আধুনিক মধ্যপন্থা  – সুপ্রিয় রায়

আধুনিক মধ্যপন্থা – সুপ্রিয় রায়

ঘড়িতে তখন ঠিক সকাল আটটা বাজে । বড় ঘড়িটার শেষ ঘণ্টাটা এখনও কানে বাজছে । বারান্দায় বসে খবরের কাগজের সাথে বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছিলাম । এমন সময় সাম্য এসে বলল –

– “বাবা , তোমার সাথে একটা খুব দরকারি কথা আছে ।”

খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললাম – “বল , কি দরকারি কথা ?”

সাম্য গলার স্বরটা একটু নামিয়ে আস্তে করে বলল – “বাবা , আমি একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি । ওকেই বিয়ে করতে চাই ।”

খবরের কাগজ থেকে চোখটা চলে গেল সাম্যর মুখের দিকে । বলে উঠলাম – “এতো দারুন খবর । দাঁড়া মাকে ডাকি ।”

আমি চিৎকার করে সাথীকে ডাকার আগেই সাম্য বলে উঠলো – “একটু দাঁড়াও , মাকে ডাকার আগে একটু শোন । মাকে একটু ম্যানেজ করতে হবে ।”

– “ তা কি ম্যানেজ করতে হবে শুনি ? তুই কি অন্য ধর্মের বা অবাঙ্গালি কোন মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছিস ?”

সাম্য এসে পাশে বসলো আর আস্তে আস্তে বোলতে লাগলো – “আরে, না, না। অন্য ধর্মের না , বাঙালি , হিন্দু , তবে অন্য জাতের । মার হয়ত একটু খারাপ লাগতে পারে । মা তো সবসময় স্বজাতি চায় ।তাই বলছিলাম মাকে একটু ম্যানেজ করতে হবে ।”

এক চুমুকে চা শেষ করে , খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বলে উঠলাম – “দূর , মার কোন আপত্তি থাকবে না । দেখ তোর বিয়ের বয়স হয়েছে এবং তুই ছেলে হিসাবে বিয়ের বাজারে উপরের দিকেই আছিস। তাই জানাশোনার মধ্যেই প্রচুর সমন্ধ আসছে । তোর মার সাথে এব্যাপারের আমার আগেই কথা হয়েছে । তোর মারও মত হল মেয়েটা ও তার পরিবার যেন ভাল হয় , জাত্টা কোন ব্যাপারই না । এমনকি অন্য ভাষাভাষীতেও তোর মায়ের কোন আপত্তি নেই । আরে, কোন চিন্তা করিস না । চল বসার ঘরে চল ।”

দুজনে বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে আমি চিৎকার করে ডেকে উঠলাম – “সাথী শীগগির বসার ঘরে এসো । খুব দরকার আছে ।”

– “ আরে আমিতো তোমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি , একটু অপেক্ষা কর ।” – সাথী রান্নাঘর থেকেই জবাব দিল ।

– “ ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে না । আজ বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট এনে খাবো । তুমি শুধু তাড়াতাড়ি এসো । শুনলে লাফিয়ে উঠবে । আমি কিন্তু আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছি না ।” – আমি আর সাম্য দুজনে এসে সোফায় আরাম করে বসলাম ।

– “ কি ব্যাপার , কি হয়েছে ? এতো তলব কেন ?” – সাথী হাত মুছতে মুছতে বসার ঘরে ঢুকল ।

সাম্যর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম –“ তুই মাকে বল ।”

– “ কিরে সাম্য ? তোর বাবা কি বলতে বলছে ?” – বসতে বসতে সাথী বলল ।

এক নিঃশ্বাসে সাম্য বলে উঠল – “ মা , আর সমন্ধ দেখতে হবে না । আমি নিজেই একটা মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি । আশা করি তোমাদেরও পছন্দ হবে ।”

– “ তা কি রকম পছন্দ তোর শুনি ?” – সাথী একটু গম্ভীর হয়েই বলল ।

– “ ওর ভাল নাম বাসবদত্তা বসু , আর ডাক নাম তিথি । বাড়ি শিলিগুড়িতেই । বাবা কাস্টমসে কাজ করেন । এক মেয়ে । এবছর ও কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার ডিগ্রি করলো । কয়েক বছর হল আমাদের আলাপ হয়েছে ।”

সাথী জিজ্ঞেস করলো – “ ওদের বাড়িতে সব জানে ?”

“ হ্যাঁ , ও কাল ওর বাবা আর মাকে সব বলেছে । ওর বাবা -মা আমাকে দেখতে চেয়েছে ।”

আস্তে আস্তে সাথীর মুখ থেকে কুয়াশা সড়তে লাগলো । মুখটা এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে । ওর শুধু একটাই ভয় ছিল । মেয়ে যেন অন্য কোন ধর্মের না হয় । আমার অবশ্য ধর্মের ব্যাপারে কোনদিনই কোন আপত্তি ছিল না । আর জাতের ব্যাপারে আমাদের কারই কোন আপত্তি নেই । সমাজ এখন অনেক আধুনিক । তখন আমরা কেন পরে থাকবো জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে । খুব ভাল করেই আমরা জানি যে এই জাতপাতের সৃষ্টি খুব বেশি দিন আগের নয় । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী জাতের সৃষ্টি সেন বংশের রাজত্বকালে অর্থাৎ ১১৫৮-১১৭৯ সাল যখন পদবি আসে আমাদের নামের সাথে লেজ হিসাবে । আমাদের সনাতন ধর্মে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই বর্ণপ্রথা যেমন ব্রাহ্মণ , বৈশ্য , ক্ষত্রিয় ও শূদ্র এই চার বর্ণকে কিন্তু এই চার বর্ণের মধ্যে উপাধি বা পদবি ছিল না বা বলা যায় যে এই চার বর্ণ সৃষ্টি হওয়ার আগেতো সবাই এক ছিল ।এ নিয়ে আমরা স্বামী – স্ত্রীতে আগেই অনেক আলচনা করেছি । তাই আমার বিশ্বাস ছিল সাথী এ ব্যাপারে কোন আপত্তি করবে না । আর যদি সবাই inter caste বিয়ে করতে শুরু করে দেয় তাহলে তো কয়েক বছর পর আর জাতপাত নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যাথা থাকবে না । ব্যাস , সাম্যও দারুন খুশী ।

সাথী বলে উঠল , – “ একটা কাজ কর । ওনাদের , আমাদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যাবেলা ডাক । তিথিকেও আসতে বল । আর বলিস রাত্রে যেন এখানেই খেয়ে যায় ।”

আমিও বললাম – “ সেই ভাল । আলাপ পরিচয়ও হবে তার সাথে আমরা উভয় পক্ষই দুই পরিবারকে ভাল মতো চিনে নিতে পারবো । তিথির এবং ওর বাবা মার আমাদের বাড়িটা ও আমাদের আগে দেখা খুব জরুরী । কারণ তিথিকে তো আমাদের সাথে এখানেই কিছুদিন থাকতে হতে পারে ।”

“ঠিক আছে , আমি ফোন করে দিচ্ছি । তারপর তোমাদের জানাচ্ছি । আচ্ছা বল কি ব্রেকফাস্ট আনাবো ?” – সাম্য সোফার থেকে উঠতে উঠতে বলল ।

“ না, না, বাইরে থেকে কিছু আনতে হবে না। আমি তোদের পছন্দের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিচ্ছি । আরে আজ তো মনের আনন্দে খাবার বানাবো । এতদিন মনের মধ্যে একটা চাপ ছিল। তুই নিজেই মেয়ে ঠিক করাতে অনেকটা হালকা লাগছে । এতো সমন্ধ আসছিল যে কিছুতেই কিছু ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না । এখন আমি মুক্ত । সব ছেলে – মেয়েরা নিজেরাই যদি নিজেদের পছন্দ ঠিক করে ফেলে তাহলে আমাদের অর্থাৎ বাবা – মায়ের কাজ অনেকটাই হালকা হয়ে যায় । ঠিক আছে তুই তাড়াতাড়ি ফোন কর । কেননা বাজার ও রান্না দুটোই তো করতে হবে । জেনে নিস কি খায় আর কি খায় না ।” – এই বলে সাথী উঠে পড়ল খাবার বানাতে । সাম্য উঠে ফোন করতে নিজের ঘরে গেল আর আমি তাড়াতাড়ি খবরের কাগজ নিয়ে পরলাম কেননা এখুনি আবার বাজারে ছুটতে হতে পারে । বাজারটা আমিই করবো , সাম্যকে দেবনা ভাবছি ।

ঠিক হল ওরা সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমাদের বাড়ি আসবে । সাম্য গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে । ভাবছি কত তাড়াতাড়ি কতগুলো বছর কেটে গেল । এখনও মনে হয় এই তো কিছুদিন আগে সাথীকে বিয়ে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছি । এর মধ্যে এতগুলো বছর কেটে গেল যে আমাদের সন্তান বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠলো । মনে পড়ছে বিয়ের কদিন পর সাথীকে সবাই একটা মেনু রান্না করতে বলল । তখন তো বাড়ি ভরতি লোক । বাবা , মা তখন বেঁচে আর আমরা সব ভাই ও তাদের সংসার নিয়েই আমাদের বড় পরিবার । রাতদিন বাড়িতে নিত্য নুতুন খাবার তৈরি হচ্ছে । সবাই বলল নুতুন বউয়ের হাতে যে কোন একটা মেনু হোক । নুতুন বউ যা খুশী তাই রান্না করতে পারে এবং ওকেই ঠিক করতে বলা হোল । ও আদৌ রান্না করতে পারে কিনা আমার জানা নেই । পড়াশুনা করত , নাচ – গান করত এইটুকু জানি । উৎসাহ নিয়ে তৈরি হতে দেখলাম । ঠিক হোল ও বাঁধাকপির শুকনো মাখা মাখা যে তরকারী হয় সেটা রান্না করবে । মাকে দেখলাম বাঁধাকপি নিয়ে কাটতে বসে গেল । কয়েকটা আলুও সাথে নিয়ে নিল , বাঁধাকপি কাটার পর সেগুলো কাটবে । সাথীকে দেখলাম চুল শক্ত করে বেঁধে নিয়ে ম্যাক্সির উপর আপ্প্রনটা পড়ে নিল । কাজের মাসিকে সব অস্ত্র – সস্ত্র দিতে বলল । এমন ভাব করছে যেন এটা ওর কাছে জলভাত । মা জিজ্ঞেস করলো – “ আগে কোন দিন রান্না করেছ ?” এতো জোরে ও মাথা নাড়ল যেন মনে হোল কত করেছি , এ আর এমন কি । যাইহোক ধীরে ধীরে যুদ্ধ শুরু হোল । আমরাও একে একে যে যার ঘরে চলে গেলাম । কিছুক্ষণ পর হটাৎই সাথী আমাদের ঘরে এসে উপথিত । মুখটা থমথমে । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কান্না কান্না গলায় ও বলে উঠলো – “ আমিতো বাড়িতে থাকতে মা আমাকে সেরকম রান্না করতে দিত না । বলত শশুর বাড়ি গিয়ে তো করতেই হবে , এখন একটু আনন্দ করে নে । আমি তো খুব স্মার্টলি রান্নাটা শুরু করলাম কিন্তু কেমন যেন হয়ে গেল । তুমি একটু টেস্ট করবে ?”

বললাম – নিয়ে এসো ।”

একটু পরে একটা বাটিতে করে বাঁধাকপির তরকারী আসলো একটা চামচ সহযোগে । তাকিয়েই বুঝলাম এরকম

বাঁধাকপির তরকারী আমি কেন , আমার বাড়ির লোক কেউ বাপের জন্মে খায়নি । মনের ভাব চেপে চামচে একটু নিয়ে টেস্ট করলাম । বুঝলাম আজ ওর কপালে দুঃখ আছে । আমাদের বাড়িতে আবার সবাই ভাল রান্না করে ।সুতরাং বুঝতে পারছি এটা খেতে সবার খুব কষ্ট হবে । আমার মুখ দেখেই সাথী বুঝতে পারল ও কিরকম রান্না করেছে । আর ওর মুখ দেখে আমি বুঝলাম আকাশটা কালো হয়ে এসেছে । এখনি শুরু হবে বারি ধারা । বললাম –“ তোমার এক বন্ধুর গুজরাটির সাথে বিয়ে হয়েছে না ? ওর মোবাইল নাম্বারটা আছে ?” ও মাথা নাড়ল । গুজরাটিতে বাঁধাকপির তরকারীকে কি বলে জানতে বললাম । ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে থাকাল । আমি ইশারায় ওকে ফোন করতে বললাম । জানতে পারলো গুজরাটিতে, বাঁধাকপির তরকারীকে বলে সামবড়া । এটা জানতে বন্ধুকে যে কত মিথ্যা কথা বলতে হল আমি সেটা ভালই টের পেলাম । এবার আমি ওকে পাশে বসিয়ে বললাম – “ ব্যাস হয়ে গেছে , আর কোন ভয় নেই । আমার স্থির বিশ্বাস আমাদের বাড়িতে কেউ বাঁধাকপির সামবড়া খায়নি । শোন , তুমি সবাইকে বলবে এটা একটা গুজরাটি প্রিপারেশন , এর নাম বাঁধাকপির সামবড়া ।বাঙালিদের বাঁধাকপি রান্না তো সবাই খেয়েছে , তাই ভাবলাম গুজরাটি প্রিপারেশনই করে ফেলি । আমার এক বন্ধুর কাছে আমি এই রান্নাটা শিখেছি । বোঝা গেল ।” সাথী হো হো করে হেসে উঠলো ।

– “ গুজরাটিরা বোধহয় বাঁধাকপি এমনি ভাবেই রান্না করে । হ্যাঁ , ওরা তো তেল মশলা একটু কমই দেয় । খাবারের ফুড ভ্যালুটা ওরা বজায় রাখে । বাঁধাকপির এতো উপকারিতা , আমাদের রান্নায় তো কিছুই থাকে না । ভালই করেছো বউমা গুজরাটি প্রিপারেশন করে । এবার থেকে আমরাও খাবারের ফুড ভ্যালুর দিকে নজর দেব ।”- বাবার এই কথা শুনে সবাই চুপচাপ সুন্দর ভাবে বাঁধাকপির সামবড়া খেয়ে নিল । মনে মনে আমি বাবার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম । মুখ তুলতেই দেখি সাথী আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । যেন মনে মনে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে ।

আর এখন সাথী পাক্কা গিন্নী হয়ে গেছে । সব রান্না শিখে নিয়েছে । পরিচিতর মধ্যে ওর এখন রান্নায় যথেষ্ট নাম হয়েছে । ইচ্ছা থাকলে রান্না করাটা কোন ব্যাপারই না । আর এখন তো ইয়উ টিউব দেখে যেকোনো রান্না যখন খুশী করা যায় । আমাদের সময় তো আর ইয়উ টিউব ছিল না , তখন রান্না নিয়ে জা দের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা । বউ রান্না না জানলে বেশিরভাগ বাড়িতেই কথা শুনতে হত । ছুটির দিন , তাই দুপুর বেলা তিনজনে একসাথে খেতে বসলাম । খেতে খেতে আমরা পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম । সাম্যকে বলছিলাম যে আমাদের বিয়ের সময় আমরা কোন উপহার নিইনি । যাদের খালি হাতে আসতে লজ্জা করছিলো তাড়া ফুল নিয়ে বউভাতে এসেছিল ।

সাম্য বলল – “ gift কেউ না দিক কিছু যায় আসে না কিন্তু আমাদের দেশে যে ধরনের উপহার বেশি্রভাগ লোক নিয়ে আসে তার কোন মানেই হয় না । এই তো সেদিন আমার এক বন্ধুর বিয়েতে দেখলাম অনেকগুলো হাত ঘড়ি , দেওয়াল ঘড়ি , বেশ কয়েকটা লেডীস ব্যাগ , কয়েকটা ফ্লাওয়র ভাস , একই ধরনের বেড সিট ও বেড কভার , ঘর সাজানর কিছু শো পিস আর বেশ কয়েকটা শাড়ি পেয়েছে । উপহার দিতে হবে , খালি হাতে গেলে খারাপ লাগবে তাই যে যার মতো জিনিষ নিয়ে এসেছে । অথচ কাজেই লাগবে না । আমার বন্ধুর বউ শাড়ি বেশি পরে না । ওতগুলো শাড়ি কি করবে বল । একে ওকে দিয়ে দিতে হবে । কটা ঘড়ি লাগাবে বল ? যে ঘর সাজাবে সে তার মতো সাজাবে , অন্যের পছন্দ মতো কেও কেন ঘর সাজাবে ? এর থেকে টাকা দিলে তো কোন সমস্যাই থাকে না। এইযে ধর নিকট আত্মিয়রা সোনার গহনা দেয় । আজকাল কে সোনার গহনা পরে বল ? সেই তো লকারে রাখতে হবে এবং তারজন্য লকার ভাড়াও দিতে হবে । তার থেকে টাকা দিলে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দেওয়া যায় বা টাকাটা কোন কাজে লাগান যায় । বিয়ে করতে একটা ছেলের বা মেয়ের যা খরচা হয় তার একটা অংশ যদি উপহারের মাধ্যমে উঠে আসে মন্দ কি ? পাবলোকে দেখলাম লোণ নিয়ে বিয়ে করলো , তারপর প্রত্যেক মাসে লোণ শোধ করতে করতে প্রান খুলে আনন্দও করতে পারছে না । নূতন বউয়ের কাছে কিরকম লাগছে বলো ? ওর মনে হচ্ছে যে বউ ভাবছে ও চাকরি নিয়ে বিয়ের আগে মিথ্যা বলেছে ।সবাই উপহার হিসাবে যে যা পারে সেটা টাকা হিসাবে দিলে অনেকেরই সেটা কাজে লাগে , এটা কেন কেউ বোঝেনা ।”

– “ ঠিক বলেছিস , তবে সোনা ভবিষ্যতে বিপদের সময় কাজে লাগতে পারে এই ভেবেই নিকট আত্মিয়রা সোনা দেয়।”

– “ কেন মা , টাকা দিলে সেটাতো তাড়াতাড়ি কাজে লাগানোর আরও সুবিধা । ফিক্সড ডিপোজিট আর সোনা কোনটা থেকে তাড়াতাড়ি টাকা পাওয়া যাবে বল ? সোনা ভাঙ্গাতে গেলে বিল চাইবে , কি করে সব বিল পাবে বল ? যারা উপহার হিসাবে দেবে তারা কি বিলও সঙ্গে করে দেবে ?”- সাম্য বলে উঠলো ।

– “ একদম ঠিক বলেছিস । আমি তোর সাথে ১০০ ভাগ সহমত পোষণ করছি ।” – আমি বললাম ।

– “ আচ্ছা সাম্য , একটা কথা জিজ্ঞেস করবো , রাগ করবিনা বল ।”- সাথী বলল ।

– “ কি বলবে বল ।”

– “ তিথির রঙ ফর্সা না কালো ? না , মানে আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি । তুই খুব ফর্সা কিনা , তাই । অবশ্য তুই যখন পছন্দ করেছিস তখন আমরা সব মেনে নিতে রাজি । তবুও ।”- খুব আমতা আমতা করে সাথী বলছিল ।

– আচ্ছা মা , ও তো আজকে আসবেই , তখন দেখে নিও আর যা জানার সব জেনে নিও । তোমাদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে ।জানি , তোমরা এমন কোন প্রশ্ন করবে না যাতে ওদের অপমান হয় । আর মা , তুমি কি জানো আমাদের শরীরের রঙ ফর্সা বা কাল কেন হয় ?” মার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাম্য বলতে লাগলো –

“ আমাদের শরীরের উপর থেকে চামড়াটা ছাড়িয়ে নিলে তার ভিতরের রঙটা সবারই মনে হয় এক । ছাল ছাড়ান অবস্থায় সমস্ত মুরগীর রঙ যেমন একই লাগে । উপরের চামড়াটার জন্যই তো যত ঝামেলা – পরিচয় হয় ফর্সা না কালো , সাদা চামড়া না কালো চামড়া । অথচ আমরা কি জানি যে আমাদের আদিম মানুষের রঙ কি ছিল বা কি কারণে আমাদের চামড়ার রঙ সাদা বা কালো । গবেষকদের মত অনুযায়ী প্রায় ২০০,০০০ বৎসর আগে আমাদের আদিম মানুষের রঙ ছিল কালো এবং তারা থাকতো বিষুব রেখার কাছকাছি যেখানে আলটা ভাইওলেত রশ্মির বিকিরণ বেশি বা বলা যায় যেখানে সূর্যের কিরন বেশি । মানুষ যখন নিজেদের প্রয়োজনে বিষুব রেখার থেকে দূরে গিয়ে থাকতে লাগলো , তখন তাদের শরীরে আলটা ভাইওলেত রশ্মি কম লাগতে লাগলো কারন সেখানে সূর্যের কিরন কম । অনেক বৎসর লাগলো ঠিকই কিন্তু মানুষের চামড়ার রঙ ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হতে লাগলো । গবেষকদের মত অনুযায়ী সময় লাগলো প্রায় ৫০,০০০ বৎসর । তারপর বংশানুক্রমে চলে আসছে সাদা আর কালো চামড়া । কিন্তু এখনও চলছে পরিবর্তনের ধারা । গবেষকদের মত অনুযায়ী লাগছে প্রায় ১০০ টি প্রজন্ম । যে প্রধান পদার্থের উপর চামড়ার রঙ নির্ভর করে তার নাম মেলানিন (Melanin)। আমাদের চুলের রঙও এই পদার্থের উপরই নির্ভর করে । চুলের রঙ সাদা হলে তাকে আমরা কালো করি আবার শরীরের রঙ কালো হলে তাকে সাদা করার আপ্রান চেষ্টা করি । কিন্তু আমরা কি জানি Dark skin reduces the incidence of skin cancer and sunburn আমাদের একসময়ের শাসক অর্থাৎ ইংরেজদের রঙ সাদা চামড়া ছিল বলেই কি আমাদের বেশিরভাগ সাদা চামড়ার প্রতি আকৃষ্ট ! তাই কি এখনও বিজ্ঞাপনে দেখতে পাওয়া যায় –“ফর্সা পাত্রী চাই “।

সাদা চামড়া বা কালো চামড়ার বদলে আমাদের বলা উচিৎ হালকা বা ঘন চামড়া । হালকা চামড়ার রঙ হয় নীল -সাদা । তার নীচ দিয়ে শিরার মধ্য দিয়ে লোহিত কণিকা প্রবাহিত হয় বলে চামড়ার রঙ লালচে লাগে । যেটা রেগে গেলে ভালো বোঝা যায় । মুখমণ্ডল হয়ে ওঠে রক্তবর্ণ । হালকা চামড়ার মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্রের ধারে রৌদ্রের মধ্যে শুয়ে থাকতে কারন তাদের দরকার সূর্যের থেকে ভিটামিন ডি । শরীরে ক্যালসিয়াম গ্রহন করতে এই ভিটামিন ডি দারুনভাবে সাহায্য করে ।

হালকা চামড়ার মানুষ বেশি দেখা যায় ইউরোপ, পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া , সুমেরু অঞ্চল ও আমেরিকাতে । আর ঘন চামড়ার মানুষ বেশি দেখা যায় গ্রীষ্ম প্রধান আফ্রিকা , ভারতবর্ষের দক্ষিণ অংশ , ইন্দোনেশিয়া , মেলানেসিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে । মোটামুটি বলা যায় যারা অনেকদিন ধরে বিষুবরেখার কাছাকাছি থাকে তাদের চামড়ার রঙ হয় ঘন আর যারা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অনেকদিন ধরে থাকে তাদের চামড়ার রঙ হয় হালকা ।”

– “ বুঝলে তো কাল বা ফর্সা এটা আমাদের কারও হাতে নেই । এটা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে । মানুষের শিক্ষা , সংস্কৃতি ,ব্যবহার এগুলই সব । রঙের বাঁচ বিচার করতে যাওয়া মনে ছোট মনের পরিচয় দেওয়া । যারা বিয়ে করবে তাদের শিক্ষা – সংস্কৃতি মিলছে কিনা সেটাই বড় ব্যাপার , কি রকম দেখতে সেটা গৌণ । আসলে আমরা সমাজের কথা বেশি চিন্তা করি , কে কি বলবে সেটার প্রাধান্যই বেশি দিই । মনে আর কোন সংশয় থাকলে এখনি বলে ফেল । “ – আমি সাথীর দিকে মুখ করে বললাম ।

– “ আমাদের সময় প্রথম প্রশ্ন থাকতো বাঙ্গাল – ঘটি নিয়ে । বাঙ্গাল – ঘটির বিয়ে নিয়ে মজার মজার সিনেমা , গল্প খুব বেড় হতো । কিন্তু এখন বাঙ্গাল – ঘটি নিয়ে খুব কম কথা ওঠে । আজকালকার অনেক ছেলেমেয়ে জানেই না কাদের বাঙ্গাল আর কাদের ঘটি বলা হয় । “ -সাথী বলছিল ।

আমি বললাম -” রাজনৈতিক স্বার্থে আমাদের দেশভাগ হয়েছে , মানুষের স্বার্থে না । তাই প্রচুর মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে , ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে শুধু বাঁচার আসায়। রাজনৈতিক নেতারা শুধু তাদের স্বার্থ দেখেছে । দেশভাগ যদি না হতো তাহলে বাঙ্গাল – ঘটি ব্যাপারটাই আসতো না । দেশভাগের আগে কোন ঝামেলাই ছিল না । এই ঝামেলা রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে। মানুষকে বাঙ্গাল – ঘটি হিসাবে ভাগ করে লড়াই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে । কত মানুষের কত নিদারুন কষ্টের ইতিহাস আজ চাপা পরে আছে । সবাই বাঙালি অথচ তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে জাতপাত বা ধর্মের ভিত্তিতে নয় শুধু মাত্র বাসস্থানের ভিত্তিতে । ভাবতে অবাক লাগে আমরা কেমন মানুষ যে পূর্ববঙ্গ , পশ্চিমবঙ্গ , উত্তরবঙ্গ , দক্ষিণবঙ্গ – সবই বঙ্গ অথচ মানসিক রেষারেষি করি । যার কোন মানেই হয় না ।রাজনৈতিক নেতাদের উপর রাগ হওয়া উচিৎ তা না করে আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করি ।”

-” সাম্য বলল – তোমাদের একটা কথা বলবো মনে কিছু করবেনা তো ।”

আমি বললাম – “বল , আগে তো শুনি , তারপর মনে করার ব্যাপার আসবে ।

সাম্য – “ আমার খুব ইচ্ছা শুধু registry marriage করে আমাদের বিয়েটা হোক । Registration এর দিন একটা joint party হোক । আর কিছু না ।”

আমি বললাম – “ দ্যাখ , বিয়েটাতো একটা পরিবারের নয় , দুটো পরিবারের । সুতরাং যা হবে উভয় পরিবারের মত নিয়ে । আমারও অনেক ইচ্ছা ছিল আমাদের বিয়ে নিয়ে কিন্তু আমাকে অনেক কিছুর সাথে compromise করতে হয়েছে । না করলে অশান্তি হবে এবং সেটা ভুগবে বেশি নূতন বউ । তাই বলছি , তোর ইচ্ছাটা তুই আমাদের বলেছিস ঠিকই , কিন্তু জোর করে তো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না । সবার মতের একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকা দরকার । দেখি কি করা যায় ।”

সাথী বলে উঠলো – “ দ্যাখ সাম্য , আজকাল registration must কেননা registration ছাড়া বিয়েটা আইন সিদ্দ হয় না । কিন্তু সামাজিক বিয়ের একটা আলাদা আনন্দ আছে । ‘গায়ে হলুদ’ মেয়েদের কাছে একটা দারুন আনন্দের অনুষ্ঠান । সবাই মিলে হলুদ মাখামাখি করে একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি করে । ভাইদের কাঁধে চেপে সাত পাকে ঘোড়া , মালা বদল , শুভ দৃষ্টি , সিঁদুর দান এসব আচার অনুষ্ঠানকে ঘিরে খুব আনন্দ হয় । এছাড়া বিয়েটাকে যদি ক্যামেরা বন্দী করে রাখতে চাস তাহলে নানারকম অনুষ্ঠান ছাড়া ভাল লাগে না ।”

-” আচ্ছা মা , আমাকে বলতো বিয়েতে কি কি অনুষ্ঠান হয়?”

– গঙ্গা নিমন্ত্রণ , দধি মঙ্গল , জল সইতে যাওয়া , হলুদ কোটা , বৃদ্ধি , গায়ে হলুদ , গায়ে হলুদের তত্ত বর বরন , বরযাত্রী , পট বস্ত্র ,সাতপাক , শুভ দৃষ্টি , মালা বদল, সম্প্রদান , যজ্ঞ , সপ্তপদী , অঞ্জলি , সিন্দুর দান , বাসি বিয়ে , বিদায় , বউ বরন , খেলার জন্য , কাল রাত্রি , বউ ভাত , ফুল শয্যা ,দ্বিরা গমন – পর পর সবকটা আচার অনুষ্ঠান তোকে আর তোর বাবাকে বলে দিলাম । এখন তোরা দেখ কোনটা রাখবি আর কোনটা রাখবি না ।”

-” আচ্ছা মা , গঙ্গা নিমন্ত্রণ আর জল সইতে যাওয়া মানে তো দল বেঁধে ঐ নোংরা পুকুরটায় যাওয়া । তাইতো । তাহলে প্রথমেই এই দুটো বাদ । শুভ দৃষ্টি তো আমাদের অনেকবার হয়ে গেছে সুতরাং ওটাও বাদ । পট বস্ত্র ,সাতপাক , সম্প্রদান , যজ্ঞ , সপ্তপদী , অঞ্জলি ,বাসি বিয়ে এগুলো যদি বাদ দিতে পার তাহলে আমার থেকে খুশী আর কেউ হবে না ।”

আমি বললাম – “এটাতো এখনই ঠিক করা যাবে না । ওনাদের সাথে আগে আলোচনা করে নিই তারপর বসে সব ঠিক করা যাবে ।আজ প্রথম দিন এসব নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হলে তবেই করবো । তবে একটা জিনিষ খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দেব যে আমাদের কোন রকম দাবী নেই । এমনকি বরের বিয়ে করতে যাওয়া এবং বরযাত্রী নিয়ে যাওয়ার খরচ সব আমাদের ।”

-” বাবা , আমি চাই আমাদের বিয়ে যেন সবার কাছে আদর্শ হয়ে থাকে । আধুনিক বিয়ে বলতে সবাই যেন আমাদের বিয়েকে উদাহরন হিসাবে সামনে হাজির করে ।”

-” আমি তোর কথা মানছি । তবে একটা কথা মাথায় রাখিস যা করবো সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে , জোর করে নয় । তাহলে কিন্তু বিয়ের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে । বড়দের সাথে ছোটদের চিন্তাধারার যেন একটা সুন্দর মেলবন্ধন থাকে ।” – আমি খুব শান্তভাবে সাম্যকে বললাম ।

– দেখ , কতটা কি করা যায় । আমার মনে হচ্ছে আমাদের বিয়েটা হবে আধুনিক মধ্যপন্থায়

Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s