ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে মহামায়া দ্বারা সংগঠিত সার্বজনীন দুর্গাপূজা মহা ধুমধামের সাথে পালিত হলো ৮ ও ৯ ই অক্টোবর অর্থাৎ শনি ও রবিবার । এই পুজোর দুদিনের প্রতিটা মুহুর্তের সাক্ষী থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছিল । প্রকৃত অর্থে এই পূজা ছিল সার্বজনীন । সমস্ত ধর্মের এক মিলন মেলা ।দর্শনার্থীদের মধ্যে হিন্দু ছাড়াও ছিল মুসলিম , ফিনিস ও রাশিয়ান ।এই আনন্দ অনুষ্ঠান সবাইকে দেখলাম নিজেদের মত করে ভাগ করে নিতে । উদক্তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সময়ে বাংলা দেশ থেকে এদেশে এসে বসবাস করছেন । কেউ কেউ এদেশে পড়তে এসেছিলেন তারপর কাজের খাতিরে এখানেই রয়ে গেছেন । পাকিস্তান থেকে আসা এক হিন্দু পরিবারের সাথেও কাটালাম এই দুইদিন ।
ফাইবার গ্লাসের প্রতিমার মূর্তির সাথে এবছর কলকাতা থেকে এসেছে ঢাক । ঢাকের তালে কোমর দোলে । ঢাক না হলে পুজো জমে ? কিন্তু ঢাকী আনতে অনেক খরচ ।কুচ পরোয়া নেই । দেখলাম পশ্চিমবাংলা থেকে আগত তিন যুবক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ময়দানে উপস্থিত । ঢাক , কাসর ঘন্টা আর তাশা নিয়ে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখল পূজা মন্ডপ । পূজা মন্ডপ মানে এখানকার ছোট বাচ্চাদের এক স্কুল বাড়ি । এখানকার বাড়িগুলো এমনভাবে তৈরী যে বাইরের কোনো আওয়াজ ভিতরে আসতে পারে না বা ভিতরের আওয়াজও বাইরে যেতে পারে না । বাইরের তাপমাত্রা যাই হোক না কেন ভিতরের তাপমাত্রা সবসময় ২০ থেকে ২১ ডিগ্রীর এর মধ্যে । বাইরে থেকে শীতের পোশাক পরে ভিতরে ঢুকে সবাই চলে যাচ্ছে ড্রেসিং রুমে ।তারপর ড্রেসিং রুম থেকে বেড়চ্ছে বাঙালি হয়ে ।ছেলেদের গায়ে থাকছে পাঞ্জাবি আর মেয়েদের শাড়ি । মনে পরে যাচ্ছে সেই গানটা – “একদিন বাঙালি ছিলাম রে “। দুর্গাপূজার পুরোহিত পাওয়া বিদেশের মাটিতে খুবই কষ্টকর । ব্রাহ্মন ছাড়া পূজা করার রীতি যেহেতু এখনও নেই , তাই পুজোর সমন্ধ্যে ওয়াকিবহল ব্রাহ্মন পাওয়া এদেশে সত্যিই কঠিন ।কিন্তু তাও দেখলাম জোগার হয়ে গেল । কলকাতা থেকে এখানে চাকরি করতে আসা এক ঝকঝকে যুবক পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতে বসে গেল । পাঁচ দিনের পূজা দুদিনের মধ্যেই করতে হবে । দুদিনে অনেকেই অঞ্জলি দিল । দেশের মতো এখানেও মাইকে হচ্ছিল অঞ্জলি পাঠ । অঞ্জলি দানে ফুল হিসাবে ছিল গোলাপের পাপড়ি । এই হেলসিঙ্কিতে জিলিপি ছাড়া অন্য কোনো মিষ্টি চোখে পরেনি । যেহেতু জিলিপির উত্স ইরান তাই এখানকার ইরানিয়ান দোকানে জিলিপি পাওয়া যায় । স্বাদ একটু আলাদা । আমার তাই খুব কৌতহল ছিল পূজার ভোগে কি মিষ্টি দেয় তা দেখার । কিন্তু দেখি পূজার ভোগে ফল ছাড়া রয়েছে খিচুরি ,পাঁচ মিশালি তরকারি, লুচি , বাঁধাকপির তরকারী ,আপেলের চাটনি , পায়েসের সাথে ছিল মালপোয়া,নারু,রসগোল্লা ,সন্দেশ ও পাটিসেপ্টা ।আমি অবাক । এত সব কোথায় পেল ?স্বভাবতই জানতে ইচ্ছা করলো । সব বানিয়েছে মহিলারা । সত্যিই দশভুজা । চাকরি করছে , সাজগোজ করছে আবার এত লোকের জন্য বাড়ির থেকে খাবার বানিয়ে আনছে । এখানে কাজের লোক , রান্নার ঠাকুর পাওয়া খুবই মুশকিল । সব কিছু নিজেদেরকেই করতে হয় । খাবার বানানোর ব্যাপারটা মহিলারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে । পূজা হয়ে যাওয়ার পর পুরো স্কুলবাড়িটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে । কোথায় কিছু ফেলে আসলে বা নোংরা করে আসলে দিতে হবে ফাইন । পূজা মন্ডপে সবসময় দর্শনার্থীদের জন্য ছিল চা ও কফির ব্যবস্থা । এছাড়া সবার জন্য ছিল ভোগ । সন্ধ্যাবেলাও দেখেছি দর্শনার্থীদের প্রসাদ খেতে । কিন্তু কোথাও একটুও নোংরা হতে দেখিনি ।পরিস্কার রাখার দায়িত্ব যেন সকলের । সন্ধ্যাবেলা ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । অনেক বিদেশীদের দেখলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে । তিনজন বাঙালি মুসলিম যুবক একটার পর একটা সুন্দর গান পরিবেশন করে সবাইকে মাতিয়ে রাখলো । নিজেদের মধ্যেই কেউ করলো কবিতা আবৃত্তি , কেউ বা গান , কেউ নাচ –সুন্দর একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা দিল উপহার । এছাড়া ছিল ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ । কিন্তু একটাই ব্যাপার সময়টা ছিল নির্দিষ্ঠ । রাত্রি দশটা ।সবাই যে যার মতো ঘরে চলে গেল । মহিলাদের দেখলাম রাত্রি দশটার সময়ও গা ভর্তি সোনা পরে যেতে কোনো সংশয় ছিল না ।

পরের দিন তিথি অনুযায়ী অষ্টমী । সন্ধ্যাবেলা যখন দেশের সমস্ত মন্ডপে মন্ডপে ভীড় উপচে পরছিল তখন ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির পূজা মন্ডপে চলছিল সিন্দুর খেলা ।বাইরের তাপমাত্রা ছিল ৪ বা ৫ ডিগ্রী কিন্তু মন্ডপের ভিতরের উত্তাপ ক্রমশঃ বেড়েই চলছিল । ঢাকের তালে তালে মাতোয়ারা সবাই ।কেননা আবার একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে । তাই এবছরের দুর্গাপূজার শেষ আনন্দটুকু সবাই ভাগ করে নিতে চাইছিল । এবছরের এই দুদিনের দূর্গা পূজার আনন্দের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলছিল । সিন্দুর খেলার পর চলছিল মিষ্টিমুখ । হাতে বানানো রসগোল্লা ও পাটিসেপ্টা । খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথে বিসর্জনের ঢাকের বাদ্যির সাথে চলছিল নাচ মাকে একবছরের জন্য বিদায় জানাতে ।নদী , লেকে বা সমুদ্রে নয় । মা দূর্গা তার পরিবার নিয়ে চলে যাবেন বাক্সের মধ্যে ।পরের বছর আবার সপরিবারে মাকে বাক্স থেকে বের করে বরণ করে নিয়ে আসা হবে মন্ডপে । তবে এবছরের মতো ফিনল্যান্ডে দুর্গাপূজা শেষ তা নয় ।আগামী ১৪ থেকে ১৬ ই অক্টোবর হেলসিঙ্কিতে আরেকটা দূর্গা পূজার আয়োজন করেছে ফিনবেন , আরেকটা বেঙ্গলি কমিটি ।তাদের এবার ১৮ তম বছর ।
-কলকাতা ,মঙ্গলবার ১১ অক্টোবর, ২০১৬ ইং আজকাল পত্রিকা থেকে প্রকাশিত
Please visit my You tube channel : https://www.youtube.com/cha…/UCwI8JNW7FmslSEXnG6_GAgw/videos