একটু যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে শুনে আসছি আমেরিকা একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশ । ছোটবেলা থেকে সামন্ত্রতন্ত্র বা সামন্ত্রবাদ দেখে বড় হয়েছি । ইউরোপ গিয়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ছোঁয়াও পেয়েছি । সাম্যবাদ দেখেনি বা এ জীবনে দেখতে পাবো কিনা সন্দেহ আছে । তাই যখন আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ আসলো , লাফিয়ে উঠলাম এই মনে করে যে একটা বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশকে সামনে থেকে দেখতে পারবো বলে । আমার ছোট ছেলে এখন আমেরিকাতে কর্মরত । টিকিট কেটে আমাদের পাঠিয়ে দিল । আমাদেরকে শুধু ভিসার জন্য DS -160 form fill up করতে হবে । বড় ছেলে ফিনল্যান্ডে বসে আমাদের জন্য DS -160 form fill up করে জমা করে দিল । সাথে সাথেই Appointment confirmation letter চলে আসলো । প্রথমে একদিন যেতে হবে সেক্সপিয়ার সরণির অফিসে ও আরেকদিন যেতে হবে হো চি মিন সরণির অফিসে । অনেকেই বলল যে মিস্টার ট্রাম আসার পর আমিরিকার ভিসা পাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে ।সুতরাং ছেলের প্রচুর ডকুমেন্ট এবং আমাদের প্রচুর ডকুমেন্ট ও আমাদের দুজনের দুটো করে ভিসার জন্য আলাদাভাবে তোলা ফটো নিয়ে আমাদের জন্য রাখা নিদিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলাম সেক্সপিয়ার সরণির অফিসে । অনেকেই বলল যে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া যাবে না । গিয়ে শুনলাম মোবাইল ফোন আনা যায় তবে ভিতরে যাওয়ার আগে সেটা সাইলেন্ট বা বন্ধ করে নিয়ে যেতে হয় । লাগবে শুধু Appointment confirmation letter , DS -160 আর Passport । এই তিনটে ডকুমেন্ট নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম । মেশিনে হাতের ছাপ আর ছবি তুলে ছেড়ে দিল । খুব বেশী হলে পাঁচ মিনিট লাগলো । তারপর American Consulate office , Ho chi Min Sarani তে যে সময় এবং যেদিন যাওয়ার কথা ছিল সেদিন ঠিক সময়ে সব কাগজপত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম । এখানে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া মানা ।সেই তিনটে জিনিস Appointment confirmation letter , DS -160 আর Passport হাতে নিয়ে আর বাকী কাগজপত্র একটা transparent file এর ভিতরে নিয়ে অফিসে ঢুকলাম । ফর্মালিটি সেরে পৌছালাম ইন্টারভিউের ঘরে । একজন আমেরিকান লেডি আমাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিল । মাত্র কটা প্রশ্ন – কার কাছে যাচ্ছ ? , ছেলে কি করে এবং কোথায় কাজ করে ? কয় ছেলে ? বড় ছেলে কোথায় ? ওর কাছে গেছ ? তুমি কি রিটায়ার করেছো ? ব্যাস । বলল তোমাদের ভিসা approve হয়ে গেছে । আমি জানতে চাইলাম কবে ভিসা পাবো । একটা কাগজ দিল । তার মধ্যে লেখা আছে যে আমাদের ভিসা approve হয়ে গেছে এবং কোথার থেকে পাবো , কি নিয়ে যেতে হবে – এই সব । কি সুন্দর ব্যবহার । ভিসা অফিসে যাওয়ার আগে আমাদের কত টেনশন ছিল , কত ডকুমেন্ট নিয়ে গেছি । কিন্তু কিচ্ছু দেখল না ।এর আগে দুবার ইউরোপ ও একবার UK এর জন্য ভিসার interview দিয়েছি । অমেরিকার ভিসা সবচেয়ে সহজ লাগলো । চারদিনের মাথায় ভিসা পেয়ে গেলাম ।১০ বছরের ভিসা ।
রাত্রি ৩ টে ১৫ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু হল দমদম থেকে । বাড়িতে থাকলে ঘুম হবে না , তাই একটু আগেই পৌঁছে গেলাম দমদম এয়ার পোর্ট ।আগেভাগে সব জিনিসপত্র জমা দিয়ে , ইমিগ্রেশন সেরে , সিকিউরিটি চেক করিয়ে আমাদের নিদিষ্ট গেটের সামনে গিয়ে বসলাম একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য । কেননা অনেক সময় বাকী প্লেনে ওঠার । কিন্তু ঘুমাব কি ? মশা কানের কাছে গান গেয়ে বেড়ালে এবং শরীরের খালি জায়গা দেখতে পেয়ে বসে পড়লে , কি ঘুম আসে ? অগ্যতা বসেই রইলাম । আমরা এখান থেকে যাব দোহা – লসএঞ্জেলেস – সল্টলেক সিটি । রাত্রি ৩ টে ১৫ মিনিটে আমাদের প্লেন ছাড়ল দমদম থেকে । ৬ ঘণ্টা জার্নি করে সকাল ৬ টা ৪৫ মিনিটে (ওখানকার সময় ) পৌছালাম দোহা । বিশাল এয়ারপোর্ট । আমাদের অনেকটা দূরে গিয়ে আবার সিকিউরিটি চেক সেরে লসএঞ্জেলেসের জন্য প্লেন ধরতে হবে । চলমান রাস্তা , চলমান সিঁড়ি ও কিছুটা পায়ে হেঁটে পৌছালাম এয়ারপোর্টের ভিতরেই ট্রেন ধরতে । তারপর ট্রেনে করে নিদিষ্ট টার্মিনালে । অনেকটা রাস্তা । তাই ট্রেন । ট্রেনে করে কোনদিন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ভিতরে এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যাইনি । ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে গেছি বাসে করে । তাহলেই বোঝা যাছে যে দোহা এয়ারপোর্ট কত বড় । দোহা থেকে সকাল ৭ টা ৪৫ মিনিটে ( ওখানকার সময় ) যাত্রা শুরু করে ১৬ ঘণ্টা ২৫ মিনিট জার্নি করে লসএঞ্জেলেস পৌছালাম দুপুর ১ টা ১০ মিনিটে (ওখানকার সময় ) । এই প্রথম দেখলাম কাস্টম চেক হওয়ার আগে মেশিনে একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হল , আর মেশিনে হাতের ছাপ , চোখের ছবি ও ভিসার ছবি তুলতেই ছবি সহ একটা কাগজ বেড়িয়ে আসলো । ওটা নিয়ে কাস্টম অফিসারের কাছে যেতে হয় । কিছুই দেখল না , শুধু একটু জিজ্ঞেস করলো ।ইমিগ্রেশন ও কাস্টম চেক এত সহজভাবে হবে আগে ভাবিনি ।এরপর আমরা লসএঞ্জেলেসের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে টার্মিনাল ১ এ যাব । শুনলাম বাইরে বেড়িয়ে বাসে বাঁ ট্যাক্সিতে যাওয়া যায় বা এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা গেছে সেটা দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় । ১৫ মিনিট মতো লাগবে বলল । আমরা দুজনেই হাঁটতে ভালবাসি আর বাইরের তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি , হাতে সময়ও প্রচুর , দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে , যেখানে খুশী দাঁড়ানো যাবে , তাই ঠিক করলাম হেঁটেই যাব । ওখান থেকে আমাদের রাত্রি ৯ টা ১৫ মিনিটে যাত্রা । ঘুরে ঘুরে এয়ারপোর্ট দেখতে লাগলাম । তারপর ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট জার্নি করে রাত্রি ১২ টা ৫ মিনিট নাগাদ (ওখানকার সময় ) পৌছালাম সল্টলেক সিটি।এত ঘণ্টা সময় কাটিয়েও তারিখ কিন্তু বাড়ল না । যেদিন কোলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম সেই তারিখেই ওখানে পৌছালাম । সময়ের তারতম্যের জন্য এখানে আমরা একদিন বেশী পেলাম । এয়ারপোর্টের ভিতরেই ছেলে অপেক্ষা করছিলো । জিনিসপত্র নিয়ে ১০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম ওর বাড়ি । প্রথমেই একটা চমক । গাড়ি থেকে বোতাম টিপে গ্যারেজের লোহার গেট তুলে আমরা গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে ঢুকে পড়লাম । কোন সিকিউরিটি গার্ড নেই । অনেক রাত । ওকেও কাল অফিস যেতে হবে তাই সবাই একটু কথাবার্তা বলে শুতে চললাম । কিন্তু ঘুম আর আসে না । কেননা আমাদের দেশে এই সময় তো দুপুর বেলা । এখানে রাত্রি , তাই ঘুমাতে হবে । কিন্তু ঘুম আর আসে না । এক দুদিন সময় লাগবে এখানকার সময়ের সাথে মিলিয়ে নিতে । ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম । ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ । দিনের আলো ফুটছে । জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম । দেখি কাছেই একটা পাহাড় আমাদের হাফ সার্কেল করে ঘিরে রেখেছে । যেদিকে তাকাই সেদিকই সাদা । সারা পাহাড় জুড়ে বরফ । যেখানে সূর্যের আলো পরছে সে জায়গাটা মনে হচ্ছে সোনার গয়না পরে আছে । ব্যাস আর ঘুমানোর চেষ্টাও করতে পারলাম না । দুচোখ দিয়ে প্রাণভরে শুধু দেখলাম । মনের ক্যামেরায় আর মোবাইলের ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলে রাখলাম ।
Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos