার উকার প্রভৃতির জন্য এক একরকম শব্দ । ২০ ডেসিবেলের উপরে বললে লোকে শুনতে পায় । তার নীচে আওয়াজ করলে লোকে বলে ফিসফিস করে কথা বলছি । আর মনে মনে যে সব কথা বলি তা তো কেউ শুনতেই পায়না ।কিন্ত অনেক সময় কেউ কেউ বুঝতে পারে সামনের লোকটি মনে মনে কি বলছে মানে মনে মনে কি চিন্তা করছে ।আমরা যখন কথা বলি তখন তো একটা শব্দ তরঙ্গ তৈরি হয় এবং সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় কিন্তু যখন মনে মনে কথা বলি তখন কি কোনভাবে সেটাকে বোঝা যাবে । বিজ্ঞানী মানুষ । লেগে পড়লেন মানুষের মনের কথা উদ্বার করতে । ভাবতে লাগলেন একবার যদি মানুষের মনের কথা ধরতে পারা যায় তাহলে কুকীর্তি করার আগে বা পরে দোষীকে ধরা সহজ হবে । আদা জল খেয়ে লেগে পড়লেন মনের কথা বোঝার যন্ত্র আবিষ্কারে ।দিন রাত এক করে দিলেন আবিস্কারের নেশায় । অবশেষে সুদিন আসলো ওনি সফল হলেন এমন একটা যন্ত্র আবিস্কার করতে যেটা কারও মনের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবে দশ ফুট দূর থেকেও । যেহেতু যন্ত্রটি আকারে একটা পেনের মতো এবং সরু তার দিয়ে ইয়ার ফোনের সাথে যুক্ত তাই হটাৎ করে কেউ বুঝতে পারবে না । অলীক বাবু ঠিক করলেন প্রথমে তিনি পাড়ার রাজনৈতিক নেতার বাড়ি যাবেন যন্ত্রটি পরীক্ষা করতে ।কারণ সবাই জানে রাজনৈতিক নেতারা বাইরে যেটা বলেন মনে মনে অন্য কথা বলেন । যা ভাবা তাই কাজ । পৌঁছে গেলেন নেতার বাড়ি । ওনাকে দেখে নেতা একগাল হেসে বললেন – “ আরে আমার কি সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজন বিজ্ঞানী আমার বাড়িতে পদধূলি দিয়েছেন” ( আর মনে মনে বললেন – ‘ কি ব্যাপার , সাতসকালে এই বুড়োটা আমার সাথে দেখা করতে আসলো কেন ?’ )। অলীক বাবু তো সব শুনতে পারছেন । তবু খুব বিনয়ের সাথে বললেন – “ এখন তো আমি অবসর গ্রহণ করেছি । হাতে অনেক সময় আছে । তাই ভাবলাম পাড়ায় যদি একটা বিজ্ঞান মঞ্চ খোলা যায় । সেই জন্যই আপনার কাছে আসা । আপনার একটু সহযোগিতার লাগবে ।”
মুখের হাসিটা বজায় রেখে নেতা বললেন – “ আরে এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব । আমি সবসময় আছি আপনাদের সঙ্গে । মাঝে মাঝে সময় পেলে আমিও যোগ দেবো । আমারও একটু শেখা হবে ।” (আর মনে মনে বললেন – ‘ না , না কোনমতেই বিজ্ঞান মঞ্চ খুলতে দেওয়া যাবে না । তাহলে সব যুক্তিবাদী তৈরি হাবে । আমার রাজনীতি করা মুশকিল হয়ে যাবে ’) । অলীক বাবু সবই বুঝলেন কিন্তু না বোঝার ভান করে নমস্কার জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন । বাড়ি এসেই তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা স্পীকারে লাগালেন । যন্ত্রটা সব ভালমতো রেকর্ড করতে পেরেছে কিনা দেখার জন্য । স্পীকারে নেতার প্রতিটা কথা পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল । অলীক বাবুর আজ দারুণ আনন্দ হচ্ছে । এতদিনের পরিশ্রম সফল । চীৎকার করে ওনার স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন – “ কল্পনা , কল্পনা শিগগিরি এখানে এসো । দেখে যাও আমার নতুন আবিস্কার ।” আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না , দৌড়ে গিয়ে কল্পনাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসলেন । এক নিঃশ্বাসে কল্পনাকে সবকিছু বললেন , এমনকি নেতার বাড়ির সব কথোপকথনও বললেন । এইবার স্পীকার চালিয়ে নেতা মনে মনে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো সব শোনালেন । কল্পনা দারুণ খুশী । বললেন – “ এতো এক যুগান্তকারী আবিস্কার । এই প্রথম মনের কথা শোনার এক যন্ত্র আবিস্কার হল । এই যন্ত্রের কথা যখন সবাই জানতে পারবে পৃথিবী জুড়ে এক দারুণ আলোড়ন তৈরি হবে । কেননা এই যন্ত্র সব ভাষাই রেকর্ড করতে পারবে । এই যন্ত্রের দ্বারা না বলা অনেক কথাই জানতে পাড়া যাবে ।তবেই একটাই অনুরোধ বা শর্ত রেখো যাতে এই যন্ত্র , স্বামী -স্ত্রী যখন কথা বলবে তখন যেন কেউ ব্যবহার করতে না পারে । তাহলে স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ অনিবার্য । ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার সম্ভবনা থাকবে প্রচুর ।” হো হো করে হাসতে হাসতে অলীক বাবু বললেন – “ OK , AGREED” ।
আজও মনে পরে
সেদিনের কথা আজও মনে পড়লে মনটা বিষাদে ভরে ওঠে । অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সেদিনের কথা মুছে ফেলতে পারছি না । মুছে ফেলতে পারলে খুব ভাল হতো তাহলে অন্তত দুঃখটা কম হতো । আমি তখন মুম্বাইতে কর্মরত । একা থাকি মুম্বাইতে আর আমার পরিবার থাকে শিলিগুড়িতে । শিলিগুড়িতেই থাকে আমার এক দাদা বৌদি জানালো যে আমার কাছে কদিনের জন্য আসতে চায় ।কারণ বউদির হঠাৎ করে ক্যান্সার ধরা পড়েছে । তাই মুম্বাইয়ের টাটাতে চিকিৎসার জন্য আনতে চায় । সাথে সাথেই চলে আসতে বলে দিলাম । শিলিগুড়ি থেকে মুম্বাই আসতে হলে সেই দাদার – গৌহাটি ছাড়া আর কোন ট্রেন সেই সময় ছিল না । তাই ওনারা নির্ধারিত দিনে দাদার – গৌহাটিতেই রওনা হলেন আমার কাছে মুম্বাই আসার জন্য । এই ট্রেনটা ভি টি বা ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস হয়ে দাদারে এসে শেষ হয় । ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে অনেকক্ষণ দাঁড়ায় আর প্রায়ই ভালই লেট করে । তাই ওনাদের আমি বলেছিলাম কল্যাণ স্টেশন আসলে আমাকে একটা ফোন করতে তাহলে আমি ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে চলে আসবো আর ওখান থেকে নিয়ে আসবো । আমাদের শিলিগুড়িতেই থাকে এবং আমাদের খুবই পরিচিত আরেকটা ছেলে আস্রাব , বর্তমানে মুম্বাইতে কর্মরত সেও আসবে বলল ভিটি স্টেশনে আমাদের সাথে দেখা করতে ।কল্যাণ থেকে দাদা -বৌদির ফোন পেলাম যে ট্রেনটা অবিশ্বাস্য ভাবে প্রায় ঠিক সময় মতোই চলছিল , সামান্য একটু লেট । এটা শুনে আমি ওনাদের বললাম দাদার অবধি চলে আসতে তাহলে আমারও ভাল হয় আমি ওনাদের দাদার থেকেই নিয়ে আসতে পারবো । কেননা আমি তখন থাকি আন্ধেরিতে । আমার থেকে দাদার স্টেশন কাছে । আস্রাব বলল যে ও ভিটিতেই আসবে কারণ ওটাই ওর সুবিধা , পরে একদিন সময় করে আমার বাড়িতে আসবে ।ট্রেনটা সামান্য একটু লেট ছিল । আমি ওনাদের দাদারে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিলাম । শুনলাম আস্রাব এসেছিল ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে দেখা করতে । সাথে এনেছিল ফল । ওনাদের ট্রেন ছাড়া অবধি ও স্টেশনেই ছিল । আস্রাব বরাবরই পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিল । ও ছিল ওর বাবা -মার একমাত্র ছেলে তখন মুম্বাইতে চাকরী করে । ওর বাবা মা থাকতো শিলিগুড়িতে । তাই ওর জন্য ওর বাব -মা, দাদা- বৌদির হাতে করে কিছু নারু , মোয়া আর মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছিল ।সেগুলো পেয়ে আস্রাব খুব খুশী হয়েছিল । আমি ভেবেছিলাম দাদার স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ওনাদের নিয়ে আসবো কেননা মুম্বাইতে ট্রেনে যা ভিড় হয় ওনারা উঠতেই পারবেন না । কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম দাদার থেকে আন্ধেরির ট্রেনে খুব একটা ভিড় নেই । সাড়ে নটা বাজে অথচ ট্রেনে ভিড় নেই, খুবই অবাক হচ্ছিলাম । যাইহোক আমাদের তো ভাল , উঠে পড়লাম ট্রেনে । তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারবো । বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম । ভাগ্যকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম । হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল । দেখলাম শিলিগুড়ি থেকে আমার স্ত্রী ফোন করেছে ।হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওদিক থেকে চীৎকার শুনলাম – “ তোমরা এখন কোথায় ? ভিটি স্টেশনে নেই তো?”
- “ না, না আমি ভিটিতে যাইনি । আমি দাদারে এসেছিলাম ওনাদের নিতে । এখন ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছি ।”
- “ তুমি যে ভিটিতে না গিয়ে দাদারে এসেছ সেটা আমায় কেন জানাওনি ?”
– “ আরে এটা জানানোর কি আছে ?তুমি এমনি করে কথা বলছো কেন ?”
“ বাড়ি গিয়ে টিভি দেখ , তাহলেই বুঝতে পারবে । আমার হাত পা এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে ।”
“ আরে বাবা এতো চিন্তার কি আছে । তাড়াতাড়ি হাত পা গরম করে নাও ।”
“ মজা কর না । বাড়ি যাও তাহলেই বুঝবে । আর শোন বাড়ি পৌঁছেই আমাকে ফোন করবে । খুব চিন্তায় থাকবো ।”
“ কি হয়েছে বলবে তো ?”
“ টিভিতে বলছে একটু আগে ভিটি স্টেশনে প্রচুর গোলাগুলি চলেছে , অনেক লোক মারা গেছে ।”
“ তাই নাকি ? ঠিক আছে ফোনটা রাখ । আমি বাড়ি পৌঁছে তোমায় ফোন করছি ।”
বাড়ি পৌঁছেই টিভি খুললাম । ভাবতেই পারছিলাম না কি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল মুম্বাইতে ।আমাদের যে সময়ে ভিটি স্টেশনে থাকার কথা ঐ সময় কিছু জঙ্গি স্টেশনে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল । আর তাতে স্টেশনে উপস্থিত প্রচুর লোক মারা গেছিল । ভাবছিলাম ভাগ্যিস ওনাদের দাদার আসতে বলেছিলাম , নাহলে ঐ সময় আমরা ভিটিতেই থাকতাম । জানিনা কি হতো । হটাৎ মনে পড়ল আস্রাবের কথা । ও তো ঐ সময় ভিটিতে ছিল । সাথে সাথে মোবাইলে ওকে ধরার চেষ্টা করলাম । ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছিল না । ও যেখানে থাকে সেই জায়গাটাও চিনতাম না আর সেখানকার কারও ফোন নাম্বারও আমার জানা ছিল না । কি যে করবো বুঝতে পারছিলাম না । এমনি করেই সময় বয়ে যেতে লাগলো । ঠিক হল ফোনে যোগাযোগ না করতে পারলে কাল সকালে ওর অফিসে যাব ।
খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে যেতে বেশ রাত হল । সবে চোখের পাতা দুটো একটু বুঝে এসেছে এমন সময় আবার ফোন । মোবাইলে আস্রাবের নাম ভেসে উঠলো । তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা অচেনা গলা ভেসে আসলো। কি হল বোঝার আগেই ওপাশ থেকে একজন হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো আমি আস্রাবকে চিনি কিনা ? আমি হ্যাঁ বলাতে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি এখুনি একবার ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে আসতে পারবো কিনা ? আমি সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম- “ কে বলছেন ? কেন যেতে বলছেন ? এটা তো আস্রাবের ফোন ? ও কোথায় ?”
ওপাশ থেকে উত্তর আসলো – “ আমি মুম্বাই পুলিশের ইনেস্পেক্তর ভেদক বলছি । ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে আজ যে জঙ্গি হামলা হয়েছে তাতে আরও অনেকের সাথে আস্রাবেরও গায়ে গুলি লেগেছে । ওর মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার পেয়ে আপনাকে ফোন করছি এখন আর কথা নয় । আপনি তাড়াতাড়ি ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে চলে আসুন ।”
আমি আর শিলিগুড়ির দাদা সাথে সাথেই ছুটলাম ভিটি স্টেশনে । গিয়ে দেখলাম পুলিশে পুলিশে ছয়লাম । প্রচুর মানুষের ভিড় । যন্ত্রণায় চীৎকার করছিল বহু মানুষ । চারিদিকে রক্তের দাগ ।মাটিতে পড়ে ছিল বহু মানুষ ।চারপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল ।কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না । বুঝতে পারছিলাম না আস্রাব বেঁচে আছে কিনা ! একজন পুলিশকে ইনেস্পেক্তর ভেদকের কথা বলতেই আমাদেরকে ওনার কাছে নিয়ে গেল ।গিয়ে দেখলাম একহাতে মোয়ার শিশি আর একহাতে নারুর শিশি নিয়ে আস্রাব পড়ে ছিল মাটিতে । সারা জামা রক্তে ভিজে গেছিল । শুনলাম ওর বুকে গুলি লেগেছে ।মনে হচ্ছিল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে । কি করে আস্রাবের বাড়িতে খবর দেবো । কি করে বলবো এক জঙ্গির নৃশংস আচরনে আমাদের প্রিয় আস্রাব ভিটি স্টেশনে ২৬শে নভেম্বর ২০০৮ রাত্রি ৯ টা নাগাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেল ।এতে কার কি লাভ হল জানিনা কিন্তু এটা বুঝি যে যারা মারা গেল তাদের পরিবারের কি নিদারুণ ক্ষতি হল । তারা জানতেও পারলো না যে কি কারণে তাদের মারা হল ।
আমার ধর্ম আমার অধিকার
হাতে সেরকম কোন কাজ ছিল না তাই একা বসে বসে পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম মনে মনে । খুব ভাল লাগছিল । সিনেমার মতো এক একটা দৃশ্য এক এক করে সামনে আসছিল । হঠাৎই আমার চোখের সামনে ভেষে উঠলো আমাদের শিলিগুড়ির আবাসনের বেশ কিছু দিন আগের দুর্গাপূজার কিছু ঘটনা । সেবার আবাসনের অষ্টমী পূজার দিন সবাই সকালবেলা অঞ্জলীর জন্য দাঁড়িয়ে ছিল । পাড়ার এক মহিলা সবার হাতে ফুল- বেলপাতা দিচ্ছিল । হটাৎই একটা ৫ -৬ বছরের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠলেন – “আরে তুই এখানে? তুই কি অঞ্জলি দিবি নাকি? তোর বাবা – মা জানে?” ছেলেটি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো , তারপর বললো –“কেনো বাবাই , টুবাইয়ের হাতে তো ফুল দিলে , ওদের তো কিছু বললে না ।“ যেহেতু ছেলেটির বাবা অন্য ধর্মের তাই মহিলাটি কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না । ওর বাবা -মা একটু দুরে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিল । ওর মা এগিয়ে এসে বললো –“আমাদের কোনো আপত্তি নেই ।তোমাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে ওর ইচ্ছা ওকে পূরণ করতে দাও নাহলে এই ছোটবেলাতেই ওর মনে ভেদাভেদ তৈরি হবে।“ খুব ভালো লাগলো কথাটা শুনে এবং আরও ভাল লাগলো যখন দেখলাম সবাই খুশি মনে ব্যাপারটা মেনে নিল । বাচ্চাটিও ওর দুই বন্ধু বাবাই , টুবাইয়ের সাথে আনন্দের সাথে অঞ্জলি দিল । ছেলেটি অঞ্জলি কি জিনিষ জানে না । শুধু জানে ওর বন্ধুরা যা করছে ওকেও তাই করতে হবে ।
বাচ্চাটির বাবা আমার খুবই পরিচিত । ও ভালোবেসে বিয়ে করেছিল অন্য সম্প্রদায়ের একটি মেয়েকে । মেয়েটির বাড়ির লোকেরা কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারিনি । অন্য জাত বা অন্য কাস্ট হলে বাড়ির লোকেদের আপত্তি হতো না যদি দুজনে একই ধর্মের হত । অগ্যতা দুই বাড়ির চরম অসন্তোষের মধ্যে ওরা দুজনে একে অপরের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ল অজানার উদ্দেশ্যে । আমরা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । নিয়ে আসলাম আমাদের আবাসনে । দুজনেই সাবালক এবং যথেষ্ঠ শিক্ষাদীক্ষা আছে ওদের মধ্যে। অর্থনৈতিক সংগতিও আছে । সুতরাং কোনো ঝামেলাই বেশিদিন টিকলো না । ওরা চুটিয়ে সংসার করতে লাগলো । দুপক্ষেরই কিছু আত্বীয়স্বজন লুকিয়ে যোগাযোগ রাখা শুরু করলো ।
আমরা সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলাম । মাঝে মাঝে ছুটির দিনে ওরাও আসে আমাদের বাড়িতে , আমরাও যাই ।একসাথে খাওয়া- দাওয়া , গল্প -গুজব করে বেশ ভালই সময় কাটছিল ।ওদের বাড়িতে একটা মজার জিনিস দেখছিলাম ।খুব একটা গোঁড়া না হলেও ধর্মীয় কিছু আচার ও অনুষ্ঠান ওদের পালন করতে দেখেছি । সেটাও একসাথে এবং দুই ধর্মেরই । যেহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান দুজনেরই ছোটবেলা থেকেই রন্ধে রন্ধে ঢুকে গেছে , তাই হয়ত দুজনে দুজনের মত মানে। দুজনের কারও কোন আপত্তি দেখনি । আমরাও খুশি কারণ একই জায়গায় দুই সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করছি । অনেকদিন ধরে দেখে আসছি কোন হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করলে মেয়েটি ধর্ম পরিবর্তন করে, এমনকি এতদিনকার নাম পরিবর্তন করে মুসলিম নাম রাখে। আবার দেখেছি কোন হিন্দু ছেলে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলে ছেলেটি তার ধর্ম পরিবর্তন করে এবং সেই এতদিনকার নামও পরিবর্তন করে নূতন নাম নেয়।
কিন্তু আমাদের কাছে ওরা দুজনে আগে যা ছিল তাই আছে ।একই নাম , একই পদবি ,একই ধর্ম , একই আচার , একই বেশ, কোনো পরিবর্তন চোখে পরে না । এমনি করে বেশ আনন্দেই কাটছিল ওদের জীবন ।
পরিবারের সংখ্যা বাড়লো ।ছোট্ট এক নুতন অতিথি জন্ম নিল ওদের ঘরে । নুতন অতিথির আকর্ষনে দুই পরিবারের মিলন হলো । ছেলের বাড়ি আর মেয়ের বাড়ি উভয়েই সব ভুলে মেতে উঠলো আনন্দে ।আমরাও দারুন খুশি । বাচ্চাটাও দুই বাড়ির আদরের সাথে বড় হতে লাগলো । বা ও মা, ঠাকুরদা ও ঠাকুমা এবং দাদু ও দিদিমার কাছ থেকে শিখতে লাগলো দুই ধর্মের আচার ও অনুষ্ঠান । ওদের বাড়িতে বসে একদিন জমিয়ে আড্ডা মারছিলাম ওদের একটা কথা আমাদের সবাইকে দারুনভাবে নাড়িয়ে দিল ।বলে কিনা, বাচ্চা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হবে তখন ও ঠিক করবে ও কোন ধর্ম নেবে বা আদৌ কোনো ধর্ম নেবে কিনা । ওরা চাপিয়ে দেবে না । আর এই জন্য ওরা বাচ্চার কোনো পদবি রাখেনি ।এ নিয়ে তো কোনো দিন চিন্তাই করিনি । বাবার যা ধর্ম ছোটবেলা থেকে তাই মেনে এসেছি । ব্যাপারটা ভালই লাগলো । সত্যিই তো ১৮ বছরে একজন ভোট দানের অধিকার পায় , সাবালক হয় তাহলে সেই সময় ধর্ম পছন্দ করার অধিকার সে পাবে না কেন ।যদি সব স্কুলে ছোটবেলা থেকে সব ধর্ম পড়ানো হয় তাহলে সবাই সব ধর্ম সমন্ধে ভাল করে জানতে পারবে এবং ভবিষ্যতে কোন ধর্মালম্বী হবে বা আদৌ হবে কিনা সেটা সে নিজেই ঠিক করতে পারবে । অন্যান্য দর্শনের মত যে কোনো ধর্মগ্রন্থ তো একটা ভাববাদী দর্শন। প্রত্যেকেরই অধিকার আছে তা ভালোভাবে জানার এবং মন থেকে মানার বা না মানার ।ব্যঙ্গ করার অধিকার কারো নেই । যেটা দেখা যায় শুধুমাত্র হিন্দুদের দেবদেবী নিয়ে । এর মধ্যে যা লেখা আছে সেটা কারো পছন্দ হতে পারে বা নাও হতে পারে । কিন্তু মানা বা না মানার সাথে ব্যঙ্গ বা ভয়ের কোনো সমন্ধ নেই । ভয় দেখিয়ে যেমন ভালবাসা করানো যায় না আবার ভয় দেখিয়ে তেমনি ভালবাসা শেষ করাও যায় না । ধর্মের সাথে যোগাযোগ মানসিক শান্তির , ক্রোধের নয় বা ভয় দেখানো নয় । মাঝে মাঝে দেখি অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ ফেসবুকে কোনো ছবি শেয়ার করতে বা ফরওয়ার্ড করতে বলে , করলে খুব ভাল হবে , না করলেই অমঙ্গল ।এতো সরাসরি ভয় দেখানো । কোনো ধর্মে এর স্থান আছে বলে আমার মনে হয় না । প্রচার প্রচারের মতই হওয়া উচিত । কেউ যদি এক ধর্মকে আলিঙ্গন করতে চায় সেটাতো সেই ধর্মের মানুষের কাছে আনন্দের । কোনো রকম বাঁধা দেওয়া তো উচিত নয় । সানন্দে গ্রহণ করাইতো উদারতা । আগুনের ধর্ম যদি হয় পোড়ান , জলের ধর্ম যদি হয় ভেজানো তাহলে মানুষের ধর্ম নিশ্চয় মনুষ্যত্ব ।ধর্ম সমন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের কথা খুব মনে পড়ছে ওনি বলেছিলেন – ”ধর্ম এমন একটি ভাব, যাহা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। ” যাইহোক ধর্ম কি এবং ধর্ম কাকে বলে এই নিয়ে বিস্তর লেখা আছে । আমার শুধু এই পৃথিবীর কাছে একটাই অনুরোধ পৃথিবীর সব মানুষের কাছে ধর্ম হোক তার নিজস্ব অধিকার ।
ইন্টারভিউ
আজকেই বিকালে ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেড়ানোর কথা ছিল ।সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে ঝা চকচকে মাইক্রোসফটের অফিসে তাই সবাই বসে ছিল । সবাই সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে এবং চাকরীর জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে । প্রচুর ছেলে মেয়ে লিখিত পরীক্ষায় বসেছিল । তারমধ্য থেকে এই ২০০ জনকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছিল । সবার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে শুধু রেজাল্ট বেড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে সবাই । ইন্টারভিউয়ের শেষে নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দিয়ে দেবে । কিন্তু না , সবাইকে জানানো হল যে কাল একইসময়ে সবার আবার ইন্টারভিউ হবে আর তারপর রেজাল্ট জানানো হবে । কিছু করার নেই তাই সবাই আবার পরেরদিন যথা সময়ে এসে হাজির । সবাইকে বসান হল বোর্ড রুমে । বিশাল বড় বোর্ড রুম । পুরু কার্পেট দিয়ে মোড়া । পাশের ঘরেই কিছুক্ষণ বাদে শুরু হবে ইন্টারভিউ । হটাৎ ঘরে প্রবেশ করলো ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান । সবাই দাঁড়িয়ে উঠে ওনাকে সন্মান জানালো । সবাইকে বসতে বলে ওনি শুরু করলেন- আমি জানি তোমরা সবাই যারা ইন্টারভিউ দিতে এসেছ তাদের সকলের মাতৃভাষা বাঙালি । তাই আমি বাংলাতেই বলছি । তোমাদের কারও বাংলা বুঝতে অসুবিধা হলে হাত তোল । একটু থেমে আবার ওনি বলতে লাগলেন – গুড , তারমানে কারও কোন অসুবিধা নেই বরং আমার মনে হয় তোমাদের মধ্যে বেশ অনেকজন ইংরাজির থেকে বাংলায় বেশী সরগরম ।তাই যেহেতু কাল ইংরাজিতেই ইন্টারভিউ হয়েছে তাই আমার মনে হয় তোমাদের মধ্যে অনেকেই নিজেকে উজাড় করে ইন্টারভিউ দিতে পারনি । এতে কোন লজ্জা নেই । আমরা কোয়ালিটির বিচার করবো ভাষার নয় । যে ছোটবেলা থেকে যে ভাষা শিখে বড় হবে সে সেই ভাষা ভাল বলতে পারবে । তার জন্য পুথিগত শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই । শিক্ষার সাথে একটা মানুষের কোয়ালিটির বিচার হয় । সে শিক্ষা যে কোন ভাষায় হতে পারে । তাই আমরা ঠিক করেছি আজ আবার সবার ইন্টারভিউ নেবো এবং তোমরা যে যে ভাষায় বেশী পারদর্শী সেই ভাষাতেই ইন্টারভিউ দেবে । তোমরা যে যে ভাষায় খুশী ইন্টারভিউ দিতে পার । আমি আবার বলছি যে আমরা কোয়ালিটির বিচার করবো ভাষার নয় । পড়াশুনায় ভাল হতে গেলে চেষ্টা চাই আর ব্রেনটাকে ভাল মতো খাটানো চাই । কিন্ত ভাষা শেখার জন্য শুধু শুনতে হবে আর চাই বলার অভ্যাস । যারা বাংলা মিডিয়াম থেকে পড়ে এসেছ তাদের জন্য আমি আমার কথা বলবো । আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম । থাকতাম এক গ্রামে । সেখানে গ্রামের স্কুলেই বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি । ছোটবেলা থেকে পড়াশুনায় আমি বরাবরই ভাল । মাধ্যমিকে ও উচ্চ মাধ্যমিকে আমি স্ট্যান্ড করেছি । ইচ্ছা ছিল আই আই টিতে পড়ার কিন্তু ইংরাজিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পারলাম না । তাই ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্টে ভাল রেজাল্ট করে কোলকাতার নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম ।ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করলাম ঠিকই কিন্ত ইন্টারভিউতে আটকে যাচ্ছিলাম গড় গড় করে ইংরাজি বলতে না পাড়ার জন্য । কি করবো বাড়ির অবস্থা ভাল নয় চাকরী আমাকে একটা করতেই হবে। তাই ব্যাঙ্কে চাকরীর জন্য চেষ্টা করলাম এবং পেয়েও গেলাম । পোস্টিং পেলাম বাড়ির থেকে অনেক দূরে দিনাজপুরের একটা গ্রামে। ছোট্ট শাখা । মোটে আমরা তিনজন। খুব খারাপ লাগতো । কাউকে কিছু বলতে পারতাম না । ধীরে ধীরে পয়সা জমাতে লাগলাম আর GRE র জন্য নিজেকে তৈরি করতে লাগলাম । ওই যে বললাম পড়াশুনায় খারাপ ছিলাম না তাই GRE র রেজাল্ট বেশ ভাল হল । অথচ আমার ইংরাজির উচ্চারণ শুনে আমারই কিছু বন্ধু বান্ধব যারা ইংরাজি মিডিয়ামে পড়েছে তারা আমাকে ব্যাঙ্গ করত । ব্যাস অ্যামেরিকার এক ভাল University তে MS পড়ার সুযোগ পেলাম । চলে গেলাম অ্যামেরিকা । আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল । দু মাসের মধ্যেই ইংরাজি বলাটা রপ্ত হয়ে গেল ।কারণ ওখানে ভুল বললে কেউ ব্যাঙ্গ করত না বা হাসত না । যেটা আমাদের দেশে খুব হয় । পাশ করে বেড়িয়েই মাইক্রোসফটে চাকরী পেলাম । কাজের সুনাম হল এবং তাড়াতাড়ি বেশ কটা প্রোমোশনও পেলাম । তাই আমার বিশ্বাস কোয়ালিটির বিচার করতে হলে যে যে ভাষায় পারদর্শী সেই ভাষাতেই ইন্টারভিউ নেওয়া উচিৎ । আশা করি আজ তোমরা সবাই কালকের থেকেও ভাল ইন্টারভিউ দেবে ।মনে রাখবে যদি কোয়ালিটি থাকে তাহলে কোন কিছুই বেশীদিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না ।
ইস্পাতের রং নীল
ট্রেনটা কানপুর স্টেশনে দাঁড়াতেই সার্থক ওর সুটকেসটা নিয়ে নেমে পড়লো । অচেনা শহর । প্রথম চাকরী । তাও আবার বাড়ির থেকে হাজার কিমি দূরে । সম্পূর্ণ অপরিচিত এক গণ্ডির মধ্যে । কিছু করার নেই । চাকরীটা সার্থককে এই মুহূর্তে করতেই হবে । চারিদিক দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে ও স্টেশন থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসলো । প্রচুর সাইকেলরিক্সা দাঁড়িয়ে আছে । সুটকেস নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই একটা রিক্সা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো – “কাহা জানা হ্যায় বাবুজি ?”
- আরমাপুর । যায়গা?
হিন্দিটা খুব ভাল বলতে পারেনা সার্থক । তাই যদি নূতন লোক মনে করে বেশী টাকা চায় তাই বেশী কথা আর বলল না সার্থক । সুটকেসটা পায়ের কাছে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো । ও শুনেছে রিক্সায় আরমাপুর যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে । শহরের মধ্যে দিয়ে রিক্সা চলেছে তার গতি নিয়ে । সার্থক ভাল করে চারিদিক দেখছে । শহরটাকে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । কালপী রোডের উপর দিয়ে যেতে যেতে ডান হাতে দেখতে পেল একটা গেট যার উপর লেখা আছে ARMAPUR ESTATE । ওর রিক্সা গেটের মধ্যে ঢুকে পড়লো । দুপাশে একতলা সব কোয়াটার । সোজা আর একটু এগিয়ে যাওয়ার পর সামনেই একটা চৌরাস্তা । বাঁ হাতে একটা লাল রঙের মন্দির । সার্থক রিক্সা দাড় করিয়ে এদিক ওদিক দেখছে এমন সময় ওর নাম ধরে কে যেন ডেকে উঠলো । তাকিয়ে দেখে কিছু দূরে সাম্য দাঁড়িয়ে । সাম্য ওর ছোটবেলার বন্ধু । যে কোম্পানিতে ও কাজে যোগদান করবে সেখানেই ও কাজ করে । সাম্যর কথায় রিক্সা ছেড়ে হাতে সুটকেস নিয়ে চলল সাম্যর সাথে সাথে । কাছেই থাকে সাম্য । দুকামরার একটা কোয়াটার, কোম্পানিই ঠিক করে দিয়েছে । এবার থেকে ওরা দুজনেই ওখানে একসাথে থাকবে । দুজনেই অবিবাহিত । তাই কোন অসুবিধা হবে না ।
পরেরদিন সকালে নিদিষ্ট সময়ে সার্থক সাম্যর সাথে পৌঁছে গেল ওদের সাইট অফিসে । বিশাল এক কারখানা তৈরি হচ্ছে । চলছে তার কর্মকাণ্ড। অনেক বড় বড় কোম্পানি এখানে কাজের বরাত পেয়েছে । ওদের কোম্পানি বড় বড় পিলার তৈরি করার বরাত পেয়েছে যার উপর অত বড় কারখানাটা দাঁড়িয়ে থাকবে । সবাই টেম্পোরারি সাইট অফিস বানিয়েছে ।সাম্যই সার্থককে ঘুরে ঘুরে সাইটটা দেখাতে লাগলো আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো ।হটাৎই পিছনে সাম্যদা ডাক শুনে দুজনেই পিছনে তাকাল । সার্থক দেখল কালো করে ১৯ -২০ বছরের এক স্বাস্থ্যবান যুবক ওদের দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। সাম্যই পরিচয় করিয়ে দিল। বলল ওর নাম বিপ্লব ।ওর বাড়ি ঘাটশিলার ধারাগিরি ফলসের কাছে বাসাডেরা গ্রামে । ও একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড়। বিপ্লব সাম্যকে বলল যে ওদের কাজ শেষ হয়ে গেছে তাই ওরা কালই বিকালে রওনা দেবে । সাম্য বিপ্লবকে কাল যাওয়ার আগে একবার ঘুরে যেতে বলল । বিপ্লব মাথা নাড়িয়ে সার্থকের দিকে একটু হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল । কি সরলতায় ভরা সে হাসি । বিপ্লব চলে যেতেই সাম্য বলতে লাগলো ঘাটশিলা শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের উপরে ওদের গ্রাম । সামান্য কিছু চাষবাস ছাড়া ওদের জীবন ধারনের আর কিছুই নেই । স্কুলে যেতে গেলেও অনেক দূরে পায়ে হেঁটে যেতে হয় । ঘাটশিলা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মধ্যে পরে কিন্তু ওদের গ্রামে ওরা সবাই বাংলায় কথা বলে । খুবই গরীব সবাই । ওদের গ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশ জন এসেছে এখানে কাজ করতে । বিপ্লবের ধ্যান জ্ঞান শুধু ফুটবল ।ওর স্বপ্ন ও একদিন বড় ফুটবলার হবে । কিন্তু বাড়ির জন্য ওকে ফুটবল ছেড়ে এখানে কাজে আসতে হয়েছে ।কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে বলে ও দারুণ খুশী । গিয়েই আবার ফুটবল খেলতে পারবে । ওকে তাই সাম্য কাল আসতে বলেছে কারণ ওর ইচ্ছা ওকে কিছু ফুটবলের জিনিস কিনে দেব । সাম্য আরও বলল যে খুব ভাল ছেলে বিপ্লব । সবার বিপদে ঝাপিয়ে পরে । ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে হোগলা পাতার সব ঘর ওখানেই সব অদক্ষ শ্রমিকরা থাকে । এখানে কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে এসেছে এখানকার লেবার কন্টাকটার ।লোকাল লোক কাউকে নেয়নি ।আর সেই সব শ্রমিকদের থাকার জায়গার পাশে একটা মুদি খানার দোকান খুলে দিয়েছে যাতে শ্রমিকদের খাবার জিনিসের জন্য অন্য কোথাও যেতে না হয় । সব শুনে সার্থকের লেবার কন্টাকটার লোকটার প্রতি ধারনাটা ভাল হল । এখানে প্রত্যেকটা কোম্পানির নিজস্ব দক্ষ শ্রমিক আছে শুধু লেবার কন্টাকটারের কাছ থেকে কোম্পানিগুলো অদক্ষ শ্রমিকদের ভাড়া নেয় ।সাম্যর থেকে আরও জানা গেল যে কিছুদিন আগে লোকাল কতগুলি লোফার ছেলে ওদের ওখানকার মেয়ে শ্রমিকদের কুপ্রস্তাব দিতে এসেছিল । বিপ্লব শাবল নিয়ে এমন তাড়া করেছিলো যে ওরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ।বিপ্লবের জন্যই এখানে মহিলা শ্রমিকদের উপর কেউ খারাপ নজর দিতে পারে না । সার্থক যত বিপ্লবের কথা শুনছে ততই যেন বিপ্লবের প্রতি আকর্ষণটা তীব্র হচ্ছে ।
পরেরদিন ঠিক সময়ে সাইট অফিসে এসে সার্থক দেখে কোথাও কোন কাজ হচ্ছে না । শ্রমিকরা সবাই হরতাল করেছে ।একটু খোঁজ নিতেই ব্যাপারটা জানা গেল। লোকমুখে ঘুরছে পুরো ঘটনাটা । যেহেতু ওদের কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং ওরা দেশে ফিরে যাবে তাই বিপ্লব ওর গ্রামের লোকজনদের নিয়ে কন্টাকটার বাবুর কাছে গেছিল ফাইনাল হিসাবের জন্য । ওদের এই এক বছরের মজুরির থেকে মুদিখানার হিসাব কেটে বাকী টাকা নেওয়ার জন্য ।কিন্তু হিসাব দেখে ওদের মাথা ঘুরে গেল । যাতে বাড়ি ফেরার সময় হাতে বেশী টাকা নিয়ে দেশে ফিরতে পারে তাই ওরা মুদিখানার থেকে কম কম জিনিস নিত ।কিন্তু মুদিখানার হিসাব দেখে ওরা অবাক । মুদিখানার হিসাব যা হয়েছে তাতে ওরা প্রত্যেকেই হাতে সামান্য টাকা পাবে । কন্টাকটার বাবু ভেবেছিল শ্রমিকরা সবাই অশিক্ষিত তাই যা হিসাব বলবে সবাই তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। আর বাইরে থেকে সবাই এসেছে তাই কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না । ভাবতেই পারিনি যে বিপ্লব একটু পড়াশুনা জানে এবং ও ব্যাপারটা ধরে ফেলবে ।বিপ্লব আগে থেকেই সবাইকে শিখিয়ে রেখেছিল যে মুদিখানার প্রত্যেক দিনের হিসাব বিপ্লবকে এসে বলতে আর বিপ্লব সেগুলো সব লিখে রাখতো ।এছাড়াও প্রত্যেকটা জিনিষের দাম বাজার থেকে অনেক বেশী ধরা হয়েছে । গরীব অশিক্ষিত মানুষকে ঠকানো সোজা কিনা । কিন্তু ওদের মধ্যে যে বিপ্লবের মতো কেউ আছে সেটা কন্টাকটার বাবু ভাবতেই পারিনি । প্রথমে বিপ্লবকে আলাদাভাবে কিছু লোভ দেখাল কিন্তু বিপ্লব রাজি না হওয়ায় ভয় দেখানো শুরু করলো । বিপ্লব ভয় পাওয়ার ছেলেই নয় । তাই লেগে গেল তুমুল কথা কাটাকাটি । তারপর শুরু হোল হাতাহাতি । বিপ্লবও ছাড়ার পাত্র নয় , বেধড়ক মার দিল কন্টাকটারকে আর বলল যদি ঠিকমত হিসাব না করে তাহলে সবাই মিলে ওর বাড়ি ঘেরাও করবে । ঐ মুহূর্তে কন্টাকটার বাবু পালিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু কিছু পরে পুলিশ এসে বিপ্লবকে ধরে নিয়ে গেল ।কেননা ঐ কন্টাকটার বাবু থানায় গিয়ে বিপ্লবের নামে ভুলভাল রিপোর্ট করেছিল। কন্টাকটার বাবুর টাকার গরম আছে তাই পুলিশও কিছু না শুনে বিপ্লবকে থানায় ধরে নিয়ে গেল আর বাকী সবাইকে শাসিয়ে গেল । তাই সব শ্রমিকরা মিলে ঠিক করলো যতক্ষণ না বিপ্লব মুক্তি পাচ্ছে ততক্ষণ হরতাল চলবে । ব্যাপারটা শুনে সবারই খুব খারাপ লাগছিল । সার্থকও বিপ্লবের জন্য কিছু করার একটা তাগিদ অনুভব করছিল ।সার্থক ঠিক করলো লেবার কমিশনারকে একটা চিঠি দেবে । সেই মতো একটা চিঠি তৈরি করলো আর বেশ কয়েকজন শ্রমিকদের দিয়ে সাইন করিয়ে নিল । তারপর সাম্যকে নিয়ে সার্থক গেল লেবার কমিশনারের অফিসে । লেবার কমিশনারের সাথে দেখা করে চিঠিটা দিল এবং ওনাকে খুব করে অনুরোধ করলো ব্যাপারটা নিয়ে তাড়াতাড়ি কিছু করার জন্য । লেবার কমিশনার কথা রেখেছেন, সাথে সাথেই নিজেই চলে এসেছেন সব খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ।হরতালের খবরও সব শুনলেন । শ্রমিকদের বললেন যে ওনি ব্যাপারটা দেখছেন এবং অনুরোধ করলেন হরতাল তুলে নেওয়ার জন্য । কিন্তু শ্রমিকরা নাছোড়বান্দা বিপ্লবকে না ছাড়লে কিছুতেই হরতাল তুলবে না । কন্টাকটার লোকটার কাছে সব খবর পৌছাল । ও ভাবতেই পারিনি যে বাইরের লোকের জন্য এতো কাণ্ড হয়ে যাবে ।তারমধ্যে আবার লেবার কমিশনারের কাছে রিপোর্ট হয়ে যাওয়াতে খুব ভয় পেয়ে গেল । আর কিছুদিন হরতাল চললে ওর দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারলো । টাকা পয়সার ব্যাপারটা এই ধরনের লোকেরা ভাল বোঝে । তাই থানায় গিয়ে বিপ্লবের নামে সব কেস তুলে নিল । বিপ্লবও মুক্তি পেল আর ওরা ওদের প্রাপ্য টাকা বুঝে পেল ।
তারপর কাজ করতে করতে একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল সার্থক টেরও পেল না ।বিপ্লব চলে যাওয়ার পর ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ ছিল না । কিন্তু হটাৎ একদিন সাম্য একটা খবরের কাগজ নিয়ে এসে সার্থককে দেখাল ।সার্থক দেখল বিপ্লবের ছবি বেড়িয়েছে কাগজে । ঝাড়খণ্ডের হয়ে বিপ্লব সন্তোষ ট্রফিতে বিহারের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করেছে । সার্থকের মনটা আনন্দে ভরে গেল । নিজের অজান্তেই বলে উঠল বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ।
কাজের মেয়ে
মা , আজ তো আমার জন্মদিন তাইনা ? আমি আজ ১৪ বছরে পড়লাম । আজ তোমাদের কি আমাকে মনে পড়ছে ? সত্যি আজ তোমাদের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করছে আমার । কিন্ত জানি সেটা সম্ভব নয় । আমি এখন তোমাদের থেকে অনেক দূরে কোলকাতা শহরে । আমি জানি তোমাদের কাছে তেমন পয়সা নেই যে আমার সাথে দুদণ্ড দেখা করতে আসবে ।আমার যখন খুব ইচ্ছা করছে তখন আমি জানি তোমাদেরও খুব ইচ্ছা করছে আমার সাথে দেখা করার। আমাকে তোমাদের কাছে রাখার । চাইলেই তো হবে না আমায় কি খেতে দেবে বল । তোমাদেরই প্রতিদিন খাওয়া জোটে না । তাই তো বাধ্য হয়ে আমাকে তোমাদের থেকে এত দূরে কাজ করতে পাঠিয়েছ । প্রথম প্রথম যখন কাজ করতে আসলাম তখন বেশ আনন্দই হচ্ছিল । তোমরা বলেছিলে প্রতিদিন খেতে পাবো , ভাল জামা কাপড় পড়তে পারবো । শহরের আদব কায়দা শিখতে পারবো । সত্যি মা , তিনবেলা খেতে পারছি । দিদিমনির পুরানো ভাল ভাল জামা কাপড় পরতেও পারছি তবুও মনটা মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে । তোমাদের কাছেই ছুঁটে যেতে ইচ্ছা করে । আমার স্বাধীনতা যেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে । আমার নিজের কোন ইচ্ছা নেই । জানো মা , আমাদের এই বাড়ির পাশেই একটা পার্ক আছে। আমার বয়সী মেয়েরা বিকাল বেলা সবাই মিলে কত আনন্দ করে । আমাকে সেই সময় কিছু না কিছু কাজ করতে হয় । মাঝে মাঝেই জানলার কাছে গিয়ে লুকিয়ে ওদের খেলা দেখি । কেননা বাড়ির কেউ দেখে ফেললেই বকাবকি করবে । বলবে কাজে ফাকি দিচ্ছি । মনটা হু হু করে ওঠে ।
প্রথম যেদিন বাবা আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলো , সেদিনটার কথা আমার খুব ভালো করে মনে আছে । এই বাড়ির বসার ঘরে সোফায় কর্তাবাবু , কর্তামা আর আমার থেকে একটু বড় একটা দিদি বসে ছিল। বাবা বসেছিল মাটিতে । আর আমি বাবার পাশে বাবাকে ধরে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমি ভাবছিলাম সবাই তো উঁচুতে বসে আছে , বাবা কেন মাটিতে বসে । আমাদের বাড়িতে তো এরকম উঁচুতে বসবার জায়গা নেই তাই বাবা বোধহয় মাটিতে বসতেই পছন্দ করেছে । কিন্তু এখন বুঝি – বাবুরা যাতে বসে আমাদের তাতে বসার অধিকার নেই । বাবুরা যেখানে শোয় আমাদের সেখানে শোয়ার অধিকার নেই । কর্তামা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমার বয়স কত । বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কর্তামাকে বলেছিল – “এই ১৩ বছর মেমসাহেব” । কর্তা বাবু খুব জোরে হেসে উঠেছিল । বলেছিল – “ সাহেব , মেম কবে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে নিজেদের দেশে চলে গেছে । এখন আর কেউ সাহেব , মেম নয় । আমরা কর্তাবাবু , কর্তামা । এই নামেই ও আমাদের ডাকবে । আর আমদের মেয়েটিকে ও ডাকবে দিদিমনি বলে ।” কর্তামা আমকে বলেছিল – “ এই দিদিটা তোর থেকে দুবছরের বড় । এই দিদিটার বেশ কিছু জামা কাপড় ছোট হয়ে গেছে । তোকে দেব এক এক করে । যদি ভালো মতো কাজ করিস তাহলে সব জামাকাপড় পাবি । নাহলে না । এই দিদিটার সাথে মাঝে মাঝে তুই খেলতে পাবি ।দিদিটার সাথে মাঝে মাঝে বসে টিভি দেখতে পাবি”। খুব আনন্দ হয়েছিল । আমাদের বাড়িতে তো টিভি নেই তাই । তখন তো আমি বুঝিনি যে বনের পাখীটাকে খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হচ্ছে ।
জানো মা , সেদিন দিদিমনির এক বন্ধুর জন্মদিনে সেই বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম কর্তামা আর দিদিমনির সাথে । এমনিতে সব অনুষ্ঠান বাড়িতে ওনারা আমাকে নিয়ে যায় না । ওখানে দিদিমনির বন্ধুরা কেক কাটল । সবাই মিলে খুব আনন্দ করছিল । আমি এক কোনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম । বসার জায়গা ছিল কিন্তু জানি ওখানে আমি বসলে কর্তামাই আমাকে উঠিয়ে দেবে । বসার পরে সবার সামনে উঠিয়ে দিলে আমার কান্না পাবে । তাই আগে থাকতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমি নিজেকে নিমন্ত্রিত বলে ভাবতেই পারছিলাম না । যদিও নিমন্ত্রণ করার সময় ওনারা আমাকেও নিয়ে যেতে বলেছিল । দিদিমনি যাদের সাথে খেলছিল তারা সবাই আমারই বয়সই । একটু ছোট – বড় । আমার দিকে ওরা তাকাচ্ছিল কিন্তু আমাকে খেলতে ডাকছিল না । খুব লজ্জা করছিলো । ইচ্ছা করছিলো ওখান থেকে ছুটে বাইরে চলে যাই । তবে একটা জিনিষ আমার খুব ভাল লেগেছে । খাওয়ার সময় আমি সবার সাথে টেবিল চেয়ারে বসে খেয়েছি । বাড়িতে প্রতিদিন আমি মেঝেতে বসে খাই । এখানে কাজের লোকেরা মেঝেতে বসেই খায় , বাবুদের মতো টেবিল চেয়ারে বসে খায় না । আজ টেবিল চেয়ারে বসে খেতে কি ভালই না লাগছিল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । এখানে কেবল অনুষ্ঠান বাড়িতেই বাবুরা আর কাজের লোকেরা একসাথে টেবিল চেয়ারে বসে খায় । বাড়িতে গেলে আবার যে কি সেই ।
জানো মা, এদের বাড়িতে একটা বড় ঠাণ্ডা মেশিন আছে । যেখানে খাবার রাখলে নষ্ট হয় না । খাবার বেঁচে গেলে এখানে রাখে , পরে বের করে খায় । আমাদের বাড়িতে তো খাবার বাঁচেই না । ভাত যদি বাচে তাহলে তুমি জল ঢেলে রাখ । এখানে এমনি রাখলেই হয় । এত খাবার রাখা হয় যে অনেক সময় মনেই থাকে না কি কি রাখা আছে । যেদিন দেখা হল , দেখা গেল সেই খাবারটা একটু বেশিদিন রাখা আছে । ওনারা তো সেই খাবার খাবে না । বড় খাবার দোকান থেকে আনা খাবারও থাকে অনেকসময় । আমায় জিজ্ঞেস করে আমি খাব কিনা ? কি ভাল ভাল দেখতে সব খাবার । আমরা কোন দিন খাইনি । অনেকসময় আমার লোভ হয় । খেয়ে নিই । মাঝে মাঝেই খাবার ফেলা যায় । তোমাদের সবার কথা খুব মনে হয় তখন । ভাইটার কথা বেশী করে মনে হয় । অনেকসময় কর্তামা আমাকে বকাবকি করে কেন আমি খাবারগুলোর কথা মনে করিয়ে দিইনি । আমিতো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ছোট । তবু কেন আমার দায়িত্ব হবে ? আমি কাজের লোক বলে !
তোমার কি মনে আছে গতবছর দুর্গাপূজার দু / তিন মাস আগে আমি এখানে এসেছিলাম । পুজতে কর্তামা আমাকে দিদিমনির ছোট হয়ে যাওয়া দুটো ফ্রক দিয়েছিল । দিদিমনি আর পরে না । কি সুন্দর দেখতে । পুরানো তো কি হয়েছে ? পূজার সময় আমাদের আগে তো কেউ কক্ষন জামা কাপড় দেইনি । আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছিল । ষষ্টি পূজার দিন সামনেই বাড়ির কাজের মহিলার সাথে সন্ধ্যাবেলা আমি ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছিলাম । চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে ।নদীর মতো মানুষের মিছিল খালি বয়ে চলেছে । তোমাকে চলতে হবে না , পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তোমায় এগিয়ে দেবে । কাছাকাছি অনেক ঠাকুর দেখলাম । আমাদের ওখানে ঠাকুর দেখতে আমাদের কতদূর পায়ে হেঁটে যেতে হতো বল । পূজার কদিন স্কুল বন্ধ থাকতো । তাই আমরা খাওয়া পেতাম না । পূজার কদিন কোথায় কাঙালি ভোজন হয় সেই খোঁজ নিয়ে আমাদের খেতে যেতে হত । কিন্তু জানো মা এখানে বাড়িতে ভোগ দিয়ে যায় । কর্তাবাবু , কর্তামা , দিদিমনি কেউ খায় না । শুধু হাড়িতে হাত লাগিয়ে প্রনাম করে । ব্যাস আমিই দুবেলা খাই । কর্তাবাবু , কর্তামা , দিদিমনিরা পূজার কদিন বাইরেই খায় । তোমাদের কথা খুব মনে হচ্ছিল । বাবা তো পূজার কদিন থাকে না । ঢাক বাজাতে অনেক দূরে চলে যায় টাকা রোজগারের জন্য । পূজার সময় বাবা থাকে না , তোমার খুব খারাপ লাগে আমি জানি । কিন্তু কিছু করার তো নেই । যাদের টাকা পয়সা আছে পুজায় তাদের আনন্দ । আমাদের আবার পূজা !
যাক গে । তুমি কিছু ভেব না । আমি সব মানিয়ে নেব । মানিয়ে তো আমাকে নিতেই হবে তাইনা ? গ্রামে থাকলে তো খেতে পাবো না । স্কুলে গেলে শুধু দুপুরবেলা খেতে পেতাম । যেদিন স্কুল বন্ধ থাকতো সেদিন তো আর খাবার পেতাম না । এছাড়া তোমাদের আরও কত খরচা আছে । আমাকে কাজ না করলে চলবে কেন ? তবে মা , আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের কেন কাজ করতে হবে । আমারা কেন ছোটবেলাটা পাবনা দিদিমনিদের মতো । আমাদের কি দোষ ? অনেক কথা মনে আসলো তাই মনে মনে বললাম । যদি তুমি শুনতে পাও । আমি তো আর লিখতে জানিনা আর তুমিও পড়তে জাননা । তাই আমাদের অনেক্ কথা আমাদের ভিতরেই থেকে যায় । জানো মা , আমাদের একটা গালভরা নাম আছে পরিচারিকা । আসলে ২৪ ঘণ্টার কাজের লোক ।
ভাল থেকো । শুধু মনে বিশ্বাস রাখ একদিন সুদিন আসবেই আসবে ।
চিড়িয়াখানা
একদম ফাঁকা রাস্তা । মাঝে মাঝে দু- একজনকে দেখা যাচ্ছে । হটাৎ হটাৎ একটা দুটো গাড়ি ভুস করে চলে যাচ্ছে । রাস্তাটা বেশ চওড়া । এই আলিপুর রোড দিয়ে একা একা হাঁটতে সার্থকের খুব ভাল লাগছিল । চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখে কোথাও কোন লোকজন নেই । প্রধান গেটে নেই কোন পাহারাদার । একেবারে ফাঁকা । এই লকডাউনে রাস্তা দিয়ে হাটলে যদি পুলিশ ধরে তার থেকে ভাল চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়া যাক ।কোথাও যখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না আর একটা ছোট গেট খোলা আছে তখন কোন কিছু না ভেবে সার্থক ঢুকে পড়ল চিড়িয়াখানায় । দেখলো লেখা আছে এই চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১মে ১৮৭৬ সালে । আর আজকের তারিখ ১ মে ২০২০ । মানে আজ থেকে প্রায় ১৪৪ বছর আগে । কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না । করোনার জন্য চিড়িয়াখানা বন্ধ । নইলে কি ভীষণ ভিড় হয় ।অবশ্য বৃহস্পতিবার সাধারণত বন্ধই থাকে চিড়িয়াখানা । কেউ যখন আটকাচ্ছে না তখন সার্থক ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো । প্রথমেই বাঁদিকে দেখলো একটা বিরাট ম্যাপ যেখানে কোথায় এবং কতদূরে কি জন্তু আছে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও বাঘের ছবি , শিম্পাঞ্জীর ছবি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ওনারা কোথায় আছেন । কারন বাচ্চারা ওনাদের দেখতে ভীষণ আগ্রহী ।শীতকালে পিকনিকের আমেজ থাকে এই চিড়িয়াখানায় । করোনার জন্য দূষণের মাত্রা এখন অনেক কম । কলকাতাতে এখন খুব সুন্দর আবহাওয়া । গরম নেই বলেই চলে । তাই ঘুরতে ভালই লাগছিল । একটু সোজা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল রয়েল বেঙ্গল টাইগার । মনের আনন্দে খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে । নইলে এই সময় গরমের জন্য ছায়ায় শুয়ে থাকতে হতো । সার্থকে দেখে বাঘটা একগাল হাসি দিল আর হালুম করে বলে উঠলো ‘ ভাগ্যিস করোনার জন্য কেউ আসছে না নইলে তো আবার নিউইয়র্কের মতো আমাদেরও করোনা হয়ে যেত । শুনলাম ওখানে নাকি এক বাঘিনী বা সিংহীর মানুষের মতো করোনা হয়েছে ।আমরা তো আবার তোমাদের মতো বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারবো না । হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাইয়ে দিলে যদি আবার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে তোমাদের মতো বমিভাব, মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি পরিবর্তন এবং পেশীর দুর্বলতা হয় তাহলে তো তোমাদের জাতীয় পশু হিসাবে সন্মানে লাগবে । তার থেকে ভাল করোনা টরোনা ঠিক হয়ে যাক তারপরেই চিড়িয়াখানা খুলুক । ও আরেকটা কথা পাশের বড় গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখ কত বাদুর । ওটা ওদের একটা গ্রাম । ওই বাদুর থেকেই তো শুনলাম তোমাদের এই কোভিট ১৯ ভাইরাসটা এসেছে ।তা বাপু তুমি এখন এখান থেকে যাও ।’ অগ্যতা বাঁদিকে একটু এগিয়ে গেল সার্থক । সামনেই দেখলো একদল জেব্রা । আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের হাতের ছাপ যেমন আলাদা তেমন প্রত্যেকটা জেব্রার গায়ের ছাপও আলাদা । ওকে দেখে ঘোড়ার মত চিঁহি করে উঠলো একটি জেব্রা । মনে হল বলছে ‘ তোমরা তো এই কদিনের লকডাউনেই হাপিয়ে উঠেছো আর আমাদের দেখো বছরের পর বছর লকডাউনে আছি । তোমরা শুনেছি লকডাউন ঠিক করে মানছোই না । পুলিশ দিয়ে তোমাদের মানাতে হচ্ছে । আমাদের মতো খাঁচায় আটকে রাখলে কি করতে । তোমাদের ভাষায় আমরা তো সবসময় Quarantine বা Hospital এ আছি । Quarantine থেকে ১৪ দিন বাদে তোমরা ছাড়া পেয়ে যাও কিন্তু আমাদের থাকতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত ।’ শুনতে একদম ভাল লাগছিলনা সার্থকের । খালি মানুষের বদনাম । উল্টোদিকে শিম্পাঞ্জীর খাঁচা ওখানেই ও গেল ।ওকে দেখে শিম্পাঞ্জী কটা লাফ দিয়ে নিল তারপর যেন মানুষের মতো বলে উঠলো ‘ চিড়িয়াখানার গেট কি খুলে দিয়েছে ? সবাইকে আবার ঢুকতে দিচ্ছে ?আজ তো মেদিবস ।বেঙ্গলে তো আজ সবার ছুটি । তাহলে অনেকে আসবে , তাইনা ? সত্যি একা একা আর ভাল লাগছে না । সারা দিন ঘরের মধ্যে কিছু করার নেই । কারও সাথে একটু কথা বলবো তারও উপায় নেই । আর তাছাড়া লোকজন না আসলে আয় হবে না , কতদিন আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে বল ?’ কি উত্তর দেবে ? তাই কিছু না বলে আর একটু এগিয়ে গেল সার্থক । দেখা হল ব্রাজিলের অ্যামাজনের জঙ্গল থেকে আনা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বাঁদর মারমোসেট (Marmoset ) যার উচ্চতা মাত্র ১৯ সেন্টিমিটার । ব্রাজিলের করোনার আক্রান্ত প্রায় ৮০০০০ এবং মারা গেছে প্রায় ৫৫০০ তা শুনে দেখলাম মারমোসেট মর্মাহত । আমাদের দেশে আছে ঠিকই কিন্তু মন তো পরে আছে ব্রাজিলে । তাই ওখানে না দাঁড়িয়ে আর একটু এগোতেই দেখলো বড় বড় দুটো কচ্ছপ বা অ্যালডেবরা জায়েন্ট টরটয়েস।যাদের নাম কথা আর কলি ।সার্থকের দিকে তাকালোও না ।ওরা দুজনে একে অপরের সাথে ভালই আছে । ওরা একটু আলাদাই থাকতে চায় । তবে অদ্বৈত নামে এখানে আগে ২৫০ বছরেরও বেশি বয়সের এক দৈত্যাকার কছপ ছিল যেটা ২০০৬ সালে মারা যায় ।এরপর আর কোথাও না গিয়ে সার্থক সোজা গিয়ে পৌছাল পাখীর খাঁচার সামনে । কিচির মিচির করে পাখিরা কথা বলেই চলেছে । সার্থক যেন ওদের প্রতিটা কথা বুঝতে পারছে । অনেকটা টিয়ার মতো দেখতে কিন্তু খুব রঙিন একটা ম্যাকাউ (Macaw) পাখি কাকাতুয়াকে বলছে , ‘ দ্যাখ, আমরা মুক্ত বিহঙ্গ , আমাদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে লাগে না কোন ভিসা , লাগে না কোন যানবাহন । লকডাউন হলেও আমরা কোন নিয়ম ভাঙি না , মানুষের মতো কারও ক্ষতি আমরা করিনা তবুও আমাদের ওরা নিজেদের স্বার্থে বন্দী করে রাখে । নিজেরা বলে মানব না শৃঙ্খলে , মানব না বন্ধনে কিন্তু আমাদের পশু , পাখিদের সাথে উল্টোটাই করে । কথায় এক আর কাজে আরেক । মানুষ জাতিটা যদি না থাকতো তাহলে পরিবেশে এতো দূষণও হতো না আর আমাদের পশু পাখিদের পরাধীন হয়ে থাকতে হতো না । নিজেরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে আর আমাদের পরাধীন করে রাখবে । আমরা সব পশু, পাখিরা এক হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে যদি লড়াই করতে পারতাম বা নিদেন পক্ষে প্রতিবাদ করতে পারতাম তাহলে মানুষ জাতিটার একটু শিক্ষা হতো । পৃথিবীর সর্বত্র চিড়িয়াখানা খুলে আমাদের অনেককে ধরে রেখেছে । পরিবারের সবাইকে নিয়ে যদি একসাথে রাখতো তাহলেও একটা কথা ছিল । কিন্তু তা করবে না । যাকে পাবে তাকে ধরে নিয়ে আসবে । আমাদের পরিবার যে কি কষ্ট পায় তা একবারের জন্যও ভাবে না ।দারুণ নিষ্ঠুর এই মানুষ ।’ কাকাতুয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো ‘ আমার ছেলে , মেয়ে , বৌ , বৃদ্ধ বাবা , মা কোথায় আছে , কি খাচ্ছে কিচ্ছু জানিনা না । কিচ্ছু করার নেই , তাই বসে বসে শধু কাঁদি । মানুষরা ভাবে আমাদের মন বলে কিছু নেই । শুধু ওদেরই আছে ।যেদিন সব পশু , পাখি ওদের অধিকার সন্মন্ধে সচেতন হবে আর সবাই একসাথে চীৎকার করে বলবে – এই পৃথিবী আমাদের সকলের , আমাদের সকলের সমানভাবে বাঁচার অধিকার আছে । কোন রকম দমন পীড়ন আমরা মানবোনা । এক মে দিবসে মানুষ ওদের অধিকার অর্জন করেছিল , আরেক মে দিবসে আমরা অর্জন করবো আমাদের অধিকার ।’
সার্থকের নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল । যাতে ওকে কেউ দেখতে না পারে তার জন্য জোরে দৌড় লাগালো । কিন্তু পা যেন কিছুতেই চলছে না। ও চীৎকার করে উঠলো । সাথীর ধাক্কাতে ওর ঘুম ভেঙে গেল । সাথী জিজ্ঞেস করলো – “ কিগো এমন চীৎকার করছিলে কেন ? স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি ?”
জলাশয়
দাদা একটু দাঁড়ান । প্লাস্টিকের ব্যাগ ভর্তি ময়লা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলার আগে একটু আমার সাথে কথা বলবেন ।
- অনেকদিন ধরেই এখানে ময়লা ফেলে আসছি । কেউ কোনদিন বাঁধা দেয় নি ।এখন please disturb করবেন না । তাড়া আছে । কেন? কে আপনি ? আপনাকে তো আমি চিনিনা ।
- আমি কাছেই থাকি । আমি আপনার বেশী সময় নেব না । সবার বাড়িতে তো প্রত্যেকদিন সকালবেলা corporation এর গাড়ি আসে বাড়ির ময়লা নেওয়ার জন্য । তা আপনি কেন ওখানে ময়লা ফেলেন না?
- সকালের দিকে তাড়া থাকে গাড়ি কখন আসে টেরই পাইনা ।
- কেন প্রত্যাকদিন এক সময়ে আসে না? হুইসেল বাজায় না ?
- তা আসে । হুইসেলও বাজায় কিন্তু আমরা রেগুলার ফেলে উঠতে পারিনা । যেদিন পারিনা সেদিন এই পুকুরে এসে ফেলি ।
পাশ দিয়ে কয়েকজন কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে যাচ্ছিল । আমাদের কথা শুনে ওরা দাঁড়িয়ে গেল । ওদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো – এমনিতেই জলাভুমি জমিরাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচান যাচ্ছে না । যেখানে সেখানে জলাভুমি বুজিয়ে ফ্লাট বাড়ি বানিয়ে ফেলছে ।আমারা সাধারণ জনগণ যদি এমনি করে ময়লা ফেলে আমরাই পুকুর ভরিয়ে দিই তাহলে তো জমিরাক্ষসদের পোয়াবারো । - ঠিক বলেছিস । একজনকে দেখলে সবাই ফেলতে শুরু করবে – আরেকটি ছেলে বলে উঠলো ।
সবচেয়ে লম্বা যে মেয়েটি চোখ থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে বললো – জানিস তো পুকুরে অনেক ছোট ছোট জলজ উদ্ভিদ হয় । এই উদ্ভিদগুলো সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে জলের মধ্যে প্রচুর অক্সিজেন মিশিয়ে দেয় । জল ভাল থাকে আর সেই জল মাছ , পশু পাখি খেয়ে সুস্থ থাকতে পারে ।। এই প্লাস্টিক ভর্তি ময়লা ফেলে এইসব গাছগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে । তার ফলে পুকুরের জল পচে যাচ্ছে । - শুধু যে মাছ, পশু পাখিই অসুস্থ হচ্ছে সেটা ভাবলে চলবে না । আমরাও অসুস্থ হতে পারি ।
- কেমন করে?
- এই প্লাস্টিক তো আর জলে বা মাটিতে মিশে যাবে না । ছোট ছোট টুকরো হয়ে জলে ভেসে বেড়াবে । কোন মাছের পেটে যাওয়ার পর যদি সেই মাছটা আমরা খাই তাহলে আমরাও অসুস্থ হবো ।
ভদ্রলোক ব্যাগ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন । প্লাস্টিকটা পুকুরে ফেলতেও পারছে না আবার চলে যেতেও পারছেন না । বুঝতে পারছি আমাকে মনে মনে খুব গালি দিচ্ছেন । যাকগে মনে মনে বলছেন তো ক্ষতি নেই কেউ শুনতে পারছে না ।
আরেকজন মেয়ে বলে উঠলো – এই যে জৈব পদার্থগুলো ফেলা হচ্ছে এর কুফল কি জানিস । বেশী জৈব পদার্থ একসাথে পচন ধরলে জল দূষিত হয়ে যায় । - এছাড়া পুকুর, দীঘিতে যেটা হয় সেটা কুয়োতে হয় না ।
- কি জিনিষ? অন্য ছেলেমেয়েরা বলে উঠল ।
- পুকুর দীঘির জল একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, হালকা হাওয়ার জন্য ওপরের জলে ছোট ছোট ঢেউ হয় তারফলে বাতস থেকে কিছু অক্সিজেন জলে মিশে যায় । এছাড়া বৃষ্টির জল পুকুর, দীঘি এরাই তো ধরে রাখে । কতদিন কত কাজে লাগে এই জল বল ।এছাড়া পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখে এইসব জলাশয় । এই যে দেখুন দুটো হাঁস জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে , কি সুন্দর লাগছে । জলাশয় না থাকলে সেটাও দেখা যাবে না ।
ভদ্রলোক আর না থেকে বলে উঠলেন – তোমাদের কথা শুনে ভাল লাগলো । তোমরা এই বয়সেই কত কি জানো । আমাদেরই দোষ । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দোষী হওয়ার থেকে তোমরা আমায় বাঁচালে । আমাকে একটা জিনিষ বল , যদি পুজর ফুল হয় তাহলে কি করবো , সেটা তো আর corporation এর গাড়িতে দিতে পারবো না । - পুজর ফুল প্লাস্টিক থেকে বেড় করে পুকুরে ফেলতে পারেন । কারণ ফুল, জলে – মাটিতে একদম মিশে যাবে । কিন্তু প্লাস্টিক কখনই জলে ফেলবেন না । পুকুরের ধারে যদি ময়লা ফেলার জায়গা থাকে সেখানে ফেলবেন ।
- এবার আমি ভদ্রলোককে বলতে বাধ্য হলাম – আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে আপনি আমাদের কথা মেনে নিলেন । অনেকেই তো বুঝতেই চায় না শুধু ঝগড়া করে । তাকে কেউ মানা করবে সেটা মানতেই চায় না । জলাশয় বাঁচিয়ে রাখা পরিবেশের ভালর জন্য খুব দরকার ।
- ঠিক বলেছেন কাকু । পুকুর প্লাস্টিকে ভরে থাকলে কি বিচ্ছিরি লাগে । প্লাস্টিকের ব্যাগ ছাড়া অন্য জিনিসের ব্যাগ ব্যবহার করলে তা জলে বা মাটিতে মিশে যায়, প্লাস্টিকের মতো ক্ষতি করে না ।
- একদম ঠিক ।Carry bags made of paper, cloth, jute and other eco-friendly materials can be used as alternatives to non-biodegradable plastic carry bags.
ডিভোর্স
“ এতক্ষণ ধরে আপনারা আমাদের প্রিয় ইউনিভার্সিটির বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যে ধৈর্য সহকারে শুনছেন তার জন্য উপস্থিত সকল শ্রোতাদের জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ।এই অনুষ্ঠান যে আপনাদের আনন্দ দিচ্ছে তা আপনাদের করতালির শব্দে আমরা অনুভব করতে পারছি । আপনারা জেনে খুশী হবেন যে এবারের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আমরা বাইরে থেকে কোন শিল্পীকে ভাড়া করে আনিনি । এবারের সব শিল্পীই আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্র – ছাত্রীরা । আমরা চাই আমাদের ছাত্র , ছাত্রীদের প্রতিভা আপনাদের সবার সামনে আসুক । তাই এবার আপনাদের সামনে আমরা উপস্থিত করছি আমাদের ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিঙের ফাইনাল বর্ষের ছাত্র সার্থক রায়কে । সার্থকের আরেকটা প্রতিভা নিশ্চয় আপনারা জানেন । হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন – সার্থক খুব ভাল ছবি আঁকে । এবারের আমাদের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় সার্থক প্রথম হয়েছে । যাইহোক আর দেরী নয় , এবার আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসছে সার্থক রায় ।” – ঘোষকের বলা শেষ হতেই মঞ্চে প্রবেশ করলো একটি সৌম্য দর্শন যুবক । তারসাথে আরও কয়েকজন যুবক মঞ্চে আসলো বাদ্যযন্ত্র সহকারে । ঘোষক একে একে মঞ্চে উপস্থিত সকল শিল্পীর সাথে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিল । সার্থক গান শুরু করতেই সবার গুঞ্জন থেমে গেল , শুধু শোনা যাচ্ছিল মাইকে গানের আওয়াজ । মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা সার্থকের গান শুনছিল । এরপর আরও অনেক শিল্পী ছাত্র , ছাত্রী এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে মাতিয়ে রাখল । সবাই খুশী ইউনিভার্সিটির ছাত্র , ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক দক্ষতা দেখে ।
পরেরদিন সকালে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে ঢোকার মুখে সার্থকের ধাক্কা লাগলো একটি মেয়ের সাথে । আসলে সার্থক ছিল খুবই আনমনা ।
মনটাও ভাল ছিল না । মেয়েটি আর একটু হলেই পরে যেত ভাগ্যিস সার্থকের ঠিক সময়ে হুশ ফিরে আসে এবং ওকে ধরে ফেলে । কিন্তু পরমুহূর্তেই খুব লজ্জা পেয়ে গেল । এমনিতেই সার্থক খুবই শান্ত স্বভাবের এবং কম কথা বলে ।তবুও সার্থক বলে উঠলো – “সরি, প্লীজ কিছু মনে করবেন না । আমি ইচ্ছা করে করিনি । আমারই দোষ । আমি খুব আনমনা ছিলাম। তাই একদমই খেয়াল করিনি । কি বাজে ব্যাপার হল বলুন তো !” মেয়েটি হাসি মুখে জবাব দেয় – “যে এতো সুন্দর হৃদয় দিয়ে গান গাইতে পারে তার হৃদয় যে অপরিষ্কার হবে না সেটা আমি জোড় দিয়ে বলতে পারি । যাইহোক আমি সাথী । এবার ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বিএসসিতে ভর্তি হয়েছি ।”
সার্থক বললো – “আমি সার্থক, আমি কম্পুউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেকের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ।”
- “আমি জানি । আমি কাল অনুষ্ঠানে ছিলাম । ওখানেই আপনার পরিচয় পেলাম । আপনি তো খুব ভাল ছবি আঁকতেও পারেন । আমি আপনার ছবি আঁকাও দেখেছি । ছবিটার মধ্যেও আমি কিন্তু আপনার হৃদয়ের স্পর্শ পেয়েছি ।”
সার্থক একটা বোকা বোকা হাসি দিল । কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না । সাথী বলতে থাকলো – “ বলতে নেই আপনি একটা দারুণ সুন্দর গলা পেয়েছেন । তার সাথে যোগ হয়েছে আপনার মাথা আর হৃদয় । এই তিনটে জিনিসের সমন্বয়ে যেটা কাল শুনলাম এক কথায় অনবদ্য । খুব ভাল লেগেছে । এবার আসি আপনার ছবির প্রসঙ্গে । ছবির মধ্যে যদি মনের ছোঁয়া না থাকে তাহলে সেটা শুধু ছবিই হবে , জীবন্ত রূপ তার মধ্যে থাকবে না আর সেটা অন্য কাউকে স্পর্শ করতেও পারবে না । কিন্তু আপনার ছবির মধ্যে সেই জীবন্ত রূপ ছিল যেটা আমি দেখতে পেয়েছি । আপনার ছবি আর গান শুনে আমি আপনার হৃদয়টা যেন উপলব্ধি করতে পারছি । কিছু মনে করবেন না , আমার মনে হয় আপনার বুকের ভিতর কোথাও যেন একটা ব্যাথা আছে ।” - সার্থক একটু ঘাবড়েই গেল । ওর সমন্ধ্যে সাথী কিছু জানে নাকি । ও তো কাউকে কোনদিন কিছু বলেনি । তাহলে এই মেয়েটা কি করে এই কথাটা বললো । ও কি সত্যিই অন্যের হৃদয় পড়তে পারে নাকি! সার্থককে চুপ থাকতে দেখে সাথী ভাবল যে ও নিশ্চয় সাথীর কথায় মাইন্ড করেছে ।ও কি একটু বেশী বলে ফেললো ।
- “আচ্ছা চলি । আমার আবার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে ।”
সাথীর কথা শুনে সার্থকের সম্বিৎ ফিরে আসলো । খুব ভাল লাগছিল সাথীর সাথে কথা বলতে । কি সুন্দর কথা বলে মেয়েটি ।অনেকদিন পরে কাউকে যেন মনে হল দারুণ আপন । যেন কত দিনকার চেনা । সাথীর সঙ্গ খুব ভাল লাগছিল সার্থকের ।তাই মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল – “আবার কখন দেখা হবে?” বলেই বুঝতে পারলো এইরকম তো ওর স্বভাব না । না জানি সাথী কি মনে করলো । কিন্তু সাথী হেসে একটা কাগজে কি লিখে দিল । সার্থক দেখল একটা ফোন নাম্বার । সাথী বললো – “যখন দেখা করতে ইচ্ছা হবে আমাকে ফোন করে দেবেন । আমি হাজির হয়ে যাব । এখন আসি ।” সার্থক এমনই একটা ছেলে যাকে ভাল না লেগে উপায় নেই । সাথীরও সার্থককে ভাল লাগলো । সাথী এগিয়ে গেল । সার্থক বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে সাথীর চলে যাওয়া দেখল । তারপর নিজের ক্লাসের দিকে এগিয়ে চললো ।
এরপর অনেক কটা দিন বয়ে গেছে । সাথী আর সার্থক একে অপরকে অনেকটা সময় দিয়েছে । দুজন দুজনের অনেকটাই কাছে এসে গেছে । সার্থক বিটেক পাশ করার পর কোলকাতার বাইরে একটা ভাল চাকরী পায় । কিন্তু সাথীর টানে সে চাকরীটা ও ছেড়ে দেয় । ওই ইউনিভার্সিটিতেই এম টেক নিয়ে ভর্তি হয় । সাথীও মনে মনে দারুণ খুশী । একে অপরের সঙ্গ পেতে আর কোন অসুবিধা রইলো না । এমনি করেই চলতে থাকলো ওদের রূপালি দিনগুলো । আরও নিবিড় হল ওদের বন্ধুত্ব । সুন্দর সময় তাড়াতাড়ি চলে যায় । ওদের জীবনের এই দুটো বছর খুবই তাড়াতাড়ি কেটে গেল । দুজনেই ভালভাবে পাশ করলো । আর পাশ করার সাথে সাথে সার্থকও একটা ভাল চাকরী পেয়ে গেল । কিন্তু পোস্টিং কোলকাতার বাইরে । ওরা ঠিক করলো যে এবার বিয়ে করে নেবে আর দুজনে মিলে শুরু করবে ওদের নূতন জীবন। এতদিন যখনই ওদের দেখা হতো কোথা দিয়ে যে সময় চলে যেত ওরা টেরই পেতো না । কত বিষয় নিয়ে ওরা অলোচনা করতো কিন্তু কোনদিন পারিবারিক বিষয় ওদের আলোচনার মধ্যে আসেনি । সার্থক এখন জানলো যে সাথী ওর বাবা , মার একমাত্র মেয়ে । ওর পুরো নাম সাথী সান্যাল । ওরা থাকে বালিগঞ্জে । আর সাথী জানতে পারলো যে সার্থকরা দুই ভাই । সার্থক বড় । ওরা থাকে গড়িয়াতে ।সাথী ওর বাবা, মাকে সার্থকের কথা বলেছে । এতো ভাল ছেলে ওর বাবা, মার আপত্তি করার কোন কারণই নেই । সাথী সার্থককে বললো – - “তোমার বাবা, মাকে নিয়ে এরমধ্যেই একদিন আমাদের বাড়িতে আসো । কবে আসবে আমাকে জানিয়ে দিও । আমি বাড়িতে বলে রাখবো । তুমি বাইরে যাওয়ার আগে দুই বাড়ির মধ্যে সব কথাবার্তা হয়ে যাক । নাহলে আমার খুব টেনশন হবে ।” সার্থক বললো যে ও ওর মাকে সাথীর কথা সব বলেছে এবং এটাও বলেছে যে ওরা বিয়ে করতে চায় । বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তা বলে সাথীকে জানাবে যে ওরা কবে আসবে ।
- সাথী আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে কেননা একটু পরেই সার্থক ওর বাবা, মাকে নিয়ে আসবে ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে । সময় যেন কাটতেই চায় না । অবশেষে বেল বাজলো । সাথী আর ওর মা এগিয়ে গেল দরজার দিকে । ঘরে ঢুকল সার্থক আর ওর পিছনে পিছনে ঢুকল ওর বাবা, মা । সার্থককে দেখে প্রথম দর্শনে সাথীর মার খুব পছন্দ হোল আবার সাথীকে দেখে সার্থকের বাবা, মার খুব পছন্দ হোল । অবশ্য ওদের দুজনকে অপছন্দ করার কোন কারণই নেই । সবাই সোফাতে বসতে বসতে সাথীর বাবা নমস্কার করতে করতে ঘরে ঢুকলেন । সাথীর বাবাকে দেখে সার্থকের মা সোফার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন । জিজ্ঞেস করলেন – “তুমি?” সাথীর বাবা বললেন – “হ্যাঁ, আমি সাথীর বাবা । তুমি কি সার্থকের মা । সার্থক কি আমাদের শুভ ?”
- “হ্যাঁ , আমি ওর ছোটবেলার তোমার দেওয়া নাম বদল করে সার্থক রেখেছি । কারণ আমি চাইনি তোমার কোন স্মৃতি নিয়ে ও বড় হোক । তা তুমি তো জামশেদপুর ছিলে , এই কোলকাতায় কবে আসলে ?”
বাকী সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে , কেউ কিছু বুঝতে পারছে না । তবে সবাই এটা বুঝতে পারছে যে সার্থকের মা আর সাথীর বাবা দুজনে দুজনের অনেকদিনের পরিচিত ।মুখ খুললো সাথীর বাবা । সার্থকের মাকে বললো –“ তোমার আমার ডিভোর্স হওয়ার পর কিছুদিন আমি জামসেদপুরে ছিলাম । তারপর আমি জামশেদপুর ছেড়ে নতুন চাকরী নিয়ে কোলকাতায় চলে আসি । শুনেছিলাম তুমিও শুভকে নিয়ে জামশেদপুর ছেড়ে কোথাও চলে গেছো । তোমার আর শুভর আর কোন খোঁজ আমার কাছে ছিল না । কোলকাতায় এসে সাথীর মার সাথে পরিচয় হয় এবং আমাদের বিয়ে হয় । সাথী আমাদের একমাত্র মেয়ে ।” সার্থকের মা বললো – “ সার্থকের তখন দুবছর বয়স ।তোমার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ওকে নিয়ে আমি কোলকাতায় আমার বাবার বাড়ি চলে আসি । আমি একটা স্কুলে চাকরী নিই । এমনি করেই চলছিল । তারপর সার্থকের এখনকার বাবা আসে আমার জীবনে । আমাদের আরেকটি ছেলে হয় । আমরা সবাই এখন দারুণ খুশী ।” এখানে বসেই সার্থকের মনে পরে যাচ্ছিল ছোটবেলার কথা । চোখের সামনে সিনেমার মতো সব ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকলো । মনে পড়ছিল প্রতিদিন বাবা, মার চীৎকার করে ঝগড়া করার ঘটনা । পরে বুঝতে পেরেছিল যে দুজনের এতো শিক্ষা থাকা সত্বেও একে অপরকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলতো । বাবা , মার যখন ঝগড়া হতো সার্থক খুব ভয় পেয়ে যেত । চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতো । কতদিন ভাল করে খাওয়া হতোনা । বাবা, মা অনেক সময় কেউ কারও সাথে কথাই বলতো না । ওর খুব খারাপ লাগতো ।এসব ভাবতে ভাবতে ও চীৎকার করে উঠলো –“ থামাও তোমাদের বাক্যালাপ । তোমাদের পুরানো কথা শুনতে আমার একদম ভাল লাগছে না । তোমরা তোমাদের স্বার্থে ছাড়াছাড়ি করেছো ।একবারের জন্য ভেবেছ ওই ছোট ছেলেটার কথা ।ওরও তো একটা মন বলে কিছু ছিল । প্রকাশ করতে পারতো না বলে তোমরা ওর কথা ভাবলেই না । সংসারে যে আরেকটি প্রাণী আছে তার কথা বেমালুম ভুলে গেলে ।আমাকে আনার আগে কেন তোমরা একে অপরকে ছেড়ে দিলে না । অনেক সংসারে তো ভালবাসা থাকে না কিন্ত দায়িত্ব , কর্তব্য বোধ থেকে সংসার টিকে থাকে । নিজের নিজের দোষ না দেখে একে অপরের দোষই খালি দেখে গেলে । আগে বুঝে নিতে তোমাদের বনিবনা হবে কিনা , তারপর সন্তান আনতে । যেহেতু তোমাদের দুজনের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছিল তাই ছাড়াছাড়ি হতে খুব বেশী চিন্তা করলে না । কতদিন আমি কারও সাথে ভাল করে মিশতে পারিনি যদি আমাকে কেউ আমার বাবা মার কথা জিজ্ঞেস করে এই ভয়ে । কি বলবো ? আমার বাবা মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । একবারের জন্য ভেবেছ এই কথা । ছোটবেলায় সবার বাবা স্কুলে আসতো শুধু আমার বাবা আসতো না ।ওই বয়সে আমার ছোট ছোট বন্ধুদের দেখতাম ওদের বাবার কোলে উঠে ওরা কত আবদার করতো । আমার ভীষণ কষ্ট হতো । মাকে আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে মা কোন জবাব দিত না ।আর এখন তোমরা ভাল ব্যবহার করছো । একে অপরের খোঁজ নিচ্ছ । আমার ছোটবেলাটা নষ্ট করে তোমাদের শান্তি হয়নি , এখন আমার বড়বেলাটা নষ্ট করতে এসেছো ।” এই বলে সার্থক কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল । বোঝা যাচ্ছিল ওর দুচোখ জলে ভড়ে আছে ।আর সাথী, অবাক হয়ে ওর বাবা আর সার্থকের মার দিকে দেখছে । বুঝতে পারলো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে । কাউকে কিছু না বলে দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে । দরজা বন্ধ করে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো । কিছুতেই মন মানতে পারছে না যে ওদের এতো দিনকার স্বপ্ন, ভালবাসা সব এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে ? - যখন সার্থক চোখে জল নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল আর সাথী চোখের জল সবাইকে লুকিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছিল তখন কিন্তু সাথীদের বসার ঘরে বাকী সবাই বসে ছিল । সার্থকের বাবা , মা আর সাথীর বাবা , মা । সবারই খুব খারাপ লাগছিল । সার্থকের বাবা বলে উঠলেন –“ ওদের কি দোষ । ওদের যখন ভালবাসা হয় তখন তো ওরা জানত না যে ওদের পিছনে এরকম একটা ঘটনা আছে । আমার ওদের জন্য খুব খারাপ লাগছে । তোমরা একটু অন্য রকম ভাবে ভাবতে পারো না ?” সাথে সাথে সার্থকের মা জবাব দিল –“ দেখো সাথীকে আমারও খুব ভাল লেগেছে । কিন্তু হিসাব মতো ওরা ভাই -বোন । তাই কিছুতেই ওদের বিয়ে হতে পারে না ।”এতক্ষণ সাথীর বাবা চুপ করে বসেছিল । এখন সাথীর মার দিকে তাকিয়ে বললেন –“ আমরা দুজনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , আজ মনে হচ্ছে সেটা ভাঙতে হবে ।” সাথীর মা মাথা নাড়লেন অর্থাৎ সন্মতি দিলেন । সাথীর বাবা আবার বলতে লাগলেন – “ আজ আমি এমন একটা কথা সবার সামনে বলবো যে সবাই চমকে উঠবেন । সাথীকে একদম ছোটবেলায় আমরা দত্তক নিয়েছি । আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কোনদিন কাউকে একথা জানাবো না কারণ সাথী কোনদিন জানতে পারলে ভীষণ দুঃখ পাবে । কিন্তু আজ ভাগ্যের কি পরিহাস । এই কথা জানলে সাথী সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবে । তাই আমাদের মনে হয় বিয়েতে আর কোন বাঁধা রইলো না । আমরা ওদের দুই হাত এক করে দিতে পারি ।যাও তুমি গিয়ে সাথীকে বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসো ।” এই কথা শুনে সাথীর মা সাথীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল । সার্থকের বাবা সার্থকের মাকে বললো – “ তুমিও যাও সার্থককে ডেকে আনো । ও নিশ্চয় গাড়িতে বসে আছে । ওই তো ড্রাইভ করে আমাদের এনেছে । আমাদের না নিয়ে ও যাবে না যতই ওর কষ্ট হোক । ওকে সব বুঝিয়ে বলো ।”
- ব্যাস সব কষ্টের অবসান । এখন শুধুই আনন্দ । ওদের দুজনকে এক করতে এবার দুটো পরিবারই উদ্যোগ নিচ্ছে । কিন্ত এখন যে করোনার প্রকোপ , বড় করে অনুষ্ঠান করা যাবে না । তাই ঠিক হলো সামনের মাসে ছোট করে রেজেস্ত্রি করে বিয়ে করে নেওয়া হবে এবং করোনা কাটলে হবে আসল অনুষ্ঠান ।
দুর্নীতি
অনেকদিন পর ছোটবেলার বন্ধুরা সবাই একত্রিত হয়েছে সার্থকের বাড়িতে । চলছে নির্ভেজাল আড্ডা । আর বাঙালির আড্ডা মানে তো কোন নিদিষ্ট বিষয় নিয়ে চর্চা করা নয় , যখন যে বিষয় কেউ উস্থাপন করবে সেটা নিয়েই চলবে কথোপকথন । তবে দেখা গেছে প্রায় সব আড্ডাতেই খেলা আর রাজনীতি এই দুটো বিষয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসে । এখানেও আসলো । রাজনীতি আসা মানে প্রথমেই আসে দুর্নীতির প্রসঙ্গ । সবারই এক কথা যে দুর্নীতি দেশটাকে শেষ করে দিল । সাম্য একটা রেস্টোরেন্টের উদাহরণ দিল । বললো – “ একটা রেস্টোরেন্টের কোন কর্মচারী যদি লুকিয়ে কোন একটা খাবার খেয়ে ফেলে তাতেও সেই রেস্টোরেন্টের বিরাট কোন ক্ষতি হয় না কিন্তু যদি কেউ রেস্টোরেন্টের ক্যাশ বাক্স থেকে লুকিয়ে ক্যাশ নিজের পকেটে ঢোকায় তাহলে সেই রেস্টোরেন্ট ক্ষতির মুখ দেখতে বাধ্য । আমাদের দেশের অবস্থাও তাই । ক্যাশ চুরি হচ্ছে ।
উদয়ন জিজ্ঞেস করলো – “ আচ্ছা বল দুর্নীতি বলতে আমারা কি বুঝি ?”
বিপ্লব উত্তর দিল – “ যে ব্যাক্তিরা তাদের নিজস্ব বস্তুগত স্বার্থকে সমষ্টির স্বার্থর থেকে বেশি পছন্দ করে তাদেরকেই দুর্নীতিগ্রস্থ বলা হয় ।”
সাম্য আবার বললো – “ দেখ সোজা ভাবে বলতে গেলে দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি অসৎ উপায়ে টাকা বা সম্পতি আত্মসাৎ করা ।তাই তো ? তা সেটা যেমন ভাবেই হোক । কাজের বরাত দিয়ে কমিশন খাওয়া , ঘুস নেওয়া , অসৎ উপায়ে সম্পত্তির আত্মসাৎ করা , সরকারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা, সরকারের প্রাপ্য টাকা না দেওয়া যেমন ট্যাক্স ফাকি দেওয়া , ব্যাংক থেকে লোণ নিয়ে টাকা শোধ না দেওয়া ,কালোবাজারি ইত্যাদি – এগুলোই তো দুর্নীতির মধ্যে পড়ে ।কি বলিস । কিন্তু সবাই এই সবকিছুকে দুর্নীতি বলে মনে করে না ।বিশেষ করে ব্যাংক থেকে লোণ নিয়ে টাকা শোধ না দেওয়া আর যেকোন ভাবে ট্যাক্স ফাকি দেওয়াকে দুর্নীতি বলে মনে করে না । আরে এগুলোও তো জনগণের টাকা আত্মসাৎ করা । কি বলিস তোরা । আচ্ছা চুরি আর ডাকাতিকে কি আমরা দুর্নীতির মধ্যে ফেলতে পারি ? ”
সাথী চা আর কিছু খাবার দিতে এসে সাম্যর শেষ কথাটা শুনতে পেল । বললো – “ আমি কি তোমাদের মাঝে একটু বলতে পারি ?”
সবাই সন্মতি জানালো । সাম্য হাসতে হাসতে বলেই ফেললো – “ না বলতে দিলে রক্ষে আছে ? চা , খাবার কিছুই তো তাহলে জুটবে না ।”
সাথী হেসে চা ঢালতে ঢালতে বলতে লাগলো – “ যেখানে নীতি বা নিয়ম আছে সেখানে যদি কোন অনিয়ম হয় তাহলে তাকে আমরা দুর্নীতি বলি ।চোর বা ডাকাতদের কোন নীতি নেই সুতরাং চুরি আর ডাকাতিকে আমরা দুর্নীতির মধ্যে ফেলতে পারি না ।তবে দুর্নীতি নিয়ে যখন তোমরা আলোচনা করছো তখন একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছা করছে । এই দুর্নীতিবাজ লোকগুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় যখন দেশে আসে মহামারী , বন্যা , তুফান ।দুহাতে উপার্জন করে তখন। ”
আরেক বন্ধু সৌম্য বললো –“দ্যাখ অসৎ হওয়াটা নো ডাউট দোষের কিন্তু সৎ হওয়াটা কোন গুনের নয় । তাদের জন্যই গুনের যাদের অসৎ হওয়ার সুযোগ ও সাহস থাকা সত্বেও সৎ থাকে । দ্যাখ একটা মানুষ সৎ কিন্তু কারও জন্য কিছু করে না তাকে কি তোরা ভাল বলবি ? আরেকটা মানুষ জানি কিছুটা অসৎ কিন্ত লোকের জন্য খুব করে তাকে অন্তত আমি ভাল বলবো আবার তার অসৎ কাজের সমালোচনাও করবো । তোদের মত হয়তো আমার সাথে নাও মিলতে পারে । কিন্তু তারমানে আমি বলছি না যে অসৎ হওয়াই ভাল ।”
এতক্ষণ সার্থক চুপ করে শুনছিল ।হটাৎ বলে উঠলো-“ আজ তোদের আমি আমার জানা এক সৎ লোকের অসৎ হওয়ার গল্প বলবো । আমি আজ যার কথা বলবো সে ছিল এক গরীব , সৎ প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক । এক গ্রামে ছিল তার বাস ।গ্রামের লোক তাকে দারুণ মান্যি গন্যি করত । যার যা কিছু অসুবিধা ওনার সাথে আলোচনা না করলে কারও চলত না ।আর গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই ছিল অশিক্ষিত তাই শিক্ষক মহাশয়ের কদর সাবার কাছে আরও বেশী ছিল । ওনিও নিঃস্বার্থভাবে যতটা পারতেন করতেন । ওনি একটা রাজনৈতিক দলের ওখানকার নেতা ছিলেন ঠিকই কিন্তু দলমত নির্বিশেষ সবার উপকার করতেন । এরজন্য সবাই ওনাকে ভালও বাসতো । বাব ,মা , স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে শিক্ষক মহাশয়ের সুখের সংসার । শিক্ষকতা করে যা উপার্জন হতো পাঁচজনের সংসার মোটামুটি চলে যেত । ভালই চলছিল সবকিছু কিন্তু বাদ সাধল অসুখ । শিক্ষক মহাশয়ের বাবার নিউমনিয়া ধরা পড়ল । গ্রামে চিকিৎসা করা যাবে না , নিয়ে যেতে হবে শহরে । অনেক টাকা লাগবে । ঘরে যে সামান্য টাকা আছে তাতে কিছুই হবে না । কি করা যায় কিছুতেই মাথায় আসছে না শিক্ষক মহাশয়ের । চুপচাপ চেয়ারে বসে ভাবছে । ওনার স্ত্রী ব্যাপারটা আঁচ করে ওনার কাছে এসে আসতে আসতে বললো – “ পার্টির অতোগুলো টাকা তো তোমার কাছেই থাকে । এখন আপাতত ওর থেকে খরচা কর , পরে শোধ করে দেওয়া যাবে ।”
ওনাদের কাছে এছাড়া আরেকটা রাস্তা খোলা ছিল , সেটা হল মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নেওয়া ।ওই মুহূর্তে এছাড়া আর কিছু করার ছিল না । প্রথম রাস্তাটাই ঠিক মনে হল । তাই শিক্ষক মহাশয় পার্টি ফান্ডের টাকা থেকে টাকা নিয়েই চললো তার বাবার চিকিৎসা করাতে ।সব কিছু ভালমতো মিটে গেল এবং বাবাও ভাল হয়ে গেল কিন্তু অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল । প্রত্যেক মাসে অনেক কষ্ট করে সংসার থেকে পয়সা জমিয়ে ওনারা পার্টি ফান্ডে জমা করতে লাগলো ।তাতে কি আর পুরোপুরি শোধ হয় , বেশ অনেকটাই বাকী । সামনে আবার বাৎসরিক মিটিং এসে গেল ,সব কিছুর হিসাব দিতে হবে । আর কোন উপায় না দেখে ওই শিক্ষক মহাশয় বাধ্য হল হিসাবে গোলমাল করতে ।ভয়ে ভয়ে মিটিঙে হিসাব দাখিল করলো এবং আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ কোন আপত্তি করলা না । কারণ সবাই ওনাকে খুব বিশ্বাস করতো । ব্যাস এই হল হাতেখড়ি ।শিক্ষা নিল প্রথমে বিশ্বাস অর্জন তারপরে দুর্নীতি । আর দুর্নীতি করে ধরা না পড়লে আত্মবিশ্বাস তো বাড়বেই । তারপরের কথা আর নাই বা বললাম ।আজ সে বড় নেতা এবং সাহসের সাথে অসৎ কাজ করে ।”
সবাই চুপ করে শুনছিল । সাম্য সার্থককে জিজ্ঞেস করলো – “ তুই জানলি কি করে ?”
সার্থক উত্তর দিল – “ ওই শিক্ষক মহাশয়ের ছেলে আমার পরিচিত । এখন তো প্রচুর টাকা । একদিন নেশার ঘোরে ওর বাবার কীর্তি সব উজাড় করে দিয়েছিল আমার কাছে । সেদিন বোধহয় বাবার কাছে কিছু চেয়ে পায়নি , তাই রাগ ছিল । আর তার জন্য খুব নেশা করেছিলো । আমি কোনদিন কাউকে কিছু বলিনি , তোরাও কাউকে কিছু বলিস না । একবার যে অসৎ কাজে হাত পাকাবে তাকে দুর্নীতির হাত থেকে আটকানো মুশকিল ।টাকার স্বাদ পাওয়া বাঘের রক্তের স্বাদ পাওয়ার মতোই ।”
“ এবার আড্ডা থামিয়ে তোমরা চা টা খেয়ে নাও, নাহলে আমাকেই দুর্নীতি দমনে মাঠে নামতে হবে” – হাসতে হাসতে সাথী যাওয়ার আগে বলে গেল ।
বিঃ দ্রঃ – এটা নিছকই একটা গল্প এবং চরিত্রগুলি কাল্পনিক ।সুতরাং কারও সাথে মিলে গেলে লেখকের কোন দায় থাকবে না ।
পেরাসিটামল
খুব ঘটা করে উদয়ন আর ঊর্মির বিয়ে হয়ে গেল ফেব্রুয়ারিতে । সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিলিগুড়িতে এসেছিল ।মেয়ের বাড়ি আর ছেলের বাড়ি দুটোই যেহেতু শিলিগুড়িতে, তাই দুই পক্ষের সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন জমা হয়েছিল এই শিলিগুড়ি শহরে ।একটা বড় বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল দুই পক্ষের জন্য । দুই বাড়ির সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন ছিল একই বাড়িতে । মেয়ে পক্ষ ছিল একতলা আর দোতলা নিয়ে আর ছেলে পক্ষ ছিল তিনতলা আর চারতলা নিয়ে । অবশ্য সবার খাওয়া দাওয়া ছিল একসাথে । তাই সারাদিন ধরে সবাই খুব আনন্দ করেছিল । বিয়ে বৌভাতের পর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডুয়ার্স ভ্রমনে । শিলিগুড়ির আশে পাশে এতো সুব্দর সব জায়গা আছে যে আত্বিয়স্বজনরা যারা বাইরে থেকে এসেছিল তারা ঘুরে যেতে চাইলো । তাই সব মিটতে মিটতে ফেব্রুয়ারি মাসটা কেটে গেল । উদয়ন আর ঊর্মি ঠিক করেছিল হানিমুনে ওরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফিনল্যান্ডে যাবে পাঁচ দিনের জন্য তারপর রোমে দুদিন কাটিয়ে ফিরে আসবে কেননা ফিনল্যান্ডে তখন ভালই ঠাণ্ডা পাবে আর রোমে তো খুব একটা গরম পাবে না । তাই এই প্রোগ্রাম । কেউ কেউ অবশ্য করোনার জন্য এখনকার মতো প্রোগ্রাম বাতিল করতে বলেছিল ।কিন্তু আগে থেকে ওদের সব ঠিক করা ছিল । প্লেনের টিকিট , হোটেল সব আগে থেকে বুক করাছিল । না গেলে অনেকগুলো টাকা নষ্ট হবে । আর লোকজন তো যাচ্ছে । তাই ওরাও নিদিষ্ট দিনে রওনা হয়ে গেল ।ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড গিয়ে ওদের আনন্দ আর ধরে না । চারিদিকে প্রচুর বরফ । শান্তাক্লজের গ্রাম দেখে ওরা অভিভুত । একটু সময়ের জন্য মেরুজ্যোতি বা আরোরা যা আকাশে একধরনের প্রাকৃতিক আলোর প্রদর্শনী তা দেখার সৌভাগ্যও ওদের হয়েছিল । ফিনল্যান্ডে দারুণ আনন্দ করে ওরা নিদিষ্ট সময়ে পৌছাল রোমে । রোমে পৌঁছেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জার্নি করে সোজা চলে গেল ভেনিসে। অনেকক্ষণ ধরে চলল নৌকাবিহার । দুজনে একসাথে দারুণ আনন্দ করে বিকালবেলা রোমের হোটেলে ফিরল কেননা রাতে দিল্লীর জন্য ফেরার প্লেন ধরতে হবে ।হটাৎ ঊর্মি উপলব্ধি করলো যে উদয়নের শরীরটা একটু গরম লাগছে । উদয়নও সেটা অনুভব করতে পেরেছে । ওদের সাথে পেরাসিটামল ছিল একটা খেয়ে নিল । যেহেতু আর কোন অসুবিধা ছিল না ওরা খুশী মনেই রওনা হল দিল্লীর উদ্দেশে । দিল্লী পৌঁছানোর আগে আবার একটা পেরাসিটামল খেতে হল । তাতে জ্বরটা কমে গেল আর তার ফলে দিল্লিতে থারমাল পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ল না । ওরা শুনল যে যারা বিদেশ থেকে আসছে তাদের প্রত্যেকেই থারমাল পরীক্ষার মাধ্যমেই বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে যে তাদের করোনার সংক্রমণ হয়েছে নাকি । ওরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডোমেস্টিক বিমানবন্দরে গেল বাগডগরার জন্য প্লেন ধরতে । দু ঘণ্টা পনের মিনিটের জার্নি । ওরা পৌঁছে গেল বাগডোগরা । প্লেনে খাবার পর আবার একটা পেরাসিটামল খেয়ে নিল উদয়ন । তার ফলে বাগডোগরাতেও থারমাল পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ল না । বিমানবন্দর থেকে বেড়িয়ে একটা গাড়ি নিয়ে সোজা চলল হাকিমপাড়া । শিবমন্দির পেরোতেই বাঁ হাতে দেখল সিটি সেন্টার খোলা আছে । যেহেতু ওরা তাড়াতাড়ির ফলে সকলের জন্য বিদেশী চকলেট কিনে আনতে পারেনি , তাই উদয়ন , ঊর্মিকে গাড়িতে বসিয়ে সিটি সেন্টার থেকে কিছু বিদেশী চকলেট কিনতে গেল । তারপর সোজা বাড়ি । সারাদিন আর কোন অসুবিধা নেই , আনন্দেই কাটল । কিন্তু পরেরদিন আবার জ্বর আসলো । এবার সবার মনে ভয় ঢুকল কেননা ততদিনে করোনা নিয়ে প্রচার শুরু হয়ে গেছিল । ডাক্তার দেখানো দরকার । কিন্তু কোথায় ডাক্তার ?সবার চেম্বার বন্ধ । যেসব ডাক্তাররা হসপিটাল আর নার্সিংহোমের সাথে জড়িত তারাই শুধু কাজে যাচ্ছে আর বাকী সব বন্ধ । অগত্যা জানাশোনা এক ডাক্তারকে ফোন করা হল । ওনি বললেন মেডিকাল কলেজে নিয়ে যেতে । উদয়ন বুঝতে পারলো বাড়ির লোক সব ভয় পাচ্ছে । ওর থেকে দূরে দূরে থাকছে । ঊর্মিও ওর বাপের বাড়িতে বলে দিল কেউ যেন এখন ওদের বাড়িতে না আসে । ঊর্মি ঠিক করলো উদয়নকে নিয়ে মেডিকাল কলেজ যাবে । বাড়ির সবাই একটু ভয় পেয়ে গেছিল ঠিকই কিন্তু ঊর্মির সাহস দেখে আর কারও কোন ভয় রইলো না । বাড়ির সবাই উদয়নকে বলল যদি তোকে হসপিটালে Quarantine এ থাকতে বলে তাহলে ঘরে চলে আসবি । আমরা সবাই একসাথেই থাকবো । তারপর যা হবে দেখা যাবে । ঊর্মিকে আর বাড়ির লোকজন উদয়নের সাথে যেতে দিল না । উদয়নের বাবা উদয়নকে নিয়ে গেল মেডিকাল কলেজ। ডাক্তার সব শুনে উদয়নের লালারস নিল পরীক্ষা করার জন্য আর উদয়ন আর ঊর্মিকে হসপিটালে Quarantine এসে থাকতে বললো । উদয়নের বাবা পরিষ্কার বলে দিল যে ওরা বাড়িতেই থাকবে আর বাড়ির সবাই যার যা প্রোটেকশন নেওয়ার দরকার সব করবে । ওষুধ নিয়ে ওরা বাড়ির দিকে রওনা হল । তবে বাড়ি যাওয়ার সময় বেশ কিছু জিনিষ ওরা নিয়ে নিল যাতে আর কদিন বাড়ির থেকে বেড়তে না হয় । উদয়নের মা কাজের লোককে কদিন আসতে মানা করে দিল । ব্যাস খবর রটে গেল পাড়ায় । প্রচুর ফোন আসতে লাগলো । পাড়ার যারা একটু পাকা গোছের তারা বলতে লাগলো যে বাড়িতে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না, এতে পাড়ার ক্ষতি হতে পারে । কিন্তু উদয়নের বাবা সবাইকে বললো যদি তেমন পরিস্থিতি হয় তাহলে অতি অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করা হবে । আর আমরা কেউ বাড়ির বাইরে যাব না । কোন কিছুর দরকার হলে পুলিশ বলেছে ঘরে পৌঁছে দেবে । তবে বেশীরভাগ পাড়া-পড়সি এবং লোকাল বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন বললো যে তারা সাথে আছে । কোন কিছুর দরকার হলে তারা এমন ভাবে পৌঁছে দেবে যে কোন রিস্ক থাকবে না । সবার সহযোগিতায় উদয়নরা মনে জোড় পেল । উদয়নের বাবা একটা কথা উদয়নকে বললো যে ও একটা ভীষণ ভুল করেছে । ওর দিল্লী বিমানবন্দরে বলা উচিৎ ছিল যে ও পেরাসিটামল খেয়েছে । দরকার পড়লে ওরা দিল্লিতেই কোয়ারেনটাইনে থাকতো ।উদয়ন বললো যে ওর একদম করোনা ভাইরাসের কথা মাথায় ছিল না । ও স্বীকার করলো যে একটা দারুণ ভুল হয়ে গেছে । ওর সিটি সেন্টারে যাওয়াটাও খুব ভুল হয়ে গেছে । ওর জন্য আরও অনেকের বোধহয় ক্ষতি হয়ে গেল । যাইহোক এখন আর কিছু করার নেই । শুধু অপেক্ষা রিপোর্টের জন্য ।দুদিন লাগবে রিপোর্ট জানতে । এই দুদিন যেন কাটতেই চায়না । কারোই রাত্রে ভালকরে ঘুম হচ্ছে না । একটাই ভয় রিপোর্ট পজিটিভ হবে না তো ? ঊর্মি সবাইকে সাহস দিচ্ছিল যা হবে আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করবো ।কেউ যেন নিজেকে একা না মনে করে । অসুখ তো কারও হতেই পারে । কিন্তু মানুষটা তো সবার আপনজন । সবাই ভাল করে প্রোটেকশন নিয়ে একে অপরকে সেবা করবো । সেদিন দুপুরে সবাই অপেক্ষা করছে কখন হাসপাতাল থেকে ফোন আসে । ল্যান্ড লাইনের নম্বর দেওয়া আছে । হটাৎ ফোনের আওয়াজ । সবাই ভয় পাচ্ছে ফোন ধরতে ।
ঊর্মি উঠে গেল ফোন ধরতে । সবাই একদম চুপ । তাকিয়ে আছে ঊর্মির দিকে । ঊর্মির মুখটা থমেথমে ।হু হা করতে করতে হটাৎই চীৎকার করে উঠলো – “ নেগেটিভ” । সে আওয়াজ ভাসতে ভাসতে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল ।
ফিরে দেখা
চোখটা প্রায় লেগে গেছিল । হঠাৎ তোমার গুনগুন গান শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল । আমরা প্লেনে এত জার্নি করেছি কিন্তু কোনদিন তোমাকে এভাবে প্লেনের মধ্যে গুনগুন করে গান গাইতে শুনিনি । বুঝতে পারছি তোমার মনটা খুব আনন্দে আছে । তা কত বছর বাদে তোমার গ্রামে ফিরছো ? আমারও তো তোমার গ্রাম দেখা হয়নি । – সিটের থেকে মাথা না তুলেই কথাগুলো বলল সাথী, সার্থককে ।তা সত্যিই খুব আনন্দ হচ্ছে । কিছুতেই ঘুম আসছে না । আজ প্রায় ত্রিশ বছর বাদে আমাদের গ্রামে যাচ্ছি । কত ঘটনা মনে পড়ছে । চোখের সামনে আমাদের গ্রামটা ভেসে উঠছে । চার পাশে ধানের ক্ষেত । মধ্যেখান দিয়ে একটু উঁচু মাটির রাস্তা । রাস্তার দুপাশ দিয়ে বেশ কটা খেজুর গাছ । শীতকালে এই সব খেজুর গাছে রসের জন্য হাড়ি ঝুলিয়ে রাখত । কত রস খেয়েছি ভোরবেলা ঐ হাড়ির থেকে ।কক্ষন মাথায় আসেনি বা বড়রা কেউ কোনদিন বলে নি যে ঐ হাড়ির রসটা hygienic কিনা । স্টেশনের পাশের জমিতে আঁশফল, ফলসা , আম , জাম , কাঁটাল আরও কত গাছ ছিল । ছোটবেলায় আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে স্টেশনে ট্রেন দেখতে আসতাম আর এই সব গাছ থেকে প্রচুর ফল খেতাম । যেহেতু রেলের জমিতে এই গাছগুলো ছিল তাই কেউ বকাবকি করত না । আমরা এক গাছ থেকে আরেক গাছে বাঁদরের মতো লাফিয়ে বেড়াতাম । জানো আমাদের স্কুল মাঠের পাশে একটা বড় পুকুর ছিল। সবসময় টলটল করতো জল । আমরা বিকালে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলতে আসতাম । আর খেলার পর সবাই মিলে পুকুরে ঝাপ দিতাম । ভেজা কাপড়েই বাড়ি যেতাম । কোনদিন জ্বর হয়নি । – কথাগুলো বলে সার্থক সাথীর দিকে তাকাল । দেখল সাথী একদৃষ্টিতে সার্থককে দেখছে ।
কি দেখছ অমন করে?
তোমার মুখটা দেখছি কেমন জ্বলজ্বল করছে । তুমি তোমার গ্রামকে খুব ভালোবাসো তাইনা?
ভালবাসবো না? আমার ছোটবেলার কত স্মৃতি রয়েছে গ্রামের মাটিতে । ঐ ঘটনাটা না ঘটলে এতদিনে তোমায় কতবার গ্রামে নিয়ে যেতাম । কথাটা বলে সার্থক একটু গম্ভীর হয়ে গেল ।
সাথী বলল – তোমায় কতবার জিজ্ঞেস করেছি ঘটনাটা বলার জন্য । কিন্তু প্রত্যেকবার তুমি বলেছ সামান্য ঘটনা , ছাড়োতো । আজ তোমায় বলতেই হবে । এতদিন বাদে তোমাদের গ্রামে যাচ্ছি , আমার তো ঘটনাটা জানা উচিৎ ।কতবার তোমাদের গ্রামে যেতে চেয়েছি কিন্তু তুমি বারবারই বলেছ সময় হোক ঠিক নিয়ে যাব । বলোনা তোমার সাথে কি ঘটেছিল যে তুমি গ্রামে যেতে চাইতে না ।
একটু চুপ থেকে সার্থক বলতে আরম্ভ করলো – তখন আমি কলকাতায় কলেজে পরি । যেহেতু গ্রাম থেকে যাতায়াত করলে প্রচুর সময় যাতায়াতেই চলে যায় , পড়ার সময় কম পাওয়া যায় , তাই বাবা -মা আমাকে হোস্টেলে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়ে ছিল। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আসতাম । প্রথম সেমিস্টার শেষ হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম । ছোটবেলা থেকে আমি গ্রামেই বড় হয়েছি । ওখানকার বাংলা মিডিয়াম স্কুলেই পড়েছি। দারুন আনন্দে কাটছিল দিনগুলো । সেদিন কি একটা পুজো ছিল । গ্রামের মন্দিরে খুব ভিড় । আমরাও বন্ধুরা মিলে ভিড় জমালাম মন্দিরে । ভাল মন্দ প্রসাদ খাওয়ার আশায় । মন্দিরের আগের যে পুরোহিত ছিলেন ওনি মারা যাওয়াতে ওনার ছেলে গোপাল তখন মন্দিরের পুরোহিত । ও আমাদের স্কুলে আমার থেকে এক ক্লাস নীচে পড়তো । পড়াশুনায় একদমই ভাল ছিল না তাই ওর বাবা ছোটবেলা থেকে ওকে পুরহিতের সব কাজ শিখিয়েছিল । ওর বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামের বড়রা ওকেই বলল মন্দির সামলাতে । ও এক কথায় রাজি কারণ তাহলে আর পড়তে হবে না । মন্দিরে খুব ভিড় হয় । দূর গ্রাম থেকেও মহিলারা আসেন এই মন্দিরে পূজা দিতে । অনেকটা জায়গা নিয়ে এই মন্দির । মন্দিরের ভিতর উচু উচু অনেক গাছ ছিল । প্রচুর পাখি আসতো সারাদিন । ছায়াঘেরা এই মন্দিরে যখন ককিলের আওয়াজ শোনা যেত তখন মন্দির ছেড়ে যেতে আমাদের কারও মন চেতোনা । ফুলের গন্ধে , ধুপের গন্ধে মম করত চারিদিক । খুব সুন্দর এক পরিবেশ ছিল আমাদের এই মন্দিরটার । সেদিন হটাৎই চোখ পড়লো গোপালের উপর । বড় বড় চুল , মাথায় বিশাল তিলক কাঁটা , হলুদ ধুতি আর গায়ে সাদা পাঞ্জাবি পরে মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে আছে । মহিলারা মন্দির ছেড়ে যাওয়ার আগে ওর পায় হাত দিয়ে, কেউবা মাটিতে গড় হয়ে শুয়ে ওকে প্রনাম করছে । ও হাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করছে । যারা প্রনাম করছে বেশীরভাগই ওর মায়ের বয়েসি । দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল । দৌড়ে গেলাম ওর কাছে । সজোরে ওর গালে দিলাম এক থাপ্পড় । চীৎকার করে বললাম – লজ্জা করে না মার বয়সি মহিলাদের প্রনাম নিতে । বারন করতে পারছিস না । বিভিন্ন জনের নানা রকম পেশা আছে । তেমনি তোর পেশা পুরহিতগিরি করা । তুই এখানে পুরহিতের চাকরী করছিস । সবার প্রনাম নিস কোন সাহসে ।হটাৎ থাপ্পড় খেয়ে ও একটু ঘাবড়ে গেল । এরকম ঘটনা আগেতো কোনদিন হয়নি । ও আমতা আমতা করছিলো । আমার বন্ধুরা আমাকে জোড় করে বাইরে নিয়ে গেল । দূর থেকে শুধু চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছিল ।ব্যাপারটা নিয়ে গ্রামে দারুন সোরগোল পড়ে গেল । পঞ্চায়েত বসলো । পঞ্চায়েত বিধান দিল আমাকে সবার সামনে গোপালের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে । এটা নাকি ব্যাক্তি গোপালের উপর আঘাত না ,এটা ধর্মের উপর আঘাত । আমি শহরে পড়াশুনা করে নাকি নাস্তিক হয়ে গেছি । আমিও ঠিক করলাম আমি ক্ষমা চাইব না । কারণ আমি মনে করি আমি ঠিক করেছি । আমার মতো অনেকেই মনে করে আমি ঠিক করেছি । কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধর্ম । খুব অভিমান হল যারা আমায় ভালবাসে তারাও আমার পাশে দাঁড়াচ্ছে না দেখে । কেবল মাত্র আমার কিছু বন্ধু আর আমার বাবা মা পাশে ছিল । কিন্তু পঞ্চায়েতের ক্ষমতা অনেক বেশী ছিল । তাই আমি গ্রাম ছাড়লাম । ঠিক করলাম গ্রাম আমায় না ডাকলে আমি আর গ্রামে ফিরব না।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল আজ আমি সুপ্রতিষ্ঠিত । কিছুদিন আগে ভারত সরকার আমাকে ‘ ভারতবাসীর কৃতি সন্তান’ হিসাবে পুরস্কৃত করেছে । টেলিভিশনে , সব খবরের কাগজে আমার ইন্টারভিউ বেড়িয়েছে । তাই আমার গ্রামের লোকেরা আমার বাবা – মাকে ধরেছে আমাকে গ্রামে নিয়ে আসার জন্য । ওরা আমাকে সম্বর্ধনা দেবে । বাবা – মার কথা ফেলতে পারলাম না , তাই এত বছর বাদে গ্রামে যাচ্ছি । আমার খুব ইচ্ছা আমাদের গ্রামে গ্রামের ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা বিজ্ঞান মঞ্চ তৈরি করা আর একটা প্যাথলজিকাল ল্যাব তৈরি করবো যেখানে গ্রামের গরীব লোকেরা বিনা পয়সায় টেস্ট করাতে পারবে । বাবার সাথে কথা হয়েছে , আমাদের জমির থেকে কিছুটা জমি এই কাজের জন্য আমরা দান করবো । একটা ট্রাষ্ট বানিয়ে দেব ওরাই সব করবে ।
সাথিরও খুব আনন্দ হচ্ছিল এই প্রথম ও গ্রামের বাড়িতে যাবে । সার্থক কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসাতে ওর বাবা মাও চলে আসে কলকাতাতে । তাই ওরও আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি । আর বিয়ে হওয়ার পর সার্থকের সাথে চলে যায় বিদেশে ।
সব জিনিসপত্র নিয়ে দমদম হাওয়াইআড্ডা থেকে বেড়তেই দেখা হল বাবা মার সাথে । বাবা- মার পাশে আরেক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । আমি ঠিক চিনতে পারছিনা । আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল – কিরে আমায় চিনতে পারছিস না ?
আমি একদৃষ্টে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বলে উঠলো – আরে আমি সৌম্য । স্কুলে একসাথে পরতাম । চিনতে পারছিস না ?
- ও সৌম্য, আজ কত বছর বাদে দেখা বলতো । সেই রোগা পাতলা সৌম্য আজ বিশাল বপুর অধিকারী । কি করে চিনবো বল? (দুজনেই জোড়ে হেসে উঠলো ।)
- ও এখন তোদের স্কুলের হেডমাস্টার । ওটা এখন ১২ ক্লাস অবধি । সাইন্স, আর্টস, কমার্স সব পড়ানো হয় । – বাবা বললেন ।
দমদম থেকে বেড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল আমাদের গ্রামের উদ্দেশে । আগে ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা । এখন দেখছি ভাল রাস্তা হয়েছে । আমরা রাস্তা ধরেই যাচ্ছি । কোলকাতা শহর শেষই হচ্ছে না । যত এগচ্ছি কোন গ্রামই নজরে পড়ছে না । না দেখতে পারছি ধানের ক্ষেত , না দেখতে পারছি চালা ঘর । চলেছি তো চলেছি । হঠাৎ গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল । শাঁকের আওয়াজ আর উলু ধ্বনির আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলাম । আমাদের স্কুলের মাঠের সামনে আমাদের গাড়িটা এসে দাঁড়াল । দুপাশে সারি দিয়ে মেয়েরা আমাদের বরণ করছে । রোবটের মতো এগিয়ে চললাম সৌম্যর সাথে । স্কুলের মাঠে প্রচুর লোক আমার কথা শুনতে জমা হয়েছে । গ্রামের লোকের সাঁজ পোশাক , আচার ব্যবহার আমার কাছে একদমই অচেনা লাগছে । স্কুলের পাশে যে বড় পুকুরটা ছিল সেখানে দেখছি একটা বড় হাউজিং কমপ্লেক্স উঠেছে । স্কুল বাড়িটাকে আর স্কুল মনে হচ্ছে না , মনে হচ্ছে একটা বড় কলেজে ঢুকেছি । মাইকের আওয়াজ কিছুতেই আমার কানে ঢুকছে না । আমার ছেলেবেলার সেই সুন্দর মাটির গন্ধ মেশানো গ্রামটাকে আমার মন খুজে বেড়াচ্ছে । আগের মতন বুকভরা নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে । বারবারই মনে হচ্ছে কোলকাতা শহর থেকে এত দূরে চলে আসলাম অথচ কোন ধান ক্ষেত নজরে পড়লো না । ধীরে ধীরে গ্রামগুলো শহরে পরিণত হচ্ছে । ভাল ভাল চাষের জমিতে গড়ে উঠছে অট্টালিকা । এই ত্রিশ বছরে আমাদের দেশে অফিসিয়ালি জনসংখ্যা বেড়েছে ৪৭ কোটি । এত জনসংখ্যা বাড়ছে যে গ্রামগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে । একদিন এমন দিন হয়তো আসবে যখন আর ভাল চাষের জমি থাকবে না । যে পরিমাণে জনসংখ্যা বাড়ছে এখনই তা আটকাতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনে খুব কষ্ট আছে । হঠাৎ সার্থকদা ডাক শুনে ঘুরে তাকালাম । দেখি মাইকে হাতে গোপাল পুরোহিত । সেদিনকার ঘটনা ও সবিস্তারে বর্ণনা করে বলল – সার্থকদা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধুরা কেউ আমার সাথে কথা বলত না । আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম । তারপর থেকে আজ অবধি আমি কারও প্রনাম নিইনা । সার্থকদা দয়া করে আমায় ক্ষমা কোর । - আমি উঠে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো । ধীরে ধীরে কিছু পুরানো মানুষের মুখ দেখতে পেলাম । সৌম্য কানে কানে এসে বলল যে আমাদের ক্লাসের বন্ধুরা প্রায় সবাই এসেছে। অনুষ্ঠানের পর সবাই একসাথে বসবো । শুনে খুব ভাল লাগলো । আমি আমার বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমার ইচ্ছার কথা বললাম । আমাদের জমিতে একটা বিজ্ঞান মঞ্চ আর একটা প্যাথলজিকাল ল্যাব তৈরি করা যেখানে গ্রামের গরীব লোকেরা বিনা পয়সায় টেস্ট করাতে পারবে ।সবাই করতালি দিয়ে আমাকে সমর্থন করলো । আবার মনে হচ্ছে আমার গ্রামটাকে কিছুটা হলেও যেন ফিরে পাচ্ছি । সব মান অভিমান মিটে যাওয়াতে বাবা – মা , সাথী সবাই খুব খুশী । আবার সেই পুরানো দিনগুলোকে ফিরে দেখার চাহিদা অনুভব করছি ।
বিচ্ছেদ নয় মিলন চাই
ছোটবেলা থেকেই সার্থকের গল্পের বই পড়ার দিকে খুব ঝোঁক । সুযোগ পেলেই বসে পড়তো গল্পের বই বা ম্যাগাজিন নিয়ে । কতদিন পড়ার বইয়ের মধ্যে গল্পের বই নিয়ে পড়েছে যাতে বাবা – মা টের না পায় । যাতে বাবা, মা ভাবে ও পড়ার বই পড়ছে । আগে তো খাওয়ার সময় আর শোবার সময় ওর হাতে বই চাইই চাই । যতদিন ছাত্র ছিল এই অভ্যাসটা বজায় ছিল । চাকরী পাবার পর অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেল । কিন্তু কিছুটা সময় বের করে নিচ্ছিল গল্পের বই পড়ার জন্য । নতুন নতুন বই কেনার অভ্যাসটা ধরে রেখে ছিল । বাদ সাধল বিয়ে করার পর । অফিস থেকে আসার পর যদি বই নিয়ে বসতো তাহলে সাথীর মুখ ভার হতো । ওর কথা অনুযায়ী সারাদিন ও অপেক্ষা করে থাকে সার্থক কখন অফিস থেকে ফিরেব আর ও সার্থকের সাথে গল্প করবে বা একসাথে কোথাও কাছাকাছি ঘুরতে যাবে । সত্যিই তো অফিসে যাওয়ার সময় সার্থকের তারা থাকে আর ওকেও সব রেডি করতে হয় । কথা বলার সময় কোথায় । সুতরাং ও তো আশা করতেই পারে সার্থক অফিস থেকে এসে ওকে সময় দেবে । তাই সার্থক বই পড়ার সময় অনেকটাই কমিয়ে দেয় । এরপর সংসার বাড়ার সাথে সাথে বই পড়ার সময়টাও অনেক সময় সার্থক পেতোনা ।এমনি করেই চলছিল । আবার পুরানোদিন ফিরে আসলো নতুন রুপে । না আছে পড়াশুনা করার চাপ আর না আছে কাজের চাপ আছে শধুই অবসর । বই এখন নিত্য সঙ্গী , সারাক্ষণের বন্ধু । ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিছানায় বসে বই পরছিল সার্থক । আর সাথী ফোনে ওর এক বান্ধবীর সাথে কথা বলছিল । এতো আস্তে কথা বলছিল যে সার্থক অন্য ঘরে থেকেও ওর কথা মাঝে মাঝেই কানে আসছিল । হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল ।সাথী ঘরে ঢুকল । ওকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল । বইয়ের থেকে মুখ তুলে সার্থক দেখল সাথীকে আর বুঝতে পারলো কোন একটা বিষয় নিয়ে ও খুব ভাবছে । চুপচাপ মোবাইলটা নিয়ে সাথী বিছানার এক পাশে বসলো ।
“ আরে কি ব্যাপার ? এতো মন দিয়ে কি ভাবছ ?” – সার্থক জিজ্ঞেস করলো ।
-অপরাজিতা ফোন করে ছিল ।
“ অপরাজিতা , মানে তোমার সেই বান্ধবী যার ছেলের বিয়েতে কিছুদিন আগে আমরা ঘুরে আসলাম ।”
-হ্যাঁ গো । এই তো কদিন আগে বিয়ে হল । আর এর মধ্যেই ওর ছেলে আর বৌমাকে ওরা ওদের থেকে আলাদা করে দিতে চাইছে ।
“ কেন ? ওদের তো বেশ বড় বাড়ি । কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি ?”
-না না । ওরা নিজেরাই ছেলে -বৌমাকে আলাদা করে দিতে চাইছে । ওদের মত অনুযায়ী আলাদা থাকলে নাকি সম্পর্ক ভাল থাকবে । যদি বৌমার সামনে ছেলে, অপরাজিতা বা ওর স্বামিকে রাগ করে কিছু বলে তাহলে ওদের প্রেস্টিজে খুব লাগবে । ওদের সহ্য করা খুব মুশকিল হবে । তাই যাতে এইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয় তাই আগেই আলাদা করে দিয়েছে ।
“আমার মনে হয় ওদের এখনও ম্যাচিউরিটি আসেনি । আরে বাবা প্রিয়জনদের সাথে মতান্তর হতেই পারে কিন্তু মনান্তর কেন হবে ? এতো বছর একসাথে সুখে দুঃখে থাকার ফলাফল কি তাহলে জিরো ।বাবা , মা আর ছেলের সম্পর্কের গভীরতা এতো কম ? বাবা , মা অনেক সময় ছেলেকে বকাবকি করে তাতে স্বাভাবিকভাবে ছেলেরও খুব খারাপ লাগে। কিন্তু বল সেটা কেউ মনে রাখে । পর মুহূর্তেই হয়তো ছেলে এসে মাকে বলে – “ মা । খেতে দাও” । যেখানে সম্পর্ক দৃঢ় সেখানে কেউ কোন কথা নিয়ে বসে থাকে না । আর ছেলের বৌ ওদের পর নাকি । সেও তো ছেলের মতই আপন । বাড়ির মধ্যে সব কিছু জানার অধিকার সবার আছে । আর যেকোন ঘটনা সামনেই হওয়া ভাল , পিঠ – পিছে নয় ।তাহলেই সম্পর্ক ঠিক থাকে ।সম্পর্ক খারাপ হয় কিছু লোকের ফিসফিসানিতে আর অহেতুক সমালোচনায় । সেটা কাছে থাকলেও হতে পারে বা দূরে থাকলেও । আন্তরিকতার অভাব থাকলে সম্পর্ক উপর থেকে যতই দৃঢ় মনে হোক আসলে সেটা মেকী । ”
-তোমার কথা আমি মানছি । আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু অপরাজিতা কোন কথাই শুনতে চায় না । ওর একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যা আলাদা থাকলে সম্পর্ক ভাল থাকবে ।
“ আরে বাবা ছেলেদের সামনেও তো আমাদের কম ঝগড়া হয়নি । বাইরের লোকের সামনেও মাঝে মাঝে হয়েছে । তাতে কি আমাদের সম্পর্কের চিড় ধরেছে ? ভিতরের টান বা একসাথে থাকার ইচ্ছাটাই আসল । সেটা যে কোন সম্পর্কই হোক না কেন ?”
-আমি অপরাজিতাকে বললাম তোর তো একটাই ছেলে । কেন শুধু শুধু আলাদা করে দিচ্ছিস । তোর ছেলে আর বৌমা কি বলছে? ওরাও কি আলাদা হতে চাইছে ?
“ তা কি বলল ?”
-না , ছেলে আর বৌমা আলাদা হতে চাইছে না । কিন্তু ওরা চাইছে ।ওদের কথা, সম্পর্ক একবার খারাপ হয়ে যাওয়ার থেকে আগেই আলাদা হয়ে যাওয়া ভাল । এক জায়গায় থাকলে ঠোকাঠুকি লাগার সম্ভবনা বেশী তাই আগেই আলাদা করে দিতে চাইছে ।
“ কত পরিবার একসাথে আছে এবং বেশ আনন্দেই আছে । সেটা কি ওরা দেখতে পারছে না । এর পর যখন নাতি , নাতনি হবে তখন সবসময় তাদেরকে কাছে পেতে ইচ্ছা করবে না ?একটু পজিটিভ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হতে বল । আরে বাবা প্রত্যেক সংসারেই ঝগড়া হয় । সবার তো একটা নিজস্ব চিন্তাধারা আছে । একজনের চিন্তাধারা অন্যজনের চিন্তাধারার সাথে অমিল হতেই পারে । একটা কথা জেনে রাখ যেখানে আন্তরিকতা আছে সেখানে ঝগড়া আছে, মান – অভিমান আছে আর যেখানে আন্তরিকতা নেই সেখানে ঝগড়াও নেই , মান – অভিমানও নেই । বাইরে তো আমরা প্রতি নিয়ত অভিনয় করি । একটা জায়গা অন্তত আমাদের থাকা দরকার যেখানে আমরা সবসময় ওরিজিনাল , অভিনয় সেখানে থাকবে না । আর সেটা হল আমাদের সংসার । বাইরের লোকের সাথে সেন্টিমেন্টাল হতে বল , নিজেদের লোকের সাথে না । বিয়ের পর ছেলেকে আলাদা করে দেওয়ার অর্থই হল বৌমাকে নিজেদের মেয়ে হিসাবে না মেনে নেওয়া । বিয়ের পর বৌমাকে যদি আপন করে না নেওয়া যায় তাহলে ও কি করে স্বামীর বাবা,মা কে আপন করে নেবে । যদি ওকে ছেলের সাথে আলাদা করে দেওয়া হয় , তাহলে ও কোনদিনই ওর শ্বশুর শাশুড়ির সংসারটাকে নিজের বলে ভাবতে পারবে না ।ছেলেরও ধীরে ধীরে এই সংসারটাকে আর নিজের বলে মনে হবেনা ।”
-ঠিক বলেছো । কাল সকালেই চলো অপরাজিতাদের বাড়ি গিয়ে ওদের বোঝাই । কিছুতেই একটা সংসারকে দুইভাগ হতে দেওয়া যাবে না ।
বিবাহের আধুনিক মধ্যপন্থা
ঘড়িতে তখন ঠিক সকাল আটটা বাজে । বড় ঘড়িটার শেষ ঘণ্টাটা এখনও কানে বাজছে । বারান্দায় বসে খবরের কাগজের সাথে বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছিলাম । এমন সময় সাম্য এসে বলল –
- “বাবা, তোমার সাথে একটা খুব দরকারি কথা আছে ।”
খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললাম – “বল , কি দরকারি কথা ?”
সাম্য গলার স্বরটা একটু নামিয়ে আস্তে করে বলল – “বাবা , আমি একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি । ওকেই বিয়ে করতে চাই ।”
খবরের কাগজ থেকে চোখটা চলে গেল সাম্যর মুখের দিকে । বলে উঠলাম – “এতো দারুন খবর । দাঁড়া মাকে ডাকি ।”
আমি চিৎকার করে সাথীকে ডাকার আগেই সাম্য বলে উঠলো – “একটু দাঁড়াও , মাকে ডাকার আগে একটু শোন । মাকে একটু ম্যানেজ করতে হবে ।” - “তা কি ম্যানেজ করতে হবে শুনি? তুই কি অন্য ধর্মের বা অবাঙ্গালি কোন মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছিস ?”
সাম্য এসে পাশে বসলো আর আস্তে আস্তে বোলতে লাগলো – “আরে, না, না। অন্য ধর্মের না , বাঙালি , হিন্দু , তবে অন্য জাতের । মার হয়ত একটু খারাপ লাগতে পারে । মা তো সবসময় স্বজাতি চায় ।তাই বলছিলাম মাকে একটু ম্যানেজ করতে হবে ।”
এক চুমুকে চা শেষ করে , খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বলে উঠলাম – “দূর , মার কোন আপত্তি থাকবে না । দেখ তোর বিয়ের বয়স হয়েছে এবং তুই ছেলে হিসাবে বিয়ের বাজারে উপরের দিকেই আছিস। তাই জানাশোনার মধ্যেই প্রচুর সমন্ধ আসছে । তোর মার সাথে এব্যাপারের আমার আগেই কথা হয়েছে । তোর মারও মত হল মেয়েটা ও তার পরিবার যেন ভাল হয় , জাত্টা কোন ব্যাপারই না । এমনকি অন্য ভাষাভাষীতেও তোর মায়ের কোন আপত্তি নেই । আরে, কোন চিন্তা করিস না । চল বসার ঘরে চল ।” - দুজনে বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে আমি চিৎকার করে ডেকে উঠলাম – “সাথী শীগগির বসার ঘরে এসো । খুব দরকার আছে ।”
- “আরে আমিতো তোমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি, একটু অপেক্ষা কর ।” – সাথী রান্নাঘর থেকেই জবাব দিল ।
- “ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে না । আজ বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট এনে খাবো । তুমি শুধু তাড়াতাড়ি এসো । শুনলে লাফিয়ে উঠবে । আমি কিন্তু আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছি না ।” – আমি আর সাম্য দুজনে এসে সোফায় আরাম করে বসলাম ।
- “কি ব্যাপার, কি হয়েছে? এতো তলব কেন ?” – সাথী হাত মুছতে মুছতে বসার ঘরে ঢুকল ।
সাম্যর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম –“ তুই মাকে বল ।” - “কিরে সাম্য? তোর বাবা কি বলতে বলছে ?” – বসতে বসতে সাথী বলল ।
এক নিঃশ্বাসে সাম্য বলে উঠল – “ মা , আর সমন্ধ দেখতে হবে না । আমি নিজেই একটা মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি । আশা করি তোমাদেরও পছন্দ হবে ।” - “তা কি রকম পছন্দ তোর শুনি?” – সাথী একটু গম্ভীর হয়েই বলল ।
- “ওর ভাল নাম বাসবদত্তা বসু, আর ডাক নাম তিথি । বাড়ি শিলিগুড়িতেই । বাবা কাস্টমসে কাজ করেন । এক মেয়ে । এবছর ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার ডিগ্রি করলো । কয়েক বছর হল আমাদের আলাপ হয়েছে ।”
সাথী জিজ্ঞেস করলো – “ ওদের বাড়িতে সব জানে ?”
“হ্যাঁ, ও কাল ওর বাবা আর মাকে সব বলেছে । ওর বাবা -মা আমাকে দেখতে চেয়েছে ।”
আস্তে আস্তে সাথীর মুখ থেকে কুয়াশা সরতে লাগলো । মুখটা এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে । ওর শুধু একটাই ভয় ছিল । মেয়ে যেন অন্য কোন ধর্মের না হয় । আমার অবশ্য ধর্মের ব্যাপারে কোনদিনই কোন আপত্তি ছিল না । আর জাতের ব্যাপারে আমাদের কারই কোন আপত্তি নেই । সমাজ এখন অনেক আধুনিক । তখন আমরা কেন পরে থাকবো জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে । খুব ভাল করেই আমরা জানি যে এই জাতপাতের সৃষ্টি খুব বেশি দিন আগের নয় । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী জাতের সৃষ্টি সেন বংশের রাজত্বকালে অর্থাৎ ১১৫৮-১১৭৯ সাল যখন পদবি আসে আমাদের নামের সাথে লেজ হিসাবে । আমাদের সনাতন ধর্মে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই বর্ণপ্রথা যেমন ব্রাহ্মণ , বৈশ্য , ক্ষত্রিয় ও শূদ্র এই চার বর্ণকে কিন্তু এই চার বর্ণের মধ্যে উপাধি বা পদবি ছিল না বা বলা যায় যে এই চার বর্ণ সৃষ্টি হওয়ার আগেতো সবাই এক ছিল ।এ নিয়ে আমরা স্বামী – স্ত্রীতে আগেই অনেক আলচনা করেছি । তাই আমার বিশ্বাস ছিল সাথী এ ব্যাপারে কোন আপত্তি করবে না । আর যদি সবাই inter caste বিয়ে করতে শুরু করে দেয় তাহলে তো কয়েক বছর পর আর জাতপাত নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যাথা থাকবে না । ব্যাস , সাম্যও দারুন খুশী ।
সাথী বলে উঠল , – “ একটা কাজ কর । ওনাদের , আমাদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যাবেলা ডাক । তিথিকেও আসতে বল । আর বলিস রাত্রে যেন এখানেই খেয়ে যায় ।”
আমিও বললাম – “ সেই ভাল । আলাপ পরিচয়ও হবে তার সাথে আমরা উভয় পক্ষই দুই পরিবারকে ভাল মতো চিনে নিতে পারবো । তিথির এবং ওর বাবা মার আমাদের বাড়িটা ও আমাদের আগে দেখা খুব জরুরী । কারণ তিথিকে তো আমাদের সাথে এখানেই কিছুদিন থাকতে হতে পারে ।”
“ঠিক আছে, আমি ফোন করে দিচ্ছি । তারপর তোমাদের জানাচ্ছি । আচ্ছা বল কি ব্রেকফাস্ট আনাবো ?” – সাম্য সোফার থেকে উঠতে উঠতে বলল ।
“ না, না, বাইরে থেকে কিছু আনতে হবে না। আমি তোদের পছন্দের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিচ্ছি । আরে আজ তো মনের আনন্দে খাবার বানাবো । এতদিন মনের মধ্যে একটা চাপ ছিল। তুই নিজেই মেয়ে ঠিক করাতে অনেকটা হালকা লাগছে । এতো সমন্ধ আসছিল যে কিছুতেই কিছু ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না । এখন আমি মুক্ত । সব ছেলে – মেয়েরা নিজেরাই যদি নিজেদের পছন্দ ঠিক করে ফেলে তাহলে আমাদের অর্থাৎ বাবা – মায়ের কাজ অনেকটাই হালকা হয়ে যায় । ঠিক আছে তুই তাড়াতাড়ি ফোন কর । কেননা বাজার ও রান্না দুটোই তো করতে হবে । জেনে নিস কি খায় আর কি খায় না ।” – এই বলে সাথী উঠে পড়ল খাবার বানাতে । সাম্য উঠে ফোন করতে নিজের ঘরে গেল আর আমি তাড়াতাড়ি খবরের কাগজ নিয়ে পরলাম কেননা এখুনি আবার বাজারে ছুটতে হতে পারে । বাজারটা আমিই করবো , সাম্যকে দেবনা ভাবছি ।
ঠিক হল ওরা সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমাদের বাড়ি আসবে । সাম্য গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে । ভাবছি কত তাড়াতাড়ি কতগুলো বছর কেটে গেল । এখনও মনে হয় এই তো কিছুদিন আগে সাথীকে বিয়ে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছি । এর মধ্যে এতগুলো বছর কেটে গেল যে আমাদের সন্তান বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠলো । মনে পড়ছে বিয়ের কদিন পর সাথীকে সবাই একটা মেনু রান্না করতে বলল । তখন তো বাড়ি ভরতি লোক । বাবা , মা তখন বেঁচে আর আমরা সব ভাই ও তাদের সংসার নিয়েই আমাদের বড় পরিবার । রাতদিন বাড়িতে নিত্য নুতুন খাবার তৈরি হচ্ছে । সবাই বলল নুতুন বউয়ের হাতে যে কোন একটা মেনু হোক । নুতুন বউ যা খুশী তাই রান্না করতে পারে এবং ওকেই ঠিক করতে বলা হোল । ও আদৌ রান্না করতে পারে কিনা আমার জানা নেই । পড়াশুনা করত , নাচ – গান করত এইটুকু জানি । উৎসাহ নিয়ে তৈরি হতে দেখলাম । ঠিক হোল ও বাঁধাকপির শুকনো মাখা মাখা যে তরকারী হয় সেটা রান্না করবে । মাকে দেখলাম বাঁধাকপি নিয়ে কাটতে বসে গেল । কয়েকটা আলুও সাথে নিয়ে নিল , বাঁধাকপি কাটার পর সেগুলো কাটবে । সাথীকে দেখলাম চুল শক্ত করে বেঁধে নিয়ে ম্যাক্সির উপর আপ্প্রনটা পড়ে নিল । কাজের মাসিকে সব অস্ত্র – সস্ত্র দিতে বলল । এমন ভাব করছে যেন এটা ওর কাছে জলভাত । মা জিজ্ঞেস করলো – “ আগে কোন দিন রান্না করেছ ?” এতো জোরে ও মাথা নাড়ল যেন মনে হোল কত করেছি , এ আর এমন কি । যাইহোক ধীরে ধীরে যুদ্ধ শুরু হোল । আমরাও একে একে যে যার ঘরে চলে গেলাম । কিছুক্ষণ পর হটাৎই সাথী আমাদের ঘরে এসে উপথিত । মুখটা থমথমে । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কান্না কান্না গলায় ও বলে উঠলো – “ আমিতো বাড়িতে থাকতে মা আমাকে সেরকম রান্না করতে দিত না । বলত শশুর বাড়ি গিয়ে তো করতেই হবে , এখন একটু আনন্দ করে নে । আমি তো খুব স্মার্টলি রান্নাটা শুরু করলাম কিন্তু কেমন যেন হয়ে গেল । তুমি একটু টেস্ট করবে ?”
বললাম – নিয়ে এসো ।”
একটু পরে একটা বাটিতে করে বাঁধাকপির তরকারী আসলো একটা চামচ সহযোগে । তাকিয়েই বুঝলাম এরকম
বাঁধাকপির তরকারী আমি কেন , আমার বাড়ির লোক কেউ বাপের জন্মে খায়নি । মনের ভাব চেপে চামচে একটু নিয়ে টেস্ট করলাম । বুঝলাম আজ ওর কপালে দুঃখ আছে । আমাদের বাড়িতে আবার সবাই ভাল রান্না করে ।সুতরাং বুঝতে পারছি এটা খেতে সবার খুব কষ্ট হবে । আমার মুখ দেখেই সাথী বুঝতে পারল ও কিরকম রান্না করেছে । আর ওর মুখ দেখে আমি বুঝলাম আকাশটা কালো হয়ে এসেছে । এখনি শুরু হবে বারি ধারা । বললাম –“ তোমার এক বন্ধুর গুজরাটির সাথে বিয়ে হয়েছে না ? ওর মোবাইল নাম্বারটা আছে ?” ও মাথা নাড়ল । গুজরাটিতে বাঁধাকপির তরকারীকে কি বলে জানতে বললাম । ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে থাকাল । আমি ইশারায় ওকে ফোন করতে বললাম । জানতে পারলো গুজরাটিতে, বাঁধাকপির তরকারীকে বলে সামবড়া । এটা জানতে বন্ধুকে যে কত মিথ্যা কথা বলতে হল আমি সেটা ভালই টের পেলাম । এবার আমি ওকে পাশে বসিয়ে বললাম – “ ব্যাস হয়ে গেছে , আর কোন ভয় নেই । আমার স্থির বিশ্বাস আমাদের বাড়িতে কেউ বাঁধাকপির সামবড়া খায়নি । শোন , তুমি সবাইকে বলবে এটা একটা গুজরাটি প্রিপারেশন , এর নাম বাঁধাকপির সামবড়া ।বাঙালিদের বাঁধাকপি রান্না তো সবাই খেয়েছে , তাই ভাবলাম গুজরাটি প্রিপারেশনই করে ফেলি । আমার এক বন্ধুর কাছে আমি এই রান্নাটা শিখেছি । বোঝা গেল ।” সাথী হো হো করে হেসে উঠলো ।
- “গুজরাটিরা বোধহয় বাঁধাকপি এমনি ভাবেই রান্না করে । হ্যাঁ , ওরা তো তেল মশলা একটু কমই দেয় । খাবারের ফুড ভ্যালুটা ওরা বজায় রাখে । বাঁধাকপির এতো উপকারিতা , আমাদের রান্নায় তো কিছুই থাকে না । ভালই করেছো বউমা গুজরাটি প্রিপারেশন করে । এবার থেকে আমরাও খাবারের ফুড ভ্যালুর দিকে নজর দেব ।”- বাবার এই কথা শুনে সবাই চুপচাপ সুন্দর ভাবে বাঁধাকপির সামবড়া খেয়ে নিল । মনে মনে আমি বাবার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম । মুখ তুলতেই দেখি সাথী আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । যেন মনে মনে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে ।
আর এখন সাথী পাক্কা গিন্নী হয়ে গেছে । সব রান্না শিখে নিয়েছে । পরিচিতর মধ্যে ওর এখন রান্নায় যথেষ্ট নাম হয়েছে । ইচ্ছা থাকলে রান্না করাটা কোন ব্যাপারই না । আর এখন তো ইয়উ টিউব দেখে যেকোনো রান্না যখন খুশী করা যায় । আমাদের সময় তো আর ইয়উ টিউব ছিল না , তখন রান্না নিয়ে জা দের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা । বউ রান্না না জানলে বেশিরভাগ বাড়িতেই কথা শুনতে হত । ছুটির দিন , তাই দুপুর বেলা তিনজনে একসাথে খেতে বসলাম । খেতে খেতে আমরা পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম । সাম্যকে বলছিলাম যে আমাদের বিয়ের সময় আমরা কোন উপহার নিইনি । যাদের খালি হাতে আসতে লজ্জা করছিলো তাড়া ফুল নিয়ে বউভাতে এসেছিল ।
সাম্য বলল – “ gift কেউ না দিক কিছু যায় আসে না কিন্তু আমাদের দেশে যে ধরনের উপহার বেশি্রভাগ লোক নিয়ে আসে তার কোন মানেই হয় না । এই তো সেদিন আমার এক বন্ধুর বিয়েতে দেখলাম অনেকগুলো হাত ঘড়ি , দেওয়াল ঘড়ি , বেশ কয়েকটা লেডীস ব্যাগ , কয়েকটা ফ্লাওয়র ভাস , একই ধরনের বেড সিট ও বেড কভার , ঘর সাজানর কিছু শো পিস আর বেশ কয়েকটা শাড়ি পেয়েছে । উপহার দিতে হবে , খালি হাতে গেলে খারাপ লাগবে তাই যে যার মতো জিনিষ নিয়ে এসেছে । অথচ কাজেই লাগবে না । আমার বন্ধুর বউ শাড়ি বেশি পরে না । ওতগুলো শাড়ি কি করবে বল । একে ওকে দিয়ে দিতে হবে । কটা ঘড়ি লাগাবে বল ? যে ঘর সাজাবে সে তার মতো সাজাবে , অন্যের পছন্দ মতো কেও কেন ঘর সাজাবে ? এর থেকে টাকা দিলে তো কোন সমস্যাই থাকে না। এইযে ধর নিকট আত্মিয়রা সোনার গহনা দেয় । আজকাল কে সোনার গহনা পরে বল ? সেই তো লকারে রাখতে হবে এবং তারজন্য লকার ভাড়াও দিতে হবে । তার থেকে টাকা দিলে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দেওয়া যায় বা টাকাটা কোন কাজে লাগান যায় । বিয়ে করতে একটা ছেলের বা মেয়ের যা খরচা হয় তার একটা অংশ যদি উপহারের মাধ্যমে উঠে আসে মন্দ কি ? পাবলোকে দেখলাম লোণ নিয়ে বিয়ে করলো , তারপর প্রত্যেক মাসে লোণ শোধ করতে করতে প্রান খুলে আনন্দও করতে পারছে না । নূতন বউয়ের কাছে কিরকম লাগছে বলো ? ওর মনে হচ্ছে যে বউ ভাবছে ও চাকরি নিয়ে বিয়ের আগে মিথ্যা বলেছে ।সবাই উপহার হিসাবে যে যা পারে সেটা টাকা হিসাবে দিলে অনেকেরই সেটা কাজে লাগে , এটা কেন কেউ বোঝেনা ।”
- “ঠিক বলেছিস, তবে সোনা ভবিষ্যতে বিপদের সময় কাজে লাগতে পারে এই ভেবেই নিকট আত্মিয়রা সোনা দেয়।”
- “কেন মা, টাকা দিলে সেটাতো তাড়াতাড়ি কাজে লাগানোর আরও সুবিধা । ফিক্সড ডিপোজিট আর সোনা কোনটা থেকে তাড়াতাড়ি টাকা পাওয়া যাবে বল? সোনা ভাঙ্গাতে গেলে বিল চাইবে , কি করে সব বিল পাবে বল ? যারা উপহার হিসাবে দেবে তারা কি বিলও সঙ্গে করে দেবে ?”- সাম্য বলে উঠলো ।
- “একদম ঠিক বলেছিস । আমি তোর সাথে ১০০ ভাগ সহমত পোষণ করছি ।” – আমি বললাম ।
“আচ্ছা সাম্য, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, রাগ করবিনা বল ।”- সাথী বলল ।
“কি বলবে বল ।”
“তিথির রঙ ফর্সা না কালো? না , মানে আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি । তুই খুব ফর্সা কিনা , তাই । অবশ্য তুই যখন পছন্দ করেছিস তখন আমরা সব মেনে নিতে রাজি । তবুও ।”- খুব আমতা আমতা করে সাথী বলছিল ।
আচ্ছা মা, ও তো আজকে আসবেই, তখন দেখে নিও আর যা জানার সব জেনে নিও । তোমাদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে ।জানি, তোমরা এমন কোন প্রশ্ন করবে না যাতে ওদের অপমান হয় । আর মা , তুমি কি জানো আমাদের শরীরের রঙ ফর্সা বা কাল কেন হয় ?” মার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাম্য বলতে লাগলো –
“ আমাদের শরীরের উপর থেকে চামড়াটা ছাড়িয়ে নিলে তার ভিতরের রঙটা সবারই মনে হয় এক । ছাল ছাড়ান অবস্থায় সমস্ত মুরগীর রঙ যেমন একই লাগে । উপরের চামড়াটার জন্যই তো যত ঝামেলা – পরিচয় হয় ফর্সা না কালো , সাদা চামড়া না কালো চামড়া । অথচ আমরা কি জানি যে আমাদের আদিম মানুষের রঙ কি ছিল বা কি কারণে আমাদের চামড়ার রঙ সাদা বা কালো । গবেষকদের মত অনুযায়ী প্রায় ২০০,০০০ বৎসর আগে আমাদের আদিম মানুষের রঙ ছিল কালো এবং তারা থাকতো বিষুব রেখার কাছকাছি যেখানে আলটা ভাইওলেত রশ্মির বিকিরণ বেশি বা বলা যায় যেখানে সূর্যের কিরন বেশি । মানুষ যখন নিজেদের প্রয়োজনে বিষুব রেখার থেকে দূরে গিয়ে থাকতে লাগলো , তখন তাদের শরীরে আলটা ভাইওলেত রশ্মি কম লাগতে লাগলো কারন সেখানে সূর্যের কিরন কম । অনেক বৎসর লাগলো ঠিকই কিন্তু মানুষের চামড়ার রঙ ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হতে লাগলো । গবেষকদের মত অনুযায়ী সময় লাগলো প্রায় ৫০,০০০ বৎসর । তারপর বংশানুক্রমে চলে আসছে সাদা আর কালো চামড়া । কিন্তু এখনও চলছে পরিবর্তনের ধারা । গবেষকদের মত অনুযায়ী লাগছে প্রায় ১০০ টি প্রজন্ম । যে প্রধান পদার্থের উপর চামড়ার রঙ নির্ভর করে তার নাম মেলানিন (Melanin)। আমাদের চুলের রঙও এই পদার্থের উপরই নির্ভর করে । চুলের রঙ সাদা হলে তাকে আমরা কালো করি আবার শরীরের রঙ কালো হলে তাকে সাদা করার আপ্রান চেষ্টা করি । কিন্তু আমরা কি জানি Dark skin reduces the incidence of skin cancer and sunburn । আমাদের একসময়ের শাসক অর্থাৎ ইংরেজদের রঙ সাদা চামড়া ছিল বলেই কি আমাদের বেশিরভাগ সাদা চামড়ার প্রতি আকৃষ্ট ! তাই কি এখনও বিজ্ঞাপনে দেখতে পাওয়া যায় –“ফর্সা পাত্রী চাই “।
সাদা চামড়া বা কালো চামড়ার বদলে আমাদের বলা উচিৎ হালকা বা ঘন চামড়া । হালকা চামড়ার রঙ হয় নীল -সাদা । তার নীচ দিয়ে শিরার মধ্য দিয়ে লোহিত কণিকা প্রবাহিত হয় বলে চামড়ার রঙ লালচে লাগে । যেটা রেগে গেলে ভালো বোঝা যায় । মুখমণ্ডল হয়ে ওঠে রক্তবর্ণ । হালকা চামড়ার মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্রের ধারে রৌদ্রের মধ্যে শুয়ে থাকতে কারন তাদের দরকার সূর্যের থেকে ভিটামিন ডি । শরীরে ক্যালসিয়াম গ্রহন করতে এই ভিটামিন ডি দারুনভাবে সাহায্য করে ।
হালকা চামড়ার মানুষ বেশি দেখা যায় ইউরোপ, পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া , সুমেরু অঞ্চল ও আমেরিকাতে । আর ঘন চামড়ার মানুষ বেশি দেখা যায় গ্রীষ্ম প্রধান আফ্রিকা , ভারতবর্ষের দক্ষিণ অংশ , ইন্দোনেশিয়া , মেলানেসিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে । মোটামুটি বলা যায় যারা অনেকদিন ধরে বিষুবরেখার কাছাকাছি থাকে তাদের চামড়ার রঙ হয় ঘন আর যারা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অনেকদিন ধরে থাকে তাদের চামড়ার রঙ হয় হালকা ।”
- “বুঝলে তো কাল বা ফর্সা এটা আমাদের কারও হাতে নেই । এটা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে । মানুষের শিক্ষা , সংস্কৃতি ,ব্যবহার এগুলই সব । রঙের বাঁচ বিচার করতে যাওয়া মনে ছোট মনের পরিচয় দেওয়া । যারা বিয়ে করবে তাদের শিক্ষা – সংস্কৃতি মিলছে কিনা সেটাই বড় ব্যাপার , কি রকম দেখতে সেটা গৌণ । আসলে আমরা সমাজের কথা বেশি চিন্তা করি , কে কি বলবে সেটার প্রাধান্যই বেশি দিই । মনে আর কোন সংশয় থাকলে এখনি বলে ফেল । “ – আমি সাথীর দিকে মুখ করে বললাম ।
- “আমাদের সময় প্রথম প্রশ্ন থাকতো বাঙ্গাল – ঘটি নিয়ে । বাঙ্গাল – ঘটির বিয়ে নিয়ে মজার মজার সিনেমা, গল্প খুব বেড় হতো । কিন্তু এখন বাঙ্গাল – ঘটি নিয়ে খুব কম কথা ওঠে । আজকালকার অনেক ছেলেমেয়ে জানেই না কাদের বাঙ্গাল আর কাদের ঘটি বলা হয় । “ -সাথী বলছিল ।
আমি বললাম -” রাজনৈতিক স্বার্থে আমাদের দেশভাগ হয়েছে , মানুষের স্বার্থে না । তাই প্রচুর মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে , ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে শুধু বাঁচার আসায়। রাজনৈতিক নেতারা শুধু তাদের স্বার্থ দেখেছে । দেশভাগ যদি না হতো তাহলে বাঙ্গাল – ঘটি ব্যাপারটাই আসতো না । দেশভাগের আগে কোন ঝামেলাই ছিল না । এই ঝামেলা রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে। মানুষকে বাঙ্গাল – ঘটি হিসাবে ভাগ করে লড়াই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে । কত মানুষের কত নিদারুন কষ্টের ইতিহাস আজ চাপা পরে আছে । সবাই বাঙালি অথচ তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে জাতপাত বা ধর্মের ভিত্তিতে নয় শুধু মাত্র বাসস্থানের ভিত্তিতে । ভাবতে অবাক লাগে আমরা কেমন মানুষ যে পূর্ববঙ্গ , পশ্চিমবঙ্গ , উত্তরবঙ্গ , দক্ষিণবঙ্গ – সবই বঙ্গ অথচ মানসিক রেষারেষি করি । যার কোন মানেই হয় না ।রাজনৈতিক নেতাদের উপর রাগ হওয়া উচিৎ তা না করে আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করি ।”
-” সাম্য বলল – তোমাদের একটা কথা বলবো মনে কিছু করবেনা তো ।”
আমি বললাম – “বল , আগে তো শুনি , তারপর মনে করার ব্যাপার আসবে ।
সাম্য – “ আমার খুব ইচ্ছা শুধু registry marriage করে আমাদের বিয়েটা হোক । Registration এর দিন একটা joint party হোক । আর কিছু না ।”
আমি বললাম – “ দ্যাখ , বিয়েটাতো একটা পরিবারের নয় , দুটো পরিবারের । সুতরাং যা হবে উভয় পরিবারের মত নিয়ে । আমারও অনেক ইচ্ছা ছিল আমাদের বিয়ে নিয়ে কিন্তু আমাকে অনেক কিছুর সাথে compromise করতে হয়েছে । না করলে অশান্তি হবে এবং সেটা ভুগবে বেশি নূতন বউ । তাই বলছি , তোর ইচ্ছাটা তুই আমাদের বলেছিস ঠিকই , কিন্তু জোর করে তো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না । সবার মতের একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকা দরকার । দেখি কি করা যায় ।”
সাথী বলে উঠলো – “ দ্যাখ সাম্য , আজকাল registration must কেননা registration ছাড়া বিয়েটা আইন সিদ্দ হয় না । কিন্তু সামাজিক বিয়ের একটা আলাদা আনন্দ আছে । ‘গায়ে হলুদ’ মেয়েদের কাছে একটা দারুন আনন্দের অনুষ্ঠান । সবাই মিলে হলুদ মাখামাখি করে একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি করে । ভাইদের কাঁধে চেপে সাত পাকে ঘোড়া , মালা বদল , শুভ দৃষ্টি , সিঁদুর দান এসব আচার অনুষ্ঠানকে ঘিরে খুব আনন্দ হয় । এছাড়া বিয়েটাকে যদি ক্যামেরা বন্দী করে রাখতে চাস তাহলে নানারকম অনুষ্ঠান ছাড়া ভাল লাগে না ।”
-” আচ্ছা মা, আমাকে বলতো বিয়েতে কি কি অনুষ্ঠান হয়?”
- গঙ্গা নিমন্ত্রণ, দধি মঙ্গল, জল সইতে যাওয়া, হলুদ কোটা , বৃদ্ধি , গায়ে হলুদ , গায়ে হলুদের তত্ত, বর বরন , বরযাত্রী , পট বস্ত্র ,সাতপাক , শুভ দৃষ্টি , মালা বদল, সম্প্রদান , যজ্ঞ , সপ্তপদী , অঞ্জলি , সিন্দুর দান , বাসি বিয়ে , বিদায় , বউ বরন , খেলার জন্য , কাল রাত্রি , বউ ভাত , ফুল শয্যা ,দ্বিরা গমন – পর পর সবকটা আচার অনুষ্ঠান তোকে আর তোর বাবাকে বলে দিলাম । এখন তোরা দেখ কোনটা রাখবি আর কোনটা রাখবি না ।”
-” আচ্ছা মা, গঙ্গা নিমন্ত্রণ আর জল সইতে যাওয়া মানে তো দল বেঁধে ঐ নোংরা পুকুরটায় যাওয়া । তাইতো । তাহলে প্রথমেই এই দুটো বাদ । শুভ দৃষ্টি তো আমাদের অনেকবার হয়ে গেছে সুতরাং ওটাও বাদ । পট বস্ত্র ,সাতপাক , সম্প্রদান , যজ্ঞ , সপ্তপদী , অঞ্জলি ,বাসি বিয়ে এগুলো যদি বাদ দিতে পার তাহলে আমার থেকে খুশী আর কেউ হবে না ।” - আমি বললাম – “এটাতো এখনই ঠিক করা যাবে না । ওনাদের সাথে আগে আলোচনা করে নিই তারপর বসে সব ঠিক করা যাবে ।আজ প্রথম দিন এসব নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হলে তবেই করবো । তবে একটা জিনিষ খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দেব যে আমাদের কোন রকম দাবী নেই । এমনকি বরের বিয়ে করতে যাওয়া এবং বরযাত্রী নিয়ে যাওয়ার খরচ সব আমাদের ।”
- -” বাবা, আমি চাই আমাদের বিয়ে যেন সবার কাছে আদর্শ হয়ে থাকে । আধুনিক বিয়ে বলতে সবাই যেন আমাদের বিয়েকে উদাহরন হিসাবে সামনে হাজির করে ।”
- -” আমি তোর কথা মানছি । তবে একটা কথা মাথায় রাখিস যা করবো সবাইকে বুঝিয়ে, জোর করে নয় । তাহলে কিন্তু বিয়ের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে । বড়দের সাথে ছোটদের চিন্তাধারার যেন একটা সুন্দর মেলবন্ধন থাকে ।” – আমি খুব শান্তভাবে সাম্যকে বললাম ।
- দেখ, কতটা কি করা যায় । আমার মনে হচ্ছে আমাদের বিয়েটা হবে আধুনিক মধ্যপন্থায় ।
ভালবাসি পর্যটনে
সন্ধ্যাবেলা সার্থক আর সাথী চা খেতে খেতে ল্যাপটপ খুলে দেখছে এর পর কোথায় যাওয়া যেতে পারে । হটাৎ সাথীর কি মনে হলো , সার্থককে জিজ্ঞেস করলো ।
সাথী – আচ্ছা , বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমাদের দেশের স্থান এখন কত নম্বরে দেখতো ।
সার্থক – গত বছরে ৪০ এ ছিল । এবছর দেখলাম ৩৪ শে উঠে এসেছে।
সাথী – এই ১ নম্বরটা তুমি কি হিসাবে বলছ ?
সার্থক – যদি সবচেয়ে বেশি বিদেশী পর্যটক এক বছরে যে দেশে গেছে তার স্থান এক ধরা হয় তাহলে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এর পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমাদের দেশের স্থান ২০১৯ সালে ৩৪ নম্বরে । আমাদের দেশে ২০১৮ সালে বিদেশ থেকে মোট ১৭.৪ মিলিয়ন ( ১কোটি ৭৪ লক্ষ ) মানুষ এসেছিল যেটা ২০১৭ ছিল ১৫ .৫ মিলিয়ন ( ১কোটি ৫৫ লক্ষ ) ।
সাথী – এক নম্বরে কোন দেশ ?
সার্থক – ফ্রান্স ৮৯.৪ মিলিয়ন ( ৮কোটি ৯৪ লক্ষ ) ।
সাথী – অনেক ছোট ছোট দেশ আছে যারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছে । তাই না ? আমাদের দেশ যদি আন্তরিক ভাবে চায় তাহলে ১ নম্বরে উঠে আসা কোন ব্যাপারই না । কি বল ?
সার্থক – ঠিক বলেছ । আমাদের কি নেই পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত । আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে সাতটি পর্বতমালা যাদের ১০০ টার উপর চুঁড়া আছে এবং যার প্রত্যেকের উচ্চতা ৭২০০ মিটারেরও বেশি । বরফে ঢাকা এই চুড়াগুলোর উপর যখন সূর্যের সাতটা আলো পড়ে তখন এই চুড়াগুলোর স্বর্গীয় রূপ দেখার মতো । এক এক সময়ে এক এক রূপ । আমাদের একদিকে পাহাড় আর তিন দিকে সমুদ্র । কি অসাধারণ দৃশ্পট ।এছাড়া আমাদের সাতটি প্রধান নদী , তাদের অসংখ্য শাখা – প্রশাখা নিয়ে আমদের মাতৃভুমিকে সবসময় সতেজ করে রেখছে ।
সাথী – যেমন আমাদের শরীরে অসংখ্য নাড়ি দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে শরীরকে সজীব করে রাখছে । ঠিক তেমনি । তাই তো ? আছে মরুভূমি , আছে অগুনতি অরন্য যেখানে বিভিন্ন জন্তু – জানোয়ার বিচরণ করছে । পাহাড়ে ও সমতলে দুই জায়গায়তেই আছে অনেক দীঘি বা লেক যা আকর্ষণ করে পর্যটকদের । আর সেই লেকের জলে আসে নানা দেশ থেকে নাম না জানা কত পাখি যাদের লাগে না কোন ভিসা ।পুরো পৃথিবীটাই তাদের দেশ ।নেই কোন জাতি , বর্ণ , ধর্মের বিভেদ । যত বাজে জিনিসগুলো মানুষের অধিকারে ।
সার্থক (হাসতে হাসতে ) – একদম ঠিক বলেছ । কয়েকটা দেশ শুধু সামান্য কটা সমুদ্র সৈকত নিয়ে চুটিয়ে পর্যটন ব্যবসা করছে । আর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে । আর আমরা এত সুন্দর সুন্দর সমুদ্র সৈকত,পাহাড় , জঙ্গল নিয়ে পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি ।
সাথী – আচ্ছা , ধর কোন এক জায়গায় বড় বা মাঝারি শিল্প গড়ে উঠলো না , কিন্তু পর্যটন শিল্পের খুব প্রসার ঘটলো । তাহলে কি সে জায়গার অর্থনৈতিক প্রসার ঘটবে ?
সার্থক – দেখ , কোনো এক বড় বা মাঝারি শিল্পে নির্দিস্ট করে বলা যেতে পারে যে তার কতটা বিনিয়োগ বা কত কর্মসংস্থান হতে পারে । কিন্তু পর্যটন শিল্পের পরিধি বিশাল । স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে এই পর্যটন শিল্প । যে পরিমান কর্মসংস্থান হয় তা অনেক শিল্পেই হয়না । এছাড়া ঘটে মানসিক বিকাশ । নানা জাতির সংস্কৃতি আদান প্রদানের এক মিলন ক্ষেত্র এই পর্যটন । সবচেয়ে বেশি প্রচার হয় স্থানীয় সংস্কৃতির , আতিথেয়তার । সর্বপরি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সেই দেশের নাম ।
সাথী – দেখ, ভ্রমণ বলতে আমরা বুঝি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গমন আর পর্যটনেও তাই হয় । তাহলে কি ভ্রমণ আর পর্যটনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই?
সার্থক – ঠিক বলেছ – ভ্রমন বলতে আমরা বুঝি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গমন । সেটা অনেক কারণেই ঘটতে পারে । (১) ব্যবসা (২) শিক্ষা (৩) কর্ম (৪) চিকিৎসা (৫) ধর্মীয় ব্যাপার (৬) সামাজিক ব্যাপার (৭) কেনাকাটা (৮) অবসর বিনোদন ইত্যাদি । আর এই অবসর বিনোদনের জন্য ভ্রমনকেই আমরা বলি পর্যটন । আবার এই অবসর বিনোদন এক এক মানুষের কাছে এক একরকম । (১)একটি শহর বা দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে বা সেখানে বসবাসকারীদের অথবা তাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে ভ্রমণ (২) ঠাণ্ডা জায়গা থেকে উষ্ণতর স্থানে ভ্রমন (৩) আবার উল্টোটা, উষ্ণতর স্থান থেকে শীতলতম স্থানে (৪) দুঃসাহসিক কিছু খেলার আকর্ষণে যেমন স্কিইং ইত্যাদি (৫) সুন্দর দৃশের আকর্ষণে (৬) সমুদ্র সৈকতে আনন্দ করার আকর্ষণে (৭) শুধু সময় কাটানোর জন্য । ইত্যাদি ।
সাথী – সত্যিই তো সবকটি কারণের সাথেই জড়িয়ে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ । জড়িয়ে আছে মানুষের কর্ম সংস্থান । এক জায়গার মানুষের সাথে আরেক জায়গার মানুষের ভাবের আদান প্রদান ।
সার্থক – পর্যটন শিল্পের প্রসারের জন্য তোমার মতে কি কি জিনিসের আবশ্যকতা আছে ?
সাথী – আমার মনে হয় যারা পর্যটন শিল্পের পরিসেবার সাথে যুক্ত তাদের উপর যেন করা যায় একটু নির্ভরতা ।অনায়েষে তাদেরকে যেন বিশ্বাস করা যায় । এককথায় যারা পর্যটন শিল্পের পরিসেবার সাথে যুক্ত তাদের মধ্যে যেন থাকে স্বচ্ছতা । পরিসেবার মূল্য যেন সবার জন্য থাকে একরকম । পর্যটন শিল্পের প্রসারের জন্য খুবই আবশ্যিক – (১) নিরাপত্তা (২) পরিকাঠামো (৩) পরিস্কার পরিচ্ছনতা । আর চাই পর্যটন শিল্পের উন্নতিসাধনে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ।
সার্থক – তোমার সাথে আমি পুরোপুরি এক মত । আজ, পর্যটন ব্যবসা অনেক ব্যবসাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে । আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পর্যটন এখন প্রধান খেলোয়াড় এবং একই সময় অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রধান আয়ের উৎস ।
সাথী – দেখ আমার মনে হয় পর্যটনের জন্য পর্যটকদের কাছে চারটি প্রশ্ন থাকে ।(১) কোথায় যাবো – জায়গা সন্মধ্যে (২) কিভাবে যাব – যানবহন সন্মধ্যে (৩) কোথায় থাকবো – হোটেল সন্মধ্যে (৪) কি করব – কোথায় খাবো , কোথায় ঘুরবো ইত্যাদি ।
সার্থক – ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব খবরাখবর ঘরে বসেই পাওয়া যায় । এছাড়া ঘরে বসেই ঠিক করা যায় যাতায়াত , হোটেল । এছাড়া আছে প্রচুর পর্যটন সংস্থা যারা মূল্যের বিনিময়ে সব ব্যবস্থা করে দেয় ।শুধু চাই মনের ইচ্ছা আর সময় ।
সাথী – কোনো স্থানকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষিত করতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার সেই স্থানের পরিকাঠামোর উন্নতি । আর পর্যটক আকর্ষিত হলেই সেই স্থানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন অবশম্ভাবী । যানবহন , হোটেল , খাবার দোকানের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে আরও নানাবিধ ব্যবসা । ক্রমে ক্রমে সেটা শিল্পতে রূপান্তরিত হবে ।
সার্থক – প্রতি বছর ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ২৭ শে সেপ্টেম্বর তারিখটাকে বিশ্ব পর্যটন দিবস হিসাবে পালন করে আসছে । প্রতি বছর নিয়ে আসছে এক একটা নতুন থিম বা বিষয় যার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে করে তুলছে আরো আকর্ষনীয় পর্যটকদের কাছে । যার মধ্যে একবার থিম ছিল -“পর্যটন: দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য একটি চালিকা শক্তি” ।
সাথী – সামাজিক সম্প্রীতির জন্য এই পর্যটন শিল্পের কিন্তু এক দারুন ভুমিকা আছে । সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশে এই পর্যটন শিল্পের জুরি মেলা ভার ।
সার্থক – আমাদের যা জনসংখ্যা তার ১০ % কেও যদি পর্যটনে আকৃষ্ট করা যায় তাহলেও আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয় । এছাড়া যদি পর্যটন শিল্পের সাথে NRI দের যুক্ত করা যায় তাহলেও বৈদেশিক মুদ্রাও যেমন আসবে তেমনি বাড়বে অর্থনৈতিক বিকাশ ।
সাথী – ঠিক বলেছ । যারা দেশ চালাচ্ছে তাদের আন্তরিক সদিচ্ছা কতটুকু তার উপরেই সব নির্ভর করছে । তবে আজকের মতো ওঠো । রাত্রের খাবার খেতে হবে তো ।
দুজনে চলে যায় ।
রাজনীতি তুমি কার – দলের না দেশের
কানে ভেসে আসতে লাগলো ঘোষকের আওয়াজ । বুজলাম এখনও পাশের ঘরে টিভি চলছে । কিন্তু ঘোষকের প্রতিটা শব্দ আমি পরিষ্কার শুনতে পারছি । ঘোষক বলে চলেছে ………
যে দেশে রাজা আছে সেখানে রাজার নীতিই হলো রাজনীতি। কিন্তু আমাদের মত গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি নীতির রাজা , রাজার নীতি নয় ।সহজ ভাবে বলতে হলে বলতে হয় যে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোন গোষ্ঠী বা দল জনগনের কল্যাণে যে নীতি প্রয়োগ করে তাকেই Politics বা রাজনীতি বলে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর বা দলের লোকেরা তাদের সেই নীতিকেই ছড়িয়ে দেয় জনগনের মধ্যে । বেশিরভাগ জনগন যে গোষ্ঠীর বা দলের নীতিকে গ্রহন করে বা গ্রহণ করতে বাধ্য হয় সাধারণত একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেই গোষ্ঠীর বা দলের হাতেই থাকে শাসনভার ।
প্রতিটা দলই দাবি করে তারাই প্রকৃত জনদরদী এবং নীতি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে তাদেরই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিৎ ।গনতন্ত্রে লোকশক্তির বিকাশ ঘটে কিন্তু আমাদের দেশে ঘটেছে দলতন্ত্রের বিকাশ । দেশের থেকে বা জনগনের থেকে বড় হয়ে উঠেছে দল । তাই চারিদিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে চলছে হানাহানি । দল টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতি ও ধর্মকেও আশ্রয় করতে কুণ্ঠা বোধ করছে না নেতারা। যেনতেন প্রকারে ভোটে জিততে জনগণের মধ্যে যত রকমের বিভেদ সৃষ্টি করা যায় তা করে চল্রছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি । তাই জনগন এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠেছে । জাতি, ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে এক জনআন্দোলন ছড়িয়ে
পরেছে দেশজুড়ে । এই জনআন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রপতি বাধ্য হয়েছেন সব বিধানসভা এবং লোকসভা ভেঙে দিতে । সব রাজ্যে এবং দেশে নতুন করে সরকার গঠন করতে এক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে । যারা MLA বা MP হতে চান তাদের একটি নতুন আবেদনপত্র ভালোভাবে পূরণ করে online এ আবেদন করতে হবে । সরকারের সব web site এ এই আবেদনপত্র পাওয়া যাবে ।আবেদনপত্রের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ নীচে দেওয়া হোল ।
• যারা স্নাতকে ৫০% বা তার অধিক নম্বর পেয়ে পাশ করেছে তারাই কেবল আবেদন করতে পারবে।
• ২০ বছরের নীচে এবং ৬০ বছরের উপর কেহ আবেদন করতে পারবে না ।
• কোন দলের সদস্য হওয়া বাধ্যতামুলক নয় ।
• ধর্ম ও জাত উল্লেখ না করা বাধ্যতামুলক।
• যে রাজ্য থেকে আবেদন করবে সেই রাজ্যের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে । কারণ যে যে রাজ্য থেকে আবেদন করবে সেই রাজ্যের ভাষাতেই পরীক্ষা দিতে হবে।
• এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে আবেদন করা যাবে না ।
• একের বেশি পদের জন্য আবেদন করা যাবে না ।
• প্রত্যেক রাজ্যের বিধানসভার এবং লোকসভার যে আসন এখন আছে তাই থাকবে।
• যারা যারা পাশ করবে তাদের মধ্যে থেকেই পরীক্ষার মাধ্যমে ঠিক হবে মন্ত্রী , প্রধানমন্ত্রী, মুখ্য মন্ত্রী ।
• পাঁচ বছর পর যারা পুনরায় নির্বাচিত হবে না তাদের সরকারী পদ
দেওয়া হবে ।
• তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হবে। subjective ও objective ।
• কোন reservation থাকবে না ।
• এখন যেসকল সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তাই পাওয়া যাবে ।
• বিস্তারিত জানার জন্য সরকারের web site দেখুন ।
অ্যালার্মের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল । দেখি ঘড়িতে ভোর পাঁচটা । বুজলাম এটা ভোরের স্বপ্ন ।
শাস্তি
সকালে চা খেতে খেতে নিশ্চিন্তে খবরের কাগজ পরছিল সার্থক । এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো । দেখল ছোটবেলার বন্ধু সৌম্যর ফোন । তাড়াতাড়ি ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে সৌম্যর গলা ভেসে উঠলো – Happy marriage anniversary . তা এটা কত বছরের ?
- আর বলিস না, তোকেও ফোন করে জানিয়েছে । তা এবার ৩৫ বছরে পড়বে । তুই কি কলকাতাতেই আছিস? সন্ধ্যাবেলা Princeton club আসছিস তো ?
- না এসে পারি । তোর ছেলে এমন করে বলল । আচ্ছা Princeton club টা তো প্রিন্স আনায়র শা রোডে, তাই না?
- হ্যাঁরে । নবীনা সিনেমার ঠিক উল্টোদিকে । সাতটার মধ্যে চলে আসিস । ঠিক সাতটায় ওরা প্রোগ্রাম শুরু করবে বলছে ।
- তার আগেই আসবো । আচ্ছা তোর ছেলে এখন কোথায় থাকে?
- সাম্য এখন কলকাতাতে । গত বছর ওর বিয়ে হল । ও বৌ নিয়ে এখানেই থাকে । আরে টেলিফোনেই কি সব কথা বলবি? তাড়াতাড়ি আয় । সব কথা হবে ।
খবরের কাগজটা পড়তে আর ভাল লাগছিল না । কাগজটা রেখে মাথাটা সোফায় এলিয়ে দিলাম আমি । আর সাথে সাথেই আমার ছোটবেলার কত ঘটনা চোখের সামনে ভেষে উঠলো । আমার ছোটবেলা কেটেছে কলকাতাতে । আমি এক ছেলে । বাবা একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরী করত । বেহালাতে আমাদের নিজেদের একটা ছোট একতলা বাড়ি ছিল । আমার যখন দুবছর বয়স তখন আমার ঠাকুমার মুখে সুকুমার রায়ের কবিতা শুনে শুনে সব কবিতা মুখস্ত করে ফেলেছিলাম । ক্লাস এইট অবধি মা এর কাছেই পড়েছি । অঙ্ক আর ইংরাজী বাবা দেখাতো । ছোটবেলাটা আমার ঠাকুমা , দাদুর কাছেই বেশী কেটেছে । আমার যত আবদার ছিল ঠাকুমা , দাদুর কাছে । মা সারাদিন রান্না আর ঘরদোরের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো । আর বাবা সকাল আটটা – সাড়ে আটটায় অফিস বেড়িয়ে যেত আর ফিরতে ফিরতে সেই আটটা -নটা । রবিবার দিনটা সারাদিন বাবা বাড়িতে থাকতো । মনে আছে প্রত্যেক রবিবার বাবা পাঁঠার মাংস নিয়ে আসতো আর মা খুব কষা করে রান্না করত । মনে পড়ে মাংসতে মা বড় বড় আলু দিত । আমার খুব ভাল লাগত মাংসের আলু খেতে । যেহেতু আমার ঠাম্মা মুরগির মাংস খেত না তাই প্রতি রবিবার বাবা পাঁঠার মাংসই নিয়ে আসতো । আর বিকাল বেলা আমরা সবাই মিলে কোন না কোন আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে যেতাম বা কোন আত্মীয় আমাদের বাড়িতে আসতো । মা , বাবা আর ঠাকুমা মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেত আর দাদু আমায় নিয়ে বিকালে ঘুরতে বেরত । ঘুরতে ঘুরতে আমারা মিষ্টির দোকানে যেতাম । কোনদিন সিঙ্গারা বা কোনদিন ভেজিটেবিল চপের সাথে রসগোল্লা খেতাম দাদুর সঙ্গে । তখন টিভি আসেনি তাই বসার ঘরে বসেই পড়াশুনা করতাম । দাদু আমার পাশে বসে গল্পের বই পরত । মা আর ঠাম্মা রান্না ঘরে ব্যাস্ত থাকতো । ঠাম্মা যখন বই পাল্টাতে পাঠাগার যেত আমিও মাঝে মাঝে ঠাম্মার সাথে যেতাম । রাস্তায় যেতে যেতে কত জনের সাথে কথা বলত ঠাম্মা । সবাই আমায় কত আদর করত । আমার বাবা , মা , ঠাম্মা , দাদুকে আমাদের পাড়ার সবাই চিনত । ছোটবেলাটা সবার সাথে মিলে কি আনন্দেই না কাটতো । - তারপর আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম । পড়াশুনার চাপ বাড়ল । যদিও আমার বাবা , মা কখনও চায়নি আমি স্কুলের পরীক্ষায় ১ম ,২য় বা ৩য় হই । ওনারা চাইতেন আমি যেন ভালভাবে পাশ করে উঠি । খেলাধুলা , গল্পের বই পড়া এসব দিকেই ওনাদের বেশী উৎসাহ ছিল। ক্লাস এইট অবধি আমার পড়াশুনায় কোন চাপ ছিল না । প্রত্যেক বছর আমরা বইমেলা থেকে অনেক বই কিনতাম । এছাড়া প্রত্যেক মাসে বাড়িতে আসতো ছোটদের পত্রিকা । পুজো সংখ্যাও আসতো দুটো । বাবা , মা , দাদু আর ঠাম্মা খুব গল্পের বই পরত । মার আবার বিভিন্ন হাতের কাজ করতে ও গান শুনতে খুব ভাল বাসতো । আমাদের বাড়িটা মার হাতের কাজে ভর্তি ছিল। শুনেছি মা ভাল নাচ জানত । কিন্তু বিয়ের পর নাচ নিয়ে কোনদিন থাকেনি । প্রত্যেক বছর শীতকালে আমরা সবাই মিলে দূরে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যেতাম । নাইনে উঠার পর থেকে বেড়াতে যাওয়াটা একটু কমে গেছিল । কেননা টিউশন শুরু হয়ে গেছিল । তারপর আস্তে আস্তে স্কুল পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম । ছোটবেলা থেকে কলেজ লাইফ অবধি দারুন কাটছিল । তারপর চাকরি পেতেই জীবনটা অনেকটা বদলে গেল । বাড়ির থেকে সবাই চাপ দিতে লাগলো বিয়ে করার জন্য । এর মধ্যে ঠাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । দাদুরও বয়স হয়েছে তাই দাদুর খুব ইচ্ছা নাতির বিয়ে দেখে যাবে । অগত্যা বাবা , মা আমার জন্য ভাল মেয়ের খোঁজ করতে শুরু করলো । আমি তখন ভালই চাকরী করি । বাবাও চাকরি করে । নিজেদের বাড়ি । কোন অভাব ছিল না । ভাল ভাল সম্বন্ধ আস্তে লাগলো । কিন্তু দাদুর আর নাতির বৌ দেখা হোল না । দাদুও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ।ঠাম্মাকে বড় ভালোবাসতো দাদু । তাই ঠাম্মাকে ছেড়ে আর বেশিদিন বাঁচল না । এর জন্য আমার বিয়ের ব্যাপারটা কিছুটা ভাটা পড়ল । আমিও বাবা – মার সাথে খুব আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলাম । অবশেষে মা , বাবারা সাথীকে পছন্দ করলো আমার বৌ হিসাবে ।
- সাথীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম ।
- -কি গো, ঘুমিয়ে পরলে নাকি? যাও তাড়াতাড়ি স্নান করে খেয়ে নাও । আজ আবার অনুষ্ঠান আছে না ? সবাই আসবে । আমাকে তৈরি হবার সময় দিতে হবে না ? দুপুরে একটু না ঘুমালে দেখতে ভাল লাগবে না । তাই বলছি চল , তাড়াতাড়ি কাজ গুলো সেরে নিই ।
- সাম্য ফিরেছে? ও তো আবার ক্লাবে গেল সব আয়োজন ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে । খুব ঘটা করে আয়োজন করছে ।
- কার ছেলে দেখতে হবে না । বউমা বললো ও এখনই এসে পড়বে । তুমি উঠে পর ।
সাম্য তাড়া লাগাচ্ছে – মা, আর দেরী করোনা , তাড়াতাড়ি রেডি হও । এরপর সব নিমন্ত্রিতরা এসে পড়বে আর অভ্যর্থনা করার কেউ থাকবে না । আমরা সবাই রেডি । শুধু তোমার জন্য দেরী হচ্ছে ।
আরে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী, একটু ভাল করে সাজব না । বৌমার বাপের বাড়ির লোকজন আসবে আর আমি যদি একটু ভাল করে ড্রেস না করি তোর প্রেস্টিজে লাগবে না?
তোমার ড্রেসের থেকে তোমার পরিচয়টাই আসল ।সাম্য বললো ।- আর সাজতে হবে না, চল এবার ।
খুব সুন্দর করে ক্লাবটা সাজিয়েছে সাম্য । ঝলমল করছে চারিদিক । আমার আর সাথীর আলাদা বসার একটা জায়গা করেছে । সেটাও চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে । বন্ধু – বান্ধব , আত্মীয় স্বজন অনেকের সাথে কতদিন পরে দেখা হচ্ছে । আজকাল তো আর কারও বাড়ি যাওয়া হয়না । সবাই খুব ব্যাস্ত । অনুষ্ঠানেই একে অপরের সাথে দেখা হয় । আমাকেও মাঝে মাঝে অফিসের কাজে বাইরে গিয়ে থাকতে হতো । সাথীর সাথে আমার অনেক আত্মীয়র পরিচয় পর্যন্ত নেই । সাম্য আর আমার বউমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে ওরা আমাদের বেশিরভাগ আত্মিয়দের সাথে ঠিক যোগাযোগ করেছে । আমার ছোটবেলার বন্ধুদের খুজে খুজে নিমন্ত্রণ করেছে । আবার মনে হচ্ছে ছোটবেলাটা ফিরে পেয়েছি । যাইহোক খুব আনন্দে কাটতে লাগলো মুহূর্তগুলো । রাত গড়াতে লাগলো , একে একে নিমন্ত্রিতরা বিদায় জানিয়ে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিল । রইলাম শুধু আমরা চারজন – আমি , সাথী , সাম্য আর আমার বৌমা । বৌমা আমায় জিজ্ঞেস করলো – বাপি আপনি মাম্মাকে কি দিলেন ? বললাম – এখনও কিছু দিইনি , বাড়ি গিয়ে দেব । বাড়িতে রাখা আছে । চল এখন বাড়ি যাওয়া যাক ।
সবাই খুব ক্লান্ত । তাই বাড়ি ফিরে যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম । সাথীও অপেক্ষা করছিলো আমার উপহারের জন্য । পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে ওর হাতে দিলাম ।
কি আছে? চেক নিশ্চয় । কম টাকায় হবে না । আমি যাতে ভাল একটা সোনার গহনা কিনে সবাইকে দেখাতে পারি । জানো গতবছর বিবাহ বার্ষিকীতে বোন কি পেয়েছে ? কি সুন্দর একটা সোনার গহনা । ওর বর তো তোমার থেকে অনেক কম মাহিনা পেত । কিন্তু দেখ ।
আমি চুপ করে রইলাম । সাথী আস্তে আস্তে খামটা খুলতে লাগলো । মুখটা ওর আরও চকচক করছিলো । খামটা খুলতেই বেড়লো একটা চিঠি ।
- এটা কি? শুধুই চিঠি ?
আমি বললাম – খুলে দেখ কি লেখা আছে ।
সাথী পড়তে লাগলো –
সাথী ,
আজ আমাদের এই ৩৫ বৎসরের বিবাহ বার্ষিকীতে আমি তোমায় ,আমার এতদিন ধরে একান্তভাবে মনের মধ্যে থাকা সমস্ত কথা তোমায় উজার করে বলতে চাই । মুখে বললে নানাভাবে বাঁধা আসবে জানি তাই এই লেখনী । আশা করবো তুমি শান্তভাবে আমার প্রতিটি মনের কথা অনুভব করার চেষ্টা করবে । আমাদের এই দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনের প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী শুধুমাত্র আমরা দুজন । এতদিন ধরে সঠিক সময়ের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম । আজ আমি অবসর গ্রহণ করেছি। অবসরকালীন ভাতা হিসাবে যা পেয়েছি তা আমাদের পক্ষে যথেষ্ট । আমাদের একমাত্র ছেলে সাম্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের বউমাকে নিয়ে আমাদের এই কলকাতার বাড়িতে ভালই আনন্দের সাথে আছে । কারণ আমাদের বৌমা এই কদিনেই সকলের সাথে কি সুন্দর মিশে গেছে । আমাদের সবাইকে দারুন সন্মান দেয় । এইকদিনেই সংসারটাকে একদম আগলে রেখেছে । আমি লক্ষ্য করছি যে তোমার মতকে ও সবসময় গুরুত্ব দেয় । যেটা তুমি কোনদিনই দিতে না । আর আমার বাবা মা তোমার কাছে ছিল একটা বোঝা । আমার কাছে এই বাড়িটার অনেক কষ্টের স্মৃতি আছে যেটা আমায় সবসময় পীড়া দেয় । আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরই বুঝতে পারলাম আমার বাবা- মার যে সন্মানটা পাওয়া দরকার সেটা তোমার কাছে পাচ্ছেনা । যদিও আমার বাবা মা সবসময় তোমার সাথে সহযোগিতা করছিলো । তোমার কি ভাল লাগে সেদিকেই ছিল আমার বাবা মার সবসময় নজর । সেদিনের কথাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে । আমি ঘরে বসে কাজ করছিলাম । তোমরা বসার ঘরে ছিলে । আমার বাবা হাসতে হাসতে তোমায় বললো – বৌমা প্রায় সাত -আট মাস হয়ে গেল তোমার হাতের রান্নার স্বাদ এখনও পেলাম না । এতো বছর তোমার শাশুড়ির হাতে রান্না খেয়ে খেয়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে । তুমি তোমার পছন্দ মত যা খুশি একটা রান্না কর । মুখের স্বাদটা একটু পাল্টাই । তুমি বসার ঘরে বসে সকাল বেলা হাতে নেল পালিশ লাগাচ্ছিলে ।আমার কানে আসলো তুমি বলে উঠলে – আমার মা আমাকে বিয়ের আগে কোনদিন রান্না করতে দেয়নি । আমি পড়াশুনা করেছি , গান শিখেছি । আমি এসব নিয়েই থাকবো । আমি রান্না করবো এই রকম আশা করবেন না । একান্তই যদি স্বাদ পাল্টাতে হয় রান্নার লোক রাখুন । আপনার ছেলে তার খরচা দেবে । - বাবা বা মা কেউ কিছু বললো না ।কারণ আমি কষ্ট পাই সেটা বাবা বা মা চাইছিল না । উঠে নিজেদের ঘরে চলে গেল । আমিও চুপ করে রইলাম কারণ আমি জানতাম আমি কিছু বললেই তুমি বাবা মাকে নিয়ে কিছু অপমানজনক কটু কথা বলবে । তাতে বাবা মা আরও দুঃখ পাবে । কষ্টটাকে মনের মধ্যে চেপে রাখলাম । ভাবলাম তোমার সন্তান হোলে সব ঠিক হয়ে যাবে । বাবা মাকে বুঝিয়ে একটা রান্না করার লোক ঠিক করা হল । কেননা মায়ের ও বয়স বাড়ছিলো । আরেকদিনের কথা আমার খুব ভাল করে মনে পড়ছে । রাত্রিবেলা শোয়ার আগে তুমি বললে যে তোমার বোন তার বরকে নিয়ে কদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে আসতে চায় । আমি বললাম – খুব ভাল কথা , আসুক । তা কবে আসবে ?
- তুমি বললে – একটা অসুবিধা আছে ।
- আমি বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম – কি অসুবিধা ?
- তুমি বলেছিলে যে আমাদের তো দুটো ঘর ওরা শোবে কোথায় ? বাবা -মা যদি কদিনের জন্য অন্য কোথায় গিয়ে থাকে , তাহলে ঐ সময়টা ওদের আসতে বলতাম ।
- আমি তোমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম । আমাদের বাড়িতে কত আত্মীয় স্বজন এসেছে আমার দাদু -ঠাম্মাকে তো আমার বাবা মা কোনদিন বলেনি অন্য কোথায় থাকতে । এই দুটো ঘরেই সবাই মিলে কি আনন্দে কাটাতাম ।এইরকম চিন্তা যে মাথায় আসতে পারে আমি ভাবতেই পারি না । আমি তোমায় বলেছিলাম যে ওদের আসতে বল , আমরা ঠিক adjust করে নেব । বাবা , মা থাকলে ওদেরও ভাল লাগবে ।
- না ভাল লাগবে না । ওরা আমাদের সাথে কদিন খুব আনন্দে কাটাতে চায় । বাবা মা থাকলে সেটা হবে না ।
- কেন হবে না? আমার বাবা মা তো সবার সাথেই দারুন মিশতে পারে । আমার সাথে তো বাবা মা একদম আমার বন্ধুর মতো ।
- ঠিক আছে , আমি ওদের মানা করে দিচ্ছি । তুমি রাগ করে শুয়ে পরলে । আমি ভাবছিলাম যে তোমার এখনও সাংসারিক বুদ্ধি আসেনি , তাই এমনি করছ । আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে । এরপর আমাদের মাঝে সাম্য আসলো । বাবা – মার আর আনন্দ ধরেনা । সাম্যকে নিয়ে বাবা মার সারাদিন কেটে যায় । তোমাকে সাম্যর জন্য কিছুই করতে হয় না । ভাবলাম এবার সব ঠিক হয়ে যাবে । অপেক্ষায় আছি সব ভাল হওয়ার । কারণ বাবা -মা আর তোমার উপর আমি দায়বদ্ধ । কারও দিক থেকেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারব না । সাম্যর যখন ২ বৎসর বয়স আমার মা ওকে আমার মতো সুকুমার রায়ের কবিতা শেখাতে লাগলো । সাম্যও ওর দাদু ঠাম্মা ছাড়া থাকতেই চায়না । কিন্তু তোমার ভীষণ আপত্তি । তুমি ওকে বাংলা কবিতা না শিখিয়ে ইংরাজি কবিতা শেখাতে চাও । তুমি চাও সাম্য ছোটবেলা থেকে খালি ইংরাজিতেই কথা বলুক । মা বাবার জন্য তোমার ইচ্ছাটা নাকি পূরণ হচ্ছে না । আমি তোমায় কত বোঝানর চেষ্টা করেছি । বলেছি আরে ইংরাজি তো শিখবেই কিন্তু বাঙ্গালির ছেলে বাংলাটা শিখবে না ? বাংলা কত সমৃদ্ধ একটা ভাষা । বাংলা না শিখলে বাংলা সাহিত্য থেকে ওকে বঞ্চিত করা হবে । দুটো ভাষাই শিখুক । আমরা যেমন শিখেছি । আমরা বাংলা , ইংরাজি দুটো ভাষাতেই সাছন্দ বোধ করি । তুমি নাছোড়বান্দা । ওকে শুধু ইংরাজিই শেখাবে । বাব ,মা তোমায় কত বুঝিয়েছে যে বৌমা আমাদের অনেক আত্মীয় বা পাড়া প্রতিবেশী আছেন যারা ইংরাজি ভাল করে বলতে পারে না । সাম্য তো তাদের সাথে মিশতেই পারবে না । তুমি কোন কথাই কানে নিতে চাইছিলে না ।বাবা – মার সাথে সাম্যকে নিয়ে তোমার একটা সংঘাত তৈরি হচ্ছিল । সাম্যকে তুমি বাবা – মার থেকে দূরে রাখছিলে । তাতে বাবা , মা ও সাম্যর খুব কষ্ট হচ্ছিল । আমি তোমায় কত বুঝিয়েছি কিন্তু তুমি শুধু আমার সাথে ঝগড়া করেছো । আমি নাকি আমাদের ছেলের কথা একদম ভাবিনা । তোমার জন্য সুন্দর একটা ছোটবেলা সাম্যর থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল । বাবা মার কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না । বাবা মার প্রতি অশ্রদ্ধা তোমার দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগছিল । বাবা মা এতদিনের নিজের সংসারে পর হয়ে যাচ্ছিল । আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা মা সব কিছু মানিয়ে নিচ্ছিল । ধীরে ধীরে বাবা মার সংসার থেকে মোহ উঠে যাচ্ছিল । বুঝতে পারছিলাম ভিতর থেকে ওনাদের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল । ইচ্ছা করছিলো তোমার থেকে আলাদা হয়ে যাই । কিন্তু সাম্য তো একটা শিশু । ওর মনের উপর যাতে কোন চাপ না পরে তারজন্য আমি বাড়িটাকে দোতালা করে নিলাম । বাবা , মা একতলায় থাকতে চাইলেন । আমি জানি তুমিও তাই চাইছিলে । বাবা , মার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সব ব্যবস্থা করলাম । রান্নার লোক এবং সবসময়ের জন্য একজন কাজের লোক রাখা হোল বাবা মার জন্য ।তুমি যাতে কোনরকম চিৎকার করতে না পার , দোতালার জন্যও রান্নার ও সব সময়ের জন্য কাজের লোক ঠিক করে দিলাম । বরাবরের একটা সংসার ভেঙে দুটো সংসার হোল । একতলায় বাবা মা আর দোতলায় তাদের একমাত্র ছেলে আর বৌমা ।বাবা , মা বাধ্য হয়ে সব মেনে নিয়ে ছিলেন । সাম্য কিছুতেই দোতলায় থাকতে চাইছিল না , ও চাইছিল ওর ঠাম্মা , দাদুর কাছে থাকতে । তুমি জোর করে ওকে দোতলায় নিয়ে যাচ্ছিলে । তোমার মনে আছে কিনা জানিনা যাওয়ার দিন সাম্য ওর দাদু , ঠাম্মাকে জড়িয়ে কি কান্না আর বাবা , মার চোখ থেকে অঝরে জল ঝরে পড়ছিল । আমি সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এর প্রতিশোধ আমি একদিন নেব । আজ সেই দিন্ এসেছে । আজ আমার বাবা মা বেঁচে নেই কিন্তু এই বাড়িতেই তুমি যেমন আমার বাবা মার থেকে আমাকে আলাদা করেছিলে আমিও তোমাকে তোমার ছেলের থেকে আলাদা করে দেব । এক সংসারে থাকতে দেব না । একটা কথা জেনে রাখ তুমি না চাইলেও সাম্য আর আমি বাবা , মার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখতাম । আজ সাম্য সাবালক এবং আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি ও একজন বাস্তবধর্মী মানুষ । ছোটবেলার প্রতিটি কথা ওর মনে দাগ কেটে আছে । তুমি আর ওকে অন্য কিছু বোঝাতে পারবে না । আমি জানি ও ওর দাদু , ঠাম্মাকে খুব ভাল বাসতো । তুমি শুধু আমাকেই আমার বাবা , মার থেকে শারিরীক ভাবে আলাদা কর নি , সাম্য অতটুকু একটা শিশু তাকেও তার দাদু , ঠাম্মার প্রতিদিনকার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছো ।তাই আমি কোনদিনই তোমায় ক্ষমা করতে পারিনি । শুধু আমার যা দায়িত্ব – কর্তব্য পালন করে গেছি । আজও আমি আমার বিয়ের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেকে বিরত করবো না । কিন্তু আমি মনে প্রানে তোমার শাস্তি চাই ।
- এই চিঠির আরও দুটো কপি আমি সাম্য আর বউমাকে দিয়েছি ।এখন ওরা সব জেনে ঠিক করুক ওরা কি চায় । আমি ওদের ওপর কোন জোড় করবা না । ওদের ইচ্ছার অনুগ্রহে তোমায় বেঁচে থাকতে হবে এবং সেটাই হবে তোমার চরম শাস্তি । -ইতি সার্থক
সিগারেট
কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউসে গেলে মনটা কেন জানি না আনমনা হয়ে ওঠে । মনে পড়ে যায় মান্নাদের সেই গানটা – “ কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই ”।কফি হাউসে বসে ফিস ফ্রাই আর কফি খেতে খেতে আমি আর সাথী সেই আলোচনাই করছিলাম । অনেকদিন বাদে কলেজ স্ট্রীটে বিয়ের কার্ড পছন্দ করতে আসাতে কফি হাউসে আসা হল । সাথী এর আগে কোনদিন কফি হাউসে আসেনি । ওর জন্ম ও পড়াশুনা বেঙ্গলের বাইরে , তাই ওর আগে আর কোনদিন কফি হাউসে আসা হয়ে ওঠেনি । আমাদের একমাত্র ছেলে সাম্যর বিয়ের কথাবার্তা চলছে । মোটামুটি আমাদের পছন্দও হয়ে গেছে । মেয়েটির নাম অনিন্দিতা । পড়াশুনায় যেমন ভাল তেমনি দেখতে । একবার দেখলে যে কেউ পছন্দ করে নেবে । সবে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করেছে । ওর অমন শান্ত ন্ম্র ব্যবহার সাথীকে মুগ্ধ করেছে । কি সুন্দর গানের গলা । সাথী তো পারলে ঐ দিনই ওকে বৌ করে নিয়ে আসে । দুটি পরিবার মোটামুটি নিশ্চিত যে সাম্যর সাথে অনিন্দিতারই বিয়ে হবে । আর দুজনকে খুব সুন্দর মানাবে । সাম্যও ছেলে হিসাবে খুব ভাল । সুন্দর সুদর্শন চেহারা । খুব ভাল চাকরী করে। পাত্র হিসাবে খুবই লোভনীয় । সাথী ওর ছেলেকে নিয়ে সবসময় মনে মনে গর্ব করে যেটা আমি ভালই বুঝতে পারি । এই বিয়ে নিয়ে আমার ও সাথীর খুবই উৎসাহ । সবসময় নানা রকম পরিকল্পনা করছি । এখনও বিয়ের তারিখ ঠিক হয়নি অথচ আমরা চলে এসেছি বিয়ের কার্ড পছন্দ করতে । শীতকালের দুপুর বেলা কফি হাউস গম গম করছে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে । সামনেই প্রেসিডেন্সী আর কলকাতা ইউনিভার্সিটি । সাথী চারিদেকে তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করছিলো । খাওয়া শেষ করে আমরা দুজন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি । সিঁড়ির নীচে একটা পান , বিড়ি , সিগারেটের দোকান । একটু ভিড় রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । হঠাৎ সাথী শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরল । আমি ওর দিকে তাকালাম । ও আমাকে ঈশারায় সিঁড়ির ডানদিকে তাকাতে বলল । আমি নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছি না । দেখি অনিন্দিতা ওর দুই বান্ধবীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে । ওদের সবার হাতে রয়েছে জ্বলন্ত সিগারেট । সাথী আর একটু হলেই পরে যাচ্ছিল । আমি ধরলাম ওকে শক্ত করে । বুঝলাম সাথী খুব ভেঙে পড়েছে । শুধু আমায় বলল আমি বাড়ি যাব । তাড়াতাড়ি আমরা ওখান থেকে বেড়িয়ে আসলাম । একটু দুরেই আমাদের গাড়ি রাখা ছিল । আমরা দুজনে গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । কারও মুখে কোন কথা নেই । দুজনের মনের মধ্যেই চলছে নানা টানাপোড়ন । সারা রাস্তা কেউ কোন কথা বললাম না ।
ঘরে ঢুকেই সাথীই প্রথম মুখ খুলল । অনিন্দিতার সিগারেট খাওয়া দেখে ও ভীষণ রেগে গেছে । এই মেয়েকে ও কিছুতেই সাম্যর বৌ করবে না ।
আমি বললাম , – আচ্ছা ধর যদি উল্টোটা হতো । মানে যদি অনিন্দিতার বাবা মা সাম্যকে দেখত সিগারেট খেতে । তাহলে কি ওরা সম্বন্ধটা সিগারেট খাওয়ার জন্য বাতিল করে দিত ।
- দেখ ছেলেরা বড় হয়ে গেলে অনেকেই সিগারেট খায় । ছেলেদের সিগারেট খাওয়া নিঃসন্দেহে খারাপ কিন্তু দোষের নয় । তাই বলে আমার ছেলের বৌ সিগারেট খায় এটা জেনে আমি কিছুতেই ওকে আমার ছেলের বৌ করতে পারবো না । যতই আমাদের পছন্দ হোক না কেন । ভাগ্যিস সাম্য এখনও ওকে দেখেনি । এসব মেয়ে খুব উদ্ধত হয় । দেখছনা কেমন openly সিগারেট খাচ্ছে । কাউকে কোন তোয়াক্কা করছে না ।
আমি বললাম – রাস্তা ঘাটে আমরা প্রায়ই ছেলেদের সিগারেট খেতে দেখি । আমাদের চোখ সয়ে গেছে । মেয়েদের দেখি না তাই মানতে পারছিনা । ছেলেদের মতো তুমি যদি মেয়েদের দেখতে পাড়ায় পাড়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে , তাহলে প্রথম প্রথম তোমার খারাপ লাগত ঠিকই কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ সয়ে যেত । - মেয়েদের সিগারেট খাওয়া উচিৎ নয় কারণ মেয়েরা সন্তান ধারন করে । সন্তানের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে ।আমি এটাও পড়েছি যে কোনও মহিলা দিনে ১০টি কিংবা তার বেশি সিগারেট খেলে তার গর্ভধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, সে আর জন্ম দিতে পারেনা। সিগারেটের অভ্যাস থেকে একের পর এক নিকোটিনের লেয়ার মহিলাদের উর্বরতা সশক্তি হ্রাস করে এবং এই সমস্যা বন্ধ্যাত্বও এনে দেয় । – সাথী বলে উঠলো ।
- দেখ সিগারেট খাওয়াটা যে সবার পক্ষেই ক্ষতিকারক সেটা সবাই জানে । এব্যাপারে যথেষ্ট প্রচারও চলছে । যারা খাচ্ছে সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, সবাই জেনে বুঝেই খাচ্ছে । নেশা, বুঝলে নেশার জন্য খাচ্ছে । আর নেশা আমাদের পুরাকাল থেকেই চলে আসছে । মেয়েরা পানের সাথে অনেকদিন ধরেই জর্দা, দোক্তা খেয়ে আসছে । এগুলোও তো নেশা । এগুলো খাওয়া কি স্বাস্থের পক্ষে ভাল ? এগুলো খেলে আপত্তি নেই কিন্তু মেয়েরা সিগারেট খেলে আপত্তি কেন ?
- দেখেছি এবং শুনেছি যে বিদেশে অনেক মেয়েরাই সিগারেট খায় ।
- কি বলছো, আমেরিকার পরেই ভারতে সবচেয়ে বেশী মেয়েরা সিগারেট খায় ।আমি সিগারেট খাওয়াটাকে কোনমতেই সমর্থন করছি না । পরিবেশ দূষণ ছাড়াও আমরা জানি এর থেকে অনেক রোগ হতে পারে এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে । সিগারেট কারই খাওয়া উচিৎ নয় । সে ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক ।
- দেখ ওরা যদি ভালবেসে বিয়ে করত তাহলে সব জেনেও আমি মেনে নিতাম কিন্তু সন্মন্ধ করে যখন বিয়ে হচ্ছে তখন আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারবো না । তোমার কথাও আমি মানছি যে ছেলেরা খেলে দোষ নেই, মেয়েরা খেলেই দোষ ।
- ঠিক আছে, তাহলে একটা কাজ করি সাম্যকে সব বলি । তারপর ও যা বলবে তাই হবে ।
-আমার কথাটা একটু ভাব । ওকে দেখলেই আমার খালি ওর সিগারেট খাওয়ার মুখটাই মনে পড়বে আর মনটা খারাপ হয়ে যাবে । আমি কিছুতেই ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারবোনা । শুধু শুধু আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভাল হবে না । সেটা আমার খুব খারাপ লাগবে ।সেটা শুধু সিগারেট খাওয়ার জন্যই । না, মেয়ের বাড়িতে আমি জানিয়ে দিচ্ছি এ বিয়ে হবে না ।
– কি বলবে? মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখেছ , তাই । - সত্যি কথাই বলবো । ওদের মেয়ে, হয়তো ওদের ভাল লাগবে না । কিন্তু এছাড়া আর তো কোন কারণ নেই । দেখ বিয়ের পর জানলে আমার কষ্ট হলেও সাম্যর কথা ভেবে মেনে নিতে হতো । এই বিয়েতো আর হয়নি , আমরা ছাড়া কেউ জানেও না এই সন্মন্ধের কথা । তুমি কি চাও সারা জীবন আমি গুমরে গুমরে মরি ।Please আমাকে কিছু বোঝাতে এসো না , আমি কোন মতেই মানবো না ।
এই কথা বলেই আমার সামনে দিয়ে সাথী হনহন করে wash room এ চলে গেল । জানি ওখানে গিয়ে ও এখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদবে । অনিন্দিতাকে ওর খুব পছন্দ হয়ে ছিল । বাদ সাধল সিগারেট ।
পরেরদিনই সাথী অনিন্দিতার মাকে ফোন করে সব জানিয়েছে । ওর মা অনেক অনুরোধ করেছেন কিন্তু সাথী নাছোড়বান্দা । ও কিছুতেই মানতে পারছে না । ছেলে যদি নিজেই পছন্দ করে নিত তাহলে বলার কিছু ছিল না । কিন্তু যেহেতু সাথীর উপর দায়িত্ব , তাই ও একটু খুঁতখুঁতে । সব দিক বিচার করে তবেই ও ছেলের বৌ পছন্দ করবে । অনিন্দিতার মাকে ফোন করার পর আরও দুদিন কেটে গেছে । সাথীর মনটা এখনও খচখচ করছে । বার বার মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ঠিক নিচ্ছে তো ! কোন ভুল করছে না তো । আসলে অনিন্দিতাকে ওর খুব ভাল লেগে গেছিল । ওদের বাড়ি থেকে ফিরে খালি সারাদিন অনিন্দিতার গল্পই করছিলো । ওকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ওর মনের মধ্যে জেগেছিল । ভেস্তে গেল সিগারেটের জন্য । যদি কফি হাউসের নীচে অনিন্দিতাকে সিগারেট খেতে না দেখত তাহলে এর মধ্যে কতবার যে অনিন্দিতাকে ফোন করে ফেলত তার ঠিক নেই । ও নিজে খুব গান ভালবাসে তাই ওর স্বপ্ন ছিল ওর ছেলের বৌ গান জানবে । অনিন্দিতার গলায় গান শুনে ও মুগ্ধ । কতবার যে আমাকে বলেছে – ‘অনিন্দিতা সিগারেটটা না খেলেই পারত , কি বল ?’ আমিও বার বারই ওকে বলেছি অনিন্দিতার সাথে কথা বলার জন্য । কিন্তু ও কিছুতেই কথা বলতে চাইছে না ।
আরও দুদিন কেটে গেল কিন্তু সাথী অনিন্দিতাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না । অনিন্দিতাদের সাথে আমাদের কাস্টের মিল নেই । আমাদের আলাদা কাস্ট । এসব ব্যাপারে সাথীর কোন আপত্তি নেই । মেয়েদের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন সে ব্যাপারেও সাথীর কোন মাথাব্যাথা নেই । ওর শুধু একটাই লক্ষ্য মেয়েটা যেন মনের মতো হয় । খাওয়ার টেবিলে দুজনে বসে চা খেতে খেতে এইসবই ভাবছিলাম । হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল । আমরা দুজনেই দুজনের দিকে তাকালাম । সাথী বলল – এই সকালবেলা এখন আবার কে এলো ? আমি বললাম – দেখ, কোন সেলস ম্যান এসেছে বুঝি । সাথী উঠে দরজা খুলতে গেল । দরজা খুলেই ও চমকে উঠলো – আরে তুমি ? আমিও চোখ তুলে তাকালাম । দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দিতা একা । - সাথী কি বলবে বুঝতে পারছে না । চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । আমি তাড়াতাড়ি উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । বললাম – এসো এসো । খুব ভাল করেছো এসে । তোমার কথাই আমাদের হচ্ছিল । এসো বস ।
- অনিন্দিতা ঘরে ঢুকে আমাকে আর সাথীকে প্রনাম করে সাথীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল – আনটি , আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি । আমার বাবা , মাকে বলেই এসেছি ।এটা ভেবনা যে আমি এই বিয়ের জন্য পাগল । আমি শুধু তোমায় জানাতে এসেছি যে সিগারেট খেয়ে আমি কোন অন্যায় করিনি । আশা করবো তুমি আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শুনবে আর আমাকে ভুল বুঝবে না ।
- সাথী আমতা আমতা করে বলল – ঠিক আছে আগে তুমি বস , তারপর তোমার কথা শুনছি । তুমি আমাদের বাড়ি প্রথমবার এলে কি খাবে বল ।
- না, না এখন কিছু খাব না । যদি আমি তোমাকে পুরাপুরি convince করতে পারি তাহলে খাব, নচেৎ না ।
- ঠিক আছে তাই হবে । তুমি বল কি বলতে এসেছ – সাথী সস্নেহে বলল ।
- সিগারেট খাওয়া স্বাস্থের পক্ষে খারাপ সেটা সবাই স্বীকার করবে । কিন্তু সিগারেট যারা খায় তারা খারাপ আর যারা খায় না তারা ভাল এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না ।সিগারেট যারা খায় তারা সবাই উদ্ধত আর যারা খায় না তারা সবাই ন্ম্র স্বভাবের এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না । চা , কফি , পান , দোক্তা , গুটকা এসবজিনিষ বড়দের সামনে খেলে তাদের অসন্মান করা হয় না , কিন্তু বড়দের সামনে সিগারেট খেলে সেটা অসন্মান , কেন ? সন্মান , অসন্মান তো মনের ব্যাপার । নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্ত সমাজে এতো ঠুনকো সন্মান , অসন্মান নেই , যত সব মধ্যবিত্তদের মধ্যে । কেন আনটি আমায় বলতে পার ?
- সাথী একমনে ওর কথা শুনছে । মনে মনে ভাবছে মেয়েটার মনে সাহস আছে । সোজাসুজি কথা বলতে পারে । ভালই লাগছে শুনতে । একবার জিজ্ঞেস করবো ও দিনে কটা সিগারেট খায় ? আগে শুনি ও কি বলছে তারপর নাহয় জিজ্ঞেস করা যাবে-সাথী মনে মনে এই চিন্তাই করছিলো ।
- অনিন্দিতা বলে যাচ্ছিল – আচ্ছা আনটি তুমি কি জোড় দিয়ে বলতে পার আজ যে কোন নেশা করছে না , কাল সে কোন নেশা করবে না । বা যাকে তুমি কোন নেশা করতে দেখলে না সে যে কোন নেশা করে না সেটা তুমি জোড় দিয়ে বলতে পার ।আমি তো মনে করি চারিদিকের বেশিরভাগ মানুষই hypocrite মানে ভণ্ড , সামনে এক আর পিছনে আরেক ।
- তা, ঠিক ।ফুচকা তৈরি করা না দেখলে তুমি আনন্দের সঙ্গে খাবে আর দেখলে কি তুমি খেতে পারবে?
- পরিচ্ছনতা আর অপরিচ্ছনতার সাথে বিবাহটা মিলিও না ।খাওয়ার ব্যাপারটা একদিনের বা মাঝে মাঝে কিন্তু বিবাহ বরাবরের । আমাদের দেশের প্রচুর নামকরা মহিলা আছেন যারা সিগারেট খান । তাদের আমরা সন্মান করি । কেন বল? তাদের গুনের জন্য । মানুষের বিচার তার আচরন , তার কোয়ালিটির ওপর । সে নেশা করে কিনা তার ওপরে নিশ্চয় নয় । তাইবলে ভেবনা আমি নেশা করাকে সমর্থন করছি । আমিও মনে করি যে কোন নেশা করা খারাপ । তার একটা সাইড এফেক্ট আছে । ধর তুমি সিগারেট খাওনা না কিন্তু কাকু তোমার সামনে সিগারেট খায়, তাহলে কি তোমার ক্ষতি হচ্ছে না ! ধূমপান যদি সবাই বন্ধ করে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়া যায় ।তোমরা আমায় সিগারেট খেতে দেখেছ সেটা একটা coincidence । আমি সত্যিই ধূমপান বিরোধী ।
- বাঃ । তোমার কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগলো । সাথী বলল ।মনে মনে সাথী ভাবছিল মেয়েটা কি সুন্দর এই দুদিনের আলাপে কেমন আপন করে নিয়েছে ।
আমিও শান্তি পেলাম । মনে হচ্ছে জল গলছে । সাথীতো জানে না যে আমিই অনিন্দিতাকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম । আমি জানতাম ও সাথীকে ঠিক convince করে নেবে । অনিন্দিতাও খুব আন্তরিক ভাবে সাথীকে মানিয়ে নিতে চাইছিল । সাথী যে শাশুড়ি হিসাবে খুব ভাল হবে সেটা ও জানত । সাম্যর কাছে ওর বাবা মার গল্প ও অনেক শুনেছে । ওরা ঠিক করেছিল প্রথমে ওরা জানাবে না । দুই বাবা মা আগে পছন্দ করুক তারপর জানাবে । পছন্দ না হওয়ার কোন কারণ ছিল না । কিন্তু বাঁধ সাধল সিগারেট । সাথী বেঁকে বসলো । তখন বাধ্য হয়েই সাম্য আমকে সব জানাল । অনিন্দিতা আর আমি দুজনে ঠিক করলাম আজকের ব্যাপারটা । এছাড়া অনিন্দিতা আমায় কথা দিয়েছে যে ওরা দুজনে কেউই সিগারেট ছোঁবে না । অনিন্দিতাকে আমারও খুব পছন্দ । তাই সাম্য বলাতে আরও উৎসাহ পেলাম । মনে মনে সাম্যের পছন্দের তারিফ করছিলাম । - ওকে কি আমাদের বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাবে, নাকি ওকে বসার ঘর থেকেই চলে যেতে দেবে । – আমি আস্তে আস্তে সাথীকে বললাম ।
সাথী হাসতে হাসতে বলল – দেখি আগে ওর মার সাথে কথা বলি । বলেই মোবাইলটা নিয়ে একটা নাম্বারে কল করলো । ওদিক থেকে হ্যালো আওয়াজ আসাতে সাথী বলে উঠলো – আজ থেকে অনিন্দিতা শুধু আপনাদেরই মেয়ে না , আমাদেরও । তাই আমরা ঠিক করেছি আমাদের বাড়িতে ও থাকবে ।মনে হচ্ছে ওরও ইচ্ছা আছে থাকার ।
অনিন্দিতা আর আমার চোখাচোখি হল , দুজনেই দুজনকে বললাম DONE .
স্বভাব চোর
অলীক বাবুর স্ত্রী , তিন ছেলে , তিন বৌমা , এক নাতি ও এক নাতনি নিয়ে ভরা সংসার । সবসময়ের জন্য বাড়িতে থাকে একজন কাজের মহিলা । এছাড়া ঠিকা কাজ করে দুজন । একজন ঘরদোর পরিষ্কার রাখে আর একজন বাসন মাজে । সচ্ছল পরিবার । অলীক বাবুর বাড়িতে একটা নিয়ম অনেকদিন ধরেই চলে আসছে । ছুটির দিন সবাই খাওয়ার টেবিলে ব্রেকফাস্ট , লাঞ্চ , ডিনার একসাথে বসে খায় । এখন পর্যন্ত তা কক্ষন নড়চড় হয়নি ।তাই আজও সবাই বসেছে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে । কিন্তু কোথায় যেন মনে হচ্ছে একটা তাল কেটেছে । মেজছেলে ও মেজবৌমাকে আজ যেন বেশী গম্ভীর লাগছে । অন্যদিন সবাই কত হাসি মজা করে কিন্ত আজ মনে হচ্ছে মেজছেলে আর মেজবৌমা জোড় করে কথা বলছে । খেতে খেতে এটা অলীক বাবুর নজরে আসে । তাই বাধ্য হয়েই ওনি মেজছেলেকে জিজ্ঞেস করেন – “ কি ব্যাপার মেজখোকা , তোমরা আজ এতো গম্ভীর কেন ?”
-“ কি আর বলবো বাবা , আমাদের বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে আমরা দুজনেই খুব আপসেট । আমরা কল্পনায়ও এই ধরনের ঘটনা আশা করতে পারিনা ।”
বড় বৌমা বলে উঠলো – “ কি ব্যাপার একটু খুলে বল না । তাহলে হয়তো আমরা হেল্প করতে পারি।”
উত্তর দিল মেজ বৌমা – “আমাদের ঘর থেকে কিছু টাকা চুরি হয়েছে ।”
অলীক বাবুর স্ত্রী সাথে সাথে বলে উঠলেন –“ বলিস কিরে , আমাদের বাড়িতে চুরি ! আমাদের সব ঘরেই তো সব কিছু ছড়ান ছিটানো থাকে । আজ পর্যন্ত কখন কোনদিন কিছু চুরি যায়নি ।আমাদের বাড়িতে চুরি করার কেউ নেই । তোরা ভাল করে দেখেছিস তো ?”
মেজছেলে উত্তর দিল –“হ্যাঁগো ভাল মতো দেখেই বলছি । আমরাও বিশ্বাস করতে পারছি না ।বৃহস্পতিবার আমি দশ হাজার টাকা আমাদের ঘরের তাকের উপর একটা ব্যাগের মধ্যে রাখি । কাঠের মিস্ত্রিকে টাকাটা দেবো বলে । শুক্রবার আর শনিবার একদম সময় পেলাম না । তাই আজ ব্রেকফাস্ট করে টাকাটা দিয়ে আসবো বলে ঠিক করলাম ।টাকাটা বের করে পকেটে রাখতে গেছি , দেখি ছয়টা পাঁচশো টাকার নোট নেই । ভাবলাম ও নিয়েছে কিন্তু ও বলল যে ও ওই টাকার ব্যাগটাতে হাতই দেয়নি ।”
মেজ বৌমা বলল –“ আমার তো খেয়ালই ছিল না টাকাটার কথা । ও জিজ্ঞেস করাতে আমি সতিই অবাক হয়ে যাই ।এর মধ্যে বাইরের লোক তো সেরকম আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনি । ”
ছোট বৌমা বলে উঠল – “ আচ্ছা মেজদি , শুক্রবার তোমার ঘরে তোমার এন জি ওর তিনজন মহিলা এসেছিল না ?”
“ হ্যাঁ ছোট , এসেছিল । তবে ওরা নিতেই পারেনা । ওদের সবারই সচ্ছল পরিবার । সবাই শিক্ষিতা ।কতদিন ধরে একসাথে এন জি ও করছি । ”
-“ একটা কথা না বলে পারছি না । কেউ কিছু মনে করোনা । শুক্রবার দিন মেজ যখন চা বানাতে বেড়লো তখন দেখলাম ওই এন জি ওর তিন মহিলার থেকে দুজন মেজোর সাথে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো । আর একজন মেজোর ঘরে বসে কি লিখছিল । আমি তখন মেজোর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম । ওদের ঘরে সোফার পাশে যে আয়নাটা রাখা আছে সেটা দিয়ে ওদের ঘরের প্রায় অনেকটাই দেখা যায় । আমি ওর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে হটাৎ আমার চোখ পড়ল আয়নার উপরে । দেখি নীল সালয়ার পড়া এক মহিলা মেজোর তাকের সামনে দাঁড়িয়ে কি করছে । কি করছে সেটা দেখার আমার কোন ইচ্ছাই ছিল না , তাই ভাল করে দেখিনি । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দেখলে ভাল হতো ।”- বড় বৌমা বলল ।
– “ ও ঘরে বসে একটা জিনিস লিখছিল । আর তাছাড়া ও নিতেই পারে না । কিসের অভাব ওদের ? তুমিও এই কথাটা কাউকে বল না বড়দি । ওরা শুনতে পেলে খুব খারাপ ভাববে আমাকে । যাকগে তোমরা ভুলে যাও চুরির কথা ।”
কেউ আর কথা বাড়াল না । সবাই চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ল ।কিন্ত মেজ বৌমার মনে বড় বৌমার কথাগুলো বাজতে লাগলো । মেজ বৌমা ভাবল একবার পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কি ।কার যে কখন কি ভীমরতি হয় বলা মুশকিল । পরেরদিন ওই তিনজন মহিলাকে আবার বাড়িতে আসতে বলল । ওনাদের বোঝাল যে এন জি ওর কাজে হটাৎ খুব দরকার পড়েছে । একদম বুজতে দিলনা যে মেজ বৌমার মনে ওদের একজনের প্রতি একটু সন্দেহ হয়েছে । অবশ্য ব্যাপারটা নাও হতে পারে । হয়তো অন্য কেউ টাকাটা সরিয়েছে । একটু ঝালাই করে নেওয়া দরকার । একা ওকে ডাকলে সন্দেহ করতে পারে , তাই তিনজনকেই ডাকল । বাড়ির কাউকে সে কিছু বলল না । তাকের ওপর ঐ ব্যাগটাকে আবার একই জায়গায় রাখল । ব্যাগের ভিতর একটা কাগজে লিখে রাখল ‘ আমি জেনে গিয়েছি যে টাকাটা তুমি নিয়েছ । আমি কাউকে বলবো না কিন্তু তুমি এই স্বভাব এখনই পরিত্যাগ কর নাহলে বাধ্য হবো সবাইকে জানাতে ।’ ও ভাবল যে, চুরি করে ধরা যে পড়েনি সে আবার চুরি করার চেষ্টা করবে । তাই একটা ফাঁদ পাতলো মেজ বৌ ।পরেরদিন ঠিক সময়েই ওরা তিনজন এসে উপস্থিত হল । মেজবৌমা ওদের আবার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল । কাজের কথা ও নানা রকম গল্পে ওদের বুঝতেই দিল না আসল উদ্দেশ্য ।সবাই মন খুলে কথা বলছিল । কিছুক্ষণ পরে কল্পনাকে অর্থাৎ যাকে তাকের সামনে দেখা গেছিল তাকে ঘরের মধ্যে একটা কাজ দিয়ে , বাকী দুজনকে নিয়ে মেজ বৌমা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল । কল্পনাও ভাবল যখন টাকার কথা কিছু বলল না তখন নিশ্চয় কোন সন্দেহ করেনি । তারপর মেজ বৌমা হটাৎই ওদের নিয়ে শ্বশুর- শ্বাশুরির ঘরে ঢুকল । ঘরে শ্বাশুরি ছিলেন । মেজ বৌমা ওদের বলল যে তোমরা আমার শ্বাশুরির সাথে একটু গল্প কর , এরমধ্যে আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি । ওদের বসিয়ে রেখে মেজ বৌমা সোজা নিজের ঘরের দিকে গেল ।বাইরে থেকে আয়না দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখতে লাগলো ।দেখল কল্পনা আস্তে আস্তে ব্যাগটার সামনে গেল এবং ব্যাগটার চেনটা খুলে কিছু খুজতে লাগলো । কিছু না পেয়ে কাগজটা খুলে পড়তে লাগলো । এমন সময় মেজ বৌমা ঘরে ঢুকল । কল্পনাও ঘুরে তাকাল । কল্পনার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । কল্পনা এগিয়ে এসে মেজ বৌমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরল । বলল – “ প্লিস কাউকে বোলো না আমি কালই তোমার টাকাটা দিয়ে যাব ।এখন যাই । ওদের বোলো একটা আর্জেন্ট ফোন পেয়ে আমি চলে গেলাম । তুমি প্লিস ওদের একটু বুঝিয়ে বোলো ।আর তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি জীবনে কোনদিন চুরি করবো না । একটা কথা , তোমাদের দেখেছি ইচ্ছা মতন খরচা করতে। তার মানে তোমরা হাতে টাকা পাও বা সংসারের টাকা থেকে তোমরা খরচা করতে পারো । কেউ আপত্তি করে না । কিন্তু আমি হাতে টাকাও পাইনা বা সংসারের টাকা থেকেও নিজের খুশী মতন খরচা করতে পারি না । আমার কোন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই যেটা তোমাদের আছে । আমারও তো ইচ্ছা করে বল মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছায় খরচা করি । তাই লোভে পরে এই অভ্যাসটা নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে । প্লিস পারলে আমাকে ক্ষমা কর । নইলে বল আমার কি চুরি করার কোন দরকার আছে । যাক আজ চলি । কাল এসে তোমার সাথে সব কথা বলবো ।”- এই বলে কল্পনা কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেল ।অভাবে মানুষের স্বভাব অনেক সময় নষ্ট হয় জানি । তাহলে কি কল্পনাও মনে প্রানে অভাবী ?
——————- সমাপ্ত ——————-
Add title
‘
“
-“