আমার ছোটবেলার এক বন্ধু এই দুদিন আগে জানাল ও চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর পাড়াতেই একটা ছোট অফিস খুলেছে যার নাম দিয়েছে ‘কেয়ার টেকার’ । নামটা শুনে একটু অবাক হলাম। এ আবার কিরকম কাজ । তাই দেখতে চলে গেলাম । ছোট অফিস । দুটো টেবিল সাথে কিছু চেয়ার , দুটো মোবাইল ও একটা ল্যাপটপ । দেখলাম আমার বন্ধুর সাথে আরও একটা পাড়ার ছেলে বসে আছে । আমাকে দেখেই ওরা দুজনে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল । আমি আরাম করে বসলাম । জানতে চাইলাম ওরা কি কাজ করছে । ওদের কথা অনুযায়ী যাদের দেখাশুনা করার প্রয়োজন আছে এবং কাছে দেখাশুনা করার কেউ থাকে না তাদের সাথে ওরা সমস্ত রকম দেখাশুনা করার কন্ট্রাক্ট করে । সেটা হতে পারে তিনমাস / ছয়মাস বা এক বছরের । এক মাসের নোটিস দিয়ে কেউ কন্ট্রাক্ট শেষ করতে পারে আবার এক মাস আগে খবর দিয়ে কন্ট্রাক্ট বাড়াতেও পারে । এর জন্য উভয় পক্ষ একটা এগ্রিমেন্টে সাইন করে । বিভিন্ন ধরনের কন্ট্রাক্ট আছে । যার যেটা পছন্দ সে সেটা করতে পারে ।অনেকটা A.M.C র মতো । ওখানে যন্ত্রকে ভাল রাখার জন্য কন্ট্রাক্ট হয় আর এখানে মানুষকে ভাল রাখার জন্য কন্ট্রাক্ট হয় । ওরা দেখাল কিছু এগ্রিমেন্ট । দেখলাম কারও ছেলে তার বাব -মার জন্য কন্ট্রাক্ট করেছে । তারা কিছুদিনের জন্য বাইরে যাছে তাই তাদের বাবা -মাদের দেখাশুনা করার জন্য ওদের সাথে কন্ট্রাক্ট করেছে । কোন আত্বীয় স্বজনের উপর দায়িত্ব দেয়নি ।একজন সন্তান তার বাব মাকে যেমনভাবে দেখাশুনা করে ওরাও নাকি তেমনিভাবে দেখাশুনা করে । তার জন্য ওরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক নেয় । অনেক ছেলে মেয়েকেই বাধ্য হয়ে বাবা মাকে ছেড়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য দূরে যেতে হয় । ওদের এই প্রতিষ্ঠান যখন তার বাব মার সমস্ত দেখাশুনা করে তখন তারাও নিশ্চিন্তে দূরে গিয়ে ভালভাবে কাজ করতে পারে । অনেক পরিবার আছে নিঃসন্তান এবং নিজেরাও সমস্তকিছু দেখাশুনা করতে পারেনা অথচ কোন আত্বীয় স্বজনের উপরও নির্ভর করতে চায়না । এরকম ধরনের পরিবার ওদের সাথে কন্ট্রাক্ট করে । যেহেতু দেখাশুনার পরিবর্তে পারিশ্রমিক নেওয়া হয় তাই উভয় পক্ষের কোন বাধ্যতা বা দায় থাকে না ।বিদেশের অনেক দেশে বয়স্ক বা বয়স্কাদের দায়িত্ব নেয় সরকার কিন্তু আমাদের দেশে সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের তাই এরকম প্রতিষ্ঠান খুবই প্রয়োজন । ভাল লাগলো ওদের চিন্তাধারাকে ।
এছাড়া কেউ একাকীত্ব অনুভব করলে শুধু ওদেরকে একটা ফোন করতে হবে ।ওদের কাজ হল ওনার একাকীত্ব দূর করা বা দরকার হলে দেখাশুনা করার দায়িত্ব নেওয়া । প্রথমে ওনার একাকীত্ব কাটাতে বা ওনাকে আনন্দে রাখতে কি প্রয়োজন তা জানবার জন্য ওদের অফিস থেকে একজন পৌঁছে যাবে ওনার বাড়িতে এবং তার সাথে কথা বলে বুঝে নেবে কি করলে তাকে একাকীত্ব থেকে দূরে রাখা যাবে । তার মুল সমস্যাটা কি এবং তার উৎস কোথায় ? একেকজনের একাকীত্ব একেকরকম । সঙ্গিহীন লোকজনই বেশী একাকীত্ব অনুভব করে । আবার এরকমও দেখা যায় যারা অন্যদের বিশ্বাস কম করে তারা বেশিকরে একাকিত্বে ভোগে । তবে আমার মনে হয় সব মানুষেরই একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা অনুভুব করা একান্ত প্রয়োজন । কারণ নিঃসঙ্গতাই নিজেকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করে । নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব অনেকসময় বিভিন্ন শিল্পের জন্ম দেয় , নতুন নতুন সৃষ্টি করতে সাহায্য করে । এককথায় বলা যায় নিজের ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলে । কেউ যদি এই ইচ্ছাকে জাগিয়ে না তুলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তখনই আমার বন্ধুর কাজ শুরু হয় । ওরা প্রতিনিয়ত খোঁজ রাখে কোন বাড়িতে কে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে । তার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে । প্রথমেই তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে বাস্তববাদী হতে । ওরা বোঝায় যে আশেপাশের সব প্রিয়জনেরা সব সময় পাশে থাকবে এটা কখনই সম্ভব নয় । সবার জীবনেই প্রিয় মানুষজনের সাময়িক বা পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদ ঘটতে বাধ্য । তাই সবার উচিৎ মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে, নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বকে আঁকড়ে না ধরে , নিজের পছন্দের কোন কাজ নিয়ে এগিয়ে চলা । মোট কথা নিজের সৃজনশীলতাকে ঝালিয়ে নেওয়াতা সেটা পশু- পাখি পালন , ফুল গাছ দেখাশুনা করা , বই পড়া , কবিতা বা গল্প লেখা যাই হোক না কেন । মোদ্দা কথা নিজেকে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত রাখা । যারা ক্লাবে গিয়ে বা কোন সংগঠনের সাথে একটা বড় সময় ব্যহত করে তারা খুব একটা একাকীত্ব অনুভব করে না । কিন্তু যারা একা থাকে কিন্তু বাড়ির থেকে খুব একটা বেড়তে পারেনা বা লোকের সাথে মিশতে পারে না তারাই বেশী একাকীত্ব অনুভব করে। আমার বন্ধু জানতে পারলে দলবল নিয়ে ওনার বাড়িতে উপস্থিত হয় । প্রথমেই ওনাকে চেষ্টা করে অনলাইন ফ্রেন্ডলি হতে । যাতে ওনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন তার ট্রেনিং দেওয়া হয় এবং উৎসাহিত করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সময় কাটাতে । যতক্ষণ না ওনি সড়গড় হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত চলে ট্রেনিং । তারপর তাকে শেখান হয় কি করে অনলাইনে সব কিছু কেনা যায় এবং ইলেকট্রিক বিল , ফোনের বিল , প্রোপার্টি ট্যাক্স ইত্যাদি কিভাবে পেমেন্ট করা যায় ঘরে বসে । যতদিন না ওনি পুরাপুরি শিখতে পারছেন ততদিন আমার বন্ধুর অফিসের কোন ছেলে প্রতিদিন যায় ওনার কাছে । এরপরেও যদি একাকীত্ব না কাটে তাহলে আমার বন্ধু ওনার সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয় । অনেক সময় ওরা দুই বা অধিক একাকীত্ব অনুভবকারিদের এক অপরের সাথে মিলিয়ে দেয় । একটা নতুন ধরনের সামাজিক সেবার কাজ । আস্তে করে আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলাম -এটা কি শুধু সামাজিক সেবা না এই কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেওয়া হয় ? ওরা জানাল যারা গরীব তাদের কাছ থেকে ওরা কিছুই নেয় না কিন্তু যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল তাদের কাছ থেকে ওরা পারিশ্রমিক নেয় । আর সবাই খুশী মনেই পারিশ্রমিক দেয় কারণ ওরা সবসময় থাকে একাকীত্বের বন্ধু হিসাবে ।
যাদেরকে ওরা দেখাশুনা করে তাদের সবাইকে নিয়ে ওরা বেড়াতে যায় । কক্ষন কাছে একদিন বা দুদিনের জন্য বা কক্ষন দুরে বেশ কিছু দিনের জন্য । ওরা ওনাদের শরীর অনুযায়ী ব্যায়াম শেখায় কারণ মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যায়াম শরীর থেকে এন্ড্রোফিন নামক হরমন নিঃসৃত করে যা মনকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো রাখতে সাহায্য করে । এখন পর্যন্ত প্রতিটা ক্ষেত্রেই ওরা সাকসেস হয়েছে । ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগছিল । কিন্তু আমার ওদের কাছে একটাই প্রশ্ন ছিল যে খোঁজ পেয়ে ওরা যখন কারও বাড়িতে যায় তখন সবাই ওদের গ্রহণ করে কিনা ? যারা ওদের ব্যাপারে জানে এবং ওদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বেলায় কোন অসুবিধা হয় না । কিন্তু যারা ওদের ব্যাপারে জানে না তাদেরকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কনভিন্স করানো হয় । খুব কম লোক এখন পর্যন্ত ওদের ফিরিয়ে দিয়েছে । কেননা ওরা সব রকম সাহায্য করতে এগিয়ে আসে । যাদের লোকবল নেই তাদেরকে ডাক্তার দেখানো , হসপিটালে নিয়ে যাওয়া , কারও মৃতদেহ শ্বশানে নিয়ে যাওয়া সব কিছুই ওরা করে । ওদের লিফলেট আছে যার মধ্যে বাংলা , ইংরাজি আর হিন্দিতে ওদের সমন্ধ্যে বিস্তারিত লেখা আছে । আছে যোগাযোগ করার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার । এছাড়াও আছে বিভিন্ন নামকরা লোকদের প্রশংসা পত্র । যখন ওরা খবর পায় তখনই পৌঁছে যায় ওদের লিফলেট সঠিক মানুষের কাছে । ছেলে বা মেয়ে উভয়ের জন্যই ওরা কাজ করে । ওদের এই কাজের সাথে বেশ কিছু ছেলে ও মেয়ে যুক্ত আছে । আমার তো খুব ভাল লাগছিল শুনে ।ওদের অফিসে ঢোকার সময় খেয়াল করিনি , বেড়নোর সময় দেখলাম ওদের অফিসের সামনে খুব বড় বড় করে লেখা আছে –
একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা হচ্ছে মানসিক সমস্যা। প্রথমদিকে নজর না দিলে আস্তে আস্তে এই সমস্যাটি বিশাল আকার ধারন করবে । তাই সবসময় মনে রাখতে হবে একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতাকে সমস্যা না ভেবে মানসিকভাবে একে দূর করতে হবে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করতে হবে ।
Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos
সময়োপযোগি একটি সুন্দর বিষয় নিয়ে লিখেছেন। অনবদ্য ভাবনা। খুব ভালো লাগলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ।।
LikeLiked by 1 person
Thank you very much
LikeLike
Tapasi Banerjee
Lekha ta pore monta bhore galo.
Bani Paul
Share korlam, ajker dine khub proyjon,
Deboshree Dasgupta
Ata natun chintadhara . Amar Mone hoy social media gulo ai sob kaj e valo vabe use kora jete pare..
Partho Mukherjee
Khub valo kaj. Asakori onara sinamer sange kajta chalie jaben, Ekhon etar kintu sotti sotti khub proyojon. Wishing all the best in coming days.
Pradip Kumar Das
Very good effort
Naru Mahato
খুব ভালো প্রচেষ্টা ।সব জায়গায় এই পরিসেবা পাওয়া গেলে ভালো হয় ।
Kanti S
Khub bhalo laglo lekha ta por
Apurba Neogi
Very praiseworthy effort.
Chanchal Bhattacharya
খুব সুন্দর এবং সময়োপযোগী ভাবনা।
দারুণ লাগলো।।
Aloka Mitra
Manuser seba sab theke baradharma
LikeLiked by 1 person
THANKS TO ALL
LikeLike