হটাৎ ঠিক হলো আর দুই বন্ধু মিলে রওনা দিলাম চারধামের উদ্দেশ্যে । প্রথমে যমুনেত্রি তারপর গঙ্গোত্রী , কেদারনাথ হয়ে বদ্রীনাথ । আমরা গেছিলাম ১৯৮২ সালে আর এখন ২০২০ , মধ্যে অনেকগুলো বছর গাড়োয়ালকে করেছে উত্তরাখণ্ড । অনেক পরিবর্তন হয়েছে রাস্তা ঘাটের । অনেক পরিশ্রম লাঘব হয়েছে যাত্রাপথের । ।তাই যাত্রাপথের বিবরন না দিয়ে আমাদের কিছু স্মৃতি সবার সাথে ভাগ করে নিচ্ছি ।
যমুনেত্রির পথে
হৃষীকেশ থেকে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের পাবলিক বাসে উঠে পড়লাম যমুনেত্রি যাওয়ার উদ্দেশ্যে । বসার জায়গা পেলেম আমি একদম শেষে ডানদিকের জানলার পাশে আর আমার বন্ধু মৃণাল বামদিকের আরেক জানলার পাশে । আমাদের দুজনের দুটো স্যাক আমাদের কাছে বাসে রাখতে দিল না । ওরাই বাসের ছাদে রেখে দিল । দেখতে দেখতে বাস ভড়ে গেল ।ভিড় দেখে মনে হচ্ছিল কোলকাতার পাবলিক বাসে উঠেছি । এবার দেখলাম লোকে বাসের মাথায় উঠে বসছে । আমাদের বেশ ভয় করতে লাগলো কারণ স্যাকগুলোতে তালা লাগানোর কোন ব্যবস্থা নেই । যে কেউ জিনিস তুলে নিতে পারে । আমরা সে কথা কন্ডাক্টারকে জানাতে সে আমাদের বললো আপনারা নিশিন্তে বসুন কোন ভয় নেই । কিন্তু আমাদের কি আর ভয় কমে যখনই বাস কোথাও দাঁড়াচ্ছে আমার বন্ধু মৃণাল উঁকি মেরে দেখছে । এমনি করে ভয়ে ভয়ে চলতে লাগলাম। স্যাকের জিনিস যদি খোয়া যায় তাহলে আমাদের আর চারধাম ঘোরা হবে না ।পাহাড়ি রাস্তা এঁকে বেঁকে উঠতে লাগলাম । একদিকে পাহাড় আরেক দিকে গঙ্গা নদী । হনুমান চটিতে বাস দাঁড়াতেই তড়িঘড়ি বাস থেকে নেমে আগে স্যাক নামালাম । ভাল করে দেখতে লাগলাম সব ঠিক আছে তো । স্যাকের মধ্যে ক্যামেরা , বাইনোকুলার সব ছিল । না , কোন কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হলো না । কন্ডাক্টার মহাশয় আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল , চোখাচোখি হতেই বললো – “ এ আপনাদের শহর নয় এটা গাড়োয়ালের পার্বত্য অঞ্চল । নিশিন্তে ঘুরে বেড়ান । চুরি যাওয়ার কোন ভয় নেই ।”ওর দিকে আর তাকাতে পারলাম না চোখ সরিয়ে নিলাম । ওইদিন হনুমান চটিতে থেকে পরেরদিন সকাল সকাল রওনা দিলাম ১৪ কিমি হেঁটে যমুনেত্রির উদ্দেশ্যে । তখন যমুনেত্রিতে থাকার জায়গা বলতে মন্দিরের পাশে কালি ক্লম্বলির ধরমশালা । ওখানেই উঠলাম । পাহাড়ে হেঁটে উঠতে ভালই পরিশ্রম হয়েছিল । তাই তাড়াতাড়ি রাত্রের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম ।মধ্য রাত্রে হটাৎ ঘুমের মধ্যে মনে হলো আমার নাম ধরে কে ডাকছে । চোখ খুলতে দেখি মৃণাল দাঁড়িয়ে আছে । আমায় বললো “ তাড়াতাড়ি বাইরে আয় ।” আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসলাম।দেখি আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার । থালার মতো চাঁদের রূপালি আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । সামনে খরস্রোতা যমুনা নদী একমনে বয়ে চলেছে । বামদিকে বরফে ঢাকা কালিন্দী পর্বত থেকে যমুনা তরতর করে নেমে আসছে । ঠিক দেখতে লাগছে যেন বাঁদরের লেজের মতো । তাই সবাই ঐ জায়গাকে বলে বান্দরপুঞ্ছ । কি মনোরম দৃশ্য । একটা বড় পাথরের উপরে বসে দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম । কোথা দিয়ে যে রাত কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না ।

গঙ্গোত্রীর পথে
আমাদের সময় ভৈরবঘাটি অবধি বাস যেত । ওখান থেকে পাহাড় ধরে দেড় কিলোমিটার নীচে নামতে হতো তারপর আবার দেড় কিলোমিটার পাহাড় ধরে উপরে উঠতে হতো ।জায়গাটার নাম লঙ্কা , ওখান থেকে বাস ধরে যেতে হতো গঙ্গোত্রী । এখন গঙ্গোত্রী অবধি সোজা গাড়ি চলে যাচ্ছে কারণ ভৈরবঘাটি থেকে লঙ্কার মধ্যে ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে ।কিন্তু আমাদের সময়ে ভৈরবঘাটি থেকে লঙ্কার মধ্যে রাস্তাটা খুবই কষ্টদায়ক ছিল । তাই জিনিসপত্র বহন করার জন্য পোর্টার পাওয়া যাচ্ছিল । জিনিষ প্রতি ওরা নিচ্ছিল দুটাকা করে ।কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল পরিশ্রম অনুযায়ী ওরা কম নিচ্ছে । তাই আমরা জিনিষ প্রতি দশ টাকা করে দিলাম । এতে ওরা এতো খুশী হলো যে আমাদের জন্য কিছু করতে পারলে ওরা ধন্য হয়ে যেত । ওখান থেকে গঙ্গোত্রী পৌঁছে একদিন গঙ্গোত্রীতে কাটিয়ে পরের দিন সকাল সকাল রওনা দিলাম গঙ্গা নদীকে থুড়ি ভাগীরথীকে ডান পাশে নিয়ে ১২ কিমি দূরে ভোজবাসার উদ্দেশ্যে । গঙ্গোত্রী থেকে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত গঙ্গা ভাগীরথী নামে প্রবাহিত। তারপর অলকানন্দা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করেছে। ভোজবাসায় লালবাবার আশ্রমে রাত কাটালাম । ঐ নির্জন জায়গায় থাকার মতো আর কোন জায়গা ছিল না । সবেমাত্র গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে কিন্তু চালু হয়নি । রুটি , ডাল আর গুড় সহযোগে রাত্রের আহার সারলাম । ঐ নির্জন জায়গায় যে খাবার পেলাম এই অনেক । একদিকে পাহাড় আর একদিকে ছোট্ট ভাগীরথী বয়ে চলেছে , মাঝখানে অনেকটা সমতল । রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় এর মন মোহিনী রূপ ভুলিয়ে দেয় নিজেদের অস্তিত্ব । মনে হচ্ছিল কেউ যদি হালকা করে বাঁশি বাজাত তাহলে মনে হতো স্বর্গে বিচরণ করছি । পরেরদিন সকাল সকাল চা আর রুটি খেয়ে চার কিমি দূরে চললাম গোমুখ । যেখানে দেখতে পাবো গঙ্গোত্রী হিমবাহ , গোমুখের মতো একটা মুখ দিয়ে তরতর করে জল বেড়িয়ে আসছে । গোমুখ পৌঁছে দেখলাম হিমবাহের রং আর সাদা নেই , ধুলোর আস্তরণে ধুসর হয়ে গেছে । তবে সূর্যের তাপে হিমবাহের চুড়াগুলি বিভিন্ন আকার ধারণ করেছে । চোখের সামনে গঙ্গা নদীর উৎস মুখ দেখে এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছিল । ভাবতে অবাক লাগছিল এই ছোট্ট গঙ্গা নদী হৃষীকেশে গিয়ে কি বিশাল আকার ধারণ করেছে । মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই বিখ্যাত গান – গঙ্গা আমার মা , পদ্মা আমার মা ………………।

কেদারনাথের পথে –
আমরা যখন গেছি তখন গৌরীকুণ্ড অবধি বাস যেত তারপর ওখান থেকে ১৪ কিমি পায়ে হেঁটে । গৌরীকুণ্ডে থাকার জন্য হোটেল পেয়েছিলাম তবে বেশ সাধারণ মানের । একটা ঘরে আমরা দুজন ছাড়াও আরও ছয়জন ছিল । বিকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি সবাই মিলে ভালই আড্ডা দিলাম । পরেরদিন সকাল সকাল কেদারনাথ রওনা হতে হবে তাই সবাই রাত্রে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম । শরীরে ভালই ক্লান্তি ছিল তাই সবাই মোটামুটি চোখ বন্ধ করেই ফেললাম । সবে চোখের দুটো পাতা এক করেছি হটাৎ বীভৎস এক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল । ধড়মড় করে উঠে দেখি আমাদের এক সহযাত্রীর নাসিকার আওয়াজ । চারিদিক নিস্তব্দ, তার মাঝে ঐ আওয়াজ মনে হচ্ছিল সাইলেন্সার পাইপ খুলে কেউ বাইক চালাচ্ছে । কানে মাফলার জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । না , অত ক্লান্ত থাকা সত্বেও কিছুতেই ঘুম আসছিল না । বাধ্য হয়ে বাইরে বেড়লাম যদি অন্য কোন ঘরে থাকা যায় । হোটেলের অফিস ঘরের দিকে যেতে দেখি অফিস বন্ধ । কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না । কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না । আবার হিংসাও হচ্ছিল বাকীদের নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে । ঘুমানোর ভীষণ দরকার কারণ কাল অনেকটা পথ হাঁটতে হবে । ঠাণ্ডার মধ্যে গায়ে সব চাপিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরের বাইরে করিডরে শুয়ে পড়লাম । আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনা । ভোড়ে ঘুম ভাঙল ঐ নাকডাকা সহযাত্রীর ধাক্কায় । এতো করুণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল যে কিছু বলতে পারলাম না । জানলাম অনেক ডাক্তার ওনি দেখিয়েছেন কিন্তু আওয়াজ কেউ কমাতে পারেনি । ওনার সাথে ওনার বাড়ির কেউ একঘরে ঘুমায় না । ওনার প্রতি একটু করুণাই হচ্ছিল তবে মনে মনে বললাম যাত্রা পথে ওনার সাথে আর রুম শেয়ার করছি না ।মন্দাকিনী নদীকে সবসময় পাশে নিয়ে এগিয়ে চললাম কেদারনাথ ।গরুড় চটি পার হয়ে দেওদেখনি আসতেই চোখে পড়ল কেদারনাথ । আরও বেশ কিছুটা সমতলের উপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মন্দাকিনীর পারে । সেতু পেড়িয়ে কিছুটা এগোতেই দুপাশে দেখতে পেলাম ছোট ছোট দোকান । আর একটু এগোতেই পেলাম কেদারনাথ মন্দির । তখন সূর্য সবেমাত্র ঢলে পড়েছে হটাৎ আকাশ থেকে সাদা তুলোর মতো বরফ ভেসে আসতে লাগলো । ঐ প্রথম তুষারপাত দেখলাম । গায়ে পড়ছিল কিন্তু ভিজছি্লাম না । মন্দিরের পিছনেই পাহাড় বরফে ঢাকা , আকাশ থেকে ভেসে আসছিল বরফ , ধীরে ধীরে সব সাদা হয়ে যাচ্ছিল । স্নিগ্ধ এক আলোয় চারিদিক ভরে উঠেছিল । বেশ শান্ত পরিবেশ তারমাঝে শোনা যাচ্ছিল শুধু মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। পথের ক্লান্তি ভুলে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেছিলাম প্রকৃতির কোলে । ভারতসেবাশ্রমে রাত কাটিয়ে পরেরদিন দর্শন করলাম কেদারনাথের জ্যোতির্লিঙ্গ ।

বদ্রীনাথের পথে –
চার ধামের মধ্যে তিন ধাম দর্শন করে চললাম শেষ ধাম বদ্রীনাথের পথে । এই চার ধামের একটা জিনিস আমার বেশ ভাল লেগেছে । সেটা হল দুই ধামে পূজিত হন দুই মহিলা , যমুনা ও গঙ্গা আর বাকি দুই ধামে পূজিত হন দুই পুরুষ , মহাদেব ও নারায়ন ।এছাড়া চারধামেই আছে চার নদী । যমুনেত্রিতে যমুনা , গঙ্গোত্রীতে ভাগীরথী , কেদারনাথে মন্দাকিনী আর এই বদ্রীনাথে অলকানন্দা । পুরাপুরি সাম্যবাদ । মনে হচ্ছে যেন রাহুল সাংকৃত্যায়নের জয় যৌধেয় পড়ছি । তিন ধাম দর্শন করতে হলে বেশ কিছুটা করে হাঁটতে হয় কিন্তু এই বদ্রীনাথে হাঁটতে হয় না । মন্দিরের বেশ কাছে অবধি গাড়ি যায় । এখানকার মন্দিরও অনেক কালারফুল । মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে অলকানন্দা । নদী পেড়িয়েই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় । যোশীমঠ পেড়িয়ে বদ্রীনাথের পথে আসার সময় দুটো পাহাড় পরে, যার একটার নাম ‘নর’ আরেকটার নাম ‘নারায়ন’ । কথিত আছে কলিযুগ ধ্বংসের সময় এই পাহাড় দুটো এক হয়ে যাবে । আর মন্দিরের পিছনেই আছে বরফে ঢাকা নীলকণ্ঠ পিক । সেদিন আকাশ ছিল পরিষ্কার । তাই সেই ঘন নীল আকাশে ভোরের আলো যখন সেই নীলকণ্ঠ পিকের বরফের উপর পরেছিল তখন তার সোনালি রূপ মন ভরিয়ে দিয়েছিল । খালি তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করছিল । যতটা পেরেছি ক্যামেরায় ধরে রেখেছি । যাদের এই অভিজ্ঞতা আছে তারা উপলব্ধি করতে পারবে । বদ্রীনাথে থাকার ভাল জায়গা অনেক আছে । আমরা ছিলাম গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের গেস্ট হাউসে । ভাল ব্যাবস্থা এবং ইচ্ছা মতো খাওয়া যায় । পরেরদিন সকালে বদ্রীনাথ দর্শন করে ওখান থেকে সাত কিমি দূরে অলকানন্দার উৎস স্থল বসুধারা দেখতে চললাম । তিন কিমি যেতেই পড়ল ভারতবর্ষের সব চেয়ে উঁচু গ্রাম ‘মানা গ্রাম’ । বড় মিলিটারি ক্যাম্প আছে এখানে । চারিদিকে পাহাড় আর মধ্যে অনেকটা সমতল । বাঁদিকে আছে সরস্বতী নদীর উৎস, ভীমপুল, কেশবপ্রয়াগ আর ডানদিকে আছে ব্যাসগুহা ও গণেশগুহা। লোকে বলে ঐ ব্যাসগুহাতে বসে ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করেছিলেন । আর ঐ জায়গাতে নাকি ছিল ইন্দ্রের রাজধানী – অমরাবতি । এখান থেকেই নাকি পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর যাত্রা শুরু করে ছিল স্বর্গের পথে।একটা কথা না বলে পারছি না ওখানকার গ্রামের মানুষেরা বেশ গরীব কিন্তু ছেলে ও মেয়ে সবার মুখেই ছিল এক অদ্ভুত সারল্য , এক নিষ্পাপ চাহুনি ।বসুধারার রাস্তাটা খুবই খারাপ ছিল আর স্বর্গে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমাদের ছিল না তাই বাধ্য হয়েই ফিরে আসলাম বদ্রীনাথে ।এবার ঘরে ফেরার পালা ।
