অনেকদিন পর ছোটবেলার বন্ধুরা সবাই একত্রিত হয়েছে সার্থকের বাড়িতে । চলছে নির্ভেজাল আড্ডা । আর বাঙালির আড্ডা মানে তো কোন নিদিষ্ট বিষয় নিয়ে চর্চা করা নয় , যখন যে বিষয় কেউ উস্থাপন করবে সেটা নিয়েই চলবে কথোপকথন । তবে দেখা গেছে প্রায় সব আড্ডাতেই খেলা আর রাজনীতি এই দুটো বিষয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসে । এখানেও আসলো । রাজনীতি আসা মানে প্রথমেই আসে দুর্নীতির প্রসঙ্গ । সবারই এক কথা যে দুর্নীতি দেশটাকে শেষ করে দিল । সাম্য একটা রেস্টোরেন্টের উদাহরণ দিল । বললো – “ একটা রেস্টোরেন্টের কোন কর্মচারী যদি লুকিয়ে কোন একটা খাবার খেয়ে ফেলে তাতেও সেই রেস্টোরেন্টের বিরাট কোন ক্ষতি হয় না কিন্তু যদি কেউ রেস্টোরেন্টের ক্যাশ বাক্স থেকে লুকিয়ে ক্যাশ নিজের পকেটে ঢোকায় তাহলে সেই রেস্টোরেন্ট ক্ষতির মুখ দেখতে বাধ্য । আমাদের দেশের অবস্থাও তাই । ক্যাশ চুরি হচ্ছে ।
উদয়ন জিজ্ঞেস করলো – “ আচ্ছা বল দুর্নীতি বলতে আমারা কি বুঝি ?”
বিপ্লব উত্তর দিল – “ যে ব্যাক্তিরা তাদের নিজস্ব বস্তুগত স্বার্থকে সমষ্টির স্বার্থর থেকে বেশি পছন্দ করে তাদেরকেই দুর্নীতিগ্রস্থ বলা হয় ।”
সাম্য আবার বললো – “ দেখ সোজা ভাবে বলতে গেলে দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি অসৎ উপায়ে টাকা বা সম্পতি আত্মসাৎ করা ।তাই তো ? তা সেটা যেমন ভাবেই হোক । কাজের বরাত দিয়ে কমিশন খাওয়া , ঘুস নেওয়া , অসৎ উপায়ে সম্পত্তির আত্মসাৎ করা , সরকারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা, সরকারের প্রাপ্য টাকা না দেওয়া যেমন ট্যাক্স ফাকি দেওয়া , ব্যাংক থেকে লোণ নিয়ে টাকা শোধ না দেওয়া ,কালোবাজারি ইত্যাদি – এগুলোই তো দুর্নীতির মধ্যে পড়ে ।কি বলিস । কিন্তু সবাই এই সবকিছুকে দুর্নীতি বলে মনে করে না ।বিশেষ করে ব্যাংক থেকে লোণ নিয়ে টাকা শোধ না দেওয়া আর যেকোন ভাবে ট্যাক্স ফাকি দেওয়াকে দুর্নীতি বলে মনে করে না । আরে এগুলোও তো জনগণের টাকা আত্মসাৎ করা । কি বলিস তোরা । আচ্ছা চুরি আর ডাকাতিকে কি আমরা দুর্নীতির মধ্যে ফেলতে পারি ? ”
সাথী চা আর কিছু খাবার দিতে এসে সাম্যর শেষ কথাটা শুনতে পেল । বললো – “ আমি কি তোমাদের মাঝে একটু বলতে পারি ?”
সবাই সন্মতি জানালো । সাম্য হাসতে হাসতে বলেই ফেললো – “ না বলতে দিলে রক্ষে আছে ? চা , খাবার কিছুই তো তাহলে জুটবে না ।”
সাথী হেসে চা ঢালতে ঢালতে বলতে লাগলো – “ যেখানে নীতি বা নিয়ম আছে সেখানে যদি কোন অনিয়ম হয় তাহলে তাকে আমরা দুর্নীতি বলি ।চোর বা ডাকাতদের কোন নীতি নেই সুতরাং চুরি আর ডাকাতিকে আমরা দুর্নীতির মধ্যে ফেলতে পারি না ।তবে দুর্নীতি নিয়ে যখন তোমরা আলোচনা করছো তখন একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছা করছে । এই দুর্নীতিবাজ লোকগুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় যখন দেশে আসে মহামারী , বন্যা , তুফান ।দুহাতে উপার্জন করে তখন। ”
আরেক বন্ধু সৌম্য বললো –“দ্যাখ অসৎ হওয়াটা নো ডাউট দোষের কিন্তু সৎ হওয়াটা কোন গুনের নয় । তাদের জন্যই গুনের যাদের অসৎ হওয়ার সুযোগ ও সাহস থাকা সত্বেও সৎ থাকে । দ্যাখ একটা মানুষ সৎ কিন্তু কারও জন্য কিছু করে না তাকে কি তোরা ভাল বলবি ? আরেকটা মানুষ জানি কিছুটা অসৎ কিন্ত লোকের জন্য খুব করে তাকে অন্তত আমি ভাল বলবো আবার তার অসৎ কাজের সমালোচনাও করবো । তোদের মত হয়তো আমার সাথে নাও মিলতে পারে । কিন্তু তারমানে আমি বলছি না যে অসৎ হওয়াই ভাল ।”
এতক্ষণ সার্থক চুপ করে শুনছিল ।হটাৎ বলে উঠলো-“ আজ তোদের আমি আমার জানা এক সৎ লোকের অসৎ হওয়ার গল্প বলবো । আমি আজ যার কথা বলবো সে ছিল এক গরীব , সৎ প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক । এক গ্রামে ছিল তার বাস ।গ্রামের লোক তাকে দারুণ মান্যি গন্যি করত । যার যা কিছু অসুবিধা ওনার সাথে আলোচনা না করলে কারও চলত না ।আর গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই ছিল অশিক্ষিত তাই শিক্ষক মহাশয়ের কদর সাবার কাছে আরও বেশী ছিল । ওনিও নিঃস্বার্থভাবে যতটা পারতেন করতেন । ওনি একটা রাজনৈতিক দলের ওখানকার নেতা ছিলেন ঠিকই কিন্তু দলমত নির্বিশেষ সবার উপকার করতেন । এরজন্য সবাই ওনাকে ভালও বাসতো । বাব ,মা , স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে শিক্ষক মহাশয়ের সুখের সংসার । শিক্ষকতা করে যা উপার্জন হতো পাঁচজনের সংসার মোটামুটি চলে যেত । ভালই চলছিল সবকিছু কিন্তু বাদ সাধল অসুখ । শিক্ষক মহাশয়ের বাবার নিউমনিয়া ধরা পড়ল । গ্রামে চিকিৎসা করা যাবে না , নিয়ে যেতে হবে শহরে । অনেক টাকা লাগবে । ঘরে যে সামান্য টাকা আছে তাতে কিছুই হবে না । কি করা যায় কিছুতেই মাথায় আসছে না শিক্ষক মহাশয়ের । চুপচাপ চেয়ারে বসে ভাবছে । ওনার স্ত্রী ব্যাপারটা আঁচ করে ওনার কাছে এসে আসতে আসতে বললো – “ পার্টির অতোগুলো টাকা তো তোমার কাছেই থাকে । এখন আপাতত ওর থেকে খরচা কর , পরে শোধ করে দেওয়া যাবে ।”
ওনাদের কাছে এছাড়া আরেকটা রাস্তা খোলা ছিল , সেটা হল মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নেওয়া ।ওই মুহূর্তে এছাড়া আর কিছু করার ছিল না । প্রথম রাস্তাটাই ঠিক মনে হল । তাই শিক্ষক মহাশয় পার্টি ফান্ডের টাকা থেকে টাকা নিয়েই চললো তার বাবার চিকিৎসা করাতে ।সব কিছু ভালমতো মিটে গেল এবং বাবাও ভাল হয়ে গেল কিন্তু অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল । প্রত্যেক মাসে অনেক কষ্ট করে সংসার থেকে পয়সা জমিয়ে ওনারা পার্টি ফান্ডে জমা করতে লাগলো ।তাতে কি আর পুরোপুরি শোধ হয় , বেশ অনেকটাই বাকী । সামনে আবার বাৎসরিক মিটিং এসে গেল ,সব কিছুর হিসাব দিতে হবে । আর কোন উপায় না দেখে ওই শিক্ষক মহাশয় বাধ্য হল হিসাবে গোলমাল করতে ।ভয়ে ভয়ে মিটিঙে হিসাব দাখিল করলো এবং আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ কোন আপত্তি করলা না । কারণ সবাই ওনাকে খুব বিশ্বাস করতো । ব্যাস এই হল হাতেখড়ি ।শিক্ষা নিল প্রথমে বিশ্বাস অর্জন তারপরে দুর্নীতি । আর দুর্নীতি করে ধরা না পড়লে আত্মবিশ্বাস তো বাড়বেই । তারপরের কথা আর নাই বা বললাম ।আজ সে বড় নেতা এবং সাহসের সাথে অসৎ কাজ করে ।”
সবাই চুপ করে শুনছিল । সাম্য সার্থককে জিজ্ঞেস করলো – “ তুই জানলি কি করে ?”
সার্থক উত্তর দিল – “ ওই শিক্ষক মহাশয়ের ছেলে আমার পরিচিত । এখন তো প্রচুর টাকা । একদিন নেশার ঘোরে ওর বাবার কীর্তি সব উজাড় করে দিয়েছিল আমার কাছে । সেদিন বোধহয় বাবার কাছে কিছু চেয়ে পায়নি , তাই রাগ ছিল । আর তার জন্য খুব নেশা করেছিলো । আমি কোনদিন কাউকে কিছু বলিনি , তোরাও কাউকে কিছু বলিস না । একবার যে অসৎ কাজে হাত পাকাবে তাকে দুর্নীতির হাত থেকে আটকানো মুশকিল ।টাকার স্বাদ পাওয়া বাঘের রক্তের স্বাদ পাওয়ার মতোই ।”
“ এবার আড্ডা থামিয়ে তোমরা চা টা খেয়ে নাও, নাহলে আমাকেই দুর্নীতি দমনে মাঠে নামতে হবে” – হাসতে হাসতে সাথী যাওয়ার আগে বলে গেল ।
বিঃ দ্রঃ – এটা নিছকই একটা গল্প এবং চরিত্রগুলি কাল্পনিক ।সুতরাং কারও সাথে মিলে গেলে লেখকের কোন দায় থাকবে না ।
***** Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos
Biman Kumar Chatterjee
লকডাউন বা বিশ্ব-মহামারী নিয়েও সারা বিশ্বে কত রকম দূর্নীতি চলছে। শুধু টাকা পয়সার নয় । তথ্য,তথ্যপ্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইত্যাদি আরও কত কিছু তে। সাথীর কথা সর্বৈব সত্য।
Apurba Neogi
Fantastic story..
Papia Kargupta
খুব সুন্দর হয়েছে গল্পঃ টা ভালো লাগলো
Reena Dasgupta
Bhalo likhecho
Soma Dasgupta
পরে খুব ভালো লাগল । এরকমই তো চারিদিকে সব সময়ই চলছে ।
Kanti S
Amader des ki kakhono durnete mukto hobe janena
Moitra Ashok
খুব সুন্দর লেখা, অপ্রিয় সত্য কিন্তু বাস্তবিক।
Gautam Chaki
Khub bhalo laglo pore,keep it up
Probodh Pal
লেখাটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো এবং জীবনের বাস্তব কথা।
Parimal Dhargupta
একটা বাসত ভিক ভাল গল্প।
LikeLiked by 1 person
THANKS TO ALL
LikeLike