অতি আধুনিকতার শিকার  ———- সুপ্রিয় রায়

অতি আধুনিকতার শিকার ———- সুপ্রিয় রায়

কলেজ থেকেই ওরা একসাথে রাজনীতি করে এবং তখন থেকেই ওদের ভালাবাসা । একজনকে দেখতে পেলে আরেকজনকে দেখতে পাওয়া যাবেই সেটা আমরা বন্ধুরা সব সময় টের পেতাম । পার্টির মিটিঙে , মিছিলে সব সময় চারটে পা একসাথে চলতো । সমাজ বদলের স্বপ্ন ছিলে ওদের চোখে মুখে । এই ঘুণধরা বস্তাপচা সমাজের কোন কিছুই ওরা মানতে নারাজ । সমাজে থাকতে গেলে অনেক সময় আমাদের পছন্দ না হলেও অনেক কিছুই মানিয়ে নিতাম কিন্তু ওদের চিন্তাধারা ও মন যেন একসূত্রে বাঁধা । মনের বিরুদ্ধে কোন কাজ ওদের দিয়ে কেউ করাতে পারত না । আমাদের বন্ধুদের চোখে ওদের একটা আলাদা স্থান ছিল। বন্ধু হলেও মনে মনে আমরা ওদের দুজনকে খুব শ্রদ্ধা করতাম । কিছুদিন বাদেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড়বো এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবো । জানিনা কে কোথায় ছড়িয়ে পরবো । তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দিনগুলো মধুর স্মৃতি হয়ে সারা জীবন থাকবে । কফি হাউসের আড্ডার দিনগুলো খুব মিস করবো ভাবলেই চোখে জল চলে আসে । বিশেষ কারে ওদের মানে সাথী আর সার্থককের সান্নিধ্য খুব মনে পড়বে ।

এর মধ্যে পৃথিবী , সূর্যকে বেশ কয়েকবার প্রদক্ষিণ করেছে । আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত । সবাই যে যার কর্ম ও সাংসারিক জীবন নিয়ে দারুন ব্যাস্ত । বছরে একবার আমরা বন্ধুরা পরিবার সমেত এখনও মিলিত হই । কয়েকটা ঘণ্টা দারুনভাবে হুল্লোড় করে আমাদের কেটে যায় । শুধু একটাই দুঃখ সাথী আর সার্থককের সাথে কারও কোন যোগাযোগ নেই । ওরা কোথায় যে চলে গেল কেউ বলতে পারছে না । এমনকি ওদের দুটো বাড়িরও কেউ কিছু জানে না । কেননা ওদের বাড়ির লোকেরা কিছুতেই ওদের সিধান্ত মেনে নিতে পারিনি । ওদের বক্তব্য ছিল ওরা দুজন দুজকে ভালবাসে । ওরা মনে প্রানে একে অপরকে স্বামী – স্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়েছে । একসাথে থাকতে চায় । কয়েকটা কাগজে সই করে বা অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করতে ওরা নারাজ । ওরা আধুনিকতায় বিশ্বাসী । বিদেশের মতো লিভ টুগেদার করতে চায় । ওদের বাড়ির লোকেরা কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারেনি । বাড়ির লোকেরা অনেক করে বুঝিয়েছিল যে শুধু রেজিস্ত্রি ম্যারেজ করে নাও । আর কোন অনুষ্ঠান করতে হবে না । কিন্তু ওরা কিছুতেই তা মানিনি । তাই দুই বাড়ির সাথে বিচ্ছেদ । কাউকে কিছু না জানিয়ে দুজনে কোথায় যে চলে গেল আমরাও সেটা জানতে পারিনি ।

এদিকে অফিসের কাজে আমি বেশ কদিন হোল শিলিগুড়িতে বদলী হয়ে এসেছি । পরিবার নিয়ে শিলিগুড়ির হাকিম পাড়াতে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকি । যেহেতু উত্তরবেঙ্গে আমার জন্ম এবং খুবই পরিচিত জায়গা তাই পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটছিল । এর মধ্যে আমি দু দুটো সন্তানের পিতা হয়ে গেছি । বড় ছেলে এবার ভাল নম্বর নিয়ে দশ ক্লাস পাশ করে শিলিগুড়ির একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে । আমরা ওর জন্য একজন ভাল অঙ্কের শিক্ষকের খোজ করছিলাম যে বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে । পরিচিত অনেকের সাথেই এই বিষয়ে কথা বলেছি । বেশিরভাগ সবার কাছেই গ্রুপে পড়তে হয় । কিন্তু আমাদের খুব ইচ্ছা ও একা পড়ুক । জানতে পেরেছি এক মহিলা শিক্ষিকার কথা । টেলিফোন নাম্বার যোগাড় হল এবং আমার স্ত্রীর সাথে বিস্তারিত কথা হয়ে ঠিক হোল ওনি সপ্তাহে দুদিন সোম ও শুক্রবার বিকালে পড়াতে আসবে ।

সেদিন ছিল শুক্রবার । শরীরটা ভাল ছিল না বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি । বই পরে , ঘরে শুয়ে বসেই সময় কাটছিল । ছেলেরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই বাড়িটা গমগম করে উঠলো । আমিও মেতে উঠলাম ওদের সাথে । এমনি দিনের বেলায় বাড়িতে তো থাকা হয় না । ওরাও খুব খুশী । বড় ছেলে তো বলেই বসলো আজ আর পরবো না , আজ তোমার সাথে গল্প করবো । আর আমার টিচারের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দেব । আমিও হাসতে হাসতে বললাম ঠিক আছে , টিচার আসুক দেখা যাবে । বলতে না বলতেই বেলের আওয়াজ । ছেলে বলল দিদিমনি এসে গেছেন ।দারুন সময় মেনে চলেন । ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়েই ওকে উঠতে হল । বই নিয়ে দিদিমনিকে নিয়ে ওর ঘরে গেল ।

গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছে । কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না । গলার আওয়াজটা ছেলের পড়ার ঘরের দিকে জোর করে আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আমি কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছিনা । চোখের সামনে দেখতে পারছি আমার ছেলে তার দিদিমনির কাছে পড়ছে । দিদিমনি যেহেতু পিছনদিক করে বসে আছে তাই তার মুখটা দেখতে পারছিনা ।দিদিমনির মুখটা দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছি । হঠাৎ ছেলে আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো – বাবা তুমি ? দিদিমনি ও বইয়ের থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল । একি দেখছি ? আমি ঠিক দেখছি তো ? দিদিমনিও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । আমরা কেউই কারও দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না । কখন যে আমার স্ত্রী আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি । ওর ডাকে সম্বিৎ ফিরল । একি চেহারা হয়েছে ? আমার মুখ থেকে জোরে শুধু একটা আওয়াজ বেড়িয়ে এলো – সাথী তুই । সাথীও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে । ওর চোখ ছল ছল করছে । মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে পড়বে । বিশ্বাসই করতে পারছি না যে এতো বছর বাদে এমনিভাবে সাথীর সাথে দেখা হবে । হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম ওকে বসার ঘরে । বললাম – এখনই ফোন কর সার্থককে । আমার আর তর সইছে না । জানিস আমরা সবাই তোদের কত খুঁজেছি । তোদের বাড়ির লোকেরাও তোদের কোন খোঁজ দিতে পারিনি । তোদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে জানতে পারলে সবাই কালই এখানে চলে আসবে ।

সাথী মাথা নিচু করে চুপ করে আছে । কোন কথা বলছে না। আমার তর সইছিল না । আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম – বল , সার্থক কোথায় ? ওকি শিলিগুড়িতেই আছে ? কিরে চুপ করে আছিস কেন ? চারিদিকে নিস্তব্দতা , কোন আওয়াজ নেই । ধীরে ধীরে সাথী মুখ তুললো , দুই চোখ টলটল করছে । দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো – সার্থক আর নেই রে। ও আমাদের ছেড়ে দুবছর আগে চলে গেছে । আমার স্ত্রী ওকে এক গ্লাস জল এনে দিল। সাথী এক নিশ্বাসে পুরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিল । তারপর বলতে লাগলো ——–

তোরা তো আমাদের আগের কথা সবই জানিস। আমারা তোদের নিয়ম মতো বিয়ে করিনি । কিন্তু থাকতাম স্বামী – স্ত্রীর মতো । কারণ আমরা মনে প্রানে স্বামী – স্ত্রী ছিলাম । ইউনিভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে সার্থক ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে দিল্লি গেল । আমিও গেলাম ওর সাথে । জানিস তো আমি শাখা , পলা , সিঁদুর এগুলতে বিশ্বাসী ছিলাম না । তাই এগুলো ছাড়াই আমার পরিচয় ছিল ওর স্ত্রী । কিন্তু দিল্লিতে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমরা স্বামী স্ত্রী । অগত্যা আমাকে স্ত্রী প্রমাণ করার জন্য মাথায় লাগাতে হল সিঁদুর । দিল্লির মালভিয়া নগরে বাসা নিয়ে থাকতে লাগলাম দুজনে । দারুন কাটছিল সময় । মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পরছিলাম এদিক ওদিক ঘুরতে । আমিও একটা স্কুলে চাকরি নিলাম । দিল্লিতেই আমাদের মাঝে আসে আমাদের একমাত্র ছেলে । যার নাম আমরা আমাদের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলাম সাম্য । ও এখন প্রায় তোর ছেলের বয়সই । খুব আনন্দে কাটছিল । আমি আর সার্থক মিলে একটা নাটকের দল তৈরি করেছিলাম। আমাদের বাড়িটাই ছিল নাটকের রিহার্সাল রুম । কিন্তু এতো আনন্দ সইলো না । সার্থককে কলকাতায় বদলী করলো । নানা কারণে আমরা দুজনের কেউই কলকাতায় যেতে চাই না । ও সেটা অফিসকে জানাল ।ওকে মালদহ বদলী করলো । পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলাম মালদহতে । নতুন করে আবার সংসার গোছাতে লাগলাম । আমিও একটা ভাল স্কুলে চাকরি পেয়ে গেলাম। ভালই চলছিল । অফিসের কাজে মাঝে মাঝেই ওকে এদিক ওদিক যেতে হতো । সেদিন রায়গঞ্জ থেকে আসার পথে ওর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে । অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাঁচান যায়নি । খবরের কাগজে ওর নাম দিয়ে খবরটা প্রকাশ হতেই ওর ভাই কলকাতা থেকে ওর মাকে নিয়ে চলে আসে । দুঃখের বিষয় ওনারা এই দুঃখের সময়েও আমাকে আর সাম্যকে কাছে টেনে নেয়নি । উল্টে সবার কাছে প্রচার করে যে আমি ওর স্ত্রী নই । ওরা দাবী করে অফিস থেকে সার্থকের যা কিছু প্রাপ্য সবের অধিকার কেবল মাত্র ওর মায়ের । যেহেতু আমাদের বিয়ের কোন প্রমাণ নেই আইনত আমি কিছুই দাবী করতে পারলাম না । বুঝতে পারছিলাম আবেগ আর বাস্তবের কতটা ফারাক । আইনে আবেগের কোন স্থান নেই , চাই প্রমাণ । এতদিন যারা আমাদের মাথায় করে রাখতো তারাই বলতে শুরু করলো আমি নাকি রক্ষিতা । সাম্যকে নিয়ে ওখানে থাকা দায় হয়ে উঠলো । এসব খবর তো তাড়াতাড়ি ছড়ায় , তাই আমার স্কুলেও খবর পৌছাল । হেড দিদিমনি আমাকে ডেকে বললেন যে আমি ওখানে আর চাকরী করতে পারবো না । কারণ অভিভাবকরা আপত্তি জানাবে । হেড দিদিমনি আমাকে খুব ভাল বাসতেন । ওনি সবটা বুঝতে পারছিলেন কিন্তু জানি ওনার করার কিছু ছিল না । ওনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে শিলিগুড়িতে এই স্কুলে পাঠালেন । টেলিফোনে সব বলে দিয়েছিলেন । তাই চাকরীটা আমি পেয়ে গেলাম । ওনার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারবোনা । এক কথায় ওনি আমাদের জীবন দিলেন । তোদের সবার কথা খুব মনে হচ্ছিল , কিন্তু তোদের কোন যোগাযোগ ছিল না । যাইহোক তারপর থেকে আমি আর সাম্য শিলিগুড়িতেই আছি । আত্মীয় – স্বজন কারও সাথে কোন যোগাযোগ কোনদিন ছিলও না এখনও নেই । আমাদের বিয়ে না করে একসাথে থাকাটা কেউ মানতে পারেনি । আমরা বাস্তবের কথা চিন্তা না করে আবেগের বশে ভুল সিধান্ত নিয়ে ছিলাম যার ফল আজও ভোগ করে চলেছি । দেখলাম সাথীর দুই চোখ এখনও জলে ভরে আছে । খুবই করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । যেন বলতে চাইছে – তোরা তো জানিস আমি রক্ষিতা ছিলাম না , আমি ছিলাম সার্থকের সবচেয়ে কাছের মানুষ , ওর বন্ধু , ওর সহধর্মিণী , ওর সবকিছুর সাথী ।

Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos

2 thoughts on “অতি আধুনিকতার শিকার ———- সুপ্রিয় রায়

  1. Deboshree Dasgupta
    Asob concept amader desh e toh cholbe na pishemoshai , but galpo ta besh valo likhecho
    Alekhya Ghosh
    Asombhob sundoor ekta golpo…touched
    Apurba Neogi
    Excellent but very painful story which was superbly described.
    Tapasi Banerjee
    Apurbo. Touched.
    Tapasi Banerjee
    Excellent (Tapas)
    Bani Paul
    Khub sundor Tilokda, monta chhue jae
    Rituparna Ghosh
    খুব ভালো লাগলো।
    Kanti S
    Very painful but beautiful story
    Manik Dutta
    ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে?
    ললিতা রায়
    Excellent.
    Aparajita Sengupta
    মন ছুঁয়ে গেল, সত্যি আবেগ ও বাস্তবে অনেক তফাত ।তবুও আবেগ ছাড়া আমাদের জীবন অসম্পূর্ণ ।লেখাটা সুন্দর হয়েছে
    SK Sengupta
    খুবই সুন্দর ভাবে লেখা ও একটা বাস্তব ঘটনা। শুরু করার পর শেষ অবদি না পডে থাকতে পারলাম না ।
    Mita Sen
    Ashadharan Mon k chhue gelo
    Amlan Roy Chowdhuri
    Nice. Keep it up.
    Sujoy Banerjee
    Darun lekha.
    Jaba Sengupta Roy
    Sundoor galpo. Emotions er sathe message ache. Bhalo laglo
    Swapna Sen Gupta
    খুব ভালো লাগলো।
    Tumpa Dasgupta
    Osadharon lekha…ro lekha porte chai…
    Samarendra Nath Sarkar
    Asadharon
    Aloka Mitra
    Big lesson for new generation

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s