পেরাসিটামল – সুপ্রিয় রায়

পেরাসিটামল – সুপ্রিয় রায়

খুব ঘটা করে উদয়ন আর ঊর্মির বিয়ে হয়ে গেল ফেব্রুয়ারিতে । সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিলিগুড়িতে এসেছিল ।মেয়ের বাড়ি আর ছেলের বাড়ি দুটোই যেহেতু শিলিগুড়িতে, তাই দুই পক্ষের সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন জমা হয়েছিল এই শিলিগুড়ি শহরে ।একটা বড় বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল দুই পক্ষের জন্য । দুই বাড়ির সব বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন ছিল একই বাড়িতে । মেয়ে পক্ষ ছিল একতলা আর দোতলা নিয়ে আর ছেলে পক্ষ ছিল তিনতলা আর চারতলা নিয়ে । অবশ্য সবার খাওয়া দাওয়া ছিল একসাথে । তাই সারাদিন ধরে সবাই খুব আনন্দ করেছিল । বিয়ে বৌভাতের পর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডুয়ার্স ভ্রমনে । শিলিগুড়ির আশে পাশে এতো সুন্দর সব জায়গা আছে যে আত্বিয়স্বজনরা যারা বাইরে থেকে এসেছিল তারা ঘুরে যেতে চাইলো । তাই সব মিটতে মিটতে ফেব্রুয়ারি মাসটা কেটে গেল । উদয়ন আর ঊর্মি ঠিক করেছিল হানিমুনে ওরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফিনল্যান্ডে যাবে পাঁচ দিনের জন্য তারপর রোমে দুদিন কাটিয়ে ফিরে আসবে কেননা  ফিনল্যান্ডে তখন ভালই ঠাণ্ডা পাবে আর রোমে তো খুব একটা গরম পাবে না । তাই এই প্রোগ্রাম । কেউ কেউ অবশ্য করোনার জন্য এখনকার মতো প্রোগ্রাম বাতিল করতে বলেছিল ।কিন্তু  আগে থেকে ওদের সব ঠিক করা ছিল । প্লেনের টিকিট , হোটেল সব আগে থেকে বুক করাছিল । না গেলে অনেকগুলো টাকা নষ্ট হবে । আর লোকজন তো যাচ্ছে । তাই ওরাও নিদিষ্ট দিনে রওনা হয়ে গেল ।ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড গিয়ে ওদের আনন্দ আর ধরে না । চারিদিকে প্রচুর বরফ । শান্তাক্লজের গ্রাম দেখে ওরা অভিভুত । একটু সময়ের জন্য মেরুজ্যোতি বা আরোরা যা আকাশে একধরনের প্রাকৃতিক আলোর প্রদর্শনী তা দেখার সৌভাগ্যও  ওদের হয়েছিল । ফিনল্যান্ডে দারুণ আনন্দ করে ওরা নিদিষ্ট সময়ে পৌছাল রোমে । রোমে পৌঁছেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জার্নি করে সোজা চলে গেল ভেনিসে। অনেকক্ষণ ধরে চলল নৌকাবিহার । দুজনে একসাথে দারুণ আনন্দ করে বিকালবেলা রোমের হোটেলে ফিরল কেননা রাতে দিল্লীর জন্য ফেরার প্লেন ধরতে হবে ।হটাৎ ঊর্মি উপলব্ধি করলো যে উদয়নের শরীরটা একটু গরম লাগছে । উদয়নও সেটা অনুভব করতে পেরেছে । ওদের সাথে পেরাসিটামল ছিল একটা খেয়ে নিল । যেহেতু আর কোন অসুবিধা ছিল না ওরা খুশী মনেই রওনা হল দিল্লীর উদ্দেশে । দিল্লী পৌঁছানোর আগে আবার একটা পেরাসিটামল খেতে হল । তাতে জ্বরটা কমে গেল আর তার ফলে দিল্লিতে থারমাল পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ল না । ওরা শুনল যে যারা বিদেশ থেকে আসছে তাদের প্রত্যেকেই থারমাল পরীক্ষার  মাধ্যমেই বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে যে তাদের করোনার সংক্রমণ হয়েছে নাকি । ওরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডোমেস্টিক বিমানবন্দরে গেল বাগডগরার জন্য প্লেন ধরতে । দু ঘণ্টা পনের মিনিটের  জার্নি । ওরা পৌঁছে গেল বাগডোগরা । প্লেনে খাবার পর আবার একটা  পেরাসিটামল খেয়ে নিল উদয়ন । তার ফলে বাগডোগরাতেও থারমাল পরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়ল না । বিমানবন্দর থেকে বেড়িয়ে একটা গাড়ি নিয়ে সোজা চলল হাকিমপাড়া । শিবমন্দির পেরোতেই বাঁ হাতে দেখল সিটি সেন্টার খোলা আছে । যেহেতু ওরা তাড়াতাড়ির ফলে  সকলের জন্য বিদেশী চকলেট কিনে আনতে পারেনি , তাই উদয়ন , ঊর্মিকে গাড়িতে বসিয়ে সিটি সেন্টার থেকে কিছু বিদেশী চকলেট কিনতে গেল । তারপর সোজা বাড়ি । সারাদিন আর কোন অসুবিধা নেই , আনন্দেই কাটল । কিন্তু পরেরদিন আবার জ্বর আসলো । এবার সবার মনে ভয় ঢুকল কেননা ততদিনে করোনা নিয়ে প্রচার শুরু হয়ে গেছিল । ডাক্তার দেখানো দরকার । কিন্তু কোথায় ডাক্তার ?সবার চেম্বার বন্ধ । যেসব ডাক্তাররা হসপিটাল আর নার্সিংহোমের সাথে জড়িত তারাই শুধু কাজে যাচ্ছে আর বাকী সব বন্ধ । অগত্যা জানাশোনা এক ডাক্তারকে ফোন করা হল । ওনি বললেন মেডিকাল কলেজে নিয়ে যেতে । উদয়ন বুঝতে পারলো বাড়ির লোক সব ভয় পাচ্ছে । ওর থেকে দূরে দূরে থাকছে । ঊর্মিও ওর বাপের বাড়িতে বলে দিল কেউ যেন এখন ওদের বাড়িতে না আসে । ঊর্মি ঠিক করলো উদয়নকে নিয়ে মেডিকাল কলেজ যাবে । বাড়ির সবাই একটু ভয় পেয়ে গেছিল ঠিকই কিন্তু ঊর্মির সাহস দেখে আর কারও কোন ভয় রইলো না । বাড়ির সবাই উদয়নকে বলল যদি তোকে হসপিটালে Quarantine এ থাকতে বলে তাহলে ঘরে চলে আসবি । আমরা সবাই একসাথেই  থাকবো । তারপর যা হবে দেখা যাবে । ঊর্মিকে আর বাড়ির লোকজন উদয়নের সাথে যেতে দিল না । উদয়নের বাবা উদয়নকে নিয়ে গেল মেডিকাল কলেজ। ডাক্তার সব শুনে উদয়নের লালারস নিল পরীক্ষা করার জন্য আর উদয়ন আর ঊর্মিকে হসপিটালে Quarantine এসে থাকতে বললো । উদয়নের বাবা পরিষ্কার বলে দিল যে ওরা বাড়িতেই থাকবে আর বাড়ির সবাই যার যা প্রোটেকশন নেওয়ার দরকার সব করবে । ওষুধ নিয়ে ওরা বাড়ির দিকে রওনা হল । তবে বাড়ি যাওয়ার সময় বেশ কিছু জিনিষ ওরা নিয়ে নিল যাতে আর কদিন বাড়ির থেকে বেড়তে না হয় । উদয়নের মা কাজের লোককে কদিন আসতে মানা করে দিল । ব্যাস খবর রটে গেল পাড়ায় । প্রচুর ফোন আসতে লাগলো । পাড়ার যারা একটু পাকা গোছের তারা বলতে লাগলো যে বাড়িতে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না, এতে পাড়ার ক্ষতি হতে পারে । কিন্তু উদয়নের বাবা সবাইকে বললো যদি তেমন পরিস্থিতি হয় তাহলে অতি অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করা হবে । আর আমরা কেউ বাড়ির বাইরে যাব না । কোন কিছুর দরকার হলে পুলিশ বলেছে ঘরে পৌঁছে দেবে । তবে বেশীরভাগ পাড়া-পড়সি এবং লোকাল বন্ধুবান্ধব , আত্বিয়স্বজন বললো যে তারা সাথে আছে । কোন কিছুর দরকার হলে তারা এমন ভাবে পৌঁছে দেবে যে কোন রিস্ক থাকবে না । সবার সহযোগিতায় উদয়নরা মনে জোড় পেল । উদয়নের বাবা একটা কথা উদয়নকে বললো যে ও একটা ভীষণ ভুল করেছে । ওর দিল্লী বিমানবন্দরে বলা উচিৎ ছিল যে ও পেরাসিটামল খেয়েছে । দরকার পড়লে ওরা দিল্লিতেই কোয়ারেনটাইনে থাকতো ।উদয়ন বললো যে ওর একদম করোনা ভাইরাসের কথা মাথায় ছিল না । ও স্বীকার করলো যে একটা দারুণ ভুল হয়ে গেছে । ওর সিটি সেন্টারে যাওয়াটাও খুব ভুল হয়ে গেছে । ওর জন্য আরও অনেকের বোধহয় ক্ষতি হয়ে গেল । যাইহোক এখন আর কিছু করার নেই । শুধু অপেক্ষা রিপোর্টের জন্য ।দুদিন লাগবে রিপোর্ট জানতে । এই দুদিন যেন কাটতেই চায়না । কারোই রাত্রে ভালকরে ঘুম হচ্ছে না । একটাই ভয় রিপোর্ট পজিটিভ হবে না তো ? ঊর্মি সবাইকে সাহস দিচ্ছিল যা হবে আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করবো ।কেউ যেন নিজেকে একা না মনে করে । অসুখ তো কারও হতেই পারে । কিন্তু মানুষটা তো সবার আপনজন । সবাই ভাল করে প্রোটেকশন নিয়ে একে অপরকে সেবা করবো । সেদিন দুপুরে সবাই অপেক্ষা করছে কখন হাসপাতাল থেকে ফোন আসে । ল্যান্ড লাইনের নম্বর দেওয়া আছে । হটাৎ ফোনের আওয়াজ  । সবাই ভয় পাচ্ছে ফোন ধরতে । ঊর্মি উঠে গেল ফোন ধরতে । সবাই একদম চুপ । তাকিয়ে আছে ঊর্মির দিকে । ঊর্মির মুখটা থমেথমে ।হু হা করতে করতে হটাৎই  চীৎকার করে উঠলো – “ নেগেটিভ” । সে আওয়াজ ভাসতে ভাসতে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল ।

2 thoughts on “পেরাসিটামল – সুপ্রিয় রায়

  1. Mita Sengupta
    khub bhalo laglo
    Rupa Bhattacharjee
    দারুণ সুপার্ব 👌👌
    Chanchal Bhattacharya
    বাহ্। ভালো লাগলো।।
    Lipika Roy
    গল্পটা খুব সুন্দর হয়েছে, একেবারে বাস্তব মনোভাবাপন্ন।গল্পটার একটা Positivity রয়েছে। রিপোটা টা Negetive তাই মন স্বস্তি পেল।
    Prasanta Chakraborty
    রীতিমত সাসপেন্স আর হরর স্টোরি।!! দারুন লেখা সুপ্রিয়।
    Naru Mahato
    খুব সুন্দর ভাবে পরিবেশন করছেন । ভালো লাগলো ।
    Papia Kargupta
    গল্পঃ টা পড়তে পড়তে আগে শেষ টা পড়তে ইচ্ছে করে ছিল শেষ পর্যন্ত সাসপেন্স ধরে রেখে শেষ টা পড়ে ভীষন ভালো লাগলো,👏👏
    Reena Dasgupta
    Khub bhalo laglo
    Sucheta Sen
    Khub bhalo laglo golpota pore korona jeno kauke chute na pare
    Kanti S
    Khub sundar galpo
    Swapnesh Ghosh
    negative na hole oder bibahito jibontai nosto hoea jeto.darun .
    Mita Sengupta
    Darun…
    Jaba Sengupta Roy
    Good suspense. Khub bhalo.
    Rina Ray
    Khub bhalo Sara biswer reporto jano nagative ase
    Shubhranshu Mohan Banerji
    সত্যিই অসাধারণ লেখা, এইভাবেই চালিয়ে যা ভাই, খুব ভালো লাগল রে ।
    Soma Dasgupta
    গল্পটা খুব ভালো লাগল কিন্তু খুব উদ্বেগে ছিলাম শেষটা কি হবে ।এবার সস্তি পেলাম যে পরিবার টিতে করোনার প্রকোপ এসে আর পৌছতে পারে নি ।
    ললিতা রায়
    Lalda u r great.Darun likhecho
    Dipak De
    Darun Suprya da Chaliye Jao. Tomar Golpo balar style ta darun. Keep it up.
    Partho Mukherjee
    Khub Sundar lekhata,ei monobol tai aneker thakchena.
    Apurba Neogi
    Really excellent. Congrats. to you for writing such an outstanding and brilliant story which is very much in line with the present situation..
    Kasturi Chakraborti
    খুব ভালো লাগল লেখা টা।
    Amitava Biswas
    মাঝখানে সাসপেন্স ! শেষে নিশ্চিন্ত। আহা:
    Tapasi Banerjee
    Oh! Darun likhecho.
    Pk Bhattacharjee
    খুব ভাল লাগলো ।
    Priyabrata Panja
    সুপ্রিয়দা লা জবাব।ফিনল্যান্ড ভ্রমনের অভিজ্ঞতা,ছেলে- মেয়ের বিয়ে একই বাড়িত থেকে মনের কল্পনা,শিলিগুড়িতে করোনা সংক্রমন ধরা পড়া,উত্তরবঙ্গে নানান টুরিস্ট পট যা তোমাকে আকর্ষন করে,সব মিলিয়ে এমন গল্পের প্লট।তার সাবলীল বর্ননা এবং শেষ করলে পজিটিভ টোনে।এককথায় অনবদ্য অনুগল্প।আগামীতে আরও পাবার আসায় থাকলাম।অবসর জীবন এভাবেই সুস্থ দেহে ও মনে কাটাও,এই প্রার্থনা করি।পরিশেষে অনুরোধ ম্যানাস্ক্রিপট্ গুলো রেখে দিও।
    Rinki Sen
    Bortoman porishthiti r sathe ekdom mile geche — report negetive holo jeno shwoshti pelam — darun lekha hoeche
    Mita Sen
    Darun Supriyo Roy
    Tanima Goswami
    Khub valo laglo lekheta. Darun.
    Swapna Sen Gupta
    বাবা দুরু বুকে শেষ করলাম।তবে শেষে এসে খুব খুব ভালো লাগলো।
    Biplabshankar Mazumder
    “নেগেটিভ ” কথাটা কতটা পসিটিভ আনন্দ দিতে পারে সেটা করোনা-ই দেখালো।
    গল্পটা অসাধারণ লাগলো।
    Shankar Biswas
    Bhalo laglo
    Sarat Mullick
    Really excellent
    Swapan Misra
    Tomar golpo sankalan gulo khub bhalo lage mane hoi Satyi e chapate hobeto bhalo theko tumi amader garba shuva sakal
    Saktimay Chakraborty
    লেখার বাধন গল্পের উদ্দেশ্য পুরটাই পজেটিভ।অসাধারণ, চালিয়ে জাও বন্ধু।
    Aparajita Sengupta
    গল্পের শুরু থেকে tention হচ্ছিল, শেষের “নেগেটিভ “report ” পড়ে আমি নিশ্চিত হলাম ।সময়োপযোগী লেখা পড়ে ভালো লাগল ।

    Liked by 1 person

Leave a Reply to supriyoroy Cancel reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s